হলুদ বসন্ত পর্ব-০৫

0
449

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৫
#Eshika_Khanom

আয়াতের বাবা একদৃষ্টে আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হাঁসফাঁস শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আয়াত উঠে বসে বাবার গাল ধরে বলল,
“বাবা কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন??”

তবে বিনিময়ে আর উত্তর পেল না আয়াত। পাবেই বা কিভাবে? তার বাবা কি কথা বলতে পারে? আয়াতের বাবা শুধু নিজের মেয়ের দিকে করুণ চাহুনিতে তাকিয়ে রইল। আয়াতের বুকে তীরের মতো বিঁধলো বাবার সেই করুণ দৃষ্টি। নিজের মুখটাকে সরিয়ে নিল সে। আদ্রাফ আয়াতের বাবার সামনে আসলো। তারপর বলল,
“আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি?”

ভিতরে ভিতরে অবাক হয়ে গেলেন আয়াতের বাবা। আদ্রাফ বলল,
“শুধু মাথা নাড়িয়ে বোঝালেই হবে।”

আয়াতের বাবা না করেননি, মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিয়েছেন আদ্রাফকে। আদ্রাফ আয়াতের বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
” বাবা আমি এটা বুঝতে পারছি আপনি জানেন আমি এইডস আক্রান্ত। ”

আয়াত অবাক চোখে তাকায় বাবার দিকে। সে জানতে দিতে চায়নি তার বাবাকে এই বিষয়টি।
আদ্রাফ বলে,
“বাবা আপনার মেয়ের আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ। আপনার মেয়েকে আমি কোনোদিন স্পর্শ করব না।”

কথাটা শোনামাত্রই আয়াত মাথা নিচু করে ফেলল। আয়াতের বাবাও মাথা নিচু করে ফেললো। আদ্রাফ বলল,
“আমি জানি আমার আপনার মেয়েকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। কিন্তু আপনার মেয়ের সকল স্বপ্ন পূরণ যে এখানে থেকে হতো না বাবা।”

আয়াতের বাবার চোখ ভিজে আসতে থাকে। আদ্রাফ আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে ,
“আমি আয়াতের বন্ধু হয়ে শেষ সময়টুকু বাঁচতে চাই বাবা।”

আয়াতের চোখের কোণে অশ্রু জমতে থাকলো। কি কারণে তারা চোখেতে জমা হচ্ছে তা জানা নেই আয়াতের। নিজের অনুভূতিগুলোকে আটকাতে পারছে না আয়াত। দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। আদ্রাফ আর আয়াতের বাবা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। আয়াত দৌড়ে নিজের রুমে চলে গিয়ে নিজেকে রুমে বন্দী করে নেয়। রাহেলা রান্না করার সময় এই দৃশ্য দেখতে পায়। টুম্পাকে প্রশ্ন করে,
“কিরে টুম্পা এর আবার কি হলো?”
টুম্পা শিলনড়া চালাতে চালাতে বলে,
“কি জানি খালা।”

রাহেলা পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। অপরদিকে ঘরবন্দী আয়াতের অশ্রু যেন কোনো বাঁধা মানছে না। আয়াত কেন এতো কাঁদছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আদ্রাফের কথা শুনে কি সে এতো কাঁদছে? কেনই বা কাঁদছে? উত্তর খুঁজে পায়না আয়াত। কেঁদে কেঁদেই নিজেকে শান্ত করতে থাকে সে। আদ্রাফ আয়াতের রুমের বাহিরে থেকেই আয়াতের কান্না শুনতে পারছিল। একবার ধাক্কা দিতে যায় আদ্রাফ, দিতে যেয়েও দেয়না। অদৃশ্য এক বাঁধা আকঁড়ে ধরে যেন তাকে। মন বলতে থাকে,
“থাকুক আয়াত, কাঁদুক নিজের মতো। তারও আদ্রাফের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ভালোবাসা বুঝতে হবে। বুঝতে হবে তার বসন্তের বায়ুর মতো স্নিগ্ধ প্রেমকে।”
.
.
.
“হঠাৎ এতো চুপচাপ কেন তুমি?” আয়াতকে প্রশ্ন করল আদ্রাফ। আয়াত কিছু বলল না। আদ্রাফ প্রশ্ন করল,
“আমি কি ভুল কিছু করেছি আয়াত?”

