স্মৃতির দেয়াল পর্ব-৩২+৩৩

0
1893

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৩২
Writer -Afnan Lara
.
নীল কিছু বললো না,মুন দুষ্টুমি করছে তা সে ভালো করেই জানে
মুখটা বাঁকা করে সে চলে গেলো রুম থেকে
মুনের তো মনে মনে লাড্ডু ফুটছে,নীলের বলা কথা গুলো যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে স্মৃতির দেয়াল ভাঙ্গতে চলেছে
মুন খুশিতে লাফাতে গিয়েও পারলো না,পায়ে যে অনেক ব্যাথা,,পপি ভাবী আর নিপা মিলে আংটি কিনে এনেছে
নিপা মুনের পায়ের কথা শুনে এখন ওকে দেখতে এসেছে
মুনের পাশে বসে সে মুচকি হাসলো,মুন তার হাসির কারণ বুঝলো না
তাই বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করলো যে নিপা কেন হাসছে
নিপা হাসি থামিয়ে বললো”একদিন তার এক বান্ধুবী এসেছিলো বাসায়,নাম হলো শশী,,শশী নীলকে চেনে এবং নীল ও ওকে চেনে,বলতে গেলো ভালো ফ্রেন্ড
শশী পানিতে পিছলিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে পা মচকেও ফেলেছিলো সেদিন যেদিন সে বেড়াতে এসেছিলো এই বাসায়
নীল আর নিপা ছিলো বাসায়,নীলকে এত করে বলার পরেও সে শশীকে কোলে তুলে রুমে দিয়ে আসেনি,কারণ তার কথা হলো তার কোলে হিয়া ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না
আর আজ সে কিনা মুনকে দুবার কোলে নিয়েছে,বিষয়টা অবিশ্বাস্য
আস্তে আস্তে হিয়া নামটাও মুছে যাবে নীলের জীবন থেকে,এটা বলে নিপা চলে গেলো
মুন বেশ বড় চিন্তা নিয়ে আয়নার দিকে তাকালো,তারপর তাচ্ছিল্য করে বললো”নিপা আপু!কোলে নিলেই ভালোবাসা দেওয়া নেওয়া হয়ে যায় না,যার অন্তরে হিয়ার নাম লেখা হয়ে গেছে তা থেকে মুছবে কি করে?মুছবে না বরং সেই লেখার গড়ন ঘাড়ো হবে,তুমি জানো না আমি কি অবস্থায় বেঁচে আছি,বিয়ের আজ এতটাদিন হয়ে গেলো সে আজ পর্যন্ত সেই চোখে আমার দিকে তাকালো না যেই চোখে সব স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের দেখে
.
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুন বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো,,হিয়া যদি বাচ্চার মা হয়ে যায় তাহলে হয়তবা নীল কিছুটা ঠিক হবে,মাথা থেকে হিয়ার ভূত নামাবে
তাই যেন হয়,আর পারছি না এসব দেখতে
আমি চাইনা সে আমাকে এখনই ভালোবাসুক,কিন্তু এটা চাই সে যেন আমার আর তার মাঝে হিয়াকে না আনে
তাহলেই আমি এই বন্ধনটাতে সুখী হবো
.
নীল বাগানে খোলা জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে,,ভাবছে সত্যি কি আজ হিয়া সাকিবকে মেনে নেবে?
তাহলে বেশ হবে,আমার জন্য সাকিব এত বছর কষ্ট করেছে আজ তার ভালোবাসাটা সার্থক হবে
আমার ও উচিত তাহাকে মেনে নেওয়া,হিয়া যখন সাকিবকে মেনে নিতে পারবে তখন আমি কেন তাহাকে কষ্ট দেবো??
তাহা কি আসলেই চায় আমি তাকে মেনে নিই??
.
নীল তার বারান্দার দিকে তাকালো,রোদের শেষ আলো লিচু গাছটার মাথায় গিয়ে আটকে আছে,যেন একটুখানি হলুদ রঙ মিশিয়ে দেওয়া আছে শুধু সেই জায়গাটায়
নীল মুচকি হাসলো,এসময়টাতে কখনও বাগানে বসা হয় না তার তাই হয়ত এই সুন্দর দৃশ্য দেখা হলো না ওর এতদিন
.
