হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-১৪+১৫

0
377

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

পুকুরের স্বচ্ছ টলমলে পানি থেকে মাথা তুলে নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা হতভম্ব গলায় বলল,

‘এটা কি হলো?’

মাথার ভেজা চুলগুলোকে হাত দিয়ে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে নির্বিকার গলায় শুদ্ধ বলল,
‘আপনাকে পানিতে ফেলে দিলাম।’

‘কেন?’

‘এভাবে আগে-পরে যাওয়া নিয়ে ধাক্কাধাক্কি না করে একটা সঠিক সমাধানেই যাওয়া ভালো নয় কি? কাঁদায় মাখামাখি যেহেতু দুজনে একসাথে হয়েছি, কাঁদা থেকে ছাড়াছাড়িও তো দুজনের একসাথেই হওয়া উচিত, তাই না?

‘এটা কোন কথা! কিভাবে করতে পারলেন আপনি এটা?’

‘আপনি আরেকবার উঠে পাড়ে গিয়ে দাঁড়ান। আমি আবার ধাক্কা দিয়ে দেখাচ্ছি কিভাবে করলাম। বুঝতে পারছি, ধাক্কাটা দেওয়া নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হয়েছে। একারণেই আপনি আরেকবার চাইছেন। নো প্রবলেম! স্পেশালি আপনার জন্য, শুধু আপনার জন্য আমি আরেকবার আমার ধাক্কা দেওয়ার স্টাইলটা আপনাকে দেখাতেই পারি।’

ধারা রাগে গজগজ হয়ে একদৃষ্টিতে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব মাত্র এক হাত। শুদ্ধ নিজেকে পানির উপর ভাসিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন যে! প্রেমে টেমে পড়ে গেলেন না তো আবার?’

ধারা মুখ ঘুরিয়ে একটা ভাব নিয়ে বলল,
‘কোনদিনও না। আমার সিদ্ধান্ত পাকা করাই আছে।’

শুদ্ধ হেসে বলল, ‘আহারে! আপনার জন্য আমার সত্যিই বড় আফসোস হয়। জীবনের প্রথম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন সেটাও নাকি ঠিকমত রাখতে পারবেন না।’

‘কেন? রাখতে পারবো না কেন?’

‘শুদ্ধ সারাক্ষণ কোন মেয়ের চোখের সামনে থাকবে আর তার প্রেমে সে পড়বে না এমনটা তো কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। বলা তো যায় না, হয়তো ইতিমধ্যেই আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেছেন।’

ধারা ভাব নিয়ে বুকে আড়াআড়ি ভাবে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভুল ধারণা আপনার।’

ধারার কথা শেষ হতে না হতেই শুদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলো,
‘আরে ধারা! আপনার পেছনে তো একটা সাপ।’

ধারা ‘ও মাগো!’ বলে লাফিয়ে উঠে শুদ্ধ’র একদম কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সেই কান্ড দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো শুদ্ধ। দুপুরের সোনা রাঙা রোদের ঝিলিকে তার টোল পড়া গালের হাসি ধারার মনে এক সুভাসিত মাতাল হাওয়ার পরশ বুলিয়ে গেলো। শুদ্ধ বলল,
‘আপনার ভীতু অভ্যাসটা বোধহয় কখনোই যাবে না তাই না ধারা? নাকি এটাও জানেন না, মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায় তেমন সাপও মানুষকে ভয় পাও। এমন পুকুরের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের কাছ দিয়ে সাপ কখনো এসে বসে থাকবে না।’

ধারা মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘জানি আমি।’

‘জানেন যদি তাহলে এমন করে আমার বুকে লাফিয়ে আসলেন কেন? নাকি চোখের সামনে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখে হুঁশ থাকে না! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, সাপের ভয় পাওয়া একটা বাহানাই না ছিল! আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাওয়া।’

রাগে দুঃখে ধারা পারলে তখন নিজের চুল নিজে ছিড়ে। সাথে শুদ্ধরটাও। সে এক ঝাটকায় শুদ্ধর থেকে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো তার অবাধ্য চুল। শুদ্ধ’র শার্টের বোতামের সাথে এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে যে ধারাকে আবারো টান খেয়ে শুদ্ধ’র কাছেই থাকতে হলো তাকে। শুদ্ধ সেখানে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বলল,
‘কোন ফাঁকে আবার এটাও করে রেখেছেন! হায় আল্লাহ! আরও কত কি যে দেখবো!’