আয়াত আদ্রাফের কথার উত্তর না দিয়েই প্রশ্ন করল,
“আপনি কি সত্যিই এইডস আক্রান্ত আদ্রাফ?”

আদ্রাফ হাসলো। প্রশ্ন করল, “কেন?”
“বলুননা প্লিজ।”

“তুমি তো জানোই আমি আক্রান্ত এই রোগে। এখনো হয়তো রোগটা আমায় তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরছে না। তবে জানো আয়াত আমার মনে হয় আমার হায়াত আর কয়েক মাস।”

কথাটা শুনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আয়াত। আজ সে কেন আদ্রাফকে নিয়ে এতো কষ্ট পাচ্ছে সে জানেনা। আয়াত প্রশ্ন করল,
“এই রোগের কি কোনো প্রতিকার নেই?”

আদ্রাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ!”

আয়াতের কান্নার বেগ বেড়ে গেল। আদ্রাফ ড্রাইভারকে গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করতে বলল। গাড়ি থামার পর আদ্রাফ দরজা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর আয়াতের পাশের দরজা খুলে আয়াতকে বলল,
“বের হও গাড়ি থেকে।”

আয়াত প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ বলল,
“নামো আয়াত!”

নেমে গেল আয়াত গাড়ি থেকে। আদ্রাফ আয়াতের দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে বলল,
“তোমার হাতটা ধরতে পারি?”

আয়াত কিছু না ভেবেই নিঃশব্দে হাত রাখলো আদ্রাফের হাতের উপর। আদ্রাফ শক্ত করে আয়াতের হাত ধরল, এমনভাবে যেন হাতটা ছাড়লেই আয়াত ছুটে পালিয়ে যাবে। তারপর বলল,
“চলো আয়াত।”

আয়াতের উত্তর আশা না করেই আদ্রাফ আয়াতকে নিয়ে হাঁটতে থাকল। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটি চায়ের দোকানের সামনে এসে পৌছলো। আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“চা খাবে?”

আয়াত বলল, “মন্দ হবেনা বোধহয়।”

আদ্রাফ আয়াতকে দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চিতে বসতে বলে দোকানদারের কাছে গিয়ে দুই কাপ দুধচা বানাতে বলল। তারপর আবার আয়াতের পাশে এসে বসল। প্রশ্ন করল,
“আজ ক্ষণে ক্ষণে এতো কাঁদছে কেন আয়াত?”

আয়াত চোখ মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“প্রশ্নটা কি আমায় করলেন?”

“যাকে করেছি, সে নিশ্চিত ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে।”

“উফফ, আপনি সোজাভাবে কথা বলতে পারেন না।”

“কি করব? বউটাই আমার একটু বাঁকা।”

“কি আমি বাঁকা?”

“তুমি কি নিজেকে আমার বউ মনে কর?”

আয়াত কতক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আবার বলল,”হুম”

আদ্রাফ অবাক হলো তবে প্রকাশ করল না। আয়াতকে প্রশ্ন করল, “কি হুম?”

“যেটা প্রশ্ন করলেন?”

“উত্তরটা দিতে এতো সময় লাগলো কেন?”

“নিজেকে মন প্রশ্ন করছিলাম।”

আদ্রাফ তখন আয়াতের দিকে একটু ঝুকে বলল,
“তবে মন কি শুধুই হুম উত্তর দিল?”

“না অনেক কিছুই উত্তর দিয়েছে।”

আদ্রাফ সোজা হয়ে ঠিকঠাকমতো বসে অতি উৎসুক ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল,
“তবে বল বল কি উত্তর দিয়েছে আমার বউয়ের মন?”

আয়াত হাসিমুখে বলল, “বলব না।”

আদ্রাফ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল, “কেন বলবে না?”

আয়াত উত্তর দিল, “আমার ইচ্ছে জনাব।”

কিছু সময় অতিবাহিত হল। দুইজনেই সেই সময়টুকু চুপ ছিল। আদ্রাফ পুনরায় বলতে শুরু করল,
“আয়াত আমাকে ভালোবাসো?”