আমার বাসায় গাছগুলোকে এভাবে ইউজ করার লোক আমার স্ত্রী হয়ে আসবে কে জানতো!
আর কেনো গাছ বাকি নেই যেগুলোতে তাহা উঠেনি,
মেয়ে মানুষ হয়ে এত বাঁদরামি কই থেকে শিখলো
ওর ঐ দজ্জাল মায়ের থেকে নিশ্চয় সারাদিন মার খেতো
তখন বেশ হতো,কিন্তু তাও তো ওর অভ্যাস পাল্টায় নি,তাহলে আমি কি পাল্টাবো?
ওর নিজের বাচ্চা হলেও কি ও এমন করবে?
ধুর কি ভাবছি,যাকে আজ পর্যন্ত মেনে নিতে পারছি না তাকে আবার বাচ্চার মা বানাবো,এটা তো দূরের ব্যাপার
ওর হাত ধরতে গেলেও হিয়ার ছবিটা সামনে চলে আসে
এত করে হিয়ার মাঝে মিশে গেছি এখন চাইলেও পিছোতে পারছি না আমি
তবে হিয়া সাকিবের সাথে ভালো আছে শুনলে আমি আর ওকে মনে করবো না
এটা ঠিক হবে না,,আমার মনে করার জোরে না আবার ওদের সংসারে ফাটল ধরে,এসব আমি হতে দেবো না কিছুতেই
সাকিব ভালো ছেলে,হিয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক
আমার চেয়ে সাকিব ওকে ভালো রাখতে পারবে তা নাহলে কোন ছেলেটা তিনটাবছর ওয়েট করে??
.
তুই ও তো ওয়েট করেছিস
.
ভাইয়ার কথা শুনে নীল পিছনে তাকালো,ভাইয়া মুখটা শক্ত করে এসে ওর পাশে বসলেন
তারপর নীলের হাতটা ধরে বললেন”তোর থেকে সাকিব বেশি হতে পারে না,তুই তিনটা বছর কত শতে শতে বিয়ের প্রোপোজাল রিজেক্ট করেছিস অনলি হিয়ার জন্য,কোন প্রাক্তন এমনটা করে?”
.
আমি তো মুনতাহাকে বিয়ে করে নিয়েছি,এসবের দাম রইলো কই
.
তুই হিয়াকে কতটা ভালোবাসিস এটা হিয়ার চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না,হয়ত এর জন্যই সে আজ পর্যন্ত সাকিবকে মেনে নিতে পারেনি
.
তবে এখন পারবে,আমি বুঝিয়ে দিয়েছি
.
বিষয়টা হিয়ার ভালো করে বুঝার জন্য তোকে আরেকটা কাজ ও করতে হবে নীল
.
কি?
.
তাহাকে আপন করে নে,মেয়েটার কোনো দোষ নেই
সারাক্ষণ তোকে নিয়ে ভাবে,আর তুই হিয়াকে নিয়ে
মুনতাহা বিয়ে করা বউ তোর,জোর করে বিয়ে করে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতি,,শুধু দায়িত্ব পালন করা একটা হাসবেন্ডের কাজ না নীল,ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড
.
হুম
.
হিয়া তোকে আর মুনতাহাকে একসাথে হ্যাপি দেখলে সেও সাকিবকে নিয়ে হ্যাপি থাকতে চাইবে
তাহলে আর কেউ কষ্ট পেলো না
.
নীল চুপ করে থাকলো,ভাইয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন
সবাই তাহার সাইডে,অবশ্য থাকারই কথা,,দোষটা তো আমারই,জোর করে বিয়ে করে তাকে বারবার দূরে থাকতে বলছি,কতটা পাগল হলে এমনটা করে
বিয়েটা না করলেই হতো
এখন তাহলে নীল শুরু করো হাসবেন্ডগিরি!

মুন বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে,উর্মি ভাবী দিয়ে গেছেন কিছুক্ষণ আগে,নীলের কোনো খবর নাই
আমার সাথে রাগ করলো নাকি অন্য কিছু,মাঝে মাঝে বুঝি না লোকটা এমন বিহেভ কেন করে
.
