হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-২২

0
717

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব____২২
#কায়ানাত_আফরিন❤

এতক্ষণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটি চিরে হঠাৎ করে এক চিলতে রোদ এই ব্যস্ত নগরীতে হানা দিয়েছে। যেই আকাশটি দেখে কিছুক্ষণ আগেই যে মনে হলো, যেকোনো সময় তুমুল বেগে বৃষ্টিপাত হবে , তার রেশটুকু এখন নেই। আর এই ব্যস্ত নগরের এলোমেলো পথ দিয়ে আয়াত নিজের বাইক ছুটিয়ে চলছে। পেছনেই একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বসা মাইশা। আজ দ্বিতীয়বার মাইশা আয়াতের বাইকে চড়লেও প্রথমদিনের মতো সেই অস্বস্তিটা রয়েই গিয়েছে। নিজেরদের মাঝখানে একটা ছোট ব্যাগ দিয়ে রেখেছে যেন ভুলেও ধাক্কা না লাগে। বিষয়টা দেখে আয়াত বেশ মজা পেলেও তেমন কিছু বললো না।

হাওয়ার তালে সামনের ছোট চুলগুলো বারবার স্পর্শ করে চলছে মাইশার মুখ। তারওপর আবার শাড়ি পড়ে বাইকে বসাও একটি মেয়ের জন্য সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তার জন্য মাইশার মন-মেজার বিক্ষিপ্ত। আয়াত লুকিং গ্লাসে একনজর পরখ করে নিলো মাইশার বিক্ষিপ্ত মুখ। তারপর বলে ওঠলো,

–”শাড়ির আচলটা সামলে রাখো। আর বারবার চেক করবে যে কোনোভাবেই ওটা নিচে না পড়ে যায়।”

–”আমি বাচ্চা নই বুঝলেন যে এমনভাবে বলতে হবে।”

আয়াত যেন অবাক না হয়ে পারলো না। একটা মিহি হাসি দিলো বিনিময়ে। ভ্রু নাচিয়ে বললো,

–”কি এক জ্বালা রে বাবা ! জাস্ট শাড়ির আচলটা সামলে রাখার কথা বললাম আর এই মেয়ে বলে যে সে বাচ্চা না। বাচ্চারাও শাড়ি পড়ে বুঝি?”

আয়াতের পিঠে একটা কিল মারলো মাইশা। এমনিতেও মন-মেজাজ কেমন যেন শাড়ির মতো পেচিয়ে গিয়েছে তারওপর আয়াতের অসংলগ্ন কথাবার্তা যেন ওকে পাগল না করে আর পারলো না। মুখ ফুলিয়ে তাই বললো,

–”দিন দিন আরও ফাজিল হচ্ছেন আপনি।”

–”তো আমি তোমার কাছে ভালো ছিলাম কবে? ভালোমানুষি করতে গিয়েও তোমার হাতের চড় খেতে লেগেছে তবে ফাজলামি করলে তো আমারে আর বাঁচতেই দেবে না। তখন পেপারে বড় বড় অক্ষরে ছেপে ওঠবে, ”এক দস্যু মেয়ের হাতে RJ আরহাম আয়াতের খুন !
ব্যাপারটা ইন্টেরেস্টিং হবে না?”

আয়াতের বিদ্রুপ কন্ঠ। মাইশা চোখ গরম করে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাতেই চোখ টিপ মারলো আয়াত। মাইশা সাথে সাথেই ফিরিয়ে নিলো। আয়াতের এভাবে চোখ টিপ মারাতে ওর হার্টবিট যেন দ্রুত বাউন্স করছে। আয়াত বাইকে মনোযোগী হয়ে বললো,

–”আবার ভাবুকরাণী হয়ে যেওনা কিন্ত। পরে বাইক থেকে পড়ে গেয়ে কোমড়-পা ভেঙে বসবে।”

মাইশা কিছু না বলে একহাত দিয়ে আয়াতের কাধ চেপে বসে থাকলো যেনো পড়ে না যায়। বিনিময়ে আয়াত একগাল হেসে দেয়। মাইশা আড়চোখে লুকিং মিরর দিয়ে সেই সুনিপুন দৃশ্যটি দেখেছে। আয়াতের ফর্সা মুখশ্রীর এই হাসিটাই অনন্য , কথায় কথায় তেমন একটা রাগ করেনা বরং হালকাভাবে বিষয়গুলো গ্রহণ করে নেয়। আর ঠোঁটযুগল মৃদুভাবে নাড়িয়ে যেই কথাগুলো বলে, মাইশার তো ইচ্ছে করে গিলে ফেলতে। মনে মনে নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো মাইশা। চারিদিকে আরহাম আয়াতের এই অস্তিত্ব ওকে নির্লজ্জ বানিয়ে দিচ্ছে।

মাইশা আচমকা আয়াতকে বললো,
–”একটা কথা বলবো?”

–”বলো।”

–”ভালোবাসি !”

মাইশা আয়াতের কানের কাছে হুট করে বলে ফেললো মিহি কন্ঠে। বিষয়টা যেন আয়াত নিতে পারেনি। বিস্ময়ের পাহাড় নিয়ে হুট করে রাস্তার এক কোণে ব্রেক কষলো তাই। রাস্তাটি নীরব। মাঝে মাঝে শুধু দু’একটা গাড়ি বা রিক্সা যাচ্ছে। রাস্তার কোণে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে দেখলে মনে হবে প্রকৃতি যেন প্রেমের জন্যই তৈরি। কি সুন্দর লাগছে !

এমন সুন্দর দৃশ্যগুলো ভ্রুক্ষেপ না করে আয়াত বিস্ময় নিয়ে পেছনে ঘুরলো। মাইশা ভারক্রান্ত অবস্থায় বসে আছে। আয়াত বাইক থেকে নেমে মাইশার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁট দুটো কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে। হয়তো এত বড় ধাক্কাটা সামলাতে পারছে না। জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া হালকা ভিজিয়ে বলে উঠলো,

–”কি বললে তুমি?”

–”বলেছি যে ‘ভালোবাসি!’ ”

আয়াত এবার হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না। কোমড়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন বিষয়টি নিয়ে খুবই সিরিয়াস। কিছুক্ষণ মৌনতা কাটিয়ে আয়াত এবার বললো,

–”এটা কি আদৌ কোনোরকম কোনো প্রপোজ হলো?”

–”ওসব প্রপোজ-ফ্রোপোজ আমারে দিয়ে জন্মেও হবে না।আর আপনি ওইদিন বৃষ্টিতে ভিজে আমারে ভালোবাসি না বললেও যা বলেছেন ওটাই যথেস্ট আমার জন্য। আর আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছে এখন ,তাই হুট করে বলে ফেলসি। ব্যস, সব শোধবাধ !”

বলেই মাইশা আবার নিশ্চুপ। আয়াত এমন আজব মেয়ে কস্মিক কালেও দেখেনি। কিছু না বলে চুপচাপ বাইকের সিটের দুপাশে হাত দিয়ে মাইশার কাছাকাছি চলে গেলো আয়াত। মাইশা তাই গোলগোল চোখ করে আয়াতের প্রখর চাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহিনীটা থেকেও সুন্দর ঠোঁটের কোণে থাকা দুষ্টু হাসিটা। তাই মৃদু স্বরে আয়াত মাইশার কাছে মুখ এগিয়ে বললো,

–”এখন তোমার ভালোবাসির চক্করে মাথাটা তো হ্যাং করেছিলো আমার ।বাই চান্স এক্সিডেন্ট হতো তো? তোমার সাথে আমার ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, তারপর বাসরের স্বপ্ন সব শেষ!”

–”সাধে কি আপনাকে আর লুচুবাঘ বলতাম?”

–”তখন কিছু না করেই আমি যে লুচুবাঘ সবাইকে বলে বেরিয়েছো। তবে এবার তা আর হবেনা ম্যাম ! এবার না হয় লুচ্চামি টা করেই লুচুবাঘের ট্যাগটা নেই।”

আয়াতের বিক্ষিপ্ত কন্ঠ। এই কন্ঠ আর প্রখর চাহিনী মাইশা এড়িয়ে যেতে পারছে না। কেমন যেন একটা নেশা কাজ করছে এই চাহিনীতে। আয়াত এভাবে মাইশাকে ওর কথায় হারিয়ে যেতে দেখে আস্তে করে সরে পড়লো মাইশার কাছ থেকে।বাইকে উঠে বসে ইন্জিন স্টার্ট করতেই একটা শব্দ তৈরি হলো এই মৌনিতার পরিবেশে। সিটি বাজাতে বাজাতে নির্বিকার ভাবে বলে ওঠলো,

–”চলো, এবার একটু শ্বশুড়বাড়িটা চক্কর দিয়ে আসি !”
.
________________________________________________

মাইশার কথামতো আয়াত বাইকটা থামালো দুতলবিশিষ্ট একটি ছিমছাম বাড়ির সামনে।এর আগে দুইদিন গলির মুখেই আয়াত মাইশাকে নামিয়ে দিয়েছিলো আর আজ প্রথম ওর বাড়ির সামনে এসেছে।এবার তাই তাকালো নেমপ্লেটটার দিকে। সেখানে ইটালিয়াল ডিজাইনে লিখা আছে, ”পান্থনিবাস”

নামটি পছন্দ হলো আয়াতের। এতক্ষণে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। যেকোনো সময় মাগরিবের আজান দিয়ে দেবে। তাই মাইশার একটু তাড়া।মাগরিবের আজানের পর বাড়িতে আসাটা কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়েদেরকে সমর্থন করে না বলে সমাজের ধারনা। মাইশা এবার নেমে পড়লো বাইক থেকে।আয়াত তা দেখে বিদ্রুপস্বরে বললো,

–”আমার হবু শ্বশুড়বাড়িতে আজ আসতে দেবে না?”

মাইশা মেকি হেসে বললো,
–”দেবো তো। যদি আমার চড়-থাপ্পড়, আমার আদরের বড় ভাইয়ের কেলানি, আমার বাবা-মা ওরফে তোমার হবু শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সেই মহাপুরুষী বাণী শুনতে চাও তবে তোমায় চিরতরে ওয়েলকাম ! তার আগে হসপিটালে তোমার জন্য কেবিন বুক করে আসি?”

–”ওমা ! আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেকে এভাবে ট্রিটমেন্ট করবে তোমরা?”

আয়াত আহতের ভান করে বললো। মাইশা বিনিময়ে কিছূই বললো না । আয়াতের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো,

–”এখন আগেভাগে জামাইআদর পাওয়ার দরকার নেই। ভুলে যাবেন না যে আমার বাবার সাথে খালুর ঝামেলা আছে।”

–”হুমমম ! (আয়াতের মলিন কন্ঠ) তবে এত টেনশন নিয়ো না। ইনশাল্লাহ ! সব ঠিক হয়ে যাবে।এখন একটা রিকোয়েস্ট তোমার কাছে।”

–”কি?”

–”আল্লাহর ওয়াস্তে আর আপনি আপনি করে ডাকবে না।”

–”ঠিকাছে ডাকবো না।এখন আমি ভেতরে যাই। বেশি দেরি হয়ে গেলে আম্মু ক্যালানী দেবে।”

–ওকে।

মাইশা আয়াতের চুলগুলো একপাশে সুন্দর করে রেখে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আয়াত ডাকলো,

–”মাইশু?”

পেছনে ঘুরলো মাইশা।আয়াতের মুখে এই নাম শুনে যেমন অবাক হয়েছে তেমন বিস্ময়। আয়াত ফ্লাইং কিস দিয়ে বললো,

–”ভালোবাসি।”

–”আমিও।”
মিহি কন্ঠে এই কথাটি বলে ভেতরে চলে গেলো মাইশা। আয়াতের মুখের দিকে একবারও তাকায়নি লজ্জায়। ইসসস ! একবার যদি দেখতে পারতো সেই হতভিম্ব মুখটি!
.
.
.
.
#চলবে