স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_২৬
Writer -Afnan Lara
.
নীল মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে গেছে,আর কিছু বলবে না
বললেও মুন বুঝতে চাইবে না
ফোন বাজছে অনবরত,হিয়ার কল
নীল রিসিভ করেনি দুবার হলো,তাও হিয়া কল করেই যাচ্ছে
মুন বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে বাহিরের দিকে মাথাটা তাক করে রেখে চেয়ে আছে,যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না তাও সে তাকিয়ে আছে অন্তত নীলের দিকে তাকানোর চেয়ে ভালো
.
হিয়ার তৃতীয় বার করা কলটা নীল রিসিভ করলো,কিন্তু হিয়াকে কিছু বলতে দিলো না,রিসিভ করেই বললো”আমি ব্যস্ত”
কেটে দিলো লাইনটা নীল,,ফোন পাশে রেখে পিছনে তাকালো মুনের দিকে
মুনের মন খারাপ তার মনটাকে আরও ভেঙ্গে দিচ্ছে
হয়ত ভয় পেলে মুন আবেগী হয়ে যেতো কিন্তু ভয় পায়নি বলেই ওর জেদটা বেড়ে আছে
আমার এখন কি করা উচিত?ক্ষমা চাইলাম তা তো করলো না
কি করে রাগ ভাঙ্গাই?হিয়া রাগ করলে তো ওকে জড়িয়ে ধরলেই রাগ পানি হয়ে যেতো ওর কিন্তু মুনকেও তো ধরেছিলাম ওর তো রাগ গেলো না,তাহলে কি করলে মুনের রাগ ভাঙ্গবে?
.
মুন চেয়ার থেকে উঠতেই নীলের সাথে ধাক্কা খেয়ে গেলো
নীল এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ভাবছিলো মুনের রাগটা কমানোর বিষয় নিয়ে
মুন দূরে সরে গিয়ে বললো”কিছু বলবেন?”
.
চলো কিছু খাবে
.
না খেলে?এখন আবারও অন্ধকার রুমে বন্দি করে চলে যাবেন?
.
না
.
তাহলে কি করবেন,আজকেই ডিভোর্স দিয়ে দিবেন?প্লিস দিয়ে ফেলুন,আমাকে মুক্তি দিন,আমি আর পারবো না সইতে
.
কথাটা বলে মুন বিছানায় এসে বসলো,নীল দরজা খুলে চলে গেছে সেসময়ে
হোটেলটার সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে এখন
উর্মি ভাবী আর পপি ভাবী মিলে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলেন,নীলকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা এগিয়ে আসলেন,নীলের মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখে তাদের আর বুঝতে বাকি নেই যে মুনের সাথে কিছু একটা হয়েছে ওর
.
নীল উর্মি ভাবীকে দেখে চোখ মুছে নিজের আওয়াজটাকে ঠিক করে বললো”তোমরা এসময়ে?”
.
কারেন্ট নেই বলে একটু হাঁটতে বের হলাম,তা তুমি এখানে কি করো তাও মুনকে একা রেখে,ওকে নিয়ে আসতে
.
না আসলে…..
.
আবার ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
.
নীল উর্মি ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললো”ভাবী আমি বুঝতেছি না মুন বারবার আমাকে ভুল কেন বুঝে,আর আমিও ওকে ঠিক বুঝতে পারি না,কি করে ওকে আমি ভালো রাখবো তাই ভেবে পাই না,আর ও সবসময় কথার মাঝে হিয়াকে টেনে আনে,এখানে আসার পর থেকে আমি হিয়ার সাথে কথাই বলিনি,মাত্র কল করেছিলো আমি ব্যস্ত আছি বলে কেটে দিয়েছিলাম,মুন কেন বোঝে না আমাকে
.
সামান্য একটা আননউন নাম্বারের সাথে কথা বললেও স্ত্রীর খারাপ লাগে আর সেখানে কিনা তুমি তোমার প্রাক্তনের সাথে কথা বলো,ওর চিন্তায় মগ্ন থাকো এটা মুন কি করে সইবে?
.
আমার কি করা উচিত?
.
এটা নাহয় মুনকেই জিজ্ঞেস করো
.
