স্মৃতির দেয়াল পর্ব-৩৮

0
2076

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৩৮
Writer -Afnan Lara
.
জানো কাল রাতে চোখের পাতা এক করতে আমার বারোটা তেরোটা বেজে গিয়েছিলো
.
এত প্রেম!
.
তোমার কি মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি?
.
মনে তো হয়!আচ্ছা একটা কথার উত্তর দিন তাহলে বলা যাবে আপনি আমার প্রেমে পড়ছেন নাকি এখনও কাঠখড় পোড়াতে হবে
.
ফাইন,,করো প্রশ্ন
.
একবারও হিয়াকে ফোন করেছিলেন?
.
নাহ
.
সত্যি?
.
হ্যাঁ
.
তাহলে ঠিক আছে,,মানা যায়,
.
তুমি কবে হিয়ার ভূত মাথা থেকে নামাবে?
.
আজ থেকে,,চলুন না কোথাও ঘুরতে যাই
.
সরকারি চাকুরীগত মানুষদের থেকে হুটহাট ঘুরাফিরা আশা করা বোকামি,আমার ছুটি নিতে হবে
.
এখন তো আপনার ডিউটি নাই,এখন তো আমরা ঘুরতে যেতে পারি তাই না?
.
বিকালের পরেও ডিউটি আছে
.
সন্ধার পরে তো আর নেই,চলুন না ঘুরে আসি
.
আচ্ছা রেডি হয়ে থেকো!
.
মুনকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নীল চলে গেলো অফিসে
মুন নীলের রুমে এসে হাতের ফোনটা রেখে মায়ের কাছে গেলো দেখা করতে,,সবাই যে যার রুমে
আর কয়েকদিন বাদেই নিপার বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে
এখন আপাতত সবাই রেস্ট নিচ্ছে,এই পরিবারের একটা দিক মুনতাহা খেয়াল করেছে আর তা হলো ওরা যেদিন কাজ ঠিক সেদিনই কাজটা দম লাগিয়ে করে,তার আগের দিন থেকে কেনো এরেঞ্জমেন্ট করে না
আলমারি খুলে একটা কালো জর্জেটের শাড়ী বের করলো মুন,আজ মন খুলে নীলের সাথে কথা বলবে সে
নীল যে মাথায় এখন তাকে ছাড়া হিয়াকে আনে না তা বোঝা হয়ে গেছে
আমার একার সাধ্য ছিল না নীলের মন থেকে হিয়াকে রিমোভ করার,নীল নিজ থেকেই হিয়াকে ভুলতে চেয়েছে বলে এখন চোখে মুখে মুনকেই দেখতে পাচ্ছে,ও যদি না চাইতো তাহলে এটা সম্ভব হতো না
যাই হোক,কম কষ্ট করিনি আমি এই পর্যন্ত,হিয়াকে থ্যাংকস জানানো জরুরি কারন সেও সাকিবের সাথে মোভ অন করেছে,ওরা দুজন যদি ওদের ভালোবাসা নিয়ে অটল থাকতো তাহলে এ জীবনে আর আমার নীলকে বোঝানো হতো না,কিংবা সাকিব ও হিয়াকে বোঝাতে পারতো না
.
কানে দুল পরাকালীন মুন কি যেন ভেবে দুলটা রেখে একটা বড় দুল পরলো,,বড় দুলে নাকি ওকে ভাল্লাগে
কথাটা ওর বাবা বলেছিলো একদিন
গলায় একটা হালকা পাতলা নেকলেস পরলো মুন
ব্যস,আর সাজতে হবে না,কালো শাড়ীতে এমনিতেই সুন্দর লাগে,ভারী মেকআপের দরকার নেই
আর আমি যতদূর জানি, নীল সাদামাটা পছন্দ করে,বেশি বেশি কিছুই তার পছন্দ না
.