আয়াত তটজলদি উত্তর দিল, “জানিনা।”

“কেন?”

“আদ্রাফ আমার আপনার প্রতি এক মায়া কাজ করা শুরু করেছে। তবে সেটা ভালোবাসা নাকি আমি জানিনা।”

আদ্রাফ বলল, “আমায় ভালোবেসো না আয়াত।”

অবাক হল আয়াত আদ্রাফের কথা শুনে। বলল,
“ভালোবাসা তো পাপ নয়। তবে আমি আপনাকে ভালোবাসবো না কেন?”

“কারণ ভালোবাসার মানুষটা তো আর বেশিদিন তোমার পাশে থাকবে না।”

“মন থেকে তো পাশে থাকবে।”

আদ্রাফ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল আয়াতের দিকে। আয়াত মিষ্টি হেসে বলল,
“বাসায় চলুন।”

এটা বলে আদ্রাফের অপেক্ষা না করেই সে উঠে গেল। আদ্রাফ বিল মিটিয়ে নিতে গেলে দোকানদার প্রশ্ন করল,
“চা খাবেননা?”

“না থাক।”

এটা বলেই আদ্রাফও চলে গেল সেখানে থেকে এবিং গাড়িতে উঠে পড়ল।
.
.
.

“দাদী কই তুমি?” বাড়িতে ঢুকেই দাদীকে খুজতে থাকল আয়াত। সবাই খুব অবাক হলো। আয়াত তো সহজে নিজের মুখটাই খুলতো না। এমন ভাব ছিল তার যেন সব বিষন্নতা তার উপর ভর করেছে। তবে হঠাৎ করে কিভাবে যেন খুব প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে সে। হঠাৎ এতো পরিবর্তন! আয়াত ডাকতেই থাকলো দাদীকে। দাদী এসে বললেন,
“কিরে আমার সতীন ডাকিস কেন?”

আয়াত দৌড়ে এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরল। আর বলল,
“তোমায় খুব মিস করেছি দাদী।”

“তাই নাকি রে?”

“হুম।”

“আদ্রাফ তোকে বকেনি তো?”

আদ্রাফ মাঝ দিয়ে বলল, “ওমা আমি আবার ওকে বকব কেন?”

দাদী বললেন, “তোকে বিশ্বাস নেই।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আয়াত। আদ্রাফ করুণ স্বরে বলল,
“সতীনকে পেয়ে আমায় ভুলে গেলে?”

“তোকে আমার আবার কবে মনে ছিল রে?”

আদ্রাফ কান্না কান্না স্বরে বলল,
“এই ছিল তোমার মনে?”

আয়াত বলল, “আপনি একটা ছিঁচকাদুনে।”

পিছন থেকে একজন বলল,
“কিরে আদ্রাফ? তুই না বললি তুই বাহিরে যাবি?”

আদ্রাফ পিছনে ঘুরে দেখলো নুহাশ এসেছে। অপরদিকে নুহাশের চোখ পড়লো এক রমণীর উপর। পলক আটকে গেল তার। আদ্রাফ দৌড়ে নুহাশের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আদ্রাফ একসময়ের জন্যে ভুলেই গেল তার সকল জড়তা। নিজের অজান্তেই তার জড়তা আবার কাটিয়ে ফেললো। জিজ্ঞেস করল,
“কিরে কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তোর বাসার সামনে দিয়েই আসছিলাম তাই ভাবলাম দাদীর সাথে দেখা করে যাই। আসসালামু আলাইকুম দাদী।”

দাদী দূর থেকে উত্তর দিল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম নুহাশ।”

“ও বাবা মনে আছে দেখি আমায়।”

“তোকে মনে থাকবে না?”

নুহাশ বলল, “তুই না বাহিরে যাবি?”

আদ্রাফ বললো, “গিয়েছিলাম তো।”

নুহাশ আদ্রাফকে কানে কানে প্রশ্ন করল,
“মেয়েটা কে রে?”

আদ্রাফ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, “কোন মেয়ে?”

নুহাশ ইশারা করে আয়াতকে দেখিয়ে দিল। আদ্রাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর নুহাশকে বলল,
“ও হলো আয়াত, আমার কাজিন।”

#চলবে