সৎ বাবা পর্ব-০১

0
521

#সৎ_বাবা। (প্রথম পর্ব)

এক ভর দুপুরে দরজা বন্ধ করে মা যখন নীচু স্বরে বললো “তোমার খালেক চাচাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। সিদ্ধান্তটা অবশ‍্য আমার একার নয়, তোমার নানুর বাড়ির সবাই চাইছেন আমি যেন বিয়ে করে তুমি সহ আলাদা সংসার শুরু করি। তোমার খালেক চাচাও তোমাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকদিন ধরে চিনি বলে, কথাটাতে আমার বিশ্বাস আছে। পারলে এখন থেকে তাকে বাবা বলে ডেকো।” মায়ের মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনার জন‍্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

খালেক লোকটাকে মা বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনেই গায়ে বমি বমি ভাব চলে এলো। এতো বিশ্রী একটা লোক, মা বিয়ে করলেও ডাকাত ডাকাত টাইপের এই লোকটাকে কিন্তু আমি কখনোই বাবা বলে ডাকতে পারবো না।
তাইতো মায়ের বলা কথায় উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে চুপ করে রইলাম।

মায়ের মুখেও এখন রা নেই, হয়তো অস্বস্তি নিয়েই চৌদ্দ বছরের কন‍্যাকে অপ্রিয় এ কথাগুলো বলতে এক প্রকার বাধ‍্য হয়েছেন। আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম, এরপর আমার চোখ থেকে টুপ করে ঝরে পড়া এক ফোটা কান্না মায়ের হাতে গিয়ে পড়তেই মা মেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। তিন বছর আগে হঠাৎ করে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা মা মেয়ে যে সত‍্যই অসহায়। প্রকৃতি আমাদেরকে নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলছে।

আমার বাবা আসাদুজ্জামান আর মা সাবিহা জামান দুজনেই ব‍্যাংকার। ব‍্যস্ত এই ব‍্যাংকার দম্পতির একমাত্র মেয়ে এই আমি ছিলাম বাবার এক রাজকন‍্যা। আমার বাবার জীবন জুড়ে যেন শুধুই কন‍্যা ময়। ক‍্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কঠিন সময়েও বাবা আমাকে আগলে ধরে রেখেছেন। এক সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে বাবার করুন আকুতি “ডাক্তার সাহেব, অন্ততপক্ষে আমার মেয়ের কথা চিন্তা করে হলেও আমার জীবন বাঁচান। অর্ষার জন‍্য হলেও আমি আরো কিছুদিন বাঁচতে চাই।”

প্রকৃতি মনে হয় মাঝে মধ‍্যে সত‍্যই ভীষণ নির্দয়। সেই কান্নাটার ঠিক তিন সপ্তাহ পর আমার ভীষণ ভালো বাবা মারা গেলেন। আমার মা অফশ‍্য চিকিৎসার শেষ চেষ্টাটুকু করেছিলেন, পড়নে এক রত্তি সোনাও রাখেননি। পরিচিতদের কাছে ধার বা চেয়ে স্বামীকে যথাসম্ভব চিকিৎসা করিয়েও শেষ পযর্ন্ত বাঁচাতে পারেননি।

বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স মাত্র এগারো হলেও ততোদিনে আমি যেন অনেক পরিনত এক মেয়ে। ক‍্যান্সার থার্ড স্টেজে কনফার্মেশনের পর বাবা কিন্তু চার মাসেরও কম বেঁচে ছিলেন। বাবার অসুস্থতার সেই চার মাসে আমার বয়স বেড়ে হয়ে গেল যেন চব্বিশ। আমাকে কেউ বলেনি তারপরও বুঝতাম আমার বাবা শীঘ্রই মারা যাচ্ছেন। তাইতো প্রতি মুহূর্ত বাবার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি। আমি ভীষণ ভাগ‍্যবান, বাবার শেষ নিঃশ্বাসের সময় বাবা কিন্তু আমারর হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। হাতটা ছেড়ে দিতেই বুঝেছিলাম, বাবা আর পৃথিবীতে নেই।

