হিয়ার মাঝে পর্ব-১৫+১৬

0
191

#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ১৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩২,
“একটু বাইরে আয়, কথা আছে।”

হিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় রায়া। এরপর হাটা ধরে ছাদের দিকে। হিয়া নাতাশাকে বলে পিছু পিছু যায় বোনের। রায়া ছাদে এসে রেলিং এ হাত রেখে একটু হেলান দিয়ে দাড়ালো। হিয়া রায়ার পাশেই রায়ার মতো করে দাড়ায়। রায়া চুপচাপ সন্ধ্যার আকাশে নেমে আসা অন্ধকার দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। হিয়া মনে ভয় আর সংশয় নিয়ে দাড়িয়ে আছে বোনের পাশে। রায়া কিছু বলছেনা দেখে হিয়া বলে উঠে,

” কি রে আপু? ডেকে এনে চুপ করে দাড়িয়ে আছিস যে?”

” লুইস সু”ইসা’ইড করার চেষ্টা করেছে। জানিস তুই? আমার ধারণা তুই জানিস। সত্য টা বলবি হিয়া।”

রায়া হিয়ার কথার প্রতিত্তোরে হিয়ার দিক হয়ে দাড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। রায়া বোনের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। সবাই চলে যাওয়ার পর রায়া ফোন হাতে নিয়ে মেসেন্জারে ঢুকতেই এলভিনার মেসেজ দেখেছে সে। এরপরই হঠাৎই বাবা মায়ের চলে যাওয়ার কারণটাও ধরতে পারে৷ হিয়া বিষয় গুলো জানে কিনা এটা যাচাই করতেই সে হিয়াকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

হিয়া বোনকে কখনও মি’থ্যা বলেনি এ যাবত। সেখানে বোনের চোখে চোখ রেখে মি’থ্যা বলতে চাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সে একটু হলেও ধারণা করেছে এলভিনা হিয়ার কাছে মেসেজ দেওয়ার আগে রায়াকেই মেসেজ করেছিলো। আজ হয়তো রায়া তার ফোন চেক করেছে। নয়তো রায়া এ ব্যাপারে জানার কথা না। হিয়া আনমনে এসব ভেবেই রায়াকে কাঁপা স্বরে উত্তর দেয়,

” হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু তুই আরেকটা কথা তো জিগ্যেস করলি না আপু? ”

” অন্তরের কথা?”

” হ্যাঁ।”

” মিঃ শাহীন চৌধুরী আর মিসেস অন্তরা চৌধুরী গেলেন তো। উনাদের ছেলে ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবে। মাঝ খান দিয়ে সে।”

আর কিছু বলতে পারলোনা রায়া। চোখ বন্ধ করে নিলো। ছাদের রেলিং ঘেষে বসে পরলো। গায়ের ওরনা টা একপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। হিয়া বোনের এভাবে ভেঙে পরা দেখে নিজেও বোনের কাছে বসে জড়িয়ে ধরে৷ নিজেও কেঁদে ফেলে রায়াকে ধরে৷ রায়া এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেঁদে কেঁদে বললো,

” হিয়া, বোন রে! ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচতেই পারবোনা অ’প”রাধ বোধে। আমিও ম”রে যাবো। মানুষ বলে শেতাঙ্গরা একজন চলে গেলে অন্য জনকে আকড়ে ধরে। ও কেনো পারলোনা বোন? ওর এতো ভালোবাসা তো আমার কা’ল হয়ে দাড়ালো। আমি চাইলেও আর নিজেরে নিয়ে ভাবতে পারবো না। ঐ শাহীন চৌধুরী আর অন্তরা চৌধুরী তিনটা জীবন ন’ষ্ট করলো। রাদ মানুষ টা কিছু না করেও সারাজীবন ক’ষ্ট পাবে। আমি মানতে পারবো না রে হিয়া।”

“ওনারা আমাদের বাবা মা আপু। এভাবে নাম নিও না।”

হিয়া বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটা বললো৷ রায়া ঝট করে হিয়াকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। সে বললো,

