স্মৃতির দেয়াল পর্ব-১৪

0
2263

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_১৪
Writer -Afnan Lara
.

যা করেছি তোমার ভালোর জন্য করেছি

আমার ভালোর কথা আপনাকে ভাবতে বলিনি আমি,আর আপনি কেমন মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে না করে আরেকটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করে নিলেন??শুনলাম আপনি নাকি এতবছর বিয়ে করেননি এত চাপের পরেও,তাহলে হুঠাৎ বিয়ে করতে গেলেন কেন?তাও একদিনেই সব
আপনাকে আমি বুঝি না একটুও

হিয়া বুঝতো আমাকে
.
কথাটা শুনে মুন নিজের কথা থামিয়ে ফেললো,নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় চলে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে
এত কিছুর মাঝে এই কথাটা একদমই মানাতো না,তাও নীল বললো,মুনের খারাপ লাগার কথা না তাও খারাপ লেগে গেলো
মনে হলো কেন আমাদের মাঝে আবার হিয়ার নাম জুড়লো???এখন ঐ মেয়েটার নাম না বললেও হতো,এক প্রকার বিরক্ত হয়েই মুন বারান্দায় চলে এসেছে কথার মাঝখানে
.
নীল মুনের পাশে চেয়ার টেনে বসলো চুপচাপ,সে জানে তার এই কথায় মুনের রাগ হয়েছে,কিন্তু এখন থেকেই সামান্য হিয়ার নাম নিয়ে রাগ দেখালে তো হবে না,আমার মনে হয় এখনই সময় ওকে সবটা জানানোর