বাবাকে হারিয়ে আমার চাইতেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন আমার মা, এটা আমি বেশ বুঝি। আমার বাবা আর মায়ের মধ‍্যে থাকা ভীষণ ভালোবাসাটা বাবার অসুস্থতার সময়ই উপলব্ধি করেছি। মা অসুস্থ বাবাকে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়েছেন, এক মুহূর্তের জন‍্য বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া। পরম মমতা নিয়ে মা বাবাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, এ দৃশ্য আমার আজীবন মনে থাকবে। বাবার মৃত‍‍্যুর দিন দুয়েক আগে, এক গভীর রাতে মায়ের কান্নায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মায়ের ঘরে উকি মেরে দেখি, শীর্ণকায় বাবাকে কোলে নিয়ে আমার অসহায় মায়ের জোর কান্না। বাবার অবশ‍্য তখন স্বান্তনা দেওয়ার শক্তিটুকুও অবশেষ নেই। ফ‍্যালফ‍্যাল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দূর থেকে শুধু দেখেই গেলাম, মনমনে সৃষ্টি র্কার কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে বাবার জীবন ভিক্ষা চাইলাম।

বাবা মারা যাওয়ার পরের মাসেই তাজমহল রোডের আমাদের বাসাটা ছেড়ে দিতে হলো, মূলত মা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কাজি পাড়ায় নানার বাড়িতে এক প্রকার বাধ‍্য হয়েই আমাদের উঠতে হলো, মামাদের অনিচ্ছাসত্বে। আমার নানা জীবিত না থাকলেও জীবিত নানী আমাদের পক্ষ নিলেন। আর এরপর নানীর রুমের এক কোনায় মাটিতে আমাদের মা মেয়ের জন‍্য আরেকটা বিছানার ব‍্যবস্হা হলো। আমরা অবশ‍্য তাতেই খুশি, সদ‍্যই তাজমহল রোডের বাসাতে এগারো বছরের মেয়ের উপর বাসার সিড়িতে বাড়িওলার ছেলের জড়িয়ে ধরা, মা কিছুতেই মেনে নেয়নি। থানা পুলিশ পযর্ন্ত গড়িয়ে ঐ বাসা মা তিন ঘন্টার নোটিশে ছেড়েও আসেন। আমি অবশ‍্য ঐ ঘটনায় মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত ছিলাম। ট্রমাটাইজড। সবাই আরো বড় কিছু ক্ষতি হওয়ার আগেই বাসাটা ছাড়ার পরামর্শ দেয়। মা ও সময় নেননি।

কাজি পাড়ায় নানার বাড়িতে এসে শুরু হলো আরেক উৎপাত। ফ‍্যামিলি পলিটিকস আর আমাদেরকে অপমান সইতে হলো প্রতি পদে পদে। আমার নানা নিজেও ব‍্যাংকে চাকুরী করতেন, কাজিপাড়ায় চার তলা একটা বাড়ি রেখে গেলেও দুটো ছেলেকে মানুষ করতে পারেন নি। আমার দুই মামাই বলতে গেলে বেকার, বাড়ি ভাড়ার টাকায় চলেন। দুই মামাই মাশাল্লাহ্ বিয়ে করে দুজন দাজ্জাল এই বাসায় এনেছেন। দুই মামী, মামা আর নানী- এদের মধ‍্যে সারাক্ষণই ঝামেলা চলছে। আমার মা নেহায়েতই ভাইবোনদের মধ‍্যে সবার বড় বলে, এ বাসায় আমাকে নিয়ে কোনভাবে টিকে থাকতে পারছে। মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ব‍্যাংকে উচুঁ পদে আছেন, তারপরও পরিস্থিতির কারণে ছোট ভাই ও তাদের বউকে সমঝে চলেন। আমাদের মা মেয়েকে কতোবার যে এ বাসা থেকে বের করার এটেম্পট নেওয়া হয়েছিল তার কোন হিসাব নেই। প্রতিবারই নানী আমাদের পক্ষ নিয়েছেন, আর এ বাড়িটা নানীর নামে দলিল বলে তার কথাই চুড়ান্ত।