” আজ থেকে আমার কোনো বাবা মা নাই। বাবা মা সন্তানের ভালো চায়, কেমন ভালো চায় বুঝলাম না আমি। ক’ষ্ট পেয়েই ভেতরে ভেতরে দ’ম আটকে রোজ ম”রে যাচ্ছি৷”

হিয়া বোনকে কি বলে শান্তনা দিবে! ভাষা পেলোনা। রায়া চোখের জল মুছে ওরনা কাঁধের একপাশে ফেলে এলো পায়ে ছাদ ছাড়লো। হিয়াও উঠে দাড়ালো। পাথরের মতো দাড়িয়ে বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু বোনের পিছনে আর গেলো না। রায়াকে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য একা ছেড়ে দিলো। সে জানে তার বোন একটু পর নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যাবে। তার বোনের ধৈর্যশক্তি অনেক। ছোটোবেলা বাবা মাকে কাছে না পেলেও বোনকে দেখেছে সে, নিজেকে সামলে হিয়াকেও সামলে নিতে। হিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস তার বোন এসবের ট্রমা ঠিক কাটিয়ে উঠবে। হিয়াও ছাদ থেকে নাতাশার রুমে চলে আসলো।

৩৩,
ডাইনিং টেবিলে ডিনার করতে বসেছে সবাই। এহসান মঞ্জিলের প্রতিটা সদস্য বসেছে খেতে। প্রথমে মিসেস কল্পনা আর আনিকা সার্ভ করে দিয়েছে। এরপর যে যার মনে যেটা দরকার পরছে নিয়ে খাচ্ছে। খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বলছেনা৷ মিঃ জাহিদুল এহসান এটা পছন্দ করেন না খাওয়ার সময় কেউ কথা বলুক৷ সাথে তিনি এটাও পছন্দ করেন না, বাড়ির সবাই খাবে, আর বাড়ির বউ-রা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কার কি লাগবে এগিয়ে দিবে। উনার কথা এক পরিবার, সবাই একসাথে বসে খাবে। সকালবেলা আর দুপুরবেলা কাজের সূত্রে কে কোথায় থাকে, ঠিক থাকে না। কিন্তু রাত্রীবেলা সবাইকেই একসঙ্গে হতেই হবে৷ খাওয়ার পর সবাই টুকটাক গল্প করে উঠে চলে যায় ঘুমাতে। আর শুক্রবারে বাড়ির ছেলেরা রান্না করে। পরের শুক্রবারে মেয়েরা রান্না করে। মিঃ জাহিদুল মনে করেন সংসারে পুরুষ মানুষদের যেমন কাজ সামলে একটা অবদান আছে, মেয়েরা সারা সপ্তাহ ছুটোছুটি করে রান্না করে, সংসার সামলায় তাদেরও একটু রেস্ট দরকার৷ সেজন্য মাসে চার শুক্রবারের দুই শুক্রবার বাড়ির সকল কাজ করার দায়িত্ব ছেলেদের, আর বাকি দুই শুক্রবার ছেলেদের রেস্ট করার জন্য ছাড় দেওয়া হয়। হিয়া খেতে বসার আগে নাতাশার মুখে কথাগুলো শুনেছে। শুনে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে তার। অথচ তাদের ছোট্ট পরিবার, কখনও এভাবে বসে খাওয়া হয়নি, হিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে খাওয়ার পাশাপাশি খাওয়ায় ব্যস্ত প্রতিটা মানুষকে দেখছে একটু পরপর৷ কি সুন্দর তাদের পরিবারের বাধন। হিয়া এভাবেই একবার দেখার ফাঁকে ইহসাসের দিকে চোখ পরতেই ইহসাস হিয়াকে চোখ মে”রে দেয়। হিয়া ভাতের লোকমা মুখে দিচ্ছিলো তখন। ইসাসের এহেন কাজে সে খাবে আর কি! তার হেচকি উঠে যায়। রায়া টেবিল ছেড়ে উঠে এসে বোনের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দেয়। সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে হিয়াকে নিয়ে। ইহসাস হিয়ার এই অবস্থা দেখে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আনমনে বিরবির করে, ‘এই মেয়ে সামান্য চোখ মা”রায় হেঁচকি তুলে যা তা অবস্থা করে ফেললো, একে বিয়ে করে বাসর করতে গেলে তো বাসর করেই হার্ট অ্যা”টাক করে আমায় জে”লে পাঠাবে৷ পুলিশ এসে বিয়ের রাতেই নববধু হ”ত্যার দায়ে ১৪গুস্টি সহ জে’লের ১৪শিকেয় তুলে ফেলবে৷ বাপরে কি ভয়ংকর ঘটনা৷’ ইহসাস ব্যাপারটা কল্পনা করেই ঝা’কি দিয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ পর হিয়ার হেঁচকি কিছুটা থামলে সবাই সবার চেয়ার বসে পরে। মিসেস সেলিনা হিয়াকে বলে উঠেন,