ভাবতে ভাবতেই মুখের সামনে তেঁতুল এক ছড়া দেখে মুন হাত থেকে আইসক্রিমের বাটিটা রেখে দিলো,ছড়াটা ছোঁ মেরে নিয়ে মুন উপরে তাকালো
নীল দিলো এটা তাই মুন আরও বেশি খুশি হলো
তার চেয়ে বেশি খুশি হলো নীলের মুখে এরকম একটা মিষ্টি হাসি দেখে যেমন করে নীল আজ পর্যন্ত হাসেনি
অবাক হয়ে মুন কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নীল বললো”ভাবলাম বউয়ের মনটা ভালো করি”
.
এরকম করে হাসলেন কেন?
.
মানুষ বলে আমি এমন করে হাসলে সামনের মানুষটা সব ভুলে যায়
.
মানুষ সত্যি বলে,আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম
.
যাক তাহলে ভালো,এবার বলো লবণ মরিচ দিয়ে খাবা নাকি আচার বানিয়ে খাবে?
.
লবণ মরিচ
.
বলতে না বলতেই নীল তার পিছন থেকে একটা বাটি আনলো যেটাতে লবণ মরিচ রাখা মিক্স করে
.
মুন তো বারবার অবাক হচ্ছে,তেঁতুল খেতে খেতে বললো”এত কিছু কেন?কোনো কারণ?”
.
ভাবলাম বউকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এবার একটু প্রেমের সাগরে ডুব দেওয়াই
.
আপনার কি হয়েছে বলুন তো,গিরগিটি ও তো এত জলদি রঙ পাল্টায় না
.
তোমার ভাল্লাগছে না আমার এমন করাতে?
.
আরে লাগছে তো,,জাস্ট অবাক হচ্ছি
.
হুমমম,ভেবো না আবার যে একদিনেই সব পেয়ে যাবে
আমাকে সময় দাও,আর তুমি নিজেও সময় নাও
বাই!আমার অফিসে কাজ আছে
.
কথা শেষ করে নীল চলে গেলো হনহনিয়ে
মুনের মাথার উপর দিয়ে গেলো সব,যাই হোক আপাতত সে এই তেঁতুলের ছড়া সাবাড় করা নিয়ে ব্যস্ত অনেক
.
সন্ধ্যায় নীল আবার বাসায় ফিরলো ডিউটি শেষ করে
নিপা আর ভাবীরা মিলে সোফার রুমে নিপার এঙ্গেজমেন্টের শাড়ীটা বিছিয়ে দেখছে,একদম সবাই ব্যস্ত গয়নাগাটি আর শাড়ী নিয়ে
নীল ফাঁক দিয়ে তার রুমে চলে আসলো,রুমে এসে দেখলো মুন নেই
ওমা গেলো কই,ওর না পায়ে ব্যাথা?
নীল ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে আবারও সোফার রুমে চলে আসলো,সেখানেও মুন নেই
মিশু ভাবী শাড়ীর আঁচল ধরে বললেন”দেবরজি আপনার বউকে খুঁজছেন?”
.
নীল হালকা কেশে বললো”না আসলে ওর পায়ে ব্যাথা তো,কোথায় গেলো কিভাবে গেলো তাই ভেবে একটু টেনসড্”
.
আপনার বউয়ের পা একদম ঠিক হয়ে গেছে,আপনার বউয়ের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো,,এবং সে রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে এখন,,
.
নীল মাথা চুলকিয়ে আড় চোখে রান্নাঘরের দিকে তাকালো একবার
নীল আর গোলাপির কম্বিনেশনের শাড়ী পরা মুনকে দেখা যাচ্ছে,সাদা কোমড়ে আঁচল গুজে সে চায়ের পাতিলে চা পাতা দিতে দিতে নাহারের সাথে কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে
সেই আবারও কোমড়ের দিকে চোখ চলে যেতেই নীল মুখটা আরেকদিকে ফিরিয়ে নিলো,বুকের ভেতরে ধরফর করছে
কেন জানি না সে আবারও তাকালো
মুন হাত দুটো পিছনে এনে খোঁপাটাকে টাইট করছে
নীল মন দিয়ে দেখছে সেটা
ভাবীরা সবাই একজন আরেকজনকে খোঁচা মারছে নীলের এমন বিভোর হয়ে যাওয়া দেখে
নিপা নিজের শাড়ীটা গুছিয়ে নিতে নিতে বললো”রাজা কো রাণী ছে পেয়ার হো গেয়া…..”
.