প্রচুর এক্সাইটেড হয়ে মুন বাগানে পায়চারি করছে নীলের অপেক্ষায়,নীল যে কখন আসবে,,সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনও তার দেখা নেই
বাধ্য হয়ে মুন নীলকে একটা ফোন করলো,নীল ধরছে না,নিশ্চয় ড্রাইভ করছে,যাক তাহলে পথেই আছে
মুন একটু এগিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো,দশ পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে এখনও নীল আসছে না দেখে বাগানে থাকা একটা চেয়ারে বসলো মুন,,রাতের ঠাণ্ডা পরিবেশ মনটাকে আরও ভালো করে দিচ্ছে তার সাথে ঘুরতে যাওয়ার ভালোলাগা মনে করতেই বেশ লাগছে
আবার নীল আসতে দেরি করছে বলে সব শেষে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার
ফোন চেক করে মুন হতাশ হয়ে গেলো,সাড়ে আটটা বাজে অথচ নীল এখনও আসছে না
ঠিক করলো নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে
হাজার হাজার মশা,কত গুলো মশার কামড় উপেক্ষা করে মুন নয়টা পর্যন্ত বসে ছিলো বাগানে,শেষে এক রাশ বিষন্নতা নিয়ে রুমে ফিরে আসলো সে
গায়ের সে সাজ বদলালো না,নীলের প্রতি ক্ষোভ তাকে কষ্ট দিচ্ছে
আজ আমার জায়গায় হিয়া হলে বুঝি নীল তার কাজের বাহানা দেখাতো?
আমি মুন বলে এমনটা করলো?আমি কিছু বলি না বলে আমাকে আরেকদিন ও নিয়ে যেতে পারবে এই ভেবে তিনি আজ আমার মন ভেঙ্গে দিলেন?
এমনটা না করলেও পারতেন
উনি আমাকে না বাসুক,আমি তো বেসেছি,আমার অনূভুতিকে এভাবে ছোট করে না দেখলেও হতো
আমার চেয়ে কাজ বেশি হয়ে গেলো?কত আবেগ দিয়ে আজ আমি রেডি হয়ে ছিলাম,ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান শেষ মূহুর্তে ক্যানসেল করলে তা একদমই মানা যায় না
.
মুনতাহা মন খারাপ করে বসে থাকলো বারান্দায়,নীল আসতেছে দেখলে নিপার রুমে গিয়ে থাকবে,আজ আর নীলের সাথে ঘুমাবে না সে
রাত দশটার দিকে নীলকে দেখতে পেলো মুন,সবে জিপ নিয়ে ঢুকছে সে
ক্রোধ নিয়ে মুন ছুটলো নিপার রুমের দিকে,নিপা ফোনে কথা বলছিলো তখন,,মুনকে দেখে বললো”আরে মুন,,এসেছো কখন?”
.
আমি তো বিকালেই এসেছিলাম
.
সেটা তো জানি,কিন্তু তুমি আর ভাইয়া তো আজ সামিরদের বাসায় গিয়েছিলে সন্ধ্যায় তাই না?
.
কি?কে বললো, আমি তো জানি না,
.
সামিরের বড় বোনের ছেলের আজ বার্থডে ছিলো,,হালকা পাতলা অনুষ্ঠান হওয়ায় আমাদের দাওয়াত করেনি,তবে সামিরের বড় বোন নীল ভাইয়ার ছোটকালের স্কুল ফ্রেন্ড বলে ওকে আর তোমাকে নাকি ইনবাইট করেছিলো
বার্থডেটা তো সামিরদের বাসায় হয়েছিলো,তোমাকে নেয়নি কেন ভাইয়া?
.
মুন কিছুটা পিছিয়ে গেলো,,চোখের এক ফোটা অশ্রু মুছে পিছন ফিরে ছুটলো সে নীলের কাছে
আজ নীলকে সে অনেক প্রশ্ন করবে
নীল তখন রুমে এসে গায়ের থেকে পুলিশি পোশাক খুলছিলো
মুন দরজা ঠেলে ভেতরে ডুকে নীলের সামনে এসে দাঁড়ালো
নীল অসহায় লুক নিয়ে বললো”সরি তাহা,কাজের ফাঁক করতে পারলাম না,এত কাজ ছিলো কি বলবো”
.
কাজের ফাঁক করতে পারলেন না তাই না!এত কাজ ছিলো
.
হুম
.