নীল মুখটা ছোট করে চলে গেলো রুমের দিকে,মুন খাবারের দিকে তাকিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে,পেটে খিধা অনেক
সাথে মাথা ও ঘুরছে,গোটা দিন সে কিছু খায়নি,নীলের উপর রাগ ও উঠে আছে
মোমবাতিটা ও শেষ হতে চললো
নীল সবে রুমে ঢুকছে,হাতে একটা মোমবাতি,বেশ মোটাসোটা দেখতে
দরজা লাগাতে লাগাতে সে বললো”আজ রাতে নাকি কারেন্ট আসবে না”
মোমবাতিটা একপাশে রেখে খাবারের প্লেট নিয়ে সে মুনের পাশে এসে বসলো,চামচ দিয়ে এক চামচ ভাত তুলে ধরলো মুনের দিকে
মুন মুখটা আরেকদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো”খাব না মানে খাব না”
.
নীল মুখ ফুটে “প্লিস” বললো,বলার সাথে সাথে ওর দুচোখ বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে
মুন সেটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে,এরকম করে খেতে বললে যে কেউ গলে যাবে
এই ছেলেটা এমন কাঁদছে কেন,এসময়ে আমার জায়গায় হিয়া হলে জামাই ফেলে আজকেই বাসর রাত করে ফেলতো এর সাথে,এরকম কিউট ফেসে চোখের পানি বেয়ে পড়লে যে কেউ ক্রাশিত হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে
কিন্তু নাহ!!!মুন তোকে স্ট্রং হতে হবে
.
কি হলো খাবে না?আই এম সরি মুন,আর কখনও এমন হবে না,ট্রাস্ট মি
.
মুন খাবারের লোভ আর সামলাতে পারছে না
চুপচাপ নীলের হাতের চামচ থেকে খাবারটা গিলে ফেললো সে
নীল খুশি হয়ে আরেক চামচ রেডি করে বললো”থ্যাংকস,মাফ করে দেওয়ার জন্য”
.
মাফ করি নাই,বাসায় ফিরে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন,আমার দ্বারা আর কোনো কিছু সহ্য করা সম্ভব হবে না
.
নীল মুখটা আবারও ফ্যাকাসে করে মুনকে আরেক চামচ খাইয়ে দিয়ে বললো”আমার স্ত্রী হয়ে থাকো”
.
কেন?আপনার আর হিয়ার লীলা দেখতে?
.
আর দেখাবো না
.
এটা আরও আগেও বলেছিলেন,যেই লাউ সেই কদু হয়ে যায় শেষে
.
এসব বাদ দাও,চুপচাপ খাও,তারপর গল্প করবো
.
হিয়াকে নিয়ে?
.
নাহ,তোমাকে নিয়ে
.
নীল নিজের হাতে খুব যত্ন সহকারে মুনকে খাবার খাইয়ে দিলো তারপর বালিশ কোলে নিয়ে মুনের সামনে বরাবর বসে বললো মুনের ছোটবেলা থেকে সবটা বলতে,তারপর নীল নিজেরটা বলবে
মুনের বোরিং লাগছিলো তার উপর নীল নিজ থেকে কথা বলতে চায় তো আর মানা করে কি লাভ,
বোরিং হওয়ার চেয়ে বকবক করা ভালো
মুন শুরু করলো তার যতো কথা
ছোটবেলা থেকেই সৎ মায়ের আদরে সে বড় হয়েছে
রুশা মুনের থেকে ২/৩বছরের ছোট হবে,পিঠাপিঠি ছিলো তারা দুজন
রুশা মুনকে নিজের বোন মনে করে আর মুন ও তাই
তবে সেলিনা তফাৎটা ঠিকই করতেন,আর সেটা হলো কখনও চকলেট দুটোর জায়গায় তিনটে আসলে,তিনি একটা মুনকে দিতেন আর দুটো রুশাকে
মুনের সামনে রুশাকে একটা দিতেন,পরে লুকিয়ে রুশাকে বাকিটা খাইয়ে দিতেন
মুন কিন্তু দেখতো এসব,তাও না দেখার ভান করে থাকতো
তার জ্বর হলে তা এমনি এমনি সারতো,হয়তবা বেশি জ্বরে দাদি এসে দেখতেন
সেলিনা কখনও এসবে নাক গলাতেন না,নিজের হাতে গোটা সংসার সামলাতেন তিনি এটাই অনেক মনে করতেন
বাবার তদারকিতে মুনের পড়ালেখাটা বহাল ছিলো এটা ভেবে মুন নিজেকে ধন্য মনে করতো সবসময়
প্রয়োজনে যা দরকার তার সব কিছু মুন পেতো না