নীল মুচকি হেসে বললো”হুমমমমম…..”
তারপর হুস আসতেই বললো” না মানে কি বলছো তোমরা এসব আমি তো এমনি দাঁড়িয়ে ছিলাম”
.
তো আমরা তো তোমাকে কিছু বলিনি নীল,নিজের গায়ে নিচ্ছো কেন?”
.
কথার উত্তর দিতে না পেরে নীল এক দৌড়ে রুমে ফেরত চলে আসলো
সবার মুখে নীল নাম শুনে মুন সোফার রুমে আসলো দেখার জন্য,নীল তো নেই তাই মুখটা ফ্যাকাসে করে আবারও চলে গেলো রান্নাঘরে,নাহারকে চা দেখতে বলে মুন নিজের রুমের দিকে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে,পিঠে কি যেন বিড়বিড় করছে মনে হচ্ছে
মনে হয় পিঁপড়া,চুলকাচ্ছেও
রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে মুন আয়নার কাছে এসে হাত দিয়ে পিঁপড়াটা বের করার চেষ্টা করছে
নীল তখন বারান্দায় ছিলো,বারান্দা থেকে রুমে এসে দেখলো মুন পিঠে হাত দিয়ে ছটফট করছে
.
কি হলো তোমার?
.
হঠাৎ নীলকে দেখে মুন ভয় পেয়ে দেয়ালের সাথে লেগে গেলো,তারপর হাঁপ ছেড়ে বললো”আপনি কখন এলেন?”
.
কিছুক্ষন আগে,কি হয়েছে তোমার পিঠে?
.
পিঁপড়া
.
ওদিকে ফিরো
.
না
.
আমি পিঁপড়াটা বের করে দিতে হেল্প করবো
.
দরকার নাই,আমার লজ্জা করে,আপনি বরং ভাবীদের কাউকে ডেকে দিন
.
আমি গেলে তারা আমাকে কথা শুনাবে,বলবে সামান্য এই কাজ বুঝি আমাদের দিয়ে করাতে হয়,নিজেই তো পারো
.
আপনি রুম থেকে যান,আমি চেঞ্জ করে আসছি
.
ফাইন!
.
নীল চলে গেলো,মুন চেঞ্জ করতে করতে ভাবলো নীল নিজ থেকে চাইলো আর সে মানা করে দিলো???
তার মানে এতদিন সে শুধু চাইতো হিয়ার নাম যেন নীল না নেয়,হিয়াকে নিয়ে যেন না ভাবে
আসলে সে কিন্তু এখনও নীলকে মেনে নিতে পারেনি,নীল ঠিক বলেছিলো,আমাদের দুজনেরই সময় নেওয়া উচিত

নীল?মুন কোথায়
.
আসছে,,চা দাও,চা খাব
.
নীল চায়ের কাপটা নিয়ে মুখ গোমড়া করে সোফার এক কোণায় গিয়ে বসলো
এরকম মুখ করে রেখেছে কেন তাই নিয়েই ভাবছে ভাবীরা
মিনিট পাঁচেক পর মুন ও আসলো
নীলের দিকে এক নজর চেয়ে ভাবীদের সাথে আড্ডায় মেতে গেলো সে
নীল মনে মনে ভাবছে মুন আসলেই কি চায়
এতদিন যে ভাব করত যেনো আমি আজ ভালোবাসতে চাইলে আজকেই রাজি হয়ে যাবে আর সামান্য পিঁপড়া দেখতে দিলো না,এই মেয়েটা আসলেই অাজব!
.
কি হয়েছে নীল?চোখ দিয়ে মুনকে গিলে খাচ্ছো কেন?
.
নীল চায়ের কাপটা হাত থেকে রেখে বললো”না আমি অফিসের কাজ নিয়ে ভাবছিলাম”
.
মুন হয়ত বুঝলো নীল কেন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো
পিঁপড়া দেখা নিয়ে!
আমার বুঝি লজ্জা করে না??এতদিন হিয়া হিয়া পিয়া পিয়া করে এখন তাহা তাহা করা শুরু করলে আমার ও তো বিষয়টা বুঝতে হবে,সময় লাগবে,আদৌ নীলের সুবুদ্ধি হয়েছে নাকি অন্য চাল
চলবে♥

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৩৩
Writer -Afnan Lara
.
