হারিয়েছি নামপরিচয় পর্ব-০৪

0
227

#হারিয়েছি_নামপরিচয়
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা মনি

মেঘলাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় মুন্নি। গোলাপি রঙের বেনারসি শাড়ি, খোপায় বেলি ফুল, সুসজ্জিত গহনায় খুব সুন্দর লাগছিল মেঘলাকে। মুন্নি মেঘলাকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে বলে,
‘দেখেছ আমার হাতের যাদু। তুমি তো দেখতে এমনিতেই অনেক সুন্দর। এখন তো আরো সুন্দর লাগছে। আমি তো বেচারা রিফাত ভাইয়ার কথা ভাবছি। তোমাকে এই রূপে দেখে বেচারা হার্ট এট্যাক না করে।’

‘কি যে বলো না তুমি,,’

‘ঠিকই তো বলছি। তুমি শুধু সুন্দরী নও তুমি মায়াবীও। আমি মেয়ে হয়েও তোমার রূপের মায়ায় পড়ে যাচ্ছি। সেখানে রিফাত ভাইয়া তো ছেলে। ইশ যদি আমি ছেলে হতাম তাহলে তোমাকেই বিয়ে করতাম।’

‘এভাবে বলো না আমি লজ্জা পাচ্ছি।’

‘আমার লজ্জাবতী ভাবি। আচ্ছা চলো এখন ভাইয়ার রুমে তোমাকে দিয়ে আসি। না জানি বেচারা হয়তো বউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কি অবস্থা হয়েছে। এতো সুন্দরী বউ থাকলে ছেলেদের যে কি হয়!’

মেঘলার ফর্সা গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিন্তু মুহুর্তেই তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মনে পড়ে সে একটা ঠকবাজ। রিফাতকে, তার পরিবারকে সবাইকে সে ঠকিয়েছে। সবাই ভাবছে সে রোদেলা। অথচ সে মেঘলা! না আর এইরকম অভিনয় করা তার দ্বারা সম্ভব নয়।

মেঘলা ঠিক করে নেয় আজ বাসর ঘরের রিফাতকে সব সত্য বলে দেবে। তারপর যা হবার হোক। এভাবে মিথ্যা অভিনয় করতে তার আর মোটেও ভালো লাগছিল না।

মুন্নি মেঘলাকে ভাবুক দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কি এত ভাবছ ভাবি?’

‘তেমন কিছু না।’

‘বুঝি বুঝি আমি সব বুঝি। বাসর রাত কিভাবে কা’টাবে সেসবই ভাবছ তাইতো? দেখো আজ তুমি অনেক মজা পাবে। অল দা বেস্ট।’

মুন্নির কথা শুনে এত চিন্তার মাঝেও মেঘলার হাসি পেয়ে যায়। মেঘলাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে দেখে মুন্নির চোখ জুড়িয়ে যায়।

‘তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর ভাবি। রিফায় ভাইয়া সত্যি খুব লাকি যে তোমার মতো একটা বউ পেয়েছে। আচ্ছা এখন চলো। আর একটা কথা, বরকে পেয়ে এই ননদের কথা আবার ভুলে যেওনা। আমার জন্যে দোয়া করিও আমি যেন আরমান খানের বউ হতে পারি।’

মেঘলা বলে,
‘আচ্ছা করবো তোমার জন্য দোয়া।’

৭.
মুন্নির হার ধরে সুসজ্জিত বাসর ঘরে প্রবেশ করে মেঘলা। মুন্নি মেঘলাকে বিছানায় গিয়ে বসিয়ে দেয়। পুরো ঘর জুড়ে জবা ফুলের দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেঘলা বেশ অবাক হয়ে যায় এটা দেখে যে গোলাপ নয় জবা ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজানো। মুন্নিকে জিজ্ঞেস করে,
‘বাসর ঘর জবা ফুলে সাজানো কেন?’

‘তোমার পছন্দ হয়নি ভাবি? ভাইয়া তো জবা ফুল খুব পছন্দ করে তাই এভাবে সাজানো হয়েছে।’

‘খুব সুন্দর হয়েছে। জবা ফুল তো আমার খুব ভালো লাগে।’

‘আচ্ছা তুমি এখানে বসে থাকো আমি যাচ্ছি। আর হ্যা বেস্ট অফ লাক এগেইন।’

বলেই দুষ্টু হেসে মুন্নি রুম থেকে চলে যায়। মেঘলা বেচারি রিফাতের অপেক্ষায় বসে থাকে।


মেঘলা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। অথচ রিফাতের আসার কোন নামগন্ধ নেই। এভাবে থাকতে থাকতে রাত ১২ টা বেজে যায়। মেঘলার খুব ঘুম পাচ্ছিল। সে আর চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। তাই বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ্যের ঘুম এসে তার চোখে ধরা দেয়। মেঘলা তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।

কেউ এসে মেঘলার চুলের মু’ঠি টেনে ধরে। মেঘলা তাকিয়ে দেখে রিফাতকে। রিফাত মেঘলার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। রিফাত মেঘলাকে বলে,
‘ঠকবাজ মেয়ে। তোমার সব সত্য আমি জানতে পেরেছি। মিথ্যা বলে আমায় বিয়ে করা। আজ আমি তোমাকে দেখাবো কত ধানে কত চাল।’

বলেই মেঘলাকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে যায়। মেঘলা চিৎকার করে বলতে থাকে,
‘আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ইচ্ছা করে এমন করিনি। আমার খুব লাগছে।’

রিফাতের কানে যেন মেঘলার কোন কথাই যাচ্ছিল না। সে আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মেঘলার একটা দফারফা করবেই করবে।

রিফাত মেঘলার ধা’ক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

সাথে সাথে মেঘলা চিৎকার করে ওঠে এবং তার ঘুম ভেঙে যায়। মেঘলা চারপাশে তাকিয়ে দেখে সবকিছু ঠিক আছে। হাফ ছেড়ে বাচে মেঘলা।

‘যাক তাহলে এটা একটা স্বপ্ন ছিল। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। সবকিছু তো ঠিকই আছে। কিন্তু রিফাত কোথায়? ও কি এখনো আসেনি?’

মেঘলার এসব ভাবনার মধ্যেই রিফাত হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে যায়। মেঘলা ভয়ে ঘেমে গিয়েছিল। রিফাতকে দেখে আরো একদফা ভয় পেয়ে যায়।

রিফাত মেঘলাকে এত ভীত দেখে প্রশ্ন করে,
‘তোমার কি সমস্যা হয়েছে? নিচ থেকে তোমার চিৎকার শুনে ছুটে এলাম। কোন খারাপ স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছ নাকি?’

মেঘলা জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘জ্বি, একটা খুবই খারাপ স্বপ্ন। যাইহোক আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’

‘আসলে একটা জরুরি মিটিংয়ে আটকে গিয়েছিলাম। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল। তুমি কি আমাকে মিস করছিলে?’

মেঘলা কথাটা শুনে বেশ লজ্জা পায়। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না। রিফাত মেঘলার পাশে এসে বসে।

‘এখন আর মিস করতে হবে না। আমি এসে গেছি।’

মেঘলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিফাত বলে,
‘আমি জানি আজ আমাদের বাসর রাত। কিন্তু আমি চাইছি না আজ আমাদের মধ্যে কিছু হোক। আই থিংক তোমার কিছু টাইম লাগবে। আমি চাই তোমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে। তুমি শুধু আমাকে তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ দিও।’

মেঘলা একরাশ বিস্ময় নিয়ে রিফাতের দিকে তাকায়। আজকাল এত ভালো মানুষও হয়!

৮.
রিফাত মেঘলাকে নিয়ে তাদের বাড়ির ছাদে এসেছে। আজকের রাতটা একটু অন্যভাবে কা’টাতে চায় সে। মেঘলা গায়ে একটা শাল জড়িয়ে এসেছে। শীতের রাত কুয়াশায় ঢাকা। এই কুয়াশা চাদকেও ঢেকে দিয়েছে। তাই তো পূর্ণিমার চাদকেও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না।

মেঘলার খুব পছন্দ পূর্ণিমার চাদ। আজ তাই রিফাতের ইচ্ছা অনুযায়ী তার সাথে চন্দ্রবিলাশ করতে চলে এলো। আজ মেঘলার উপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝও নেমে গেল। সে ভেবেছিল যেহেতু রিফাত ভাবছে বিয়েটা রোদেলার সাথে হয়েছে তাই তার সাথে মিলন করা ঠিক হবে না। কোন মেয়েই বা চায় যে তার স্বামী তাকে অন্যকেউ ভেবে ভালোবাসুক। আজ চাদকে সাক্ষী রেখে মেঘলা প্রতিজ্ঞা করে,
‘আমি একদিন ঠিকই আপনাকে সব সত্য বলব। কিন্তু সেইজন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আমায়। আমি জানিনা আপনি সব সত্য জেনেও আমায় মেনে নেবেন কিনা। তবুও আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব।’

রিফাত মেঘলাকে বলে,
‘জানো রোদেলা আমার অনেকদিন থেকে ইচ্ছা ছিল এভাবে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চন্দ্রবিলাশ করবো। আজ আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। আমার যে কত ভালো লাগছে, সেই অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছি আমি। তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আজ থেকে দুবছর আগে এরকমই একটা পূর্ণিমার রাতে। তুমি একা রাতে বাড়ি ফিরছিলে বৃষ্টিতে ভিজে। সেদিন আমি তোমাকে দেখামাত্রই তোমার প্রেমে পড়ে যাই। মন থেকে শুধু তোমাকেই চেয়েছি সবসময়। সেদিন তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েও পাইনি পরে খোজ নিয়ে জানি তোমার ব্যাপারে।’

রিফাতের কথাগুলো শুনে মেঘলার চোখে জল চলে আসে। তার মানুষ রিফাত আগে থেকে রোদেলাকে ভালোবাসে। অথচ সে এই বিয়েটা করে নিয়ে রিফাতকে ঠকালো।

মেঘলার চোখের লেন্সটা হঠাৎ কোথাও পড়ে যায়। যেহেতু সে এখন রোদেলা সেজে আছে তাই চশমা পড়তে পারবে না৷ এই কারণে তার মা তাকে লেন্স দিয়েছিল।

মেঘলা অন্ধকারে লেন্সটা খুজতে থাকে। মেঘলাকে এভাবে কিছু খুজতে দেখে রিফাত বলে,
‘কি খুজছ তুমি এভাবে?’

মেঘলা ভাবছিল রিফাতকে লেন্সের কথা বলা ঠিক হবে কি না। রিফাত যদি সন্দেহ করে। মেঘলা কিছু বলার আগেই রিফাত লেন্সটা দেখতে পায় এবং তুলে নেয়। মেঘলাকে দেখিয়ে বলে,
‘এটা খুজছিলে? তুমি লেন্স ব্যবহার করো জানতাম নাতো।’

মেঘলা লেন্সটা হাতে নিয়ে তারপর চোখে লাগিয়ে তড়িঘড়ি করে রুমের দিকে চলে যায়। রিফাত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