হারানো সুর পর্ব-০৬

0
297

#হারানো_সুর- ৬ষ্ঠ পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

ট্রেন এগিয়ে চলছে নিজের মত করে, নিজের গতিতে। চের চেনা শহরটা ছেড়ে দূর বহুদূরের কোন এক অজানা শহরের উদ্দেশ্যে। মেয়েটাকে বুকের সাথে লাগিয়ে ধরে জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে রয়েছি। কত দ্রুতই না ট্রেন ছুটে চলছে, মুহুর্তে সব কিছু পিছু পরে যাচ্ছে।

কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা সব ফেলে আমি ছুটে চলছি অজানা শহরে। অনিশ্চয়তায় ভরা এক শহরে, যার নাম ঢাকা শহর, যেখানে নাকি কাজের অভাব নেই, যেখানে নাকি টাকার অভাব নেই। সব
আধুনিক কল কারখানা, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, ভার্সিটি। সব কিছুই রয়েছে এই স্বপ্নের শহরে। তবে এখানে নিজেকে সামলে, বেঁচে থাকাটাই সব চেয়ে কষ্টকর ব্যাপার। এখানে বাঁচতে হলে প্রতি মুহুর্তে লড়াই করে বাঁচতে হবে, ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচতে শিখতে হবে। সব কিছুই জানা আছে। তবুও ভয় আর ভয়ে চারিদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসছিলো।

রাত দশটার সময় ট্রেন ঢাকার কমলাপুর এসে থামলো। এতো রাতে কোথায় যাবো কি করবো কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চেনা জানাও কেউ নেই এই শহরে। শরীর ও বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে রেল লাইন থেকে বের হয়ে বড় ফ্লাইওভারটার উপরে যেয়ে উঠে, মাঝ বরাবরা এসে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পরলাম। বাতাসে ক্লান্ত শরীর কিছুটা হালকা হচ্ছে। এক অন্য রকম প্রশান্তি খেলে যাচ্ছে মনের ভিতর। এতো সময় যে দম বন্ধ দম বন্ধ ভাব লাগছিলো তা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে মাথা ব্যথাটা এখনো কাটেনি।

হঠাৎ করেই অচেনা এক কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, কিরে যাবি নাকি? আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। পেছনে ঘুরে তাকে দেখার মতও আমার সাহস হচ্ছে না। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

কণ্ঠটা আরও একটু কাছে এসে আবার বলতে শুরু করলো চল আজ রাতের জন্য আমার সাথে রেট বাড়াইয়া দিমুনি। তোর ভালোই পুষাইবো, দুইজন আছি আমরা।

আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে ঘুরে বললাম, ভাই আপনার ভুল হচ্ছে, আপনি যাকে ভেবেছেন আমি সে না।

লোকটার মুখ দিয়ে নেশার প্রচন্ড রকম বাজে গন্ধ বের হচ্ছিলো। সে আমার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলছিলো, তুই খুব সুন্দরি আরও পাঁচশত টাকা বাড়িয়ে দিবো। চল আজ রাতে মজা দিবি।

আমার চোখ দু’টো জলে ভিজে উঠলো, আমি বুঝতে পারলাম এরা আসলে এভাবে যাবে না। তাই নিজেকে শক্ত করে আমার দিকে এগিয়ে আসা তার হাতটা শক্ত করে ধরে। মোচড় দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম। হারামজাদা ঘরে মা বোন নেই? রাস্তা ঘাটে যাকে দেখবি তাদেরই তোদের বাজারের মেয়ে মনে হয়। কুত্তার বাচ্চা আর কোন দিন যদি আমার চোখের সামনে পড়েছিস তবে হাত ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিবো।

লোকটা ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেলো। অনেক রাত ওভারব্রীজের উপর দিয়ে দুই চারজন যারা চলাচল করছিলো তারা আমার চিৎকারে কিছুটা ভয় পেয়ে দূর দূর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

রাগে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর তখনো কাঁপছিলো। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্রীজের মাঝ বরাবর এক সাইডে চেঁপে বসে পরলাম। শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। কোথাও হেঁটে যাবো তেমন শক্তি ও পাচ্ছি না, সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে শরীর প্রচন্ড দূর্বল হয়ে গিয়েছে। সারাদিন ট্রেনে বসে থাকার কারণে শরীরের জামা কাপড় সব ময়লা হয়ে গিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এই মুহুর্তে আমাকে ঠিক ভালো ঘরের মেয়ে মনে হচ্ছে না।

অল্প সময়ের ভিতর চারিদিক বেশ নিরব হয়ে গেলো। সব কিছু ভুলে দু’চোখে কিছুটা তন্দ্রা ভাব এসে গেলো। এমন সময় হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচিতে তন্দ্রা ভাব কেটে যাচ্ছিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন মাথার চুল টেনে ধরলো। ব্যথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। মনে হচ্ছিলো ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাবে। দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে পরছে। আমি বার বার চিৎকার করে বলছি আমাকে ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি আমার মেয়েটা পরে যাবে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে টেনে চলেছে।

আমি মনে মনে বলে চলেছি একেই বুঝি বলে মরার উপর খাড়া ঘা। আল্লাহ যখন বিপদ দেন তখন চারিপাশ থেকে বিপদ দেন। সারাদিন জার্নি করে মাথা যে পরিমাণ ব্যথা হয়েছিলো তার চেয়ে কয়েক গুন বেশী ব্যথা হয়ে গেলো। সাবা কোলের ভিতর থাকা অবস্থায় কান্না করে দিলো। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে রেখেছি।