শান্ত স্বরেই কথা শুরু করলো নীল
.
জানো??আমি হিয়াকে খুব ভালোবাসি,,ভালোবাসি বলা কম হবে,আমার পৃথিবী হলো হিয়া,,শুধু ভালোবাসি বলে আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না আমি ঠিক কতটা ওকে চাই,,ঐ যে বলে না কিছু কিছু ছেলে মেয়েদের পাবার জন্য কাঁদে??আমি সেই ছেলে,এত কেঁদেছি তুমি দেখলে তুমিও কেঁদে দিতে,বাট আমি কাউকে দেখিয়ে কাঁদিনি,কি লাভ??মানুষ দেখলে তো আর আমি হিয়াকে ফিরে পাবো না
.
৩বছর আগে আমি সবেমাত্র চাকরি পাওয়ার ট্রাই করছিলাম কারন তখন হিয়াকে পেতে হলেও আমাকে চাকরির দরকার ছিল
ওর বাবা চাকরি ছাড়া কিছুই বোঝেন না
হিয়া গ্রাজুয়েট ছিলো,বয়সের পার্থক্য আমাদের একদিনের ও ছিল না,হয়তবা আমি হিয়ার এক দুদিনের বড় ছোট হতে পারি,আমরা বয়স হিসাব করিনি কোনোদিন,ভালোবাসা তো আর হিসেবনিকেশে হয় না
আমরা ঠিক করেছিলাম সেসব হিসেব করবো না যেগুলো নরমাল কাপলরা করে,যেমন বয়সের তফাৎ কতটুকু সেটা হিসাব করা,ঝাল খায় নাকি কম,না মিললে অভ্যাস পাল্টাতে হবে ওসব টাইপ লজিক থেকে আমরা দূরে দূরে থাকতাম সবসময়
আমাদের প্রতিটা দিন শেষ হতো দুজন দুজনের অনুভূতির মুগ্ধতা নিয়ে
সম্পর্কের কিছুদিন পর নাকি একঘেয়েমি এসে যায়,কিন্তু আমাদের আসতো না কখনও,হয়ত পারফেক্ট কাপল হওয়ায় আমরা একে অপরকে পেলাম না,বিষয়টা হাস্যরত্নক তাই না??
সব মিল,সব ঠিক থাকার পরেও হেরে গেলাম,দুজন দুজনের কাছে,ভাগ্য জিতে গেলো
হিয়া আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম, সেই সূত্রে পরিচয় আমাদের
বড় ভাইয়াকে ভয় পেতাম বলে যেদিন ভাইয়া বাসায় ছিলো না সেদিন হিয়াকে বাসায় এনেছিলাম,,
হিয়াকে শুধু একদিনই আমাদের বাসায় এনেছিলাম,মাকে দেখাবো বলে
হিয়া সেদিন নিজের হাতে ইলিশ পোলাও রেঁধেছিলো
.
তো ওর ফ্যামিলি প্রব্লেম স্টার্ট হওয়ায় আমি সিরিয়াস হয়ে হিয়াকে কথা দিয়েছিলাম ৫মাসের মধ্যে আমি ওকে বিয়ে করে নিয়ে আসব,,ওর ফ্যামিলি ও রাজি ছিল,রাজি ছিল আমার ফ্যামিলিও,আমরা কত স্বপ্ন বুনেছি তার হিসেব নেই,,কারণ আমি কড়া করে বলেছিলাম চাকরি আমি পাবোই
বাবা পুলিশ অফিসার,ভাইয়ারা সবাই সরকারি চাকুরিজীবি
আমার কোনো টেনসনই ছিলো না এসব নিয়ে,কথা হলো সময়ের,সময়টা মাত্র পাঁচ মাস
সরকারি চাকরির এক্সামের মেসেজ আসতেই বছর পার হয়ে যায় তাই চিন্তা ঢুকলো মাথায়,আমার পরিবার আমাকে জানালো সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে বেসরকারি তে মন দিতে,হিয়াকে পেতে তো চাকরি দরকার
পরে না হয় সরকারি পাবো,এখন তো একটা চাকরি নিয়ে নিলেই হয়
আমি শুধু ৫টা মাস সময় চেয়েছিলাম ওর বাবার থেকে,উনি আমাকে সময় দিয়েছিলেন,কিন্তু আমার ভাগ্যে হিয়া ছিল না,,হিয়া ছিল সাকিবের ভাগ্যে,সাকিব ভালো ছেলে,হিয়ার বাবার পছন্দ বলে কথা,,
আমি সেসময়ে আমেরিকা গিয়েছিলাম,সেখানে ভালো কিছু করার আশায়,ওর বাবা আবার নরমাল চাকুরিজীবির হাতে মেয়েকে দেবেন না,পড়লাম আরেক বিপদে,তাই বিদেশ পাড়ি দিতে হলো,চাকরি তো আর হাতের মোয়া না যে পাওয়া যাবে সহজেই
এই ৫মাসের মধ্যেই আমাদের দুজনের জীবন পুরো পাল্টে যাবে তা জানলে আমি যেতাম না কখনও
হিয়ার বাবার ক্যান্সার ছিল,,৭মাস সময় দিয়েছিল ডাক্তার উনাকে,,,পারলে হিয়াকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম কিন্তু ঐ যে ওর বাবার অসুখ,উনার কিছু হয়ে গেলে হিয়া সারাটাজীবন আমাকে দোষারোপ করতো