মুন নীলের ফোনের দিকে লক্ষ করছে সেই দুপুর থেকে,কি ব্যাপার একবারও হিয়ার কল আসলো না?
বিষয়টা অদ্ভুত নাহ??হিয়ার বুঝি আজ নীলের কথা মনে পড়ছে না??
.
নীল একটা ইংরেজি বই নিয়ে পড়ছে বসে বসে,বারান্দার হাওয়ায় বই পড়াতে বেশ ভালোমতনই মনোযোগ দিয়েছে সে
এদিকে মুন পড়ে আছে নীলের ফোন নিয়ে,নীলকে কি জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে যে হিয়া কল করছে না কেন?
না থাক,মনে হয় হিয়াকে ভুলে গেছে,বই পড়ছে বই পড়ুক,আমি বরং ফোনটা নিয়ে চেক করি কথা বলেছে কিনা
মুন পা টিপে টিপে ওয়ারড্রবের উপর থেকে ফোন নিলো
ওমা লক করা!!ধুর!

রাতে ডিনার শেষ করলো সবাই নিপার বিয়ের কথোপকথন নিয়ে
কাল সামিরদের বাসার সবাই আসবে,নিপার তো রাতের ঘুম গেছে উড়ে সাথে বাকিদের ও ঘুম শেষ করছে একশোটা প্রশ্ন করে
যে তারা কি আসবে,কি খাবে,কখন আসবে,,কতক্ষণ অনুষ্ঠান হবে এসব
মুন পাশে বসে শুনছে সব,তার তো এঙ্গেজমেন্ট হলো না
ডাইরেক্ট বিয়ে হয়েছে তাই আপাতত নিপার এঙ্গেজমেন্টের আলোচনা শুনে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছে
.
উর্মি ভাবী হঠাৎ করে বললেন নীল যেন মুনকে নিয়ে শপিংয়ে যায়,নিপার ননদকে একটা শাড়ী দেওয়া হবে কাল,সেটা কেনা বাকি
নীল আর মুন তাই এখন যাচ্ছে সেটা কিনার জন্য
কাল সময় পাবে না তাই,,এসময়ে নীল আর মুন শুধু ফ্রি ছিল বলে ওদের দায়িত্ব টা দেওয়া হলো
ভাবীর প্ল্যান তো আর নীল, মুনতাহা বুঝলো না
শপিংমলে আসতেই আবারও কল আসলো ভাবীর
ভাবী নীলকে বললেন মুনের আর তার জন্য এক জোড়া রিং কিনতে,যেহেতু ওদের এঙ্গেজমেন্ট হয়নি
.
মুন অনেক খুশি হলো ভাবীর কথা শুনে,নিজে নিজে পছন্দ করে নিলো দুটো রিং
নীল চুপচাপ আছে,রিং গুলো কিনার পর মুন নিজের হাতে নিজে রিং পরতে যেতেই নীল ওকে আটকালো
মুন সন্দেহসূচক চোখে তাকিয়ে বললো”কি হলো?”
.
আমার পরানোর কথা এটা,তোমার নিজের না
.
কথাটা বলে নীল আংটিটা মুনের হাতে পরিয়ে দিলো,তারপর নিজের হাতটা মুনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো”পরিয়ে দাও”
.
মুন পরিয়ে দিতে দিতে ভাবলো এতটা বদল কি করে হয়,নিশ্চয় নীল আর হিয়ার মাঝে কিছু একটা হয়েছে
ওর ভাবনায় আবারও পানি ঢেলে দিলো নীল
গাড়ীতে বসতেই নীল আজ মুনের সিটবেল্ট টাও বেঁধে দিয়েছে
ব্যাপারটা রহস্যজনক!!

আচ্ছা আপনার কি হয়েছে বলুন তো?এরকম বিহেভ করছেন কেন??
.
কি আবার হবে,বললাম তো বউয়ের সাথে প্রেম করার ইচ্ছা জাগলো,বউয়ের আরও কেয়ার করার ইচ্ছা জাগলো,যদিও বউ আমাকে এখন উল্টো ভয় পাচ্ছে,লজ্জা পাচ্ছে
.
মুন ব্রু কুঁচকে বললো”যে ছেলেটা এতদিন আমার দিকে তাকাতেও আগে হিয়ার কথা ভাবতো সে এখন আমার পিঠে পিঁপড়া খুঁজতে রাজি হয়ে গেলো আর আমিও দিয়ে দিব??বিষয়টা কেমন আজিব না?