” সাবধানে খাবে তো আম্মু। দেখলে হেচকি উঠে কি অবস্থা হলো৷”

হিয়া মিসেস সেলিনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। উত্তরে কিছু বলে না। উনার কথার সাথে তাল মিলিয়ে মিসেস কল্পনাও বলেন,

” বড় ভাবী ঠিকই তো বললো আম্মু, খেতে বসে কোন চিন্তায় চলে গিয়েছিলে?”

হিয়া এবার চুপ করে থাকতে পারলোনা। দুজনের কথার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায়! সে হাসিমুখেই বললো,

” এতো উত্তেজিত হবেন না, আমি ঠিক আছি৷”

” খাওয়ার সময় শুধু খাবারের দিকেই মনোযোগ দিতে হয় মামনি, খাবার আল্লাহ তায়ালার এক অশেষ নেয়ামত, আমাদের রিযিকে যতটুকু খাবার আছে, ততটুকুই মনোযোগ সহকারে খেয়ে নিতে হয়। খাবার তো আমাদের বেচে থাকার মাধ্যম৷ খাবার সময় মনোযোগ দিয়ে খেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয় বুঝলে মামনি! এই সময় কথা বলা বা চিন্তা করা একদমই উচিত না৷”

মিঃ জাহিদুল এবার সুন্দর করে হিয়াকে বুঝালেন। হিয়া উনার কথার উত্তরে বললো,

” বুঝলাম আংকেল৷ মাথায় রাখবো।”

” শুধু মাথায় রাখলে চলবেনা, মানতেও হবে আম্মু।”

মিঃ রুবেল হিয়ার কথা শুনে কথাটা বললেন। হিয়া উনার কথাতেও বললো,

“জ্বি আংকেল অবশ্যই মানবো।”

হিয়া হাসিমুখে উনাকে উত্তর দিয়ে একবার ইহসাসের দিকে তাকালো। ইহসাসও হিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনের মাঝে চোখাচোখি হতেই, ইহসাস চোখ নামিয়ে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো ভাতের প্লেটে আঙুল দিয়ে আঁকাআকি করতে লাগলো আর লোকমা বানিয়ে ভাত মুখে দিচ্ছিলো। হিয়া তা দেখে নিজেও খেতে খেতে বিরবির করে বললো, ‘ ঢং দেখো, যেনো কিছুই করেনি। ব’দ একটা, যার জন্য এতোকিছু, সে এমন ভাব করছে যেনো কিছুই হয়নি। ব'”জ্জাত একটা।’ এরপর সে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রায়ার একটুও খেতে ইচ্ছে করছেনা, তবুও সবার সাথে বসায় ছোটো ছোটো গ্রাসে খাবার খেতে থাকে। সবার এতো অমায়িক ব্যবহার দেখে মনে মনে ভাবে, ‘কত সুন্দর একটা পরিবার, সবাই কতটা আদর ভালোবাসা দিচ্ছে। অথচ তার বাবা মা প্রতিটা মানুষকে ঠ*কিয়ে তার মনের অবস্থা লুকিয়ে,তাদের ছেলেকে মানতে পারবে কি না পারবে! সবকিছু লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলো।’ রায়া হতাশার শ্বাস ফে’লে। রাদ, রায়া,আনিকা,নাতাশা,ইহসাস চুপচাপ নিজেদের খাবার শেষ করে। শেষ করে উঠে হাত ধুতে যেতে ধরলেই মিঃ জাহিদুল বলেন,

” তোমরা সবাই হাত ধুয়ে এসে এখানে আবার বসো একটু। আমার কিছু কথা বলার আছে।”

ওরা সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করলো। কি কথা বলবেন উনি! আনিকা কৌতূহল দ”মন করতে না পেরে বললো,

” কি কথা বলবেন বাবা?”