‘আপনি কি একটু চুপ থাকবেন! আমাকে আমার চুলটা ছাড়াতে দিন। নয়তো আমি কিন্তু আপনার বোতাম সহই ছিঁড়ে নিয়ে যাবো!’

‘কি দিন চলে এলো ভাই! একা একটা ছেলেকে দেখে মেয়েরা কিভাবে থ্রেট দেয়।’

ধারা অতি দ্রুত বোতাম থেকে নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এতক্ষণ চোখের সামনে নিজের বউয়ের রাগে গজগজ মূর্তিরূপ শুদ্ধ বেশ ভালোই উপভোগ করছিলো। ধারার এমন রূপ খুব কমই দেখা যায়। এমনিতে তো মেয়েটা এতোটাই শান্ত যে, যে যাই বলুক কারো সাথে তাকে কখনো রাগ করতেও দেখা যায় না। তাই এমন সুযোগ যখনই শুদ্ধ’র হাতে আসে তার সঠিক ব্যবহার না করে শুদ্ধ ছাড়ে না। তাড়াহুড়োয় ধারা ঠিকমতো চুল ছাড়াতে পারলো না। বরং আরও পেঁচিয়ে যেতে লাগলো। চুলে টান পড়ে ব্যাথা হতে লাগলো তার। তা দেখে শুদ্ধ ধারাকে থামিয়ে দিল। ধারার মাথাটা দু হাত দিয়ে আস্তে করে সোজা রেখে নিজে ছাড়িয়ে দিতে লাগলো তার চুল৷ খুব সাবধানে। যাতে এতটুকুও ব্যাথা না পায় ধারা। অপলক সেই যত্নবান শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো ধারা। এমনিতে তো মানুষটা কতো ভালো। ধারার কত টা খেয়াল রাখে। শুধু মাঝেমধ্যেই ওমন হুটহাট শয়তানীটা চেঁপে বসে। ধারাকে শুধু রাগিয়ে দেয়। কিন্তু সত্যিই কি ধারার রাগ হয়? নাকি মিছে রাগের আশ্রয়ে অন্তরের কোন এক গোপন কোণে মনে মনে এই মুহুর্তগুলোর জন্যই অপেক্ষা করে থাকে তার অবচেতন মন।
__________________________________________

দুপুরের খাবার শেষে খোদেজা একটা কাঁথা নিয়ে সেলাই করতে বসলো। শুদ্ধ ধারাও তখন সবেই খেয়ে উঠেছে। এখনও রুমে যাওয়া হয়নি তাদের। তখন সদর দরজা ঠেলে ভেতরে আসে তার আরেক প্রতিবেশী আমেনার মা আর নাইওর আসা তার মেয়ে। এসে খোদেজার পাশে বসে কথায় কথায় সকল পাড়া প্রতিবেশীর দৈনিক বিবাদের ফিরিস্তি খুলে দেয়। পাশের বাসার মনির আর রোকসানার কথায় আসতেই তার গলার স্বর খাদে নেমে যায়। তারা সবটা জানে না। বাড়ির পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে নিজ মনেই কিছু মনগড়া কারণ ধরে নিয়েছে তারা। তারই সূত্রে ইনিয়ে বিনিয়ে সে খোদেজাকে বলতে লাগলো,
‘বুঝছো খোদেজা, মাইনষের ব্যাপার স্যাপার আমি না একদমই বুঝতে পারি না। আমরাও সোয়ামীর ঘর কইরা আসতাছি। কই আমরা তো কোনদিন এমন করি নাই। মনির একটু কি না কি রাগারাগি করছে হের লেইগা দিনভর মনিরের বউ কান্নাকাটি লাগায় দিছে। আসলে দোষটা মনিরেরও আছে। এরাই প্রথমে লাই দিয়া বউগো মাথায় উঠায় রাখে। পরে আর শাসন করতে পারে না। দেখো না, ঐ বাড়ির আবুলের কান্ডকারখানা। ও’র বউয়ের প্রথম বাচ্চা হইলো মতোন কি করলো? বউয়ের বাচ্চা হইছে দেইখা সে যায় কলস নিয়া পানি আনতে, আবার কিনা উঠান ঝাড়ু দেয়। কি জানি বাপু, এমন মাইগ্যা স্বভাব আমাগো ঘরের ব্যাডা গো ভিতরে নাই। কি কস আমেনা?’

