হাতে রেখো হাত পর্ব-০১

0
475

#হাতে_রেখো_হাত
#পর্ব_১
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

‘ব্রেকআপ! কলেজের বেতন দিতে পারে না যেই ছেলে সেই ছেলের কি যোগ্যতা আছে আমার সাথে রিলেশন করার? ‘

একটা ঘড়ি আর কিছু কাগজের প্রেম পত্র আবরাজের মুখে ছুঁড়ে চলে গেল রাই। তিন মাস, মাত্র তিন মাস রিলেশন ছিলো ওদের। মূলত রাই ই প্রপোজ করেছিলো আবরাজকে। ছেলেটা কঠিন ধাতুতে তৈরি না হলে রাই কে অপমান করে দিতো বিনা সংকোচে। হয়তো ভাগ্য বিড়ম্বনাকে আপন করেই মেয়েটা কে অপমান করে নি। কলেজের অন্যতম মেধাবী ছাত্র আবরাজ। সেই সুবাদে কলেজ থেকে অনুদান পায়। তবে প্রাইভেট কলেজ হওয়ার দরুন বেতন দিতেই হবে। সে যত ভালো স্টুডেন্ট ই হোক না কেন। পার্ট টাইম জব করে নিজের খরচ চালাতো ওহ। তবে এই মাসের বেতনটা কোনো কারনে এখনো হাতে আসে নি। এ দিকে বেতন না দেওয়ায় একটা নোটিশ আসে ওর কাছে। সেটাই যেন ওকে হাসির পাত্র করে দিলো। সাথে রিলশনের সমাপ্তি ও ঘটালো। আবরাজ এর ধারালো ব্যক্তিত্ব আর মেধা দেখেই প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো রাই। প্রথমে না করলে ও কোন কারনে যেন রাইকে অ্যাকসেপ্ট করে নিলো। তবে কল্পনা ও করতে পারে নি এভাবে ভেঙ্গে যাবে সম্পর্ক। অবশ্য ওর ই ভুল ছিলো। সামান্য সরকারি বেতন ভোগী বাবার ছেলে হয়ে একজন উঁচু মাপের বাবার মেয়ের সাথে রিলশনে জড়ানো উচিত হয় নি। মৃদু হাসে। মাটিতে পরে থাকা ঘড়িটা তুলে নেয়। খুব দামি নয় তবে বেতন পেয়ে মাসের প্রথমে এই ঘড়িটা কিনেছিল ঢাকার বেশ জমকালো শো রুম থেকে। তবে এটাই ছিলো সেই শো রুম এর সব থেকে কম দামি ঘড়ি। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবরাজ। পকেটে পুরে নেয় ঘড়ি। চিঠি গুলো কুঁড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। এই নাম করা শহরে সামান্য চিঠির প্রেমের কোনো মূল্য নেই। টাকার মূল্য টাকা তেই। চিঠির স্বস্তা প্রেমকে আপন করা হয় না এখানে। শুধু দেখা হয় স্ট্যাটাস। কে কতো বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়। মানুষ বড়ো অদ্ভুত জীব। এরা টাকা ছাড়া এক পা ও চলতে পারে না। ভালোবাসা নিয়ে মুখে বেশ কিছু লাইন বললে ও মনে মনে সেগুলো কে স্বস্তা বলে ফেলে রাখে আস্তাকুঁড়ে।

এক পা দু পা করে এগিয়ে চলছে আবরাজ। চেহারায় সামান্য মলিনতা।থাকবেই বা না কেন?একটু আগে যে ব্রেকআপ হলো। তবে কে বলবে এই ছেলেটার সাথে তিন মাসের প্রিয় প্রেমিকার বিচ্ছেদ ঘটেছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। নেই কোনো ব্যথার ছাপ।

ক্যান্টিনে এসে পকেটে হাত দিলো। বিশ টাকা রয়েছে মাত্র। পায়ে জোড় নেই একদম। বাসে করে গেলে দশ টাকা ভাড়া লাগবে। আবার না খেয়ে ও চলছে না শরীর। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে তৎক্ষণাৎ। এখানে এক বোতল পানির মূল্যেই বিশ টাকা। সর্বনিম্ন খাবারের মূল্য ত্রিশ টাকা। তা ও আবার ডিম ছাড়া স্যান্ডউইচ। গলা কাঁ**টা দাম নিচ্ছে। বাইরের ছোট খাটো চায়ের দোকানে এসে বসে। দশটা টাকা সন্তপর্ণে পকেটে পুরে বাকি দশ টাকা দিয়ে দুই স্লাইস রুটি কিনে নেয়। খেতে মন্দ নয় তবে টাটকা রুটি ও নয়। রুটি খেয়ে টাকা টা বাড়িয়ে দেয়। পানি খাওয়া প্রয়োজন। সামান্য আশংকা গ্রস্ত হয়েই বলল ” মামা টাকা ছাড়া পানি হবে? ”