” আগে হাত ধুয়ে এসো তোমরা। ”

সবাই বুঝলো হাত ধুয়ে না আসা অব্দি উনি বলবেন না। সবাই হাত ধুতে চলে গেলো।

চলবে?

#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ১৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৪,
হাসপাতালের কেবিনে বালিশে আধশোয়া হয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে এক যুবক৷ হাসপাতালের চার দেয়াল থেকে বের হওয়ার জন্য মনের মধ্যে ছটফট করছে তার। কিন্তু ডাক্তারের বারণ আর শরীরের অবস্থার দরুণ সে হাসপাতাল ছাড়তে পারছেনা। বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করে বাম পায়ের অবস্থা গুরুতর। বাম হাতেও ব্যান্ডেজ করা, হাত কে’টে, ড্রিংক করে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে আজ এই অবস্থা তার৷ তার-ই বা কি করার! মনে-প্রাণে যাকে ভালোবাসলো, সেই আজ থেকে একসপ্তাহ আগে কল করে জানিয়েছিলো, তার বিয়ে। তাদের মাঝে সবকিছু শে’ষ৷ ছোট্ট থেকে সম্পর্ক ভা’ঙা আর গড়ার যাতাকলে পরে নিজের জীবনে কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলা! এটা নিয়েই তো বিশ্বাস ছিলো না তার। জীবনে ২৭টা বছর সে দেখেছে বাবা আর মাকে একের পর এক জীবন সঙ্গী পাল্টাতে। বড় হয়েছে কখনও বাবার কাছে, কখনও মায়ের কাছে থেকে৷ আর নিজের চোখে দেখেছে বাবা আর মায়ের জীবনসঙ্গী বদলানো। আজ সে হাসপাতালে দেখে বাবা মা মিলেমিশে কতটা যত্ন করছে তার, কিন্তু সে সুস্থ থাকতে বড় হওয়ার পর কাউকে একসঙ্গে পেলো না৷ সে হওয়ার পরপরই বাবা মা আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে বাবা-মায়ের এরকম সম্পর্কের টানপোড়েন দেখে তবুও কিভাবে যে সম্পর্কে জড়িয়ে পরলো! জীবনে লক্ষ্য ছিলো যদি কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হয়, তাকে নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিবে। বাবা মায়ের মতো আলাদা হয়ে গড যদি তাদের সন্তান দেয়, সেই সন্তানকে কষ্ট পেতে দিবে না। যেমন কষ্ট সে নিজে পেয়েছে। নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী ভালো সে একজনকেই বাসলো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তাকে পাওয়া হলো না। ধর্মের দেওয়াল বাধা হয়ে দাড়ালো। সাথে বাধা হলো বাবা মায়ের আলাদা থাকার ব্যাপার। লাস্ট মোমেন্টে বাবা মা এক হয়ে তার জন্য ধর্ম পাল্টে নিতে চাইলেও! সেই মানুষ টাকে পাওয়া আর হলো না তার৷ মেয়েটির বাবা মা স্বদেশে নিয়ে জীবন-মৃ’ত্যুর মতো ফারাক সৃষ্টি করে দিলো। মৃ’ত্যুর পর যেমন ফিরে আসা যায় না, তাকে ফিরে পাওয়াও সম্ভব না। সেজন্য সেই মৃ’ত্যুকেই আলিঙ্গন করতে গিয়ে বেঁচে গেলো সে, সেই ভাগ্যের জোড়েই। কিন্তু এটা আদৌও বেঁচে থাকা হবে তো! নাকি রোজ রোজ তার কথা ভেবে, না পাওয়ার ক”ষ্টে বেচে থেকেও ম’রণ য’ন্ত্র’ণা পেতে হবে! চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো যুবকটির৷ মনের মধ্যে কেমন একটা অসহনীয় রকমের
তিক্ত ব্যথা। তার রেইনের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু রেইন কি আর কল ধরবে তার! রেইন যে এখন অন্য কারোর।

” লুইস?”