.
আমার কাছে তো আজিব লাগছে না,আমরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ
.
তো?
.
তো আর কিছু না,যেমন করছি তেমন করে তালে তাল মেলাও
.
সরি আমি সেটা পারবো না
.
নীল গাড়ী থামিয়ে মুনের দিকে তাকালো
মুন ওর দিকে না তাকিয়েই বললো”আমি খেলার পুতুল না মিঃ নীল চৌধুরী,,হিয়া আজ কি না কি বললো আর আপনি আজ থেকে আমার সাথে লুতুপুতু শুরু করলেন ভাবলেন আমিও তালে তাল মেলাবো??
জি না কারণ আমি সত্যিটা জানি,আপনি হিয়াকেই ভালোবাসেন,,
এখন আমার সাথে যা যা করছেন তা হলো নাটক
কিংবা হয়ত বাধ্য হয়ে করছেন
যেদিন আমার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন আপনি হিয়াকে নয় আমাকে ভালোবাসেন সেদিন আমি তালে তাল মেলাবো,তার আগে না
কারণ তার আগে আমি নিজেই আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না
সারাক্ষণ আমার মাথায় ঘুরপাক খাবে আপনার আর হিয়ার কথা
এর চেয়ে বরং আগে আমার হাসবেন্ড মশাই আমার প্রেমে পড়ুক,,ততদিন আমি নিরপেক্ষ
.
নীল মুনের কথাগুলো ভালো করে বুঝলো না,মুনের এই একটা হেভিট,মাঝে মাঝে এমন কথা বলবে যার পদবি হবে কঠিন
এত কঠিন শব্দ কি করে ব্যবহার করতে পারে একটা মানুষ??
.
নীলের যেন মুখের কথাই হাওয়া হয়ে গেছে
কঠিন কথার বদলে কঠিন কথা বলতে হয়,নীল ভাবছে কি কঠিন কথা বললে মুনের কথার সাথে কাটাকাটি যাবে
ভাবতে ভাবতে বড় শ্বাস নিয়ে সে ঠিক করলো এক লাইন কঠিন কথা বলবে
শেষে মনস্থির করলো সে বলবেই
ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নীল বললো”তাহলে ভেবে দেখো মিসেস চৌধুরী,আমার ভালোবাসা পাবার অপেক্ষা করতে গিয়ে আবার আমাকেই হারিয়ে ফেলো না যেন”
.
মুন নীলের দিকে তাকালো,নীল এরকম কথা কবে শিখেছে,যাই হোক,কঠিন কথার ঝুড়ি আমার আছে,যাকে বলে ফ্যাক্টরি,আমিও এবার এক লাইন ছাড়বো
এহেম এহেম!!
আপনাকে হারাবো মানে??আপনাকে আদৌ পেয়েছি আমি??
.
নীল যেন পুলিশ থেকে জেলের আসামি হয়ে গেছে মুনের কথায়,,কপাল কুঁচকিয়ে বললো”কেন?পাবা না কেন,আমি তো তোমার হাসবেন্ডই”
.
হুমম,এক্কেবারে আমার হাসবেন্ড,অর্থাৎ নামে আমার আপনি
আর কামে হিয়ার,তাই না?
.
নীল হালকা কেশে বললো”হইছে থামো,তোমার সাথে কথার যুক্তিতে আমি পাশ করতে পারবো না,মাফ করো,তোমার যা খুশি তাই করো,শুধু আজকের পর থেকে আমাকে পাশে পাবে,দ্যাটস্ ইট
.
ভালো!

মা আর উর্মি ভাবী অনেক খুশি হলেন মুন আর নীলের হাতে রিং দেখে,মূলত প্ল্যানটা তারা দুজন মিলেই করেছিলো,,
মুন জানালো নীল তাকে রিংটা পরিয়ে দিয়েছে,এটা শুনে মা তো আলহামদুলিল্লাহ বললেন,তার আর চিন্তা রইলো না
ভেবেছিলেন নীল বুঝি কখনও মুনের দিকে ফিরবে না,তবে এখন মনে হয় ফিরছে,এটাই অনেক
.