যাই হোক আমার চাকরি পেতে সময় লেগেছিল ঠিক ৫মাস,বিদেশে ভালো পদের চাকরি পাওয়া অনেক টাফ ছিলো
উনার শেষ ইচ্ছা ছিল হিয়ার বিয়ে দেখে যাওয়ার,
আমি অনেক রিকুয়েস্ট করে উনাকে মানিয়েই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম,,আফসোস!!পাঁচ মাস পরে পাওয়া চাকরিটা আমার কোনো কাজেই আসলো না
মানুষ চাকরি পেলে কত খুশি হয় আর আমি সেবার চাকরিতে জয়েন হওয়ার কাগজটা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম
.
হিয়ার বাবার মত ছিল আমাদের বিয়েতে,,কিন্তু আমি যাওয়ার ঠিক ১০দিন পরই উনার শরীর অনেক অনেক খারাপ হয়ে যায়,ক্যান্সারে সিউর করে বলা যায় না রুগী ঠিক কখন মারা যাবেন
উনার তখন একটাই চাওয়া ছিল আর তা হলো হিয়ার বিয়ে
হিয়া আমাকে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছিল ঠিক সময়ে
আমি আসতে আসতে ১দিন ১রাত লেগেছিল,পাগলের মতন ছুটে এসেছিলাম,আমার বুক কাঁপছিলো পুরোটা সময়,আমার মনে হচ্ছিলো কিছু একটা খারাপ হতে যাচ্ছে,বারবার মনে প্রশ্ন জাগছিলো হিয়া আমার হবে তো??এমন কোনো বিপদ হবে যেটা আমার কল্পনার বাহিরে?
আর সেটাই হলো!!!
এসে দেখলাম হিয়ার মাথায় বিয়ের কনের ঘোমটা, পরনে লাল শাড়ী,পাশে বরের বেশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে,সে হলো সাকিব
এপাশে হিয়ার বাবার লাশ,হিয়ার বিয়ের ৩মিনিট পরই উনি মারা যান,,
আশেপাশে মানুষে ভর্তি,বিয়ে বাড়ি যেমন হয় আর কি
তবে মৃত্যুর খবর শুনে লোকসংখ্যা একটু বেশি মনে হলো
দূরে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে হিয়ার মা বসে আছেন,হিয়ার ফুফু পানি ছিঁটাচ্ছেন উনার মুখে,মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন
.
হিয়াকে দেখে আমি সেদিন নিজেই কেঁদেছিলাম,ও ওর মধ্যে ছিল না,ও অনেক চেষ্টা করেও সেদিন বিয়েটা আটকাতে পারিনি,ওর কাছে সুইসাইড করার ও ওয়ে ছিল না কারন ওর বাবা শুধু চেয়েছিল ওর বিয়ে দেখে যাওয়ার
উনি দেখতে চেয়েছেন একজন চাকুরিজীবির হাতে উনার মেয়েকে দিয়ে যেতে,আর সেটাই হলো,,বাবার শেষ ইচ্ছা পূরন করতে গিয়ে হিয়া তার সবচাইতে প্রিয় মানুষটাকে দূরে ঠেলে দিলো
স্বার্থপর হতে পারলো না সে
হিয়া আমার পা ধরে কেঁদেছিল সেদিন,বারবার বলছিলো”নীল আমি তোমার হতে চেয়েছিলাম”
.
ওর বাবা মারা গেছে,এসময়ে ওর বাবার লাশ ধরে কান্না করা উচিত আর সে কিনা আমাকে না পেয়ে অাধমরা হয়ে গেছে
এমনটা হওয়ারই কথা,আমি যতটা না ওকে ভালোবাসতাম ও ঠিক ততটাই আমাকে বাসতো
সেসময়ে আমি ওকে ধরার সাহস টুকু পাচ্ছিলাম না কারন হিয়া তখন আর আমার নেই,,হিয়া যার সে এসে হিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো
আমি হিয়াকে অনেকবার ছুঁয়েছি,ওর হাত ধরেছি লাখ বার কিন্তু সেদিন আমার হাত আটকে গিয়েছিলো,ওর মাথা পর্যন্ত ছোঁয়ার অধিকার টুকু আমি পাচ্ছিলাম না
সাকিব খুব যত্নে ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো
.
দিনশেষে আমি ওর বাবার কবরে মাটি দিয়ে বাসায় যাইনি আর
বুকে পাথর বেঁধে আবারও আমেরিকা ফেরত চলে গিয়েছিলাম,,দেশে থাকলে বারবার আমি এই আঘাতের মুখোমুখি হয়ে একটা সময়ে হয়ত মরেই যেতাম
আমেরিকা থেকে আসার সময় দোয়া করছিলাম হিয়া যেন সবসময় আমার কাছে থাকে,দোয়া কবুল হলো এমন ভাবে তা ভাবতেও পারলাম না,এসে দেখলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে,কিন্তু ওর শশুর বাড়ি আমার বাসার কাছেই,মানে ও ঠিকই আমার কাছাকাছি আছে