হিয়ার সাথে আজ সাকিব ছিলো না তো?মনে হয় ছিলো না
কারণ নাহলে এতক্ষণ লাগতো না
.
কি বলতে চাচ্ছো
.
সামিরের বোনের ছেলের বার্থডে তে গিয়েছিলেন তাই না?সামিরদের বাসার আরেক ফ্ল্যাটেই তো হিয়া থাকে,নিশ্চয় ওর সাথেও দেখে করেছেন তা নাহলে এত সময় কেন লাগলো
আর আপনার কাছে তো হিয়া অনেক অনেক অনেক বেশি ইম্পরটেন্ট
.
এসব কি বলতেছো
.
আমি ঠিক বলছি,,আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন বলে আপনি হিয়ার কাছে গিয়েছিলেন মজা করতে??
.
জাস্ট শাট আপ তাহা!উল্টা পাল্টা কথা বলবে না
সামির আমাকে আর তোমাকে ইনবাইট করেছিলো ঠিক তবে আমি ওখানে যাইনি,আজ আমার মিটিং ছিলো অফিসে,হিয়ার বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা আমি এক গ্লাস পানি খাওয়ার ও সময় পাইনি
.
মিথ্যা কথা বলবেন না আপনি,আপনার যখন মিটিং ছিলো তো আর আমাকে আশা কেন দিলেন যে সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন?
তাহলে তো আর আমি এত আশা নিয়ে বসে থাকতাম না,আমার মনে হয় আমি একটা বাধ্যতামূলক সম্পর্কে জড়িয়ে আছি
যেটার কেনো নাম নাই
আপনার পরিবার ছাড়া আমাকে কেউ সম্মান করে না
আপনি নিজেও করেন না
বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত শুধু হিয়া আর হিয়া
আমার অসহ্য হয়ে গেছে সবটা,আমি আর থাকতে পারবো না আপনার সাথে
আমি যাচ্ছি!
.
মুন হাতের অপর পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো

মেয়েটা সবসময় আমাকে ভুল বুঝেছে,একটিবার আমাকে হিয়ার নাম ছাড়া বুঝতে শেখেনি,,
আমি হিয়াকে ভুলে তাকে নিয়ে ভাবছি তা এখন সে বিশ্বাস করছে না,অবশ্য করবেই বা কি করে
আজ এতটাদিন ধরে আমি হিয়াকে ছাড়া আর কিছুকে ইম্পরটেন্স দিই নাই
কোনোদিন ওকে ভালোবেসে ছুঁই নাই,ওকে বুঝাই নাই ওকে আমি পছন্দ করি কিংবা স্ত্রী হিসেবে মানি
ওর রাগটা শ্রেয়!তবে আমার উচিত ওকে নিয়ে আসা
শেষ সময়ে মিটিং পড়ে যাবে আমি আসলেই জানতাম না
জানলে ওকে কথা দিতাম না,মিটিংয়ের ফাঁকে ওকে ফোন দেওয়ার ও সময় পাইনি
.
ফাঁকা রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীল মুনের কথা ভাবছে,মুনদের বাসায় যাচ্ছে সে এখন
বাসার কাছে এসে দরজায় নক করার আগেই সে শুনতে পেলো চেঁচামেচি
মুনের সৎ মায়ের
উনি মুনকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন,টপিকটা হলো নীলকে ঘিরে
উনি বলছেন”তাই তো বলি মা হারা মেয়ের কপালে হঠাৎ এত সুখ আসলো কই থেকে,আমি তো ভুল ভাবলাম,কিসের সুখ
এ দেখি কেয়ামতের এক ঝলক!
নিজের জামাই তার পুরান প্রেমিকার প্রেমে এখনও ডুব দিয়া আছে
ওরে শুনে যাও কেউ,এমনটাই হওয়া উচিত ছিলো,আমি খুব খুশি হইছি
তোর মতন মেয়ে আমারে যে কষ্ট দিছস,জেলের ভাত খাওয়াইছোস এবার বোঝ
তোর বাবাকে বললি সব কথা,ভাবলি আমি শুনবো না?