যেমন প্রতি বছর ঈদে জামা হওয়া চাই এমন কথা বলা সাজতো না মুনের
অথচ বাবার টাকার অভাব ছিলো না,তার পরেও সে জামা পেতো না কেন তাই মাথায় ঢুকতো না
তবে রুশাকে নতুন জামা দেওয়া হতো, এক ঈদ ও মিস যেতো না
রুশা ছোট মানুষ তো,জামা না পেলে কাঁদবে তাই
সেলিনা নিজের হিসেবে মুনকে কখনও দেখেইনি,আবার মাঝে মাঝে এমন বিহেভ করত যেন তার আসল মেয়ে
মুন ভাবতো তার এমন আলগা ভালোবাসা চাই না
তার জীবনে এমন কেউ আসুক যে তাকে আলগা নয় পুরোটাই ভালোবাসবে
কিন্তু হয়ত আমার ভাগ্য আলগা ভালোবাসাই আছে
ছোট থেকেই,আমার জন্য রাখা ভালোবাসা -কেয়ার রুশা পেতো আর আমি পেতাম তার ছিঁটেফোটা
আর এখন আমার ভালোবাসা হিয়া পাচ্ছে,পেয়েও গেলো
আর আমি তার সুবাস!কি কো ইন্সিডেন্স তাই না?
.
নীল ছলছল চেখে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে
.
মুন বিষয়টাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো”এবার আপনার কথা বলুন,আমার তো সবটাই জানেন”
.
আমার আর কি,এত বড় পরিবারে জন্ম নিয়েও কেনো কিছুর কমতি হয়নি কখনও,সব ভাইয়েরা সেম টু সেম অধিকার পেয়ে এসেছি
মা আমাদের সবাইকে ঠিক একই ভাবে ভালেবাসতেন,আমার কোনো কিছুর কমতি হয়নি আজ পর্যন্ত
.
শুধু যাকে ভালোবাসলেন তাকে পেলেন না,তাকে পেলে জীবনটা সার্থক হতো তাই না?
.
হুম,পুরোটাই সার্থক হতো,কিন্তু মানুষ তো তার জীবনে সবটা পায় না,আমিও তাই
.
চেয়েছিলাম হিরা,পেয়ে গেলেন এমিটেশন
.
তুমি এমিটেশন না,তুমি অনেক দামি
.
তাই তো এত এত অবহেলা করছেন,অবশ্য অনাথদের সবাই অবহেলা করে,কারণ তারা প্রতিবাদ করে না,তাদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই,আপন বলতে কেউ নেই
আজ আমার নিজের মা থাকলে হয়ত আমাকে এত কষ্টে থাকতে হতো না,বাবার ও এমন রুপ দেখতে হতো না
.
আর কখনও তোমাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা পেতে হবে না তাহা,আই প্রমিস
.
আপনি?আপনি বাসবেন আমাকে?গলা কেটে বললেও বিশ্বাস করবো না
.
বাসলেই সব পূর্ণ হয়ে যাবে তাহা?
.
তাহলে আর কি?একজন স্ত্রী তার স্বামী থেকে শুধু কেয়ারই আশা করে?
.
তুমি কি আশা করো?
.
মুন মনে মনে বললো”আমি তো গোটা তোরেই আশা করি
ঐ হিয়ার চক্করে বিয়ের এতদিনে সবে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিস,কিস করতে তো মনে হয় বছর পেরিয়ে যাবে”
.
কি হলো কিছু বলছো না যে?
.
কিছু না,,আপনাকে আর কি বলবো,আপনার তো মনে প্রানে শুধু হিয়া,আমি কিছু চাইলে কি আর দিবেন
.
কেন দিব না,বলো
.
মুন ব্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো”কিস চাই,কাড়ি কাড়ি বাচ্চা চাই,দিবেন?এমন ভাবে বলছেন যেন আমাকে আজই সব দিয়ে দিবেন,কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তৈরি হয়ে জিজ্ঞেস করতে হয় বুঝলেন,”
.
তোমাকে তো আমি বিয়ের পরেই বলে দিয়েছি এসব আশা করবে না
.
আপনি সরুন তো,আমি ঘুমাবো,আপনি গিয়ে ডিভানে শোন,একদম আমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন না
যেদিন মাথা থেকে হিয়ার ভূত নামাতে পারবেন সেদিন আসবেন জিজ্ঞেস করতে,মুন তোমার কি চাই,এখন যান,সরেন,মেজাজ আর গরম করবেন না
আমি এখন ভাত ঘুম দেবো
.