আর তুমি বলতেছে ওকে আমি কেন বিয়ে করিনি??কেউ ইচ্ছে করে এমন কেন করবে বলো,,যাই হোক,আমি ভাবলাম হিয়া সুখে নেই,তবে ঐদিন দেখলাম ও বেশ সুখে আছে,ওর মুখে হাসি দেখে আমার ও খুশি লাগলো,,শুনলাম হিয়া এখানে ছিল না এতদিন,ও সাকিবের সাথে সিংঙ্গাপুরে ছিলো,দেশে ফিরেছে এক মাস হলো
.
মুন একটা কথা জানো??
“ভালোবাসা এক আশ্চর্য মাদক,ছেড়ে গেলেও তার নেশা থেকে যায়”আমার তো ঐ নেশা এখনও লেগে আছে
শেষে আমি ভাবলাম আর কত মাকে কষ্ট দিব,আমার মা ও তো চায় একটা বউ বাসায় দেখার বাকি বউরা তো আরেক জেলায় থাকে
আশা করি তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গেছো??আর কিছু জানার আছে??
.
মুন চোখ মুছে আড় চোখে চেয়ে বললো”ছুঁয়েছি মানে?”
.
নীল হাসলো,লিচু গাছটার দিকে এক নজর তাকালো সে তারপর মুখে হাসি নিয়ে উঠতে উঠতে বললো”ঐ ছোঁয়া ছোঁয়া হয়নি,বিয়ের পরের জন্য ওয়েট করছিলাম,তার আর হলো কই?
.
এত কিছুর পরেও মুনের মনে লাড্ডু ফুটতেছে কারণ নীল ওতোটাও করেনি হিয়ার সাথে যতটা সে ভেবেছিলো
তার মানে ছেলের চরিত্র ঠিক আছে,হুদাই আবেগে কান্দিয়া মদ পান করে,ওসব আমি কদিনেই ঠিক করে দেবো,সমস্যা না
.
কথা শেষ করে নীল উঠে চলে যেতে যেতে বললো”তোমাকে বিয়েটা করেছি তোমার দায়িত্ব নেওয়া দরকার ছিল বলে,এর বেশি আমার থেকে কিছু আশা করবে না কোনোদিন,ভালোবাসার মানুষকে হারালে দ্বিতীয় কাউকে আর চোখে ধরে না,এটা মনে রেখো”
.
মুন চোখ মুছে পিছনে তাকালো,সব শুনে মনে হয় এই জীবনে নীলের থেকে একটু কেয়ার ও আশা করা অন্যায় হবে
.
নীল চেঞ্জ করে এসে খাটে শুয়ে ও পড়েছে
মুন এগিয়ে এসে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো
.
চিনি না জানি না,সে কিনা আমার স্বামী হয়ে গেলো,মাত্র মনে পড়লো যে লোকটাকে ভালোমতন চিনি না
.
এটা ভাবতে ভাবতে মুন খাটের এক কোণে গিয়ে শুয়েছে
.
পরেরদিন আবার নীলের আগেই উঠে গেলো মুন,
নীল কখন উঠে জামা খুলে শুয়ে পড়ে কে জানে,শোয়ার সময় তো জামা পরে শোয়,যখন শুয়েছিল তখন তো উনার গায়ে জামা ছিল,এরকম এসির মধ্যেও জামা ছাড়া ঘুমায়,
মুন হাত বাড়িয়ে নীলের কপাল চেক করলো জ্বর আছে কিনা,কারন এরকম এসির হাওয়ায় জামা ছাড়া থাকলে জ্বর হওয়ার কথা,ওমা উনার দেখি temperature ঠিকই আছে
মুন ভাবতে ভাবতে উঠে গেলো,,,মুখটা ধুয়ে রুম থেকে বের হওয়ার সময় খোঁপা করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বুয়াকে কাজে হেল্প করতে গেলো
.
নাহার মুচকি হেসে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বললো”আপামনি গোসল করেন নাই?”
.
কথাটা শুনে মুনের লজ্জায় অবস্থা হালিম হয়ে গেছে
কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিলো না সে
.
মনে হয় ভুলে গেছেন তাই না??
.
মুন হালকা কেশে বললো”ওসব কিছু না,নিজের কাজ করেন”
.
নীল ঠিক ২০মিনিট পর রেডি হয়ে নিচে নেমে ব্রেড আর জ্যাম হাতে নিয়ে যাওয়ার সময় মুন সামনে এসে দাঁড়ালো ওর

কি?

টিফিনে নাস্তা দিলাম,খেয়ে নিয়েন,এখন তো বলবেন সকালের নাস্তা করার সময় নাই তাই পাউরুটি হাতে নিয়েই যাচ্ছি
.
নীল চুপচাপ টিফিন বক্সটা নিয়ে চলে গেলো,একটু যেতেই আবার থেমে গিয়ে বললো”আজ আমার ভাইয়ারা সবাই আসবে,ভাবী দের নিয়ে,সেজেগুজে থেকো,,বড় ভাইয়ার সাথে সুন্দর করে কথা বলবা,আর ভুলেও গাছে টাছে উঠবা না,আমি যদি এরকম বদনামি শুনি তো কেলাবো
.
মুন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো
চলবে♥