মুনের ও আজ মনটা বেশ ভালো হয়ে গেছে,এটাই তো সে চেয়েছিলো
তবে নীল তাকে এতটাদিন ধরে হিয়া নামক যে প্যারা দিয়েছে প্রতি পদে পদে
তার শোধ তুলতে হবে আমার এটিটিউট উপরে রেখে,তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে মুনতাহা দূর্বল,আমি বরং এখন ভাব নিব,নাহলে আমাকে ছ্যাসড়া ভাববেন উনি
হুমমম!
.
মুন গায়ের শাড়ীটা পাল্টে অন্য একটা সুতির শাড়ী পরে এসে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়েছে,ড্রিম লাইটের আলোয় তার হাতের রিংটা দেখা যাচ্ছে,হাত উঁচু করে দেখছে সে,,নীল বারান্দায় বসে বিয়ার গিলছে
লোকটার এই একটা অভ্যাস তুলতে হবে,তবে তার আগে হিয়ার নাম মুছুক,এখন নাহলে ক্যাচো খুঁড়তে কেউটে বের হবে,আমি বরং এটাকে এখন ছেড়ে দিই
.
নীল এক গ্লাস বিয়ার খেয়ে পিছন ফিরে তাকালো,মুন সাথে সাথে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো,,হাতের চুড়িগুলো ঝুনঝুন করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে
.
নীল মুচকি হাসলো,,তারপর বললো”সাড়ে দশটায় কার ঘুম আসে??আর তুমি এত জলদি ঘুমাতে গেলে?ঘুম তো আসছে না জানি তাহলে শুধু শুধু শুয়ে আছো কেন?”
.
তো কি আপনার বিয়ার খাওয়া দেখবো?
.
দেখতে হবে না,খেয়ে দেখো
.
আমি এসব খাই না,যাদের মন তিতা তারা এসব খায়,আমি তো মিষ্টি মানুষ
.
তুমি মিষ্টি মানুষ??আমাকে সেটা মানতে হবে?
আজ পর্যন্ত মিষ্টি ভাষায় কোন কথাটা বলছো তুমি তাহা?
.
তিতা মানুষের সামনে আমি আমার মিষ্টতা দেখাই না
.
আরে বাস!!তা মিসেস লজিকের ভাণ্ডার এত বকরবকর না করে ঘুমান একটু,আপনার লেকচার শুনতে শুনতে কান পেকে গেছে আমার
.
মুন কাঁথা মুখের উপরে টেনে আরেকদিকে ফিরে গেলো,পরেরদিন সকালে উঠে সেই আবারও নীলের উদম বডি দেখে দুম করে বিছানার নিচে পড়লো মুন
ধারুম করে আওয়াজ হওয়ায় নীল জেগে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো মুন কোমড়ে হাত দিয়ে নড়াচড়া করছে
.
বিয়ের পর থেকে আমাকে এমন বেশে দেখছো তারপরেও ঘুম থেকে উঠে এমন বেশে দেখলে তুমি ভয় পাও কেন বলোতো?
.
আমার কথা হচ্ছে রাতে আপনি টিশার্ট পড়ে ঘুমাতে আসেন,তাহলে টিশার্টটা খোলেন কখন??আমি তো একদিনও দেখলাম না,তাই তো হুট করে দেখে ভয় পেয়ে যাই,আসলে আজও আমি চোখ মেললে আমার মনে হয় আমি আবিয়াতি
সেই মূহুর্তে পাশে উদম ছেলে দেখলে ভয় পাবারই কথা
.
ইস রে আবিয়াতি,আমি শার্ট খুলি রাতের দুটোর দিকে,যখন আমার গরম লাগে তখন
.
এসি এত বাড়িয়ে দেন আমি দুটো কাঁথা একসাথে গায়ে দিই তাও মনে হয় হিমালয়ে আছি আর আপনার আবার মাঝরাতে গরম ও লাগে?
.
তুমি হলে মেয়ে মানুষ,ওসব তুমি বুঝবে না,আমাকে ঘুমোতে দাও এখন,আর গিয়ে মা ভাবীদের সাথে কাজে হাত লাগাও,আজকে নিপার এঙ্গেজমেন্ট,কত কাজ বাকি জানো?তার উপর উনারা কেউ তোমাকে এখনও দেখেনি
নিপার ছোট ভাইয়ের বউকে সবাই আগ্রহ করে দেখতে আসবে
আর একটা কথা!!! আজকে যদি তুমি গাছে উঠেছো তো তোমাকে গাছের সাথে কসটিভ মেরে আটকিয়ে দিব আমি,আমাকে চিনো নাই এখনও
একেবারে রিমান্ডে নিয়ে যাব
.