হঠাৎই কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো। তোদের কতদিন বলছি না, এই ব্রীজের উপর অবৈধ ব্যবসা করবি না? তারপরেও তোরা কেন এসব করিস একটাকেও ছাড়বো না। আজ সব কয়টাকে ধরে থানায় নিয়ে যাবো।

কথাটা শুনে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছিলো থানায় নিয়ে গেলে আমাকে কে ছুটিয়ে আনবে? মিথ্যা মামলায় আমার জেল হয়ে গেলে আমার সাবাকে কে দেখে রাখবে? এসব ভাবতে ভাবতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে যে মহিলা পুলিশ আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো তাকে একটা ধাক্কা মেরে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিলাম। এরপর ছুটে চললাম সেই অফিসারের দিকে, তার সামনে যেয়ে মাথাটা তুলে তার মুখের দিকে শুধু এক নজর তাকালাম। তারপর মাথাটায় চক্কর দিয়ে উঠলো আর আমি ব্রীজের উপর পরে গেলাম।

পরদিন সকাল সাড়ে দশটার সময় চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে সাবাকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন এক ভদ্র মহিলা। আমার মাথাটা তখনো প্রচন্ড ব্যথা করছিলো, চোখে তখনো ঝাপসা দেখছিলাম। আমি কোন রকমে চোখটা বন্ধ করেই সেই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললাম মা আমি কোথায় আছি?

ভদ্র মহিলা, আমার মাথায় হাত রেখে বললো, তুমি নিরাপদেই আছো, তোমার কোন ভয় নেই। তোমার মেয়েও ভালো আছে। তুমি আরও কিছু সময় রেস্ট করো। ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলো। তোমার শরীর নাকি খুবি দূর্বল। তুমি আরও কিছু সময় ঘুমিয়ে নাও। তারপর সব জানতে পারবে তুমি কোথায় আছো।

উনার কথায় আমি চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। উনি সত্যি কথাই বলেছেন ডাক্তার আমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে, যার প্রভাবে আমি ঠিকমত চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আবার দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম, মিনিট দুয়েকের ভিতর আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো দুপুর দুইটার দিকে সেই মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে এখন সব কিছু পরিষ্কার। মাথা ব্যথাটাও এখন একদম নেই, তবে শরীর এখনো অনেক দূর্বল। উনি সাবাকে কোলে নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো এখন কেমন লাগছে? আমি মাথা নেড়ে জানালাম ভালো লাগছে, তবে শরীর খুব দূর্বল।

উনি আমার দিকে সুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো খেয়ে নাও ভালো লাগবে।

আমি একটু উঠে বসে উনার হাত থেকে সুপের বাটি নিয়ে একটু একটু করে খেতে খেতে উনাকে প্রশ্ন করলাম মা আমি এখানে কি করে এসেছি?

মা, একটু হেসে তুমি কি পুলিশ খুব বেশী ভয় পাও?

আমি না ঠিক ভয় পাই না, কিন্তু গতরাতে যা যা হয়েছে আমি উনাকে সব খুলে বললাম। মা সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো দেশে ক্রাইম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নেশা করার জিনিস গুলো খুব সহজে মানুষ হাতে পেয়ে যাচ্ছে। আর এগুলো বেশী বিক্রি হচ্ছে বস্তি গুলো আর ফুটপাত ওভার ব্রীজের উপরে। তাই গতরাতে আমার ছেলে এস আই জাহাঙ্গীর আর তার টিম ঐ ব্রীজের উপর রেট দেয়। ঐ ঘটনার সময় হঠাৎ করে তুমি তার সামনে যেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পরে যাও। এরপর সে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে ডাক্তার খবর দেয়, ডাক্তার এসে তোমাকে দেখে ঔষধ দিয়ে যায়। আমার ছেলেটা পুলিশ হলে কি হবে মনটা খুবি নরম। তোমার এমন অবস্থা দেখে ভয়ে সেও সারা রাত ঘুমায়নি।

মায়ের কথা শুনে, আমার রাতের শেষ দিকের ঘটনা গুলো মনে পরছিলো। যখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাবাকে কোলে নিয়ে আমি ছুটে এসেছিলাম। সেই কণ্ঠের কাছে। তখন আর দু’চোখ খোলা রাখদে পারছিলাম না। শেষ মুহুর্তে যখন আমি সেই চেহারাটা দেখেছিলাম, তখন সুন্দর একজন মানুষকে আমি দেখেছিলাম। এরপর কিছু বলার আগেই আমি মাথা ঘুরে ব্রীজের উপর পরে যাই।

মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো তুমি খেয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার মেয়েকে দেখে রাখি ও তো খুবি ভালো একটা মেয়ে একটুও জ্বালাতন করে না। আমার শরীর এতোটাই দূর্বল ছিলো যে আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক বুঝিয়ে দিলাম। অথচ মেয়েকে আমার বুকের মাঝে নিয়ে শুয়ে থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু তা আমি পারলাম না। আমি কোন রকমে সুপটা খেয়ে শেষ করে পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে খাটের সাথে মাথাটা লাগিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম।

#চলবে…