আমি তো শুনে ফেললাম
কারোরে কষ্ট দিয়া কে কখনও সুখী হতে পারে না
জামাইর সুখ হলো বড় জিনিস,আর সেটা তুই পাস নাই
তোর তো এমন পোড়া কপাল,জন্মের পরেই মারে খাইছোস
আবার বিয়ের দিন জানতে পারছোস তোর জামাই তোরে কোনোদিন ধরেও দেখবে না,অবশ্য তোর তো রুপের ঠেলাও নাই, গুন ও নাই,ধরে দেখার কথাই আসে না
একদম ভালা হইছে,আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ২০০বার পড়বো আজকের রাতে
.
নীল গেটের সাথের ওয়ালে হেলান দিয়ে সবটা শুনছে
দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই সে একটু সরে দাঁড়ালো
মুন চোখ মুছতে মুছতে অন্ধকারের মাঝে ছুটেছে
নীল অপেক্ষা না করে ওকে আটকাতে ওর পিছু নিলো
দূরের সেই পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে এসে মুন বসলো,আশেপাশের বাড়ির আলোয় পুকুরঘাটটা মোটামুটি স্পষ্ট
মুম চিৎকার করে কাঁদছে,কারণ সে জানে এখন তার কান্না কেউ শুনবে না
চিৎকার করে সে বলছে তার সাথেই কেন এমনটা হতে গেলো
কিছু কিছু মানুষ ছুরি দিয়ে আঘাত না করে মুখ দিয়ে আঘাত করে,তাদের কথার ধার ছুরির চেয়েও কড়া
আজ মায়ের কথা গুলো তাকে অনেকটা কষ্ট দিয়েছে
তবে সেগুলো সত্য ছিলো
সব আমার কপালের দোষ
তা নাহলে আমি মাকে হারালাম কেন,মাকে বাঁচিয়ে রাখা তো আমাদের সৌভাগ্য
আর আমি হলাম দূর্ভাগ্যবতী,আর তাই তো মাকে ধরে রাখতে পারলাম না
.
তাহা!
.
নীলের গলা শুনে মুন চমকে গিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো
হালকা আলোয় দেখে বুঝতে পারলো ওটা নীল
মুন কিছুই বললো না
উঁচু করে বানানো সিঁড়িটায় বসলো সে
নীল ওর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে ওর হাতদুটো ধরলো
মুন শান্ত গলায় বললো”কি চান আপনি?”
.
তোমাকে
.
আর কত কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হবে বলবেন?আমার দোষ ছিলো সেদিন আপনাকে বিয়ে করা?তুষারকে বিয়ে করলে হয়ত আজ এই দিন আসতো না
.
আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
.
কতবার?
.
আজকে শেষবার,আমাকে সুযোগ দাও তোমাকে ভালোবাসার,কথা দিচ্ছি এই ভালোবাসায় কোনো কমতি রইবে না
.
মুন কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নীল উঠে মুনকে বুকে টেনে নিলো,ওর গলার কাছে মুখটা গুজে নিয়ে বললো”আই এম সরি,আমার কারনে আজকে তোমাকে এতগুলো কথা শুনতে হলো,তুমি আর কখনও এই বাসায় পা রাখবে না ”
.
রাখতাম না,এই বাসায় আমার বাবা আছে বলেই বারবার আসি নাহলে সেই কবেই এই বাড়ি ছেড়ে দিতাম
.
নীল মুনকে আরেকটু শক্ত করে ধরলো
মুনের শরীর কাঁপছে,,নীলের ছোঁয়া তাকে সবটা ভুলিয়ে দিচ্ছে
রাগ অভিমান কিছুকেই ঠাঁই দিচ্ছে না
নীল মুনকে ছেড়ে ওর হাত মুঠো করে ধরে বললো”চলো ঘুরতে যাব,কালকে আমার ছুটি,কাল সারাটা দিন তোমাকে দিলাম”
.
হাঁটতে হাঁটতে মুন খেয়াল করলো নীলদের বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে
মুন নীলের দিকে চেয়ে বললো”আপনাদের বাসায় যাবেন না?”
.
অন্য কোথাও যাব,যেখানে কেনে থার্ড পারসন থাকবে না,কোনো স্মৃতির দেয়াল থাকবে না
চলবে♥