কারোর কন্ঠস্বরের আওয়াজে লুইস চোখ মেলে তাকালো। এলভিনা আর তার মাম্মাকে হাতে ফলমূল আর খাবারের বাটি দেখে সে মুচকি হাসলো। ইশ কত্ত যত্ন করছে তার মাম্মা তাকে। অথচ ছোট্ট বেলায় সে জ্বরের ঘোরে মা-কে খুজতো! স্কুলে প্যারেন্টস টিচার মিটিং এ মা বাবাকে একসঙ্গে উপস্থিত করতে না পারলেও বকা শুনতো কতো! অথচ তার মাম্মাকে সে পেতো না৷ এখনও হয়তো পেতো না, বা তার রেইনের জন্য তার মাম্মা পাপা ধর্মও পাল্টাতো না। শুধু তার জোড়াজুড়ি আর নিজেকে মে”রে ফেলার ভয় দেখিয়ে রাজী করেছিলো। কিন্তু শেষ ফলাফল, সেই শূন্যই রয়ে গেলো। লুইসের প্রাপ্তীর ঘর ছোটো থেকে শূন্য, সেখানে আর তার রেইনকে পেয়ে শূন্যর পাশে এক সংখ্যাটি বসানো হলো না। লুইস তার মা-কে দেখে ডান হাতে চোখ মুছে নিলো৷ তারপর হেসে মা-কে নিজেদের প্রচলিত ফরাসী ভাষায় বললো,

” বসো মাম্মা।”

লুইসের মা মিসেস লেনা কেবিন রুমে থাকা সোফায় বসলেন।ছেলের জন্য সবথেকে দামী কেবিন টাই বুক করেছেন মিসেস লেনা। কেবিন রুমে সবকিছুই আছে, যা একটা মানুষের জীবনে ব্যবহৃত হওয়ার মতো।এলভিনা দাড়িয়েই রইলো।

৩৫,
এলভিনাকে দাড়িয়ে থাকতে লুইস বললো,

” তুমি কেনো দাড়িয়ে আছো। প্লিজ বসো।”

এলভিনা সোজা গিয়ে লুইসের কেবিনের বেডে বসে পরলো লুইসের পায়ের কাছে। হাতে থাকা টিফিন বক্সে আনা খাবার বক্স খুলে বের করতে লাগলো। লুইস বাঁকা চাহনীতে এলভিনাকে একবার দেখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

” হসপিটালে যথেষ্ট খাবার দিচ্ছে মাম্মা। আবার এসব কেনো?”

” হাসপাতালের একঘেয়ে খাবার খেয়ে নিশ্চয় তুমি বিরক্তিত। সেজন্য মাম্মা ভালোবেসে রান্না করে এনেছি। না বলবেনা লুইস, আমি জানি তুমি ঠিকমতো খাচ্ছো না এখানকার খাবার।”

মিসেস লেনা উত্তর দেন লুইসের কথার। লুইস তার মাম্মা রান্না করেছে শুনে আর কিছু বললো না। যাক এই উছিলায় যদি মায়ের হাতের রান্না করা খাবার তার পেটে যায়! এলভিনা খাবার সাজিয়ে মিসেস লেনাকে বলেন,

“, আন্টি খাইয়ে দিন লুইসকে।”

মিসেস লেনা হাতের ফোন টা সোফায় রেখে খাইয়ে দিতে শুরু করেন নিজের ছেলেকে৷ খাওয়ানোর সময় মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকান ছেলের দিকে । তার রাজপুত্রের মতো ছেলেটার এক্সিডেন্টে কি অবস্থা হয়ে গেছে! চেহারার দিকে তাকানো যায় না৷ লুইসকে চামচ দিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো উনার। লুইস তা দেখে জিগাসা করে,

” মাম্মা! কাঁদছো কেনো? রেইন তো বলতো, বাচ্চাদের কিছু হলে বাঙালি মম’স-রা এভাবে কেদে ফেলে। কিন্তু তুমি তো বাঙালি নও মাম্মা।”

মিসেস লেনা রেইন নাম টা লুইসের মুখে শুনে বলে উঠেন,

” এই নাম টা আমার সামনে নেবে না আর লুইস। ”

” হুয়াই মাম্মা?”