মুন কাঁথা টান মেরে শুয়ে পড়লো
নীল মূর্তি হয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে,তারপর বালিশ নিয়ে ডিভানে এসে বসলো সে,মুন ঘুমিয়েও পড়েছে
নীলের চোখে ঘুম নেই,সোফায় শোয়ার অভ্যাস নেই ওর
.
মুন মাঝরাতে জেগে গিয়ে দেখলো নীল ডিভানে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে,মানে এখনও ঘুমায়নি
উফ বুঝি না আমি এই লোকটা যখন আমাকে কষ্ট দেয় তখন তো তার এত খারাপ লাগে না,তাহলে আমি তাকে কষ্ট দিতে গেলে আমার এত কষ্ট লাগে কেন
এই যে শুনেন!!
.
মুন বিছানা থেকে নেমে নীলকে কয়েকবার ডাকলো,এপাশ ওপাশ করছে মানে ঘুমের মাঝেই,জেগে নেই সে
মুন নীলের কাঁধে হাত রাখতেই নীল জেগে গেলো,উঠে বসে বললো” কি হয়েছে”
.
আসুন,বিছামায় এসে ঘুমান,আপনাকে শাস্তি দেওয়া আমার কাম্য নয়
.
নীল সত্যি সত্যি বিছানায় চলে আসলো,শুয়ে ও পড়েছে
মুন বালিশটা নিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই নীল ওর হাত ধরে আটকিয়ে বললো”যেও না”
.
আপনি বলেছিলেন আমার সাথে একই বিছানায় আর শুবেন না,বেশি অধিকার দিয়ে ফেলেছিলেন
.
সরি অনেকবার বলেছি,এবারও না শুনলে পুলিশ হয়ে ঘাঁড় ত্যাড়া কাউকে ঠিক করার কৌশলটা প্রয়োগ করতে পারি
.
মুন কোমড়ে হাত দিয়ে বললো”কেন?কি করবেন?”
.
নীল মুনকে হ্যাচকা টান দিয়ে বিছানায় নিয়ে এনে বললো”আমার সাথে একই বিছানায় শুতে বাধ্য করবো,যেমন ধরো ডিভানে পানি ঢেলে দিব
.
আমি ফ্লোরে ঘুমাবো তাহলে
.
ফ্লোরেও পানি ঢেলে দিব
.
তাহলে এ পানিতেই ঘুমাবো,তাও আপনার সাথে ঘুমাবো না
.
নীল দুহাত বাড়িয়ে মুনের মুখটা ধরে বললো”প্লিস তাহা,আমাকে বুঝো”
.
মুন ব্রু কুঁচকে গালের থেকে নীলের হাত সরিয়ে বললো”কি বুঝতাম?আমি আপনার সাথে শুলে আপনার তাতে কি লাভ?”
.
তোমাকে আরামে দেখলে তো আমার দায়িত্ব পালন করা হবে
.
ঢং!যাই হোক,চোখে ঘুম আমার অনেক,তাইই আর ঝগড়া বাড়াচ্ছি না,গুড নাইট
.
মুন দুম করে আরেকদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো
নীল মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো”যার রাগ এত কম তাকে কিনা আমি এত দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট দিলাম,আমাকে মাফ করা যায় না আসলেই”
চলবে♥
স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_২৭
Writer -Afnan Lara
.
নীল একপাশে শুয়ে পড়ে ভাবছে কাল মুন কে নিয়ে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসবে
মুনের মন ভালো হয়ে যাবে তাহলে
পরেরদিন সকাল সকাল মুনই আগে উঠে পড়েছিলো
বাহিরের সূর্যের কিরণ একেবারে নাক বরাবর এসে গিয়েছিলো বলে
কিন্তু বেলা কি বেশি হয়ে গেলো?ঘড়িতে তাকাতেই চোখ চলে গেলো কপালে
সকাল দশটা বাজে আর আমি কিনা এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছি?
আর উনি?