মায়ের তাল পেয়ে মেয়েও মুখ বেঁকিয়ে বলতে লাগলো, ‘হ গো মা৷ এইসব আমাগো ভিতরে নাই। আমার ভাইরে দেখছেন খোদেজা চাচী? সে তো এক গ্লাস পানিও ঢাইলা খাইতে পারে না। আবার নাকি এগুলা করবো? আজ পর্যন্ত রান্না ঘরের সীমানাতে পারাও দিয়া দেখে নাই। বাইরে থিকা আইসা শার্ট খুইলা সেখানেই রাইখা দিবো। আজ পর্যন্তও ধুইয়া দেখছে কি না সন্দেহ। কিছু বললে বলবে সে কি ‘মাইগ্যা’ নাকি যে মেয়েদের কাজ করবে। তার আবার তেজ আছে।’

কথা শেষ করে আমেনা আর তার মা দুজনেই তৃপ্তির সাথে হাসলো। তাদের ছেলে আর ভাই যে ভবিষ্যতে বউ পাগল হবে না এতেই তাদের প্রশান্তি। শুদ্ধ এতক্ষণ সবটাই শুনছিল। তাদের হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্মিত হেসে বলল,
‘আমেনা আপা, আপনার মায়ের কথা বাদই দিলাম। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। কিন্তু আপনি নাকি এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন? স্কুলে তো আমাদের মানুষের লিঙ্গভেদ পড়িয়েছিল, কাজেরও লিঙ্গভেদ আছে কি না কখনো পড়িয়েছিল কি? আপা, বেয়াদবী নিবেন না। আপনি যা বললেন আমি তার সাথে ঠিক একমত হতে পারলাম না। আপা শুনুন, মানুষের মধ্যে জেন্ডার আছে। কাজের কোন জেন্ডার থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো ক্ষমতা। আসল কথা হলো কে কি করতে পারে, কার কতোটুকু ক্ষমতা আছে। আর কোন কাজ করতে না পারা কখনোই কোন গর্বের বিষয় হতে পারে না। আপনার ভাই কোন গর্বের কাজ করছে না আপা। তাকে এখনই সময় থাকতে উচিত দুই গালে দুইটা ঠাস করে চটকানা দেওয়া। আর বলা, নিজেদের কাজ নিজে করায় কোন মাইগ্যা স্বভাব হতে পারে না। তাহলে যদি একটু সঠিক পথে আসে।’

আমেনা আর তার মায়ের মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। শুদ্ধকে বলার মতো কোন যুৎসই জবাব তারা খুঁজে পেলো না। ধারা শুধু মুখ হা করে শুদ্ধ’র কথা শুনতে লাগলো। কি করে এতো বড়দের সামনে কত সুন্দর ভাবে শুদ্ধ তার নিজের ধারণা রেখে দিলো! ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভীষণ হট্টগোলের আওয়াজ এলো। সবাই বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখলো হাসুদের বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা হচ্ছে। রোকসানা বাবার বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ফেলেছে। মনির তাকে আটকাবে তো দূর উল্টো আরও এই হুমকি দিচ্ছে যে রোকসানা যদি আজ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে আর কোনদিনও ফেরত আসতে পারবে না। সিদ্ধান্ত তার। এই নিয়ে ভীষণ চেঁচামেচি হচ্ছে। শুদ্ধ মনিরকে আটকাতে গেলো। রোকসানা খুব চেঁচামেচি করছে। অপরদিকে মনিরও থামছে না। মনিরকে শুদ্ধ শান্ত করে নিয়ে গেলো সেখান থেকে। তার সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলো মনিরের কয়েকমাস আগে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। যদিও এখন বর্তমানে নেই। মনির সেসব ছেড়ে দিয়েছে। তবুও কিভাবে যেন ঐ ছবিটা রয়ে গিয়েছিল ফোনে। তাই দেখে ফেলেছে রোকসানা। সে এ নিয়ে রোকসানাকে কোন কৈফিয়ত দিতে রাজী না বলেই তাকে কিছু বোঝাচ্ছে না। মেয়ে মানুষ কেন এতো ঔদ্ধত্য হবে?

