হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-২৫+২৬

0
660

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
পর্ব ২৫+২৬
#কায়ানাত_আফরিন❤

বিভ্রান্ত হয়ে বারবার এদিক ওদিক তাকালো মাইশা। সামনের বাড়িটি ও ভুল দেখছে না তো? কিন্ত যখন নেমপ্লেটে বড় বড় করে লিখা, ”হাউজ নং ৭, উত্তরা, ঢাকা” তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ও ঠিকই দেখছে। আম্মুর কাছে আগেই শুনে নিয়েছিলো যে নুহাশের জন্য যে মেয়েটি দেখতে যাবে ওর বাড়ি খুব কাছে। তবে বাড়ির পাশাপাশি যেন সম্পর্কেও এত কাছের হবে মাইশা তা বিন্দুমাত্র কল্পনাও করতে পারেনাই। ওদের সাথে মাইশার খালামণি, আঙ্কেল, আরিয়া আর আয়াতও এসেছে। আয়াতের হাতে রয়েছে ফলমূলের বেশ কয়েকটি প্যাকেট। স্বভাবত মেয়ে দেখতে এসে খালি হাতে যাওয়াটা মানায় না তাই এসবের আয়োজন করা। শারমিন বেগম যখন ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন মাইশা চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,

–”আম্মু আমরা অর্পির বাড়িতে আসলাম কেনো?”

মাইশার এরূপ কন্ঠে সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নুহাশও মোটামোটি অবাক। এটা যে অর্পির বাড়ি এটা নুহাশ জানতো না। শারমিন বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,

–”আমরা যে মেয়ে দেখতে এসেছি এটা তুই ভুলে গেলি নাকি?”

–”অর্পির চৌদ্দগুষ্টিতে অর্পি আর ওর ছোট বোন ছাড়া আর কোনো মেয়ে নাই। তো তুমি নুহাশ ভাইয়ের জন্য কোন মেয়ে দেখতে আসছো এখানে?”

শারমিন বেগম চোখ পাকিয়ে বললেন,

–”বড় ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসে সবার সামনে আমার থাপ্পড় খাবি তুই?”

মাইশা গালে হাত দিয়ে বললো,”না।”

–”তাহলে বেশি বকবক করবি না। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো ভিতরে চল। তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।”

মাইশা মলিন কন্ঠে বললো,
–”ঠিকাছে।”

——————————————–

ড্রয়িংরুমে এককোণে মাইশা কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। পাশের অর্পির বিশিষ্ট মাতাশ্রী আমেনা বিবি তার রেডিও স্টার্ট করেছেন শারমিন বেগমের সাথে। স্বামীহারা এই মহিলাটির সবার সাথে মিলমিশে থাকার সুন্দর একটি গুণের জন্য মাইশার বন্ধুমহলে অর্পির আম্মুকে অপছন্দ করেনা এমন কেউ নেই। মুখে সর্বদা একটি স্মিত হাসি রাখেন তিনি। তবে অতিরিক্ত কথার জন্য মাঝে মাঝে অতীষ্ঠ হয়ে পড়ে সবাই। আনানের ঐতিহাসিক ধারনা , অর্পির অতিরিক্ত কথা বলা এই ভয়ঙ্কর গুণটি ওর মার থেকেই পেয়েছে। এই বাড়িতে অর্পির মা আর ওরা দুই বোন ছাড়াও আরও রয়েছে ওর দাদী। বয়স ৯০ ক্রস। আর কয়েক বছর পার হলেই সেঞ্চুরী মারবে। তবে নিজেকে এখনও যুবতী বলে ভাবতে ভালোবাসেন তিনি। কানে কম শোনার সমস্যা হলেও আজও রেডিওতে ৯০ শতক থেকে শুরু করে আধুনিক একটা রোম্যান্টিক গানও তিনি লাউট ভলিউমে শুনতে ভুলেননা।

কিন্ত মাইশার সেদিকে ধ্যান নেই। অর্পির রুমের দিকে বারবার তাকাচ্ছে ও। মেয়েটা কি জানে যে নুহাশ ভাই পাত্র হয়ে ওকে দেখতে এসেছে?নাকি আন্টিও ওর আম্মুর মতো বিষয়টা সারপ্রাইজ বলে চেপে রেখেছে। মাইশা মনে মনে বলছে, বলে দিলেই ভালো। এই মেয়ে যা জিনিস। এমনিতেও নুহাশ ভাইয়ের থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে আনান , অর্পি দুটোই নুহাশের নাম শুনলে হাটু কাপায়। যদি এখন অর্পি দেখে যে নুহাশ ভাইয়ের ওর ফিউচার হাসবেন্ড হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯% , ও তো তবে তো মাথায় সিট পড়ে যাবে, এমনকি হাসপাতালেও ভর্তি হতে পারে। ইয়া আল্লাহ !