এবার আজকের গল্পের মূল চরিত্র খালেক সাহেবের কথা বলবো। এই গল্পে কিভাবে তার আগমন। আমার মায়ের সাথেই বা কিভাবে তার বিয়ের প্রস্তাব। আমি তাকে কতোদিন ধরে চিনি? আমার তার সম্পর্কে কি এসেসমেন্ট! বলছি।

খালেক সাহেব আমার বাবার বন্ধু। বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের রুমমেট ও সহপাঠী, এখন সরকারি উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা। ভদ্রলোক অনেক বছর আগে বিপত্নীক, নিঃসন্তান। বউ মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আজিমপুর কলোনিতে থাকেন। বাবার অসুস্থতার সময় আমাদের পরিবারের সাথে প্রথম থেকেই ছিলেন। এমনকি বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক অর্থ সাহায্যও সংগ্রহ করেছিলেন। মা ও আমার প্রতি তখন থেকেই সম্ভবত খালেক সাহেবের দূর্বলতার শুরু। বাবার মৃত্যুর সময়টাতে, লাশ দাফন কাফন সবকিছুর সময় এই খালেক চাচার ভূমিকা অগ্রগন‍্য। এমনকি বাবার মৃত্যুর পর একে একে সবাই যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়, খালেক চাচা কিন্তু ঠিকই আমাদের নিয়মিত খোঁজ নেন। এমনকি বাড়িওয়ালার ছেলের যৌন হয়রানির বিষয়টিতে থানা পুলিশে মাকে খালেক চাচাই সহায়তা করেছিলেন।

কোন এক অজানা কারণে প্রথম থেকেই এই খালেক চাচাকে আমার ভীষণ অপছন্দ। লোকটির আমাকে জড়িয়ে ধরে করা আদর, কিংবা তার দেওয়া চাহনী কিছুই আমার পছন্দের নয়। আরেকটা কারণ হতে পারে তার গায়ের রং আর চেহারা। কুচকুচে কালো গায়ের রং আর টেকো মাথায় তার দেওয়া অট্রহাসি আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। আমার অবচেতন মন সবসময়ই জানতো খালেক চাচা একদিন আমাদের জন‍্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে আসবে।

সরকারি বড় জীপে উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তা খালেক সাহেবের এই বাসায় আগমন, সাথে নানাবিধ ফলমূল ও উপহার। আমার দুই মামা বা তাদের বউরা কখনো আপত্তি দেয়নি। আমার নানীও খালেক চাচাকে অনেক আদর যত্ন করতেন। আমি দূর থেকে আস্তে আস্তে আমার মায়ের মধ‍্যেও পরিবর্তন দেখতে লাগলাম। মা এখন খালেক চাচার সাথে কথায় কথায় হাসে, কথাবার্তাতেও ভীষণ আস্কারা।

শুধুমাত্র চৌদ্দ বছরের এই আমি খালেক সাহেবকে মেনে নিতে পারিনি, সম্ভবত কখনোই পারবো না। আমি যে প্রথম থেকেই জানতাম, খালেক সাহেব আমাদের পরিবারের জন‍্য কতোটা ক্ষতিকর। আজ মা এই লোকটাকে বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আমার সে ধারনাটাকেই সত‍্য বলে প্রমাণ করলেন। বাবার মৃত্যুর পর সবচাইতে বড় কষ্টটা আজই পাওয়া। তাইতো বাথরুমের শাওয়ার জোরে ছেড়ে দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাম “বাবা, কেনো তুমি হঠাৎ করে এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলে? কেন? কেন?”

(চলবে।)