পাশে তাকালাম,ওমা উনিও তো ঘুমাচ্ছেন
এটা কি করে হয়
জলদি করে উঠতে হবে,হায় হায় ভাইয়া ভাবীদের সামনে মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেলো তো
মুন জলদি করে একটা সেলোয়ার কামিজ নিয়ে ছুটলো ওয়াসরুমের দিকে
নীল ঠুস ঠাস আওয়াজ পেয়ে সেও উঠে পড়েছে,উঠতেই চেখে মুখে রোদ পড়তেই সেও গেলো হকচকিয়ে
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেও বোকা হয়ে গেছে
এটা কি করে সম্ভব,এত সকাল হয়ে গেলো?
মুন জলদি করে বের হও,আমাকেও রেডি হতে হবে,কে জানে সবাই অপেক্ষা করছে কিনা?
.
আপনার একটু এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত ছিলো,আপনার জন্য আজকে আমি বাকিদের সামনে লজ্জা পাবো
.
আরে আমি কি জানি এত সকাল হয়ে যাবে,তুমি বের হও
.
আমি ঢুকেছি দশ সেকেন্ড ও হয়নি,আপনি রুমে থেকেই চেঞ্জ করুন না
.
আচ্ছা সেটা করা যায়
.
নীল গায়ের জামাটা পাল্টে একটা হলুদ রঙের টিশার্ট পরছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে,এরপর জ্যাকেট একটা পরতে গিয়ে দেখলো ফোন বাজছে এবার,বড় ভাইয়ার ফোন,ধরতেই তিনি বললেন তারা সবাই ঘুরতে বেরিয়ে গেছে,ওরা যেন বের হয়
কাপ্তাই লেকের লেক ভিউ আইল্যান্ডে আসতে বলে ভাইয়া লাইন কেটে দিলো
নীল আরও জলদি হাতের কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে,কারণ ভাইয়া তো জানে না আমরা সবে ঘুম থেকে উঠলাম
মুন ওড়না পরতে পরতে বেরিয়ে বললো”আই এম রেডি”
.
চলো চলো,ভাইয়া বলেছে কাপ্তাই লেকে যেতে
.
খিধা??
.
পথে কিছু কিনে দেবো,এখন সময় নাই
.
নীল মুনের হাত ধরে ছুটলো
মুন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো”এত ছুটছেন কেন,দেরি হলে কি আপনার ভাইয়া মারবে?”
.
মারবে না তবে আড় চোখে তাকাবে,ওটাকে আমি ভয় পাই,কথা না বলে দৌড়ের গতি বাড়াও
.
আর পারবো না, হাঁটু ব্যাথা হয়ে গেছে আমার,উফ!
.
বসো গাড়ীতে
♦
নীল ড্রাইভ করতে করতে বললো”কি খাবে?”
.
আচ্ছা পরে খেলেও সমস্যা নেই,আগে বলুন তো আমরা এত ঘুমালাম কেন?
.
আমার ও মাথা ধরছে না,তুমি তো লেট করো না,আমি নাহয় লেট করি,এরকম সব এলোমেলো হলো কেন?
.
যাই হোক,আজকে মন মত ঘুরবো,মনটাকে ভালো রাখা চাই
.
নীল মুচকি হেসে বললো”আজ থেকে তোমার মন সবসময় ভালো রাখার দায়িত্ব আমার”
.
মুন কারের জানালার দিকে চেয়ে বললো”এ কদিন বুঝি ছিল নাহ?”
.
ছিলো তবে আজ থেকে বেশি
.
মুন আর কিছু বললো না,নীল ও না,দুজনে এবার কাপ্তাই লেকে এসে লেক ভিউ আইল্যান্ডেও পৌঁছে গেছে,ওখানে আসতেই ভাইয়া ভাবী সবার দেখা পেয়ে গেলো
বড় ভাইয়া টিকেট কাটছেন
নীল গেলো সেদিকে
মুন এসে উর্মি ভাবীর পাশে দাঁড়ালো,ভাবী ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন এত দেরি হলো কেন
মুন আমতা আমতা করে নীলের উপর দোষটা দিয়ে নিজে বাঁচলো কোনোমতে,আরাফের জ্বালাতনে ভাবী আর এই প্রসঙ্গে আসেননি
আইল্যান্ডে প্রবেশ ফি জনপ্রতি ১৫০টাকা,,
এখানকার হিলটপ রিসোর্টে আজকে সবাই থাকবে ঠিক হলো,,মুন আর নীলকে উর্মি ভাবী ইচ্ছামত বকছেন,সাথে নীলের বড় ভাইয়াকেও
কারণ উনি ওদের বলেননি আসার সময় এক্সট্রা ড্রেস নিয়ে আসতে
এবার পানিতে নামলে কে কি করবে তা ভেবে ভাবী বকা দিচ্ছেন
মুন বললো ব্যাপার না,নীল ও বললো ব্যাপার না
ব্যাপার না বলে দুজনে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো
শেষে ভাবী বললেন ওরা যেন পানিতে না নামে
ভাইয়ারা ঠিক করলো মাছ ধরবে এবং হিলটপ রিসোর্টে কাল থাকবে,আজকে এখানে তাবুর ব্যবস্থা আছে সেখানে থাকবে
দারুন এডভেঞ্চার হবে,মুন ইয়ে করো উঠলো খুশিতে
নীল ওর হাত মুচড়ে ধরে বললো”খুব খুশি লাগছে না তোমার??জামা কাপড় কিছু আনছো এরকম লাফাচ্ছো যে?”
.
ভাবী তো বললেনই যে পানিতে না নামলেই হয়
.
সেটা নাহয় বুঝলাম,কাল কি করবে?ভাইয়া বললো কাল হিলটপ রিসোর্টে থাকবে,তার মানে কালকেও এই এরিয়া ছাড়বে না,আমরা যে রিসোর্টে উঠেছি ওটা কত দূরে জানো?
.
পথ তো দেখেছি,, এখন কি করবো আপনি বলুন
.
আচ্ছা দাঁড়াও এখানকার জামাকাপড় যেগুলো এবেইলএভল ওগুলা সহজেই পেয়ে যাবো,কালকের জন্য ওগুলো দিয়েই চলতে হবে
.
হুম
.
ভাইয়ারা নীলকে টেনে নিয়ে গেলেন মাছ ধরতে
মুন ভাবীদের সাথে গেলো আরেকদিকে,,এখানে বাচ্চাদের জন্য পার্ক ও আছে,,মুন বারবার পানির দিকে তাকাচ্ছে,মনটা চাচ্ছে এক লাফে পানিতে চলে যাই
ইস কি ভাল্লাগবে এরলম স্বচ্ছ পানিতে হাবুডুবু খেতে
একটা জামা আনলে এতক্ষণে আমি পানিতে ডুব খেতাম
সব উনার দোষ,এত জলদি আমাকে নিয়ে ছুটলো যে আমি একটু মুখে পাউডার দেওয়ার ও সময় পেলাম না,একেবারে হাত ধরেই দৌড় দিলো
.
কি গো মুন,গাল ফুলিয়ে কাকে বকছো?
.
না কাউকে না
.
উর্মি ভাবী কি বলছো এসব,মুনতাহা কাকে বকবে,ও তো বারবার ওদিকে তাকিয়ে নীলকে খুঁজছে,কাল রাতে নীল মনে হয় রাগটা সুন্দরতম ভাবে ভাঙ্গিয়েছে
.
মুন ভেংচি কেটে বললো”ভাবী এটা তোমার ভুল ধারনা,আমার তো কপাল খারাপ,আমি জীবনে উনার মন থেকে হিয়া নামের মেয়েটাকে সরাতে পারবো না,আর সে না সরলে আমি ও জায়গা পাবো না”
.
পপি ভাবী বললো”জায়গা চাই?”
.
হুম,কেন??কি করবেন?
.
পপি ভাবী মিশু ভাবীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন
দুজন মিলে একসাথে মুনকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলো এবার
মুন এটার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না
সে সাঁতার জানে সেটা সমস্যা না তবে ওরা দুজন এমন কেন করলো সেটা মাথায় ঢুকলো না ওর
.
পপি ভাবী ব্রু কুঁচকে বললেন”এমা!তুমি সাঁতার জানো?”
.
মুন পানিতে থেকে চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললো”পারি তো”
.
সব প্ল্যান ফ্লপ,কোথায় ভাবলাম নীল উড়ে আসবে তোমাকে বাঁচাতে
.
তোমরা আমার বড় হয়ে এরকম বাচ্চাদের মতন কাজ করলে?
এখন আমাকে উঠাও
.
উর্মি ভাবী এগিয়ে এসে বললেন”একি,মুন তুমি পড়লে কি করে?”
.
মুন ব্রু কুঁচকে বললো”এরা দুজন ফেলেছে আমাকে,এখন তুলছেও না”
.
আমরা তুলবো না,নীল তুলবে,,,নীল??এই নীল!