আমাকে সকাল সকাল ধমক দিয়ে দিনটা খারাপ করতে চান আপনি?চুপচাপ শুয়ে থাকুন তো,সব মনে আছে আমার
গাছে তো পরেও উঠা যাবে
.
কি বললে?
.
না না,আর কোনোদিন উঠবো না আমি,এই তো যাচ্ছি রেডি হয়ে সবার কাছে
.
হুম!
.
মুন কোমড় ধরে উঠে নীলের পিঠের দিকে তাকিয়ে বললো”ঢং!ইচ্ছে করে উদম হয় আমি বুঝি না লাগে
যেন সকাল সকাল আমি ঠুস করে ফ্লোরে পড়ে যাই তাই
.
একটা বেগুনি রঙের জামদানি শাড়ী পরে মুন গেছে মায়ের কাছে
সেখানে মা,নাহার আর উর্মি ভাবী মিলে পিঠা ভাজছেন,নিচে মোড়ায় বসে মিশু ভাবী আর পপী ভাবী পিঠা গোল গোল করছেন হাতের তালুতে রেখে
মুন একটা মোড়া এনে তাদের পাশে বসে কাজে হাত লাগাতে যাওয়ার আগেই মা বাধা দিলেন,বললেন সবাই যেহেতু পিঠা বানানোর কাজে হাত লাগিয়েছে সেহেতু নিপাকে সাজানোর দায়িত্ব টা মুন নিক
মুন তাই রাজি হয়ে গেলো,সে গেলো নিপাকে সাজাতে
গিয়ে দেখলো নিপা গন্ডারের মতন ঘুমাচ্ছে,কাল সারারাত এক্সাইটমেন্টের জেরে তার ঘুমটাই হলো না,মুনের মুখে এঙ্গেজমেন্টের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে সে গেলো ব্রাশ করতে
মুন নিপার সাজগোজের জিনিসপাতি একসাথ করছে,গাজরা কতগুলো দেখে শাড়ীর সাথে মিলিয়ে একটা গাজরা মুন তার খোঁপায় বেঁধে নিলো
এরকম আর্টিফিশিয়াল গাজরা মুন আগে পরেনি,,বাসার পিছনের ছোট্ট ফুলের বাগান থেকে তাজা ফুল এনে চুলে লাগাতো সে সবসময়
যে যাই বলুক,এসব আর্টিফিশিয়াল গাজরা কখনও তাজা ফুলের বরাবর হতে পারবে না
.
মুন আমি ফ্রেশ হয়ে নিছি,রেডি করিয়ে দাও জলদি,একদম মনে ছিলো না আমার,ভোরবেলার সময় একটু ঘুমাতে এসেছি
আর এখন এত দেরি হয়ে গেলো,ইস!
.
আরে টেনসন নিও না,উনারা এগারোটার দিকে আসবেন,
আচ্ছা একটা কথা বলোতো,,ভাইয়ারা কেউ বাগানে করা ডেকোরেশনে হাত লাগাচ্ছে না কেন?
.
ওমা!উনারা হলেন নবাবজাদা! উনারা সবাই এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন,আলাদা ম্যানেজার রেখেছে সব দেখাশুনা করার খাতিরে
.
এটা তো ঠিক না,নিজের বোনের বিয়ের আয়োজন নিজের হাতে করলে আলাদা শান্তি পাওয়া যায়
.
তা এদের কে বুঝাবে?
.
ভাইয়ারা না যাক,মিঃ নীলকে আমি দরকার হলে পিটিয়ে পাঠাবো
.
হাসালে মুন!!!নীল ভাইয়া তো এক নাম্বারের ঘাড়ত্যাড়া
.,
আমি তার চেয়েও বেশি ত্যাড়া,তুমি শাড়ীটা পরে নাও আমি একটু আসছি
.
মুন সোজা বাথরুমে গিয়ে এক বালতি পানি ভর্তি করলো,তারপর পা টিপে টিপে নীলের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো
চলবে♥