লোকটি ময়লা গামছা তে হাত মুছতে মুছতে বলল ” কি কন মামা। পানির জন্য আবার টাকা লমু। লন লন বইসা খান।

কৃতঙ্গতার চোখে তাকায় ছেলেটি। টিনের গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঠকঠক করে পানি পান করে। এই ব্যস্ত দামী শহরে থেকে ভুলেই গিয়েছিলো টাকা ছাড়া ও পানি পাওয়া যায়। অবশ্য ওর ই বা দোষ কিসের। আজকাল যা পরিস্থিতি। পানির গ্লাসটা দোকান দারের হাতে দিয়ে আবরাজ বলল “কৃতার্থ হলাম মামা। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক। ”

লোকটা শীতল দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো। মানুষ এতোটা বিনয়ী হয় তা জানা ছিলো না ওনার। ভাগ্য বড় অদ্ভুত। ভালো মানুষ গুলোই রাস্তায় পঁচে ম**রছে। আর সমাজের নোংরা কীট গুলো হলো হাই সোসাইটির গন্য মান্য ব্যক্তি। আসলে এরা গন্য মান্য তো বটেই, তবে বেশির ভাগ ই জঘন্য ব্যক্তি।

প্রাইভেট কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি। সরকারি কলেজ দূরে হওয়ায় প্রাইভেট কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি তেই পড়া শোনা শুরু করেছিলো ছেলেটা। তখন অবশ্য টাকার টানা পোড়ন ছিলো না। মাথার উপর ছায়া নামক বাবা ছিলেন। না হলে এই দামের বাজারে কজন মধ্যবিত্ত সাহস করে প্রাইভেট কলেজে এডমিশন নেওয়ার?

তবে বছর খানেক যেতেই কপালে দুঃখ নামক হতাশা এলো। মধ্য বিত্ত পরিবারের সেই ছেলেটা দেখতে পেলো গরিব অবস্থান। বাবা নামক মানুষটির মৃত্যু ওকে সমাজ কে চিনতে সাহায্য করেছে। ছোট থেকেই ধারালো আর বিনয়ী মস্তিষ্কের অধিকারী বটে। না হলে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার পর ও চাচার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলো না। নিঃসেন্দহে ছেলেটা শক্ত মনের একজন।

রাস্তা দিয়ে হাটছিলো। হাতে দশ টাকা। যেহেতু এখন কিছুটা সুস্থ লাগছে তাই দশ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে লাভ কি? ঝড়ের গতিতে পাশ কাঁটিয়ে যায় একটি গাড়ি। পাশের নোংরা ময়লা ড্রেনের সমস্ত পানি এসে লাগে আবরাজের শরীরে। ছেলেটার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই কথা শোনাতো। অন্তত বিরক্তি প্রকাশ করতো। গাড়ি থেকে লোকটা নেমে আসে। ইয়ং বয়সের একটি ছেলে। ওর কাছে এসে বলল ” স্যরি। ”

” ইটস ওকে। ”

সামান্য হেসেই কথাটা বলল আবরাজ। তবে গাড়ি থেকে নেমে আসা সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে ভ্রুটা কুঁচকে গেল। বড় বড় চোখ করে এগিয়ে আসে রাই। ছেলেটার হাত চেপে ধরে বলল ” হোয়াট হ্যাপেন বেইবি? এই রা**সকেল, লো ক্লাসের ছেলের সাথে কি কথা থাকতে পারে তোমার? ”

” ওকে তুমি চেনো রাই? আসলে আমার ভুলের কারনেই ওর কাপড়টা নোংরা হয়ে গেছে। ”

পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায় রাই। আবরাজের শার্ট থেকে একটু গন্ধ নাকে এসে লাগতেই নাক চেপে ধরে। চেঁচিয়ে বলে
” তোমার ক্লাস কোথায় নেমে এসেছে রকি? ওর শার্টটা দেখেছো?নোংরা ,তেল চিটচিটে আর দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে ফুটপাতের। ”

” বাট রাই। ”

ছেলেটাকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেল রাই। শক্ত মন ধারী আবরাজ মৃদু হাসলো। যেই মেয়েটা দুদিন আগে ও ওকে জড়িয়ে ধরার বায়না করেছে কতোশত ভাবে।সেই মেয়েটা আজ নোংরা বলে বিদ্রুপ করে গেল! ভাবতেই অবাক লাগে, মানুষ কতোটা দ্রুত বদলে যায়। অবশ্য সঙ্গী জোগাতেও টাইম লাগে না। বড়লোক আর সুন্দরী হলে তো বা হাতের খেল। আর ছেলেদের টাকা হলেই যথেষ্ট। মিনিটে মিনিটে গার্লফ্রেন্ড জুগিয়ে নিবে!

.

পাশের রুম থেকে কাশির শব্দ কানে এসে ধরা দেয়। ছেলেটা বুঝতে পারে অরিতার ঠান্ডা লেগেছে। মেয়েটার ঠান্ডার ধাঁচ প্রচুর। একটু বৃষ্টি হলেই ঠান্ডা লেগে যায়। কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে আছে অরিতা। আদুরে হাতে বোনের মাথায় হাত রাখে আবরাজ। ঘন্টা খানেক পর ই অরিতার জন্মদিন। গুনে গুনে বারো বছর পূর্ন করবে মেয়েটি। মায়ের স্নেহ পাওয়া হয় নি। মা কি জিনিস জানা নেই। জন্মের সময় ই মা মা**রা যায়। ভাই আর বাবার হাত ধরেই বেড়ে উঠছিলো। অনাকাঙিক্ষত ঝড় এসে আবার বাবা নামক ছায়াকে তুলে নিলো। বিগত দেড় বছর ধরে ভাইকে জড়িয়ে বেঁচে আছে। রুগ্ন শরীর টা কোনো মতে মলিন কম্বলে ঢেকে দিলো আবরাজ। স্নেহের হাতটা মাথায় রেখে বলে ” খুব খারাপ লাগছে অরি? ”

” না ভাইয়া আমি ঠিক আছি। তোমার না কাল থেকে পরীক্ষা। যাও পড়তে বসো। ”

” উহু ঠিক আছে বোন। আগে তোর সুস্থতা প্রয়োজন। ”

মেয়েটার কপালে হাত রাখে আবরাজ। জ্বরের শরীর পুরে যাচ্ছে একদম। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। মেয়েটার অসুস্থতা ওকে চঞ্চল করতে বাধ্য করে। দিক ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক তাকায়। কি করবে বুঝতে পারে না। মলিন মুখে রুগ্ন শরীর নিয়ে ধীরে উঠে বসে অরিতা। আবরাজের হাতটা মুঠো বন্দী করে বলল ” আমি ঠিক আছি ভাইয়া। তুমি পড়তে বসো। না হলে অনেকটা দেড়ি হয়ে যাবে। তোমাকে বেস্ট রেজাল্ট করতে হবে তো। ”

” চুপ। একদম পাকা পাকা কথা বলবি না। তুই শুয়ে থাক, আমি আদা চা আর পানি নিয়ে আসছি। কপালে পানি পট্টি দিবো। ”

” কিন্তু ভাইয়া ”

মেয়েটার কথাটা অগ্রাহ্য করে কিচেনের পথে আসলো আবরাজ। চিনির কৌটায় অবশিষ্ট এক চামচের মতো চিনি। ফলে ছেলেটা হালকা হাসে। এতেই হয়ে যাবে। তবে চা পাতার কৌটাটা খুলতেই বুকটা ভারী হয়। এক টা দানা ও নেই। পেছন থেকে পদধ্বনি শুনতে পেয়ে কৌটাটা লুকিয়ে ফেলে ঝটপট। অরিতা বলে ” কি হয়েছে ভাইয়া? ”

” একি অরি,এখানে কেন এসেছিস? যাহ আমি চা নিয়ে আসছি। ”

শেষোক্ত কথা বলার সময় ছেলেটার গলা ধরে আসে। অরিতার চোখ কান এড়ানো দায়। দু চোখের কার্নিশে জমে থাকা পানি টুকু মুছে নিয়ে বলল ” আমি চা খাবো না ভাইয়া ”

“কেন খাবি না?”

মাথাটা নিচু করে ফেলে অরিতা। দু চোখ ফেঁটে কান্না আসতে চায়। হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে মেয়েটা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভাইকে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে
” আমি দেখেছি চা পাতা নেই। তুমি এতো ভেবো না ভাইয়া। ”

দীর্ঘশ্বাস টা কোনো মতে লুকিয়ে অরিতা কে বুকে চেপে ধরে। মনে মনে শক্ত হওয়ার মনোভাব পোষন করে বলে “আরে পাগলি এর জন্য কাঁদে কেউ? কাল বাদে পরশু ই বেতন পাবো। দেখবি সব নিয়ে আসবো। একদম ই টেনশন করবি না, ভাই আছে তো। আর চা পাতা নেই তো কি হয়েছে আমি আছি না। ”

ছেলেটার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না অরিতা। চাঁপা কান্নাটা দমিয়ে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। তাতেই হেঁসে কুটি কুটি আবরাজ। হাসি থামিয়ে বলল ” আমি আছি মানে এই নয় যে আমাকে চা পাতা বানিয়ে চা বানাবো। ”

” ভাইয়া! ”

আবারো কেঁদে উঠে মেয়েটি। র*ক্তক্ষ*রণ বোধহয় একেই বলে। তীব্র র*ক্ত ক্ষরন হচ্ছে বুকে। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে আকাশের পানে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মা বাবা ম*রা মেয়েটিকে ভালো রাখতে পারছে না আবরাজ। মনে মনে প্রশ্ন করে ভাই হিসেবে কতোটা যোগ্য আমি?

চলবে……