সবটা শুনে মাথা দুলিয়ে আফসোসের সাথে শুদ্ধ বলল, ‘তুমি কি এটা কোন ঠিক কাজ করেছো মনির ভাই? কিভাবে পারলে ভাবীকে এতো বড় ধোঁকা দিতে! দোষটা আগে হোক পরে হোক, এখন থাকুক আর নাই বা থাকুক অন্যায় তো তুমি করেছোই। আর এ নিয়ে তুমি ভাবীর কাছে মাফ না চেয়ে উল্টো তার সাথেই গালাগালি করছো?’

মনির বলল, ‘আরে এগুলা তো আগে করছি। এখন তো বাদ দিয়া দিছি। তাইলে এখন ওয় এমন শুরু করছে কেন? ওরে আমার সব কিছু কইতে হইবো? শুনো মাহতাব, মাইয়া মাইনষের বেশি বুঝোন ভালো না।’

শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, ‘আজকে এই কাজটা যদি তুমি না করে ভাবী করতো তাহলে কি তুমি তাকে ছেড়ে কথা বলতে মনির ভাই? একই বিষয় ছেলে আর মেয়ের ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যাবে কেন বলতে পারো? ভাবীর চেঁচামেচিকে তোমার বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? এর পেছনের যন্ত্রণাটাকে কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছো না? আচ্ছা মনির ভাই, তোমার মনে আছে? একবার যে তুমি তোমার দোকানে অনেক বড় লস খেলে। তোমাদের ফসলও সেবার বেশি হলো না। একপ্রকার অভাবেই ডুবে গিয়েছিলে তোমরা। তখনও কি ভাবী তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল? নাকি তখনই ছেড়ে গিয়েছিল যখন তুমি একবার অনেক অসুস্থ হয়ে গেলে? ছেড়ে যায়নি তাই তো! কিন্তু আজ একটা মেয়ের সাথে তোমার ছবি দেখে রোকসানা ভাবী তার বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইলো। তবুও কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো না মনির ভাই? সব কষ্ট সহ্য করতে পারলেও ভাবী এই কষ্টটা সহ্য করতে পারছে না। বুঝতে পারছো এটা মেয়েদের কাছে কতো ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার! বিয়ের পর একটা মেয়ে তো তার স্বামীর উপর বিশ্বাস করেই তার আপন সব কিছু ছেড়ে আসে। বিনিময়ে চায় একটু ভরসা, বিশ্বস্ততা। আমরা কি সেই বিশ্বস্ততা টা তাদেরকে দিতে পারি না? যেই মেয়ে আমাদের জন্য তার সবকিছু ছেড়ে দিল আমরা কি তার জন্য শুধু এতটুকু ছাড়তে পারি না? পারি না একটু অন্য মেয়েদের দিকে না নজর দিয়ে থাকতে? নিজেদের একটু সামলে রাখতে কি পারি না বলো? মনির ভাই, তোমার না একটা ছোট মেয়ে আছে? বিয়ে হওয়ার পর তার সাথে কখনোও কল্পনাতেও এরকম হওয়া তুমি মানতে পারবে?’