.
নীল মাছ ধরার বরশী ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে এদিকে এসে দেখলো মুন পানিতে
চোখ বড় করে সে বললো”মুন তোমাকে মানা করলাম না পানি থেকে দূরে থাকতে?”
.
আমি আসলে….
.
ও পড়ে গেছে,নিজ থেকে পড়ে নাই,এখন তুমি ওকে তুলো,বেচারি সেই কখন থেকে পানিতে
.
মিশু ভাবী??ও পড়েছে কি করে?আমি সিউর ও পানি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি নিজ থেকেই পানিতে গেছে
.
এত কিছুর পরেও আপনি আমাকে দোষারোপ করছেন আমার একটা জামা নাই আমি কেন নিজ থেকে পানিতে নামবো,আজিব
.
নীল হাত বাড়িয়ে মুনকে পানি থেকে তুলে বললো”যাও তাবুতে গিয়ে বসে থাকো,তোমার জন্য এটাই ঠিক হয়েছে,আরও করো বাঁদরামো
.
মুন নাক টেনে ভাবীদের দিকে তাকালো তারপর ওড়নাটা গায়ে পেঁচিয়ে চলে গেলো
নীল ভায়াইদের কাছে চলে যেতে নিতেই পপি ভাবী ওকে আটকিয়ে বললো”নীল?কেমন হাসবেন্ড তুমি??নিজের গায়ের জ্যাকেটটা মুনকে দিয়ে আসো যাও,আর তুমি না বলেছিলে এখানকার জামা কিনবে,মুনকে জ্যাকেট দিয়ে গিয়ে জামা কিনে আনো,মুন তো তোমার দায়িত্ব তাই না???
হিয়া হলে জ্যাকেটের সাথে সাথে আমাদের ওড়নাও নিয়ে যেতে ওকে পরানোর জন্য তাহলে মুনের বেলায় এত কিপটামো কেন?
.
নীল মাথা চুলকিয়ে মুনের পিছু নিলো
মুন নিজেকে বকতে বকতে তাবুর দিকে যাচ্ছে,ভাবীরা এত বলদ তা জানা ছিল না ওর
আর এই নীলকে দেখো!আমাকে পানিতে দেখে তার একটুও ফিলিংস কাজ করলো না,উল্টে বকলো আমাকে,অসভ্য লোক একটা
.
এই দাঁড়াও তো,এত জোরে হাঁটো কেন
.
কি হয়েছে?
.
নাও ধরো আমার জ্যাকেট,আমি আলাদা ড্রেস কিনে আনছি
.
ভাবীদের কাছে যে এক্সট্রা ড্রেস আছে ওগুলো আমাকে দিলে…
.
কচু দিবে,উনারা এতক্ষণে পানিতে নেমেও গেছে
.
ধুর!সব আমার দোষ
.
হুম তোমারই দোষ,মাছ ধরা রেখে এবার আমি যাব জামা কিনতে, এক ট্রলি ভর্তি জামা হোটেলে পড়ে আছে
.
মুন ব্রু কুঁচকে জ্যাকেটটা পরে নিয়ে বললো”জলদি আসবেন,আমার নাক জ্বলছে,বেশি দেরি হলে সর্দি লেগে যাবে
.
কাজের ছেলে পেয়েছে মনে হয়
.
আচ্ছা শুনুন,আমরা হিলটপে গিয়ে থাকলে হয়না?
.
তাবুতে থাকতে কি সমস্যা?
.
আমার কেমন যেন আনকম্পোর্টেবল লাগছে,প্লিস চলুন না হিলটপে যাই
.
তাহলে চলো,জামা কিনে সোজা রিসোর্টে চলে যাব,কিন্তু তুমি এরকম ভিজে জামা নিয়ে হাঁটবে?
.
গাড়ীতে থাকবো,আপনি গিয়ে কিনে আনবেন
.
আচ্ছা তাও করা যায়,তুমি চলো আমি ভাইয়াকে বলে আসছি,
.
মুন চুপিসারে এসে কারে বসলো,ভিজে একাকার হয়ে আছে সে,,নীল এখনও কেন আসছে না,ভাবীদের জন্য এত বিপদে পড়লাম
অবশ্য তারা তো নীলকে আমার কাছে আনার জন্যই এমন করেছে,এমনি এমনি তো করেনি,কিন্তু তা তো আর হলো না
হলো তার উল্টোটা,ধুর!ভাল্লাগে না,কোথায় ভাবলাম আজ একটু ঘুরবো,ইঞ্জয় করবো
সবকিছু নিয়ে পানিতে পড়লাম আমি,আমার কপালটাই ফুটো
.
নীল কারে ঢুকতে ঢুকতে বললো”তোমার কারণে আমার আজকের ট্রিপটাও গেলো পানিতে”
.
আমি কি করবো,ভাবীরাই তো আমাকে পানিতে….
.
কি?
.
না কিছু না
.
ভাবীদের দোষ দিচ্ছো কেন,তুমি ইচ্ছে করে পানিতে পড়েছো এটা নিয়ে আমি একশো পারসেন্ট সিউর
.
মুন রেগে মুখটা ফুলিয়ে আরেকদিকে ফিরিয়ে বসলো
নীল চুপচাপ ড্রাইভ করে হিলটপে যাওয়ার পথে একটা বাজারে নেমে পছন্দমত একটা শাড়ী কিনে নিলো মুনের জন্য,নিজের জন্য কিনলো না কারণ ওর যা গায়ে আছে তা দিয়েই চলবে
.
মুন জ্যাকেট টাকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বললো”কিগো হিয়া,জীবনে নীলের জ্যাকেট পরেছো??”
.
নীল কারে ঢুকতে ঢুকতে বললো”পরেছে”
.
মুন চোখ বড় করে বললো”কবে?আর কেন?”
.
একদিন আমরা বৃষ্টির দিনে ঘুরতে বের হয়েছিলাম,তখন ওকে আমি আমার জ্যাকেটটা দিয়েছিলাম
.
মুনের খুব রাগ হলো,এতই রাগ যে সে গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে নীলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো”তাহলে এর উপর আমার কোনো অধিকার নেই”
.
ফাইন,নাও ধরো এই শাড়ী,শাড়ীর সাথের বাকিসব ও কিনেছি রেডিমেড, নো প্রব্লেম
.
মুন কিছু বলছে না,চুপ করে সে ভাবছে তার সব অধিকার হিয়া তার আগেই পেয়ে গেছে
মুনের খুব করে কান্না এসে গেলো এটা ভাবতে গিয়ে
নীল চোখের পলক ফেলে জ্যাকেটটা মেলে মুনকে আবারও পরিয়ে দিয়ে বললো”হিয়া একবার পরেছিলো,আর তুমি চাইলে সারাটা জীবন পরবা,এসব তো তোমারই”
.
মুন চোখের পানি মুছে জ্যাকেটটাকে সরিয়ে দিয়ে বললো”যেটা আমার সেটা আমার আগেই অন্য কেউ ব্যবহার করে ফেলেছে”
.
নীল কার চালাতে মন দিয়ে শান্ত স্বরে বললো”কিছু কিছু প্রেমে ছোঁয়া বাদেই অনুভূতি সৃষ্টি হয়
আমার আর হিয়ার ছিল ঠিক তেমন ধরনের প্রেম
চোখের দিকে তাকালেই আমাদের অন্তর ছোঁয়া হয়ে যেতো,হাত দিয়ে ছুঁতে হতো না আর
এরকম খাঁটি প্রেম করেও তাকে না পাওয়ার কষ্ট আমাকে আজও খুঁটে খাচ্ছে”
.
মুন জ্যাকেটটাকে অনেকটা দূর সরিয়ে দিয়ে বললো”তাহলে দুজনে এক হয়ে যান না কেন,এখনও তো সময় আছে”
.
আমরা দুজন এখন আরেক দুজনের দায়িত্ব ভার নিয়েছি
.
ভালোবাসা তো আর দেননি
.
মুন তুমি এখনও ছোট,এসব বুঝবে না,যেদিন বুঝবে সেদিন নিজেই নিজের কপালে চড় মারবে
.
কি বুঝতাম?
.
এই যে আমি তোমার হাসবেন্ড তার পরেও তুমি আমাকে বলছো হিয়ার কাছে ফিরে যেতে
.
মুন তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো”আমি তো ভলোবাসা পেয়েও পেলাম না,যার প্রাপ্য সে নাহয় পাক নিজের করে”
.
সে পাবে না,কারণ সৃষ্টিকর্তা হিয়ার খাতায় আমার নাম লেখেনি,লিখেছে সাকিবের নাম
আর আমার খাতায় তোমার নাম,সুতরাং….
চলবে♥