হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে পর্ব-৩৬

0
410

উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:৩৬

আকাশের পাখোয়াজে নিঃসঙ্গ বিধুর শূন্য ঘরে-ঘরে ওড়ে গন্ধময় সুর,,,,,
(বিষ্ণু দে)

গাছে গাছে আমের মুকুলে মৌমাছির গুন গুন গুঞ্জরণে যখন চারপাশটা মুখরিত ছিলো তখন বিরূপাক্ষ এসে ঢুকেছিল রিতির পরিত্যক্ত শূন্য কক্ষটিতে।এ কক্ষটি কয়েকমাস আগ পর্যন্তও শূন্যই থাকতো,আর আজও শূন্য, কিন্তু তখনকার শূন্যতা আর এখনকার শূন্যতার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।গমগমে চৌধুরী বাড়িটাতে যেনো সুনসান নিঃশব্দ শ্মশান পুরীর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।কোন টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।সন্ধ্যায় সাঁঝবাতির মোলায়েম আলো জ্বলছে ঠিকই কিন্তু সেই উজ্জ্বল আভা কারো নজর কাড়তে ব্যার্থ,ধুপকাঠি নিজেকে জ্বালিয়ে বাতাসে ভুরভুর গন্ধ ছড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা কারো ঘ্রাণেন্দ্রীয়ের অন্দরকে হয়তো আন্দোলিত করতে পারছে না।সেই দুপুর থেকে রুদ্ধ দাঁড়ের ওপাশে বিরূপাক্ষ কি করছে জানে না জয়া।তারও শরীরটা ভালো নয়।মনটা তো খারাপের চরম পর্যায়ে। কেঁদে চলেছে থেমে থেমে। গর্ভাবস্থায় এমন কান্নাকাটির ফল যে সুখকর হবে না,তা ভালোই জানে জয়া কিন্তু কি করবে মনকে যে মানাতে পারছে না।বর্ষাস্নাত পুষ্পের ন্যায় সতেজ, নবজাতকের মতো নিঃস্পাপ ফুটফুটে মেয়েটার যে এমন পরিনতি হবে তা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিলো?জয়া বার কয়েক এসে ডেকেছে বিরূপাক্ষকে, কিন্তু সাড়া শব্দ পায়নি।ছেলেটা এই কটা দিন নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করেছে। রঘুনাথ বারবার ফোনে বলছে ওকে কিছু খাইয়ে দিতে কিন্তু কি করবে জয়া,সে যে দরজার ওপাশ থেকে সাড়াটি পর্যন্ত দিচ্ছে না। দুপুরের দিকে বন্ধু অখিলেশ এর সাথেই বাড়িতে পা রেখেছে বিরূপাক্ষ এতদিন বাদে।অখিলেশ এর কোনো খবরও পাচ্ছে না জয়া।

****
রাত ঠিক ক’টা বাজে খেয়াল নেই বিরূপাক্ষের,ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে আছে। এই কক্ষের পাশ ঘেঁষে উত্তরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন আম গাছটি থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত মুকুলের ঘ্রাণ আসছে হাওয়ার তোড়ে,, মৌমাছির গুঞ্জনের বদলে সেখানে এখন বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ঠান্ডা মেঝে থেকে উঠে বসেছে বিরূপাক্ষ।হতবিহ্বলের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি অভ্যস্ত করে নিতে সময় লাগছে খানিক।গায়ে জড়ানো রিতির রক্ত মাখা হালকা রঙের শার্ট টা। রক্তের দাগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়।উঠে গিয়ে আলো জ্বালাতে ই চোখ জ্বলে ওঠে।যেদিকে চোখ যায় মনে হয় রিতি বসে আছে,,সেই চার বছর বয়সের শিশু রিতি থেকে এই পূর্ণ যৌবনা রিতির প্রতিচ্ছবি সর্বত্রই, কিন্তু কিশোরী রিতির প্রতিচ্ছবি গুলো তো নেই সেখানে। কখনো সে প্রতিচ্ছবি ব্যাথা পেয়ে কাঁদছে আবার কখনো উচ্ছ্বলা তটীনির মতো খলখলিয়ে হাসছে।না বিরূপাক্ষের আর সইছে না।পাগল পাগল লাগছে তার কিন্তু পাগলামি করার শক্তি, মনোবল কোনোটাই যে নেই।এই অস্থির পাগলামি কে দেখবে?কে দেবে আস্কারা?কে মেনে নেবে করুন নয়নে নির্দ্বিধায়?তার স্বচ্ছ দীঘির মতো চোখ দুটোতে যে আজ আঁধার নেমেছে। শতবার চাইলেও সেথায় বন্দী করতে পারছে না প্রাণের রূপ দা কে।

বিছানায় চোখ যায় বিরূপাক্ষের।সেখানে অবহেলিত হয়ে পরে আছে সেই নীল মলাটে বাঁধা অফিসিয়াল ফাইলটা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানে বিরূপাক্ষ। আজকের এই নির্মম পরিণতির সকল দ্বায় যেনো ফাইলটির।কাল এঘড়ের আলমারি খুলে রিতির কাপড়, চোপড়ের সাথে এটাও পেয়েছে সে। মালিকের সাক্ষর এর স্থানটিতে রিতির নিজ হাতের সিগনেচার জ্বল জ্বল করছে সূর্যের আলোর মতো। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখে বিরূপাক্ষ,এই কোম্পানির একমাত্র অংশীদার এর স্থানটিতে লেখা, বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী। কিন্তু সেখানে তার কোনো সাক্ষর নেই।যবে থেকে এই ফাইল টির কাজ শুরু হয়েছে,তবে থেকেই জায়গাটা ফাঁকা।এটাই নেওয়ার কথা সেদিন রাহুলকে ফোনে বলছিলো রিতি।না হলে যে ব্যবসাটা দেশের বাইরে নেওয়া যাবে না।আইনি ব্যবস্থায় দুজন মালিকের ই সম্মতি থাকতে হবে।এমনি নিয়ম লেখা আছে।
নজরের তীক্ষ্ণতা পাল্টে মুহূর্তেই সেখানে বেদনার রংহীন চিহ্ন ভেসে ওঠে। বুকে আঁকড়ে ধরে ফাইলটি। সেখানে যে রিতির ছোঁয়া আছে।কত শত সহস্র বার রিতি ছুঁয়েছে এটাকে। বিরূপাক্ষ এক লহমায় বুঝে নেয় অন্নপূর্ণা বুটিক এন্ড তাঁতের মালকিন রিতি নিজেই।বড়োমার স্নেহের ঋণ শোধ করতে তাঁর নামেই করেছে।শত শত দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।
শ্রদ্ধা এবং গর্বে বুকটা ভরে ওঠে বিরূপাক্ষের।টনটনে ব্যাথাটা যে বেড়েই চলেছে।

***
কি হলো রূপদা এবার তো ছাড়ো লক্ষীটি!সময় যে বয়ে যায়।ঐযে দ্যাখো স্বর্গদ্বার রুদ্ধ হওয়ার সমাপ্তির শঙ্খনাদ বেজে উঠল।না গেলে যে আর সুযোগ হবে না আমার।রিতির চোখে করুন আর্তি।

কে নিষেধ করেছে তোকে?যা দেখি ক্যামন পারিস? একফোঁটা নড়ে দেখা বুড়ি?
সেই পুরোনো জেদ বিরূপাক্ষ’র কন্ঠে।

রিতি একবার তাকালো বিরূপাক্ষের হাতে পেঁচিয়ে থাকা সোনার শিকল এর দিকে।

দাও না যেতে রূপদা।আমি যে পৃথিবীর অযোগ্য। মানানসই নই তোমাদের মাঝে।আর দ্যাখো ওখানে মহাকাল নিজে স্বয়ং ক্রোড় পেতে রেখেছেন।আমি যাই,,

বিরূপাক্ষের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবার।মুক্ত করলো হাতের শিকল। কিন্তু এ কি?রিতির যে এবার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে,,রূপদা তাকে একা একা ছেড়ে দিলো?সে কি জানে না রিতির একা চলতে কত কষ্ট হয়?
নিজের মনকে বুঝায় রিতি, যে সকল স্বত্ত্ব ত্যাগ করে,প্রাপ্য অধিকার হেলায় হারায় তার কাছে আর কিইবা আশা করা যায়?

রথের পেছনের শিকল হস্তমুক্ত করে সামনে ছুটে আসে বিরূপাক্ষ,রিতির আলতা পরানো রাতুল চরণ যুগল বক্ষে তুলে নেয় গভীর আবেগে,,
তুই আমাকে ছেড়ে যাসনে বুড়ি।আমি থাকতে পারবো না রে একা একা।কখনো শুনেছিস,হৃদপিন্ড ছাড়া মানুষ বাঁচে?
ত্ররিতি ছাড়া যে তার বিরূপাক্ষও শূন্য,আধুরা।স্বর্গ থেকে অধিক সুখে রাখবো তোকে,একটি বার বিশ্বাস করে দেখনা সোনা।নেমে আয়।বিরূপাক্ষের চোখের জলে রিতির পায়ের আলতা ধুয়ে যাচ্ছে।আর স্থির থাকতে পারে না রিতি। কাঁদছে সেও।রূপদার কান্না তার বুকে তুফান তোলে নিমেষেই।উঠে দাঁড়ায় সিংহাসন ছেড়ে। তাচ্ছিল্য ভরে একবার তাকালো স্বর্গদ্বারের দিকে মনে মনে বললো, তোমার মতো লক্ষ,কোটি স্বর্গের সুখও আমার রূপদার চোখের জলের চেয়ে দামী নয়।কখনোই নয়।

****
বিভাগীয় শহরের স্বনাম ধন্য হাসপাতালের আই,সি,ইউ তে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাথে দিন কাটছে রিতির।দুটো রাত কেটে গেল কিন্তু জ্ঞান ফেরেনি তার।এদিকে রিতির হাই ফিবার,প্রচুর রক্তক্ষরণ, শরীরের অত্যধিক তাপমাত্রা কর্মরত চিকিৎসকদের অত্যধিক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুল হলেও বিপদ থেকে মুক্তি পায়নি রিতি। একবার জ্ঞান ফিরলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন চিকিৎসকরা।

দুটো গুলির ক্ষত স্থান থেকেই রক্ত ঝরেছে অবিরত ভাবে।জেলা শহরের নামকরা ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে রেফার করা হয়েছে বিভাগীয় শহরে।টাকা থাকলে এখানে যথোপযুক্ত চিকিৎসার অভাব হয় না।বাকী টুকু উপর ওয়ালার কারসাজি। ভাগ্য ভালো, যে গুলিটা পিঠে লেগেছে সেটা একেবারেই বাঁ পাশের মাংস পেশী ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল না হলে, এতক্ষণে হয়তো বেদনায় মুহ্যমান হৃদয়টা তার নিজের ক্রিয়াকর্ম বন্ধ করে রিতির আন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে ফেলতো। গুলিবিদ্ধ ডান হাঁটুতে অস্ত্র পচারের মাধ্যমে বুলেট বের করা হয়েছে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা।এখন শুধু অপেক্ষা দুচোখ মেলে তাকাবার।

আই,সি,ইউ এর দরজায় কয়েক জোড়া স্নেহ ব্যাকুল সজল আঁখি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভেতরের মুমূর্ষু দেহটির দিকে। কাছে আকুল প্রার্থনা তাদের ঐ নিথর দেহটা একবার একটু নড়ে উঠুক।স্থির পদ্ম দীঘিতে ঢেউ জেগে উঠুক অবিলম্বে।

বড়োমা,, ঐদিকে গিয়ে বসবে চলো।ম্লান কন্ঠে বললো প্রদীপ।ভেতরে দৃষ্টি রেখেই ডানে বামে মাথা নাড়েন অন্নপূর্ণা দেবী। বললেন বাষ্প রুদ্ধ কন্ঠে,,

না বাবা,,আর এক পা ও নড়বো না আমি। অনেক করেছিস সেবা শুশ্রূষা। এবার একটু একা ছেড়ে দে আমায়।দেখি প্রাণ ভরে। আমার সামনে কিছুতেই আমাদের ছাড়তে পারবে না ও।অত টুকু মেয়ে এত বড়ো সাহস দেখাতে পারবে না বাবা,,
সুমিতা দেবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন অন্নপূর্ণা দেবী। অতিরিক্ত টেনশন এবং কান্নাকাটির ফলে নিজেই মরতে বসেছিলেন। সারাদিন তাঁকে অন্য কেবিনে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিলো।একটু সুস্থ হতেই ছুটে এসেছেন এখানে।

প্রদীপ ডান হাতের চেঁটোয় চোখ মুছে বলে,

বড়ো মা,, জানোই তো কেমন দস্যি মেয়ে ওটা। জেগে যদি দেখে তুমি অসুস্থ আর আমরা কিছু করিনি তাহলে আস্ত রাখবে আমাদের?
আগে উঠতে তো বল,,সব দস্যিপনা মেনে নেবো। কিচ্ছু বলবো না,শাসন করবো না।শুধু একবার উঠে বড়োমা বলে ডাকতে বল বাবা,,

প্রদীপ আর সইতে পারে না। রঘুনাথ আসতেই সরে পরে কান্না চাপাতে।রিতিকে নিজের আপন বোনের চেয়ে বেশি ছাড়া কম ভাবে না সে।তাইতো মায়াটা একটু বেশি পরিমাণে।

****
অদ্রিকা কে কোলে নিয়ে বসে আছে অখিলেশ।সামনের বারান্দায়। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা।চোখে বিন্দু বিন্দু জল‌।

কি হতে কি হয়ে গেলো বলোতো?অমন ফুটফুটে মেয়েটার এমন পরিণতি ভাবা যায়? আমাদের রূপটাও ভেঙে পড়েছে খুব তাই না? নিরুপমার কন্ঠে আক্ষেপ।

সময়েরটা সময়ে না বুঝলে কে কি করবে বলো?আমি তো জানি রূপের একটু সুদৃষ্টি পাওয়ার জন্য মেয়েটা কি কি করেছে! এখন কেঁদে কি হবে বলো?অমন মন প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতে কজনে পারে? বুঝলোই না বোকা রূপ।

তোমরা পুরুষ জাতি টাই এমন। নারীর প্রেম ভালোবাসার মূল্য দিতে জানো না।যখন আর কিছুই করার থাকে না তখন দেবদাস হয়ে প্রেম দেখাতে পারো শুধু। তাজমহল গড়তে জানো ভালোবাসার তীব্রতা জাহির করতে।আসলে সবই শুভংকরের ফাঁকি।ভেতরে কিছু নেই।

নিরুপমার ঝাঁঝালো কন্ঠে সংকুচিত হয়ে পরে অখিলেশ।কি বলবে সে। কাঁদা টুকু যে তার গায়েও পরলো।

এখন এসব না বললেই নয় নিরু?মনটা যে বড্ড অশান্ত।
নিরু দমে যায়। মানুষটাকে দেখেই বিভ্রান্ত লাগছে।খেয়েছে কি না কে জানে।

সরি অখিল। কিন্তু একটা কথা,কবে বুঝবে তুমি,তোমরা নারীদের ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের যন্ত্রণা?

অখিলেশের চোখে বেদনা ঘনিয়ে আসে।রিতির পরিনতি তাকে ভেঙে দিয়েছে ভেতরে ভেতরে।সেকি পারবে কখনো নিরুর ঐভাবে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেখতে?
না না পারবে না।অদ্রিকাকে বুকের সাথে চেপে ধরে সে। এখানে যে আরো একজনের বক্ষ চাই তার।

****
থানার কর্মকর্তার নিজস্ব টেবিলের অপরপ্রান্তে চেয়ারে বসে রঘুনাথ। পাশের চেয়ারে তার সহযোগী টুকটাক বাক্যালাপ করে চলেছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে।সামনে গরম চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রঘুনাথের। অপেক্ষা করছে সে গারদের ওপাশের আসামীর জন্য।
দূর্ঘটনার পরে কেটে গেছে তিনটি দিন।সেই রাতে ঘটনা স্থল থেকে ধরা পরেছিলো লিকু সরদার সহ আরো দুজন।আমির শেখকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।বাদ পরেনি আসলাম।আজই বিকেলের দিকে ধরা পরেছে মেইন কালপ্রিট। বেনাপোল বর্ডার থেকে ধরা হয়েছে তাকে।

কনস্টেবল এসে স্যালুট জানাতেই উঠে দাঁড়ায় অফিসার। রঘুনাথ নড়ে ওঠে।

রঘুনাথ বাবু আপনার কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু অনুরোধ একটাই প্লিজ কন্ট্রোল হারাবেন না।আমাদের ও কিছু দ্বায়বদ্ধতা আছে বোঝেন,,,ই,,, তো।

কঠোর দৃষ্টি হানে রঘুনাথ। অফিসারের গলাটা মিইয়ে আসে।মাঝে মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তাদের হাত পা অদৃশ্যভাবে বাঁধা থাকে। তোষামোদ করতে হয় নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে।নইলে বদলী হয়ে যেতে হবে রাঙামাটি, বান্দরবান।

ভয় নেই অফিসার। আপনি এখানেই থাকুন আমি একাই কথা বলবো আপনার আসামীর সাথে।আর রক্তের দাগ লাগানোর হলে আপনার পুলিশ ভ্যানেই লেগে যেতো এতক্ষণে।এ অব্দি অক্ষত শরীরে যখন আসতে পেরেছে তখন আর কিছু চিন্তা নেই।

অফিসার যেনো ভরসা পায়না রঘুনাথকে। রঘুনাথ এর আদ্যোপান্ত জানে সে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে রঘুনাথ, অফিসার এর কুন্ঠিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে অবজ্ঞা ভরে,,একদম ভাববেন না অফিসার,, রঘুনাথ সব নোংরা ছোঁয় না।

*****
তোমার ঐ নোংরা শার্ট প্যান্ট নিয়ে বার বার এখানে আসো ক্যানো বলোতো? সেপ্টিক হয়ে যাবে না বলো?
তুমি কি চাও আমি সেপ্টিক হয়ে মরি?

বিরূপাক্ষ একটু সরে দাঁড়ায় রিতির বেড থেকে।
সুমিতা পিসি মৃদু তিরস্কার করে রিতিকে এভাবে কথা বলার জন্য। অন্নপূর্ণা দেবী রুখে দাঁড়ান,,

রিতি তো ঠিকই বলেছে দিদি।দ্যাখো তো ছেলের চেহারা? রাস্তার পাগলের মত হয়েছে। এ কটা দিন অন্তত পাঁচশত বার সকলে বললাম কাপড় পাল্টে চান করে নিতে শুনলো কথা?

তাই বইলা ওইরকম কইতে আছে দিদি? দুঃখ তো পোলায় কম পায়নাই।কষ্ট পাইও না বাপ আমার।সখেদে বলেন সুমিতা দেবী।রিতি মৃদু হাসে। বিরূপাক্ষ একধ্যানে দ্যাখে সে হাসি।ঠিক যেনো নতুন দিনের নতুন সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি। কয়েকদিনের অসুস্থতার জন্য শুষ্ক হয়ে থাকা ওষ্ঠদ্বয় ও সে আলোক রশ্মির বিকিরণ খর্ব করতে পারে নি।
রাতের মধ্যভাগে জ্ঞান ফিরেছে রিতির। শরীরের তাপমাত্রা নরমাল এখন। কিন্তু ক্ষতস্থানের তাজা ঘা- এর বেদনা কমেনি একটুও। তারউপর রূপদার এমন পাগল পাগল ছন্নছাড়া চেহারা ভেতরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে বার বার।পরিপাটি, ছিমছাম মানুষটিকে এভাবে নিতে পারছে না সে। অখিলেশ দেখে শুনে মৃদু হাসছিলো।বিরূপাক্ষের আকুল চাহনির অর্থ তার প্রেমিক মনের বুঝতে বাকী রইল না।

মাসিমা চলুন ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেবেন। সারাটা রাত তো চোখের পলক ফেললেন না। রূপ তুই নাহয় একটু কষ্ট করে থাক এখানে।আমি মাসিমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
সুমিতা দেবী সাদাসিধে মানুষ অত কিছু বোঝে না,যেতে চাইলো না কোথাও। অন্নপূর্ণা দেবী সবটা বুঝে নিলেন নিমেষেই।

ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ ভরা নিস্তব্ধ কেবিন। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছুই কর্নগোচর হচ্ছে না।কারো মুখে কোন কথা নেই।প্রথমে মুখ খুললো রিতি,জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো ধীর স্বরে,,
আমার গলা বুক শুকিয়ে আছে। ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে দেখো,
বিরূপাক্ষ উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে আসে এক পা।
জল খাবি বুড়ি?তেষ্টা পেয়েছে?
রিতিকে ছুঁতে যাবে অমনি স্যালাইনের ঝ নড়ে উঠলো,, থেমে যায় বিরূপাক্ষ।
খবরদার ছোঁবে না আমাকে?
বিরূপাক্ষ স্তব্ধ রিতির ব্যবহারে।কষ্টের পাহাড় জমলেও কিছুই করার নেই, এরচেয়ে বেশি তার প্রাপ্য।
রিতির শুষ্ক ঠোঁটের ডগায় পূনরায় মৃদু হাসি,,

চান(স্নান) টান করে পরিস্কার হয়ে আসো তো যাও। আমার একটা দীর্ঘ ভেজা চুমু লাগবে।না হলে কিছুই সিক্ত হবে না।বড্ড কাঠখোট্টা হয়ে আছে সবটা।
বিরূপাক্ষ শুষ্ক গলায় বিষম খায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিতির দিকে।মাথাটা কি গেলো মেয়েটার? তাকায় মুখের দিকে।
না তো সেখানে কোনো তিরস্কার নেই।আর না আছে এ কদিনের জ্ঞানহীনতার চিহ্ন।
সফেদ এপ্রোন পরিহিত ডাক্তারের কথায় স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বিরূপাক্ষ,,

মিস্টার রায় চৌধুরী, এবার যে পেশেন্টকে ছাড়তে হবে,, উজ্জ্বল হাসি ডাক্তারের ঠোঁটে।সাথে আসা সেবিকা হাসছে।
রসিকতা করতে ছাড়ে না সমবয়সী ডাক্তার,,যান তাহলে ভিজে আসুন,, রোগীনির চাহিদা বলে কথা।

ওহ্ শিওর ডক্টর!আসছি আমি। অপ্রস্তুত হয়ে গেছে বিরূপাক্ষ।এমন মশকরায় অভ্যস্ত নয় সে।

******
গতকাল শেষ রাতের দিকে অখিলেশ এর চিৎকারে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বিরূপাক্ষ। অখিলেশ হাঁফাতে হাঁফাতে যা বললো তার মর্মার্থ এই যে,
রিতির জ্ঞান ফিরে আবার হারিয়েছে।
এটুকুই যথেষ্ট ছিলো বিরূপাক্ষ’র কাছে।বৌদিদিকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না।এই কয়টা দিন বিরূপাক্ষের চোখে অশ্রু কেউ দেখেনি।সে কারো সাথে একটা বাক্য ব্যয় করেনি।সবাই শংকিত ছিলো চাপা স্বভাবের ছেলেটা অবশেষে কিছু একটা করে না বসে। অখিলেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাড়া দেয়।স্নান,আহার দূরে থাক রক্ত শুকানো পোশাক টাও পাল্টানোর সময় ছিলো না বিরূপাক্ষের।বেশ খানিকটা সময় পরে যখন হাসপাতালে পৌঁছোলো তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।রিতির জ্ঞান ফিরেছে পরিপূর্ণ ভাবে।পালস্ রেট স্বাভাবিক, শরীরের আগুন লাগা তাপমাত্রা ও নেমে এসেছে।
ডক্টর,আউট অফ ডেঞ্জার বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

****
রঘুনাথ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরতেই জয়া আগ্রহভরে এগিয়ে যায় তার দিকে।রিতির জ্ঞান ফিরেছে শুনে সেই যে মন্দিরে পরেছিলো আর একটু আগে উঠেছে। রঘুনাথ ও অনুরূপ ভাবে এগিয়ে যেতেই থমকায় জয়া,কড়া সুরে বলে,,আগে গিয়ে স্নানটা সেরে নাও তারপর আমাকে ছোঁবে। কোথায় যেন যাবে বলেছিলে?

রঘুনাথ হাসে,
কি ভাবো তুমি আমাকে?ঐ নোংরা আমি ছুঁই নি। কিন্তু খুব ভালো ব্যবস্থা করেছি।জীবনেও আর সূর্যের আলো দেখবে না বুঝলে।
আমার ভুলের মাশুল আমার প্রানের মানুষগুলো দিচ্ছে সে অপরাধ বোধ মনটাকে নিচু করে রেখেছে জয়া?
গলাটা ভারী হয়ে আসে রঘুনাথের।জয়া স্বামীর বেদনায় ভীত হয়ে পরে,
এমনটা আর ভেবো না।রিতি ফিরছে সুস্থ হয়ে,ভাই চোখে হারাচ্ছে তাকে এর চেয়ে আর আনন্দের সংবাদ কি হতে পারে। এবার আমাদের সব ভাল হবে। স্বামীকে শান্তনা দেয়।
অর্পিতা নামটা একটা বিভীষিকা আমাদের কাছে।সেটা যেনো ভুলেও আর উচ্চারণ করো না।আর কিন্তু ছাড় পাবে না তুমি।

সে নামটা ভুললেও চলবে না জয়া। আমার কলিজাতে আঘাত করেছে সে।অত সহজে ছাড়লে চলবে?? কঠোর হাসি ফুটে উঠল রঘুনাথের মুখে।
যে দুজন আছে আর যে আসছে তিনজনই আমার আত্মা। তাদের পথ আমি নিজ দায়িত্বে কন্টকমুক্ত করবো জয়া।

চলবে,,,,,