মনির এতক্ষণ চুপ করে অপরাধীদের মতো শুদ্ধ’র বলা প্রতিটা কথা শুনছিল। বয়সে ছোট একটা ছেলের থেকে এসব শোনা তার জন্য ভীষণ লজ্জিত একটা ব্যাপার। সত্যি বলতে নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ তার আগেও হচ্ছিল। কিন্তু নিজের নকল পুরুষত্ব বোধের গায়ে লাগছিল বলেই নিজের দোষের রাগ রোকসানার উপরেই ঝেড়ে দিচ্ছিল। মূলত রোকসানাকে বাপের বাড়ি যাওয়া থেকে আটকাবার জন্যই এরকম হুমকি দিয়েছিল সে। তবুও মুখ ফুটে মাফ চাইতে পারেনি।
শুদ্ধ’র শেষের কথাটায় হঠাৎ মনিরের বুক কেঁপে উঠলো। সে ঝট করে কম্পিত দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, ‘কি, নিজের মেয়ের বেলায় খারাপ লাগলো তো শুনতে? ভাবীও তো তেমনই একজনের মেয়ে মনির ভাই। মেয়ের জন্য ভালোবাসা সব বাবারই এক। তুমি যখন অন্যের মেয়েকে ভালো রাখতে পারবে ঠিক তখনই নিজের মেয়েকেও অন্যের কাছে ভালো থাকার আশা করতে পারবে। পরকীয়া খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার। কোন ব্যাখা দিয়েই তুমি এটাকে জাস্টিফাই করতে পারবে না। যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই। তুমি অনেক বড় একটা ভুল করেছো। ভাবী যদি তোমাকে আর কখনো মাফ নাও করে তবুও আমি তাকে কোন দোষ দিতে পারবো না। আঘাতটা যখন বিশ্বাসের উপর এসে হয় তখন বাদবাকি সবকিছুই ঠুনকো হয়ে যায়। ভাবীর কাছে গিয়ে মাফ চাও মনির ভাই। যতটুকু দিয়ে মাফ চাওয়া যায় সবটুকু দিয়েই। সে তোমার বউ। তাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো। ভয় পাইয়ে নয়।’

মনির অনুতপ্ত মুখে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করা রোকসানার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে হঠাৎ কেঁদে ফেললো। কান্নার শব্দটা বাইরে থেকেও শোনা গেলো। রোকসানাও যে ঠান্ডা হয়ে গেছে ভিতরের নিরবতা তাই প্রকাশ করলো। একটা প্রশান্তির হাসি নিয়ে পকেটে দু হাত গুঁজে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো শুদ্ধ। ধারা এতক্ষণ অবাক, মুগ্ধ, স্থবির সব অনুভূতি একসাথে নিয়েই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ’র কথা শুনছিলো। মনির চলে যাওয়ার পরই ধারা শুদ্ধকে এই প্রথম নাম ধরে ডেকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

‘শুদ্ধ, আপনি সত্যিই শুদ্ধ।’

চলবে,

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

রাত এগারোটা। শুদ্ধ বসে আছে একটা ল্যাপটপ নিয়ে। তার সামনেই বইয়ের স্তূপ সাজিয়ে বসে আছে ধারা। তার কোলের উপর একটা মোটা বই। বইয়ের গভীরে তার দৃঢ় মনোযোগ। তার খোলা রেশমী কালো চুলগুলো কাঁধ জুড়িয়ে এসে পড়েছে সামনে। সেদিকে ধারার ভ্রুক্ষেপ নেই। শুদ্ধ’র দেখে ভালো লাগলো। যেই স্বপ্নটা ধারাকে নিয়ে সে দেখেছে, সেই স্বপ্নের রেশ ধীরে ধীরে এখন ধারার মনেও সঞ্চারিত হচ্ছে। এতদিনে ধারাও তার পড়াশোনার দিকে ভালোমতোই ঝুঁকে গেছে। মন দিয়ে নিচ্ছে সে পরীক্ষার প্রস্তুতি। শুদ্ধ খানিক গলা খাকারি দিয়ে ধারাকে ডেকে বলল,

‘কি ব্যাপার ধারা? আজকে দেখি আপনি একবারও ঘুমে ঝিমাচ্ছেন না। এতো রাত হবার পরেও!’

ধারা স্মিত হেসে বলল,
‘আজকে আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম। আপনি তো আপনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই দেখেননি। তাছাড়াও এখন পড়াটা অনেকটাই ধরতে পারছি বলে পড়ে ভালো লাগছে।’

‘এমনভাবেই যদি পড়তে থাকেন না তাহলে দেখবেন আপনি ইনশাআল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবেন।’

‘চান্স পাবো কিনা আমি শিওর বলতে পারছি না। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। বাবা আর কাকা এখনও কিছু জানে না। বাবা তো আমাকে আর পড়াতেই চায়নি। একারণেই তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর এখন তাকে না বলেই আমি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছি তার উপর বিভাগ পরিবর্তন করে….না জানি বাবা শুনলে কি করে!’

ধারাকে আশ্বাস দিয়ে শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনি কোন ভুল করছেন না। প্রতিটা কাজের দুটি অংশ থাকে। ঠিক অথবা ভুল। যতক্ষণ আপনার বিবেক জানে আপনি কোন ভুল করছেন না ততক্ষণ তা নিয়ে কখনো শঙ্কিত হবেন না। আপনার বাবাকে আপনি সবটা খুলে বলবেন। আপনাকে আমি পড়ালেখা করাবো। আপনার যতদূর ইচ্ছা আপনি পড়বেন। বলেছি না! সবসময় মনে রাখবেন আমি আপনার পাশে আছি।’

ধারা নানা শঙ্কায় থেকেও একটা ভরসার হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ বলল,
‘একবার ইউনিভার্সিটিতে গেলে এসব কিছুই আর তখন আপনার মনে থাকবে না। ইউনিভার্সিটির লাইফটা যে কি না দেখলে মিস করবেন।’

‘আপনি খুব মিস করেন বুঝি?’

‘হুম। খুব! এতোবছর বন্ধুদের সাথে থাকতে থাকতে বন্ধুগুলা একদম আপনের থেকেও বেশি হয়ে যায়। আমরা যে একসাথে কত আড্ডা মজা করতাম! সেগুলো মনে পড়লে আপনাআপনিই মন ভালো হয়ে যায়। আমার তো অনেকগুলো ফ্রেন্ড ছিল। আপনার কয়জন ফ্রেন্ড ধারা?’

ধারা মনে মনে কিছু ভাবলো। তার আসলে কোন ফ্রেন্ড নেই। এই কথাটা যে শুনে সেই অবাক হয়। এখন এটা শুদ্ধ জানলে নিশ্চয়ই তাকে এ নিয়েও ক্ষ্যাপাবে। এদিকে ধারা মিথ্যাও বলতে চায় না। তাই বলল, ‘আমি বলবো না।’

শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘এমনিই।’

‘এমনিই মানে?’

‘এমনিই মানে এমনিই।’

শুদ্ধ ধারার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?’

শুদ্ধ ঝুঁকে পড়ায় ধারার মাথাও কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। শুদ্ধ একদম তার চোখের মধ্যে তাকিয়ে আছে। একটা ঢোক গিলে ধারা কাঁচুমাচু করতে লাগলো। শুদ্ধ যেভাবে ধারার মনের সব কথাই বুঝে যায় না জানি আবার এবারো বুঝে ফেলে। ধারাকে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিলো লোডশেডিং। হঠাৎ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুদ্ধ তার ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অন্ধকার দেখে চমকে সোজা হতে যেতেই শুদ্ধ’র মাথার সাথে জোরে একটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ ব্যাথাটা চেঁপে গিয়ে সোজা হয়ে বসলো। অন্ধকারে না বুঝে আবারো সেখান থেকে সরতে গিয়ে আবারো শুদ্ধ’র মাথার সাথে আরেকটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ এবার বলেই ফেললো,
‘ছোটবেলায় মাথায় শিং গজাবার মজাটাকে আপনি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন তাই না ধারা! আমার মাথায় শিং গজাবার চান্স থেকে বাঁচিয়ে কৃতার্থ করলেন।’

কপালে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে ধারা বলল,
‘আপনি এখন খোঁচা না মেরে কোন লাইট নিয়ে আসুন।’

শুদ্ধ গিয়ে নিচ থেকে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসলো। ধারার সামনে রেখে দিলে আবার বই খুলে পড়তে বসলো ধারা। আর শুদ্ধ ব্যস্ত হলো তার নিজের কাজে। শ্রাবণ মাস চলে যাবার পরপর বৃষ্টিরও বহুদিন হলো কোন হদিস নেই। ভ্যাপসা গরমে বৈদ্যুতিক ফ্যান ছাড়া কোন উপায় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গরমে ধারা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলো। কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। শুদ্ধ বলল,
‘কারেন্ট তাড়াতাড়ি আসবে বলে তো মনে হয় না। আজকে আর পড়তে হবে না ধারা। আপনি শুয়ে পড়ুন।’

ধারা গলা থেকে তার নীল রঙের ওড়নাটা একটু আলগা করে একটা খাতা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, ‘এই গরমের মধ্যে শুয়েই কি হবে! ঘুম তো আর আসবে না। যেই গরম!’

শুদ্ধ খেয়াল করলো আসলেই খুব গরম। রুমের মধ্যে টিকে থাকা মুশকিল। একবার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ধারার হাত ধরে টেনে বলল,
‘চলনে বাইরে যাই।’

ধারা কিছু বলার আগেই শুদ্ধ তাকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলো। বাইরে ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলো নারকেল গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করে উঠোনে আলো রেখার নকশা তৈরি করেছে। কৃত্রিম আলোর ছুটি হওয়ায় জোৎস্না যেন আজ পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। শুদ্ধ রান্নাঘরের বেড়ার গায়ের সাথে টাঙানো একটা শীতল পাটি নিয়ে আসে। তারপর উঠোন পেরিয়ে ধারাকে নিয়ে চলে এলো পুকুর পাড়ে। ধারা অভিভূত হয়ে গেলো। সামান্য চাঁদের আলোও যে কতো সুন্দর হতে পারে এই মুহুর্তে এইখানে না দাঁড়ালে কেউ বুঝতে পারবে না। আকাশের হাজারও তারকারাজির মাঝখানে হীরকখণ্ডের ন্যায় জ্বলজ্বল রত একটা পূর্ণ চাঁদ। যার স্থবির প্রতিবিম্ব পড়েছে পুকুরের স্বচ্ছ জলে। সেই আলোয় উজ্জ্বলতা পেয়েছে পুকুরের মাঝে জন্ম নেওয়া পদ্ম ফুলের দল। আহা, কি সুন্দর!

পাড় ঘেঁষে জন্মানো ঘাসের উপরে শুদ্ধ হাতের শীতল পাটি টা বিছিয়ে দিলো। তার উপরে ধারাকে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো সে। হালকা শীতল হাওয়া বইছে বলে তাদের দুজনেরই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনে জ্যোৎস্না বিলাসের পর শুদ্ধ’ই প্রথমে ডেকে উঠলো,
‘ধারা!’
ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ধারা জবাব দিল,
‘হুম?’
‘একটা গান শুনান তো!’
‘আমি গান পারি না।’
‘গান কেউই পারে না। আবার পারে সবাই। কি সুন্দর পরিবেশ দেখেছেন? শুনান না একটা গান।’
ধারা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘উহুম! আমারটা ভালো হয় না।’
‘আহা! শুনান না একটা। আপনাকে তো স্টেজে পারফর্ম করতে বলছি না! অতো ভালো হওয়া লাগবে না। আপনি যেমন পারেন গাইবেন। প্লিজ শুনান না একটা গান।’
ধারা বিব্রত হতে হতে বলল, ‘আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা।’
ধারা সামনে তাকিয়ে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে আস্তে আস্তে গাইতে লাগলো,
‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের ফুল কুঁড়ি,
লাল পরী, নীল পরী…..

এতটুকু গাইতেই শুদ্ধ বহু কষ্টে হাসি চেঁপে রেখে হঠাৎ ফস করে হেসে ফেললো। ধারা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘আপনাকে কিন্তু আমি বলেছিলাম আপনি হাসতে পারবেন না। আপনি হাসলেন কেন? আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম আমি ভালো গাইতে পারি না।’
শুদ্ধ হাসি থামাতে থামাতে বলল,
‘আপনার গাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা হলো গানে।’
‘কেন? গানে কি সমস্যা?’
‘এমন একটা সুন্দর পরিবেশে, পাশে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকলে যে কিনা সম্পর্কে আপনার হাজবেন্ড হয় সেখানে কি কেউ এমন গান গায়!’
ধারা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল, ‘তাহলে কেমন গান গায়? আপনিই বলে দিন।’
শুদ্ধ কিছুটা থেমে বলল, ‘আচ্ছা ধারা আপনাকে এই পর্যন্ত কয়টা ছেলে লাভ লেটার দিয়েছে?’
ধারা দ্রুত জবাব দিয়ে ফেললো, ‘একটাও না।’
শুদ্ধ চরম আশ্চর্যের স্বরে বলল, ‘কি বলেন! আপনাকে তো বইয়ের পরিভাষায় সাংঘাতিক সুন্দরীই বলা যায়। আর আপনি কিনা কোন লাভ লেটার পাননি?’
ধারা ভ্রুকুটি করে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। তার ঠিক ছয় ইঞ্চি দূরত্বেই বসে আছে ছেলেটা। গায়ে পাতলা একটা সাদা শার্ট। হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করে রাখা। বাতাসে গোছানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উঠছে। মুখে একটা দুষ্ট হাসি। যার মূলে আছে শুধু ধারাকে ক্ষ্যাপানো। ধারা গভীর অতীতে ঝাঁপ দিয়ে দেখলো ক্লাস ফোর এ থাকতে তাকে তার স্কুলেরই একটা ছেলে খাতায় আই লাভ ইউ লিখে দিয়েছিল। তা দেখে ধারা সেটাকে নোংরা কথা ভেবে এতোটাই জোরে জোরে কেঁদেছিল যে ছেলেটা হেড মাস্টারের কাছে বিচার যাওয়ার ভয়ে আর কোনদিন ধারার সামনেই আসেনি। কিভাবে যেন এই কথাটা ধীরে ধীরে পুরো স্কুলে ছড়িয়ে যায়। তারপর থেকে প্রাইমারী থেকে হাইস্কুল, সব ছেলেদের মাথাতেই এটা গেঁথে যায় এই মেয়েকে আর যাই হোক প্রপোজ করা যাবে না। তারপর কলেজেও ধারার নিরামিষ মার্কা স্বভাবের জন্য সব ছেলেরা তার থেকে দূরে দূরেই থাকতো। একারণেই হয়তো আজ পর্যন্ত তার কাছে কোন লাভ লেটার আসেনি। কিন্তু এই কথাটা মরে গেলেও খোঁচারাজকে জানানো যাবে না। তাই ধারা তার কথা কাঁটাতে শুদ্ধকে উল্টা প্রশ্ন করলো, ‘আমারটা বাদ দিন। আপনি কয়টা লাভ লেটার পেয়েছেন?’
মাথার নিচে একটা হাত রেখে পাটিতে শুয়ে পড়ে শুদ্ধ বলল, ‘কতগুলো! বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটিতে থাকতে।’
ধারা প্রশ্নটা করেছিল এমনি এমনিই। শুদ্ধ’র উত্তর শুনে আকাশ থেকে পড়ে বলল, ‘আপনাদের ওখানে মেয়েরাও লাভ লেটার দেয়?’
‘আপনি শহরের মেয়েদেরকে কি ভাবেন? ওদের মনে যেটা থাকে সেটা ওরা প্রকাশ করে দেয়। অবশ্য সবাই না।’

‘তারপর? আপনি একসেপ্ট করেছেন কয়টা?’

শুদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বিশেষ একজনের অপেক্ষায় আছি। সে করলেই একসেপ্ট করবো।’

ধারার হঠাৎ ই কেন যেন খুব লজ্জা করতে লাগলো। আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে ফেললো সে। ঠিক তখনই তার বাম কাঁধে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পড়তেই পুরো পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো ধারা। পেছন থেকে উঠে বসে শুদ্ধ ধারার কানে কানে গাইতে লাগলো,

“এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত,
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!
আমি ভাবতে পারিনি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি,
তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!”

শুদ্ধ’র গান থেমে যাওয়ার পরও ধারা সেভাবেই জমে রইলো। তার শরীরের প্রতিটি লোম যেন দাঁড়িয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন একধরণের মাতাল শীহরণে তার মন হয়ে উঠেছে আন্দোলিত। মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ, তার উপচে পড়া জ্যোৎস্না, পুকুর ছুঁয়ে ভেসে আসা শীতল হাওয়া, তার উপরে কানের কাছে এমন গান, স্পেশালি শুদ্ধ’র ওমন জড়ানো গলার স্বর….সরল অনুভূতি এলেমেলো না হয়ে কি পারে!

ধারা ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো কারেন্ট। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা আস্তে আস্তে বলল,
‘বাড়িতে যাবেন না? কারেন্ট চলে এসেছে।’
শুদ্ধ বসে থেকেই তার সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘হুম, দেখলাম তো। আচ্ছা ধারা! আমার গান কেমন হয়েছে বললেন না তো!’
কিছু না বলে মৃদু হেসে বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘সাবধানে ধারা! আপনি পড়ে যাচ্ছেন।’
অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের দিকে লক্ষ করে ধারা বিভ্রান্ত স্বরে বলল,
‘কোথায়?’
মুচকি হেসে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে শুদ্ধ বলল,
‘প্রেমে!’

চলবে,