মাইশার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে টেনশনে। আরিয়া তা দেখে বললো,

–”কি ব্যাপারে মাইশা? নিজের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে বড় ভাইয়ের বিয়ে পাকাপাকি চলছে , তুমি খুশি না হয়ে টেনশনে আছো কেনো?আমার তো এক্সাইটমেন্টে খারাপ অবস্থা হয়ে যেতো।”

মাইশা শুধু বলতে পারছে না, ”না গো আরিয়াপু, এটা মুভি-সিনেমাও না আর আমাদের নুহাশ ভাই অর্পি রাণীও মেড ফর ইচ আদারের জুটি না। নুহাশ ভাইয়ের এক ধমকে অর্পি ভ্যা, ভ্যা করে কেদে দেবে তাহলে বাকিসব তো পড়েই রইলো।”

মুখে মেকি হাসি টেনে মাইশা বললো,
–”আমিও ওভার এক্সাইটমেন্টের জন্যই টেনশনে আছি।”

মাঝখান দিয়ে অর্পির দাদী বললো,
–”পেনশনে? কিসের পেনশন পাও গো?”

হইসে কাম ! দাদী টেনশন রে পেনশন শুনছে। আমেনা বিবি চিল্লিয়ে দাদীর কানে বললো,
–”পেনসন না আম্মা টেনশন বলসে।”

দাদী হাহাকার সুরে বললো,
–”হ হ এত চিল্লায়া কইতে লাগবো না। আমার কান আছে।”

এরকম হাসি-তামাশার মধ্যেই কথা চলতে লাগলো সবার। মাইশা এবার ধৈর্য এককোণে রেখে আমেনা বিবিকে জিজ্ঞেস করলো,

–”আন্টি অর্পি কখন আসবে?”

হেসে উঠলো সবাই। আয়াত হাসি চেপে বললো,
–”বাবারে……………ননদের দেখি ভাবিরে দেখার জন্য যেন আর তর সইছে না। নুহাশ ভাই, তোমার বোন দেখি তোমার থেকেও বেশি ফাস্ট !”

মাইশা ছোট ছোট চোখ করে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত নির্বিকার ভঙ্গিতে অর্পির দাদীর পাশ ঘেষে বসে আছে। আর ওই বিচ্ছু বুড়িটা সেই যে আয়াতের হাত ধরে বসে আছে , আর ছাড়ার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে মনে এই বুড়িটারেও হিংসে হলো মাইশার। মিনমিনিয়ে বললো,

–”অর্পি ঠিকই বলসে…………..এই বুড়ি কদিন পর সেঞ্চুরি মারলেও জোয়ান ছেলেপেল দেখলে মাথা ঘুইরা যায়।লুচি বুড়ী একটা!”
.
.
.
কিছুক্ষণ পরেই অর্পি ছোট বোন অরির সাথে ড্রয়িংরুমে আসলো । বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রেখেছে। সবসময়ের মতো আজ চশমা পড়েনাই অর্পি। তাই মায়াবী চোখজোড়া দেখে যে কেউ হয়তো ভীমড়ী খেয়ে পড়তে পারে। কিন্ত নুহাশ ভাই?মাইশা নুহাশ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়বসে আছে। তবে অর্পি লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা। মাইশা তো ঝটকার ওপর ঝটকা খাচ্ছে। এই মেয়েরে কোনো ভূত-প্রেতে ধরেনি তো? তাহলে এত স্বাভাবিকভাবে বসে আছে কিভাবে নুহাশ ভাইকে দেখা সত্বেও?

শারমিন বেগম মিষ্টি হেসে বললো,
–”অর্পিকে আগের থেকেই আমার অনেক পছন্দ। মাইশার সাথে যখন আসতো , কি সুন্দর হেসে হেসে আমার সাথে কথা বলতো ! দেখতেও সুন্দর-সাদাসিধে-পড়ালেখা আর আপনজনদের নিয়েই সুন্দরভাবে থাকতে পারে।এমন মেয়েকেই ছেলের বউ হিসেবে পেতে চাই আমি।”

দাদী গাটা মেরে বললো,
–কি গো অর্পি? জামাই ভাল্লাগছে? আমার কুদ্দুসটা (হাজবেন্ট) দেখতে একেবারে তোর হবু জামাইয়ের মতো আছিলো। কত যে মারে ফাকি দিয়া সিনেমা হলে গেসি, এবার তোরাও যাবি।”

অবশেষে অর্পি আর নুহাশকে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ দেয়া হলো। এ নিয়ে মাইশার কৌতুহলের যেন শেষ সীমা নেই। ওর অবাধ্য মনে বারবার প্রশ্ন জেগে ওঠছে অর্পিকে নিয়ে। তাই সবার চোখে ফাকি দিয়ে মাইশা ড্রইংরুম থেকে ওঠে অর্পির রুমের দিকে যেতে থাকলো। এটলিস্ট আবছা আবছা কথা শুনলেও ওর মন শান্তি পাবে।তবে অর্পির রুমে যাওয়ার আগেই কেউ ওর হাত টেনে এমন এক কোণে নিয়ে আসলো যেখান থেকে মাইশাকে দেখা যাবে না। আকস্মিক এ আক্রমণে খানিকটা হকচকিয়ে গেলো মাইশা। আয়াত দুহাত দিয়ে ওকে দেয়ালে আবদ্ধ করে রেখেছে। মাইশা কাপাকাপা সুরে বলে ওঠলো যে,

–”তুমি এখানে কখন আসলে?”

–”যেভাবে তুমি সবার চোখ ফাকি দিয়ে অর্পি আর নুহাশ ভাইয়ের প্রেমালাপ শুনতে এসেছিলে?”
বাকা হেসে বললো আয়াত। চোখের প্রখর চাহিনী মাইশার অস্থির চোখে মিলিয়ে রেখেছে। মাইশা দ্বিধাজনিত কন্ঠে বলে ওঠলো,

–”এসব ক-কি বলছো? আমি কারও প্রেমালাপ শুনতে আসিনি।”

–”তবে কি করতে এসেছো?”

–”ওরা দুজন কি করে সেটা দেখতে।”
বলেই মুখ চেপে ধরলো মাইশা। মুখ ফসকে আবারও আসল কথা বেরিয়ে গিয়েছে।আয়াতের মুখে ফুটে ওঠেছে একটা দুষ্টুমির আভাস। নিজের হাতটা ঘাড়ের কাছে রেখে একটু ঝুঁকে এলো মাইশার দিকে। যার দরুন মাইশা খানিকটা পেছাতে চাইলেও পেছাতে পারলো না দেয়ালে আবদ্ধ থাকার কারনে। আয়াত এবার বলে ওঠলো,

–”ওরা দুজন কি করছে না করছে তা দেখার জন্য এত ইন্টেরেস্ট কেনো তোমার? বিয়ের জন্য তর সইছে না বুঝি? দিস ইস নট ফেয়ার ! তুমি বয়সে বড় হলেও হাতে পায়ে এখনও বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তারপর পিচ্চি বউকে নিয়ে ঘর সংসার করবো নাকি !”

মাইশা এবার পুরোপুরি হ্যাং খেয়েছে আয়াতের কথায়। এই সাংঘাতিক ছেলেতো বহুদূরে চলে গিয়েছে। মাইশা বিরক্ত হয়ে বললো,

–”সাংঘাতিক মানুষ তো তুমি? আমি কি একবারও বলেছি যে আমার বিয়ে করার শখ জাগছে? আর তুমি কই কই চলে গেসো। ইয়া আল্লাহ !”

আয়াত ঠোঁট কামড়ে আরও কাছে এলো মাইশার। চোখে চোখ রেখে বিক্ষিপ্ত সুরে বললো,
–”আমি তো কোথাও যাইনি। এখানেই আছি।এইযে ! তোমার কাছাকাছি ।”

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে আয়াতের। এই ছেলে তো পাগল হয়েছেই, ওকেও পাগল বানিয়ে ছাড়বে। আয়াতের হুটহাট এভাবে কাছে আসাতে ওর যেন স্নায়ু কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। মাইশাকে এতটা অস্থির হতে দেয়া আয়াত বলে উঠলো,

–”এখনই এই অবস্থা ! সামনে যদি আরও ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যায়, সহ্য করতে পারবে মাইশুপাখি?”

মাইশা মিহি কন্ঠে বললো,
–”তখনকারটা তখন দেখা যাবে। এখন সরো না……….প্লিজ!”

আয়াত কিছু না বলে সরে যেতেই মাইশা ফটাফট এখান থেকে প্রস্থান করলো। কিছুক্ষণের আটকে রাখা রুদ্ধশ্বাস নিমিষেই এবার পরিণত হলো স্বস্তির নিঃশ্বাসে।
.
.
.
.
—————————————
ঘড়ির কাটা এখন দশটায় ছুই ছুই। খাটো চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মাইশা। মাথার ওর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে ওর তীক্ষ্ন দৃষ্টি। আজ সারাটিদিন ভয়াবহ ধকলের ওপর দিয়ে গিয়েছে। বিকেলে অর্পিদের বাসায় অর্পির সাথে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ পায়নি মাইশা। তারওপর ওই বুড়িটা আয়াতের সাথে যেই লেপ্টালেপ্টি শুরু করেছিলো মাইশার ইচ্ছে করেছিলো বুড়িটাকে তুলে একটা আছাড় মারতে। এই বয়সেও প্রেম জাগে………ইসসস ! শখ কত ! কিছুক্ষণ আগেই খালামণিরা রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে তাদের বাসায় চলে গিয়েছে। তাই এখন মাইশা মোটামোটি ফ্রি। চোখেও ভর করেছে রাজ্যের ঘুম। এখন আর একমুহুর্তও জেগে থাকা যাবেনা।

লাইট বন্ধ করে যখন ঘুমের দোরগোড়ায় পা দিতে চলেছিলো তখনও ফোনের রিংটোনে ঘুমটা হালকা হয়ে এলো ওর। এই মুহুর্তে রিংটোনের এই শব্দটা মাইশার বিদঘুটে মনে হচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে মোবাইল স্ক্রীনে তাকাতেই ভেসে ওঠলো অর্পি নামটি। মাইