হারানো সুর পর্ব-০১

0
747

হারানো সুর-১ম পর্ব
©শাহরিয়ার

আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়ি ফিরেছেন। পাশের এলাকার মাঝ বয়সী এক নারীর সাথে তাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরে এলাকার লোকজন তাকে সেই মহিলার সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কথাটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে কিনা নিজের যৌন খুদা মিটানোর জন্য পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছিলো। ভাবতেই যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। অথচ রূপ যৌবন কোন কিছুর কমতি নেই আমার মাঝে। মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে আমাদের বিয়ের বয়স। মেট্রিক পররীক্ষার আগ থেকেই শাকিল বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। আর পরীক্ষায় পাস করার পর পরই শাকিল প্রস্তাপ পাঠিয়ে বিয়ে করে এ বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসে। আমাদের ঘর আলো করে আসে মিষ্টি শিশু কন্যা। শাকিল নিজেই ওর নাম রাখে সাবা। অথচ সেই শাকিলই কিনা পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছে। তাও ওর চেয়ে বয়সে একটা বড় মহিলার সাথে। কথাটা ভাবতেই প্রচণ্ড ঘৃণা লাগছে। কি করে পারলো শাকিল এমনটা করতে।

আমার শাশুড়ি মা উঠানের মাঝে বসে কান্না করছে। এ কান্নার কারণ আমি জানি। সে আমাকে নিজের মেয়ের মত করেই ভালোবাসেন। আমাদের সংসারে কোন কিছুরই কমতি ছিলো না। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিলো আমাদের সংসার। কিন্তু কোথায় থেকে কি হলো তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি দুই বছরের সাবাকে কোলে নিয়ে। মা উঠানের মাঝে বসেই কান্না করছে আর শাকিলকে নানান রকম অভিশাপ দিচ্ছে। এর মাঝেই বাড়িতে অনেক লোকের ভিড় জমে গিয়েছে। সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। গ্রামের কিছু বয়স্ক মহিলারা আমাকেও কথা শুনাতে ছাড়ছে না। কেউ কেউ ভেংচি কেটে বলছে এতো রূপ যৌবন দিয়ে কি হবে। যে যৌবন দিয়ে স্বামীকে আটকিয়ে রাখা যায় না। শাশুড়ির সামনে এমন কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা। ইচ্ছে করছিলে চিৎকার করে কান্না করি। কিন্তু কেন জানি আজ আমি কান্নাও করতে পারছিলাম না।। আমার দু’চোখ শুধু অসংখ্য মানুষের মাঝে একটা প্রিয় মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে। রত্না ওরা যা বলছে সব মিথ্যা বলছে। আমি এমন কোন কিছুই করিনি। তুমিতো জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি।

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সত্যি সত্যিই শাকিল মধ্য বয়স্ক একজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকেছে। লোকজন ছিঃ ছিঃ করতে করতে বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করেছে। আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। রাগে না কষ্টে আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমার কি করা উচিৎ তাও আমি বুঝে উঠতে পারছি না। কোলে থাকা সাবাও তার বাবাকে দেখে কান্না করতে শুরু করেছে। আর শাকিল সে মহিলার হাত ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির উঠানের মাঝে। পাশেই আম্মা কান্না করে চলেছে। আমি তারমত করে কান্নাও করতে পারছি না। হয়তো এতোটাই আঘাত লেগেছে যে আমি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছি। আর কার জন্যই বা কাঁদবো? যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি তার জন্য? নাকি যে এতো ভালোবাসার পরেও অন্য কাউকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছে তার জন্য?

কিছুক্ষণ আগেও বাড়ি ভর্তি লোকজন ছিলো আস্তে আস্তে সকলে চলে গিয়েছে। নিজের খেয়ে মানুষ কতইবা আর অন্যের বাড়ি পাহাড়া দিবে। দিনের বেলা গ্রামের সকলেরই কমবেশী কাজ কর্ম রয়েছে। বাড়িতে কেবল আমরা পাঁচ জনই রয়ে গিয়েছি। আমি মাথা উচু করে একবার শাকিলের দিকে তাকালাম, সে এখনো নিষ্পাপ শিশুর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি দরজার সামনে থেকে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। আমাকে দেখে মহিলাটা মাথায় শাড়ির আঁচলটা আরও একটু টেনে নিলো। এমন নেকামো দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছিলো। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে শাকিলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। অসংখ্য প্রশ্ন করার থাকলেও আমার মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছে না। বোবার মত দাঁড়িয়ে আমি শাকিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছি।

শাশুড়ি আম্মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো বউ মা ওরে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলো। এ বাড়িতে ওর কোন জায়গা নেই। ওর মত সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে কেন আমি মরে গেলাম না। মির্জা বাড়ির এতো দিনের মান সম্মান সব ধূলোয় মিশে গেছে। তোমার শ্বশুড় বেঁচে থাকলে এতো সময়ে এমন পোলারে কেটে টুকরো টুকরো করর নদীতে বাসাইয়া দিতো। এমন সন্তানের মুখ আমি আর দেখতে চাইনা। কথাটা বলেই উনি শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলে। আমি সাবাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছি।

হঠাৎ করেই মহিলাটা আমার পা জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আমি যথা সম্ভব নিজেকে সারিয়ে নিলাম। একি করছেন আপনি।

আপা, আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে, ক্ষমা করে দিন। আমার আপনার বাড়ির ঘরে তুলতে হবে না। যে কোন জায়গায় একটু থাকার জায়গা দিন। আপনার পায়ের কাছে তাহলেই হবে।

মহিলার অভিনয় দেখে আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। আসলে সে যে অভিনয় করছে তা বুঝতে আমার বিন্দু পরিমাণও দেরী হয়নি। তবুও সে আমার স্বামীর বিয়ে করা স্ত্রী, আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরে মাটি থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালাম। তারপর তাকে ধরে নিয়ে আসলাম আমার ঘরের দরজার সামনে। আপনাকে বাহিরে থাকতে হবে না। আজ থেকে এটা আপনার ঘর। আপনারা দু’জন এই ঘরে থাকবেন।

আমার কথা শুনে শাশুড়ি দৌঁড়ে এসে বলতে শুরু করলেন। বউমা এসব তুমি কি বলছো? এটা তোমার ঘর, তুমি এ ঘর ছাড়তে পারো না। আর ওরা এবাড়িতে থাকতে পারবো না।

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে আম্মা আপনি যে কি বলেন। যে মানুষটাই আমার না সে ঘরটায় থেকে আমি কি করবো।

কথাটা বলার পর আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তি আমার শরীরে অবশিষ্ট রইলো না। আমি সাবাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়ে পাশের গেস্ট রুমে চলে আসলাম। দরজাটা বন্ধ করে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। সকাল থেকে যে কান্না আটকে রেখেছিলাম এই সন্ধ্যায় সে আর চোখের মাঝে আটকে থাকলো না। মুহুর্তেই যেন আমার জীবন থেকে সব সুখ শান্তি শেষ হয়ে গেলো।

নিজের হাতে সাজানো ঘর, নিজের ভালোবাসার মানুষ আজ সব কিছুই আমার পর হয়ে গেলো। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করলেও আমি চিৎকার করে কান্না করতে পারছি না। মানুষ কত সহজেই বদলে যেতে পারে তা শাকিলের এমন পরিবর্তন না দেখলে আমি ভুল করেও বুঝতে পারতাম না। অথচ এই এতো গুলো বছরে আমি ভুল করেও বুঝতে পারিনি। এই ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। নারী দেহ লোভী একটা বন্ড প্রতারক। যে মানুষটাকে এতোটা বিশ্বাস করেছিলাম, সেই মানুষটাই সব চেয়ে বেশী ধোকা দিলো আমাকে। বিশ্বাস ভেঙে চূরমার করে দিলো নিমিষেই। একটা মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে এমনটা করতে পারে। কতটা জগন্য হলে ঘরে স্ত্রী থাকতে অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারে। তা এই শাকিলকে দেখে কেউ ভুলেও বুঝতে পারবে না। ভালোর মুখোশে সে একজন শয়তান। এতোদিনে আজ আমি বুঝতে পারছি।

আমাদের বিয়ের বয়স পাঁচ বছর তার আগে প্রায় এক বছর আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো। সব কিছু তুচ্ছ করে আজ সে অন্য একজনকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছে। যে মানুষটার কাছে ভালোবাসার কোন মূল্য নেই সেই মানুষকে ঘৃণা করা যায়। কখনোই ভালোবাসা যায় না। অথচ এই মানুষটাকেই আমি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে ভালোবেসে এসেছি।

কিন্তু আমার কি অপরাধ ছিলো, আমি কি অন্যায় করেছি যার জন্য আমাকে এতোটা কষ্ট পেতে হচ্ছে? সেই ছোট বেলাতে বাবা মাকে হারিয়েছি। বাবা মায়ের আদর কেমন হয় তাও আমি বুঝতে পারিনি। চাচা চাচীর সংসারে বড় হয়েছে। চাচা চাচীও কখনো আমাকে এতোটা আঘাত করেনি। যতটা আঘাতে আজ আমার হৃদয়টা ভেঙে চূরমার হয়েছে। যাকে জীবনের সব কিছু ভেবে ছিলাম। সেই মানুষটাই আমার সাথে প্রতারণা করলো।

কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসলো। আমি সাবার দিকে তাকালাম নিশ্চিন্তে সে ঘুমাচ্ছে। মেয়েকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে বাহিরে বের হয়ে আসলাম। পাশের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজা লাগানো। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো। এই সেই ঘর যে ঘরে আমি আর শাকিল থাকতাম আজ সে ঘরে শাকিল অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে হয়তো সে আমাকে যেভাবে ভালোবাসতো তাকেও একই ভাবে ভালোবাসছে। ছিঃ ছিঃ কি সব ভাবছি আমি।

দ্রুত সেখান থেকে সরে ওয়াশ রুমে এসে ওযু করে নিলাম। দ্রুত নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে জায়নাম বিছিয়ে নিলাম। নামায শেষ করে দু’চোখ বন্ধ করে, আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মুনাজাতে বসে পড়লাম। হঠাৎ করে মনে হলো কেউ একজন আমাকে বলছে।

“নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী” [সূরা আনফাল:৩০]

সাবা বিছানা থেকে কান্না করে উঠলো। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে আসে পাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে জায়নামায থেকে উঠে দাঁড়ালাম।

চলবে…