” ইউ নো ভেরি ওয়েল, আই হেইট হার৷”

লুইস হেসে উঠলো তার কথায়। মিসেস লেনা ভড়কে যান। বুঝলেন না উনি, কি এমন বললো যে তার ছেলে হাসছে। তিনি লুইসকে প্রশ্ন করেন,

” তুমি হাসছো কেনো?”

” তোমার কথা শুনে মাম্মা।”

” হাসার মতো কি বলেছি আমি?”

” আজীবনই পাপাকে হেইট করলে, ফলে তোমাদের না পেয়ে বড়ো হলাম। যখন সেসব ক্ষ’ত আমার রেইন এসে ধুয়ে দিয়ে গেলো, তখনও তাকে তুমি ঘৃণা করলে৷ মানতে পারলেনা, পরে এমন সময় মানলে আমি হারিয়েই ফেললাম তাকে। তুমি শুধু আমার থেকে সবকিছু কেড়েই নিলে মাম্মা৷”

লুইস কিছু টা ভার গলায় কথাগুলো বললো। বাচ্চাদের মতো কান্না করা যেনো তার অভ্যাস। চোখের কার্ণিশে ফের জল জমে লুইসের। মিসেস লেনা এবার আর কিছু বলার ভাষা পেলেন না। উনি খাবারের বাটি রেখে উঠে দাড়ালেন। এলভিনা এতোক্ষণ চুপচাপ বসে মা-ছেলের কথা শুনছিলো। উনি উঠে দাড়াতেই এলভিনা বললো,

” আন্টি, লুইসের খাওয়া শেষ হয়নি তো!”

“তুমি ওকে খাওয়াও এলভিনা৷ আমি আসছি একটু।”

মিসেস লেনা কথাটা বলেই ফোন হাতে নিয়ে চলে গেলেন। লুইস এবার একটু শব্দ করেই তাচ্ছিল্য সহ হেসে উঠে। এলভিনা এসে খাবার তুলে লুইসের মুখের সামনে ধরে৷ কিন্তু লুইস খাওয়া রেখে প্রশ্ন করে,

” রেইনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলে?”

” না।”

এলভিনা ব্যর্থতার সুরে উত্তর দেয়। লুইস ফের চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দেয় বালিশে। তা দেখে এলভিনা বলে,

” কি ব্যাপার? খাবার শেষ করলে না, শুয়ে পরলে? ”

” আর খাবো না এভি। ইউ ক্যান লীভ নাও। আমি একটু একা থাকতে চাই।”

লুইস এলভিনা কে সবসময়ই ছোটো করে এভি ডাকে। লুইসের কথায় এলভিনা উত্তর দেয়,

” আমি যাচ্ছি চলে, কিন্তু খাবারটা তো শেষ করো!”

” আমি তোমায় চলে যেতে বলেছি এভি। আমায় রাগিও না।”

লুইসের রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে এলভিনার। সেজন্য সে সব গুছিয়ে বেড সাইড টেবিলে রেখে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই লুইস ডেকে উঠে এলভিনাকে। লুইসের ডাকে এলভিনা লুইসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সে তাকাতেই লুইস বলে,

” এভি, রেইনকে একটু কল করবে?”

” তার নাম্বার নেই লুইস। ”

” মেসেন্জারেও কি সে আসেনা এভি?”

” আই ডোন্ট নো লুইস। আমি তাকে এক্টিভ দেখি না কখনও। একসময় হয়তো হয়েছিলো এক্টিভ,কিন্তু তখন আমি একটিভ ছিলাম না। তাকে সেন্ড করা মেসেজ গুলো সীন হয়ে আছে।”

” আমার কাছে তার নাম্বার ছিলো জানো, কিন্তু ফোন টাই তো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।”

লুইস ছোট্ট করে শ্বাস নেয়। বেহায়া মন টা এতো ছটফট করছে তার রেইনের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু আদৌও এটা সম্ভব তো! এলভিনা নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলো লুইসের কথায়। এলভিনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে লুইস বলে,

” তাকে টেক্সট করে রেখো এভি, সে অন্য কারো হলেও আমি তারই আছি, তাকে বলে দেখো তার লেমন বয়েলড তার সাথে কথা বলতে হাসফাস করছে। একটি বার যেনো সে কথা বলে। তুমি এখন যাও এভি৷”

এলভিনা মাথা দুলিয়ে চলে যায়। লুইস নিজের রেইনের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো নিয়ে ভাবতে থাকে। তার রেইন প্রথম তার নাম লুইস বয়েলভিন শুনে মজা করে বলেছি লেমন বয়েলড। এরপর রেইনের মুখে এ নামই শুনতো লুইস। কত্ত সুন্দর দিন ছিলো তাদের। ভাবতেই মুখের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে লুইসের৷ আচ্ছা রেইন কি একটি বার তার সঙ্গে কথা বলার আবদার টা রাখবে না! জানলে অবশ্যই রাখবে। লুইস নিজেকে শান্তনা দেয়।

৩৬,
সময় টা রাত ১১টা। নিজেদের সব কাপড় চোপড় ব্যাগ প্যাক করে হাফ ছেড়ে বসলো রায়া৷ গতকাল খাবার শেষে তার শ্বশুর মশাই বলেছিলেন, রায়া আর হিয়া যেহেতু বাংলাদেশের ভ্রমণ করার মতো জায়গা দেখেনি, সেহেতু রাদ,রায়া,হিয়া, নাতাশা একসঙ্গে সিলেট চা বাগান, জাফলং,চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড,কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসবে এক ভ্রমণের লম্বা একটা সময় নিয়ে। উনি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। রায়া শ্বশুর মশাইয়ের কথার উপর কথা বলতে পারেনি, আর হিয়াও খুব খুশি ছিলো। নিজের মনের মধ্যেও কম ঝড় যাচ্ছে না। সবদিক চিন্তা করেই রায়া রাজী হয়ে যায়। রাদও তার বাবার কথার পর রায়ার মুখের দিকে চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে ছিলো যে, তার বউ তার বাবার মুখের উপর না করে না বসে! রায়া রাদের সেই চিন্তিত চাহনী আর দেখতে চায়নি। হ্যাঁ বলে দেয়। হিয়া যেহেতু তার শ্বশুর বাড়িতেই ছিলো, গোছগাছের একটা ব্যপার আছে। সেজন্য মাঝখানে একদিন সময় দিয়েছেন রায়ার শ্বশুর, যেনো হিয়া বাসায় গিয়ে সব গুছাতে পারে। আর আজকে রাদ গিয়ে হিয়াকে তাদের বাসায় রেখে এসেছে। যেহেতু লম্বা সফর, সেহেতু কাপড় চোপড় অনেক দরকার। গতকাল খাওয়া শেষে রুমে এসে অনেক গোছগাছ করেছে রায়া। কিন্তু আজ রাদ আবার ফ্যাশন হাউজ থেকে ফিরার সময় অনেকগুলো শাড়ি আর গাউন এনেছে। সেগুলোই গোছগাছ করলো রায়া৷ গোছগাছ শেষে নিজের ফোন টা খুজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো৷ নিজপর উপরেই নিজে ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসে রায়া। একসময় ফোন ছাড়া খেতো না অব্দি, এখন ফোন কোথায় পরে থাকে নিজেও জানেনা৷ অনেক খোঁজাখুঁজির পর রায়া তার ফোন টাকে পায় ড্রেসিং টেবিলের একদম উঁচু তাক টায়। রায়ার যতদূর মনে পরে সে ফোন টা লাস্টবার দেখে রেখেছিলো খাটের এক সাইডে। ওত উচুতে ফোন টা পৌছালো কিভাবে! হয়তো রাদ রেখেছে রায়া এটাই ভেবে নেয়। তাছাড়া তো কেউ আর তার ফোন হাতে নেয় না। রায়া টুল এগিয়ে নিয়ে ফোনটা নামায়। এরপর কি জানি মনে করে ডাটা ওন করে মেসেন্জারে ঢোকে। মেসেন্জারে ঢুকতেই এলভিনার মেসেজ ফোনের স্কিনে ভেসে উঠে। রায়া মেসেজ টা পড়ে। এলভিনা লিখেছে, ‘ তোমার লেমন বয়েলড তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক। তোমার মতামত জানিও। সে খুবই কষ্ট পাচ্ছে৷’ রায়ার হাত পায়ের শক্তি যেনো হারিয়ে যায় লুইসের কথা মনে আসতেই৷ ফোন টা হাত থেকে পরে যায়। মেঝেতে বসে পরে শক্তিহীন হয়ে। কান্নায় ভেঙে পরে রায়া। তখুনি রাদ রুমে প্রবেশ করে। সে এতোক্ষণ ইহসাসের রুমে ইহসাসের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো। সে রুমে এসে রায়াকে এমন ভাবে কান্না করতে দেখে ছুটে গিয়ে রায়ার সামনে বসে।বসেই জড়িয়ে ধরে একরকম। তাড়াহুড়ো করে জিগাসা করে,

” কি হয়েছে আপনার? এরকম কাঁদছেন কেনো?”

রায়া রাদকে পেয়ে নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারেনা৷ রাদের বুকে লুটিয়ে পরে। রাদ শক্ত করে রায়াকে ধরে কোলে তুলে বিছানায় বসায়। এরপর রায়ার গালে হাত রেখে জিগাসা করে,

” প্লিজ শান্ত হোন। আপনার কান্না বুকে রক্তক্ষরণ শুরু করায়৷”

রায়া চোখ তুলে তাকায় রাদের এই কথায়। রাদের চোখে চোখ রেখে তেজি গলায় বলে,

” আমার কান্না আপনার বুকে রক্তক্ষরণ করে, আর অন্য জনের কষ্টে আমার বুকেও সেইম অবস্থা হয়। কেনো আসলেন আপনি আমার জীবনে? সহ্য করতে পারছিনা আর!”

” আপনার অতীত মানুষ টার সম্পর্কে, আপনার অতীত সম্পর্কে আমায় জানাবেন রায়া?”

রায়া বিস্ময়ে তাকায় রাদের দিকে। সে যে কথা বললো, তাতে রাদের একটু হলেও রাগ হওয়া উচিত। বউয়ের মুখে পরপুরুষের কথা কোনো স্বামীই এক্সপেক্ট করেনা। সেখানে রাদ নিজে জানতে চাচ্ছে। সেটাও এরকম একটা পরিস্থিতিতে। রায়া যেনো কাঁদতে ভুলে যায়। সে দুচোখের পানি মুছে রাদকে বলে,

” জেনে কি লাভ? ঘৃণা করবেন, আর যতদূর জানি ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা আর মনের মধ্যে ছুড়ির আ”ঘাত একই। জেনেশুনে নতুন করে কি আ”ঘাত দিই! কত তো ক’ষ্ট দিচ্ছিনা।”

“কিছু কিছু মানুষের অতীত থাকে, সেটাকে ঘৃণা নয়, বরং মানুষ টার প্রতি আরও সম্মান-শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বাড়ায়। আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসার মানুষটির ক্ষেত্রেও এটাই ঘটবে। আপনাকে জেনে আমি ঘৃণা নই, আশা রাখি আরও গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে পরতে বাধ্য হবো৷”

রাদের কথায় আরেক দফা বিস্মিত হয় রায়া। সে অস্ফুটস্বরে বলে,

” আপনি মানুষ টা বড্ড অদ্ভুত রাদ।”

রাদ হাসলো রায়ার কথায়। সে রায়াকে ফের বলে,

“বলবেন না আপনি? আপনার অতীতের প্রেমিক পুরুষের কথা! যে বিয়ের পরও আমার স্ত্রীর মনে গেঁথে আছে! জানতে চাই তার সম্পর্কে।”

রায়ার রাদের কথায় মনের মধ্যে মোচড় দেয় লুইসের কথা মাথায় আসায়। সে রাদকে পাশ কাটিয়ে উঠে দাড়ায়। শাড়ির আচল সামলে উত্তর দেয়,

” বলবো,ব্যালকনিতে আসুন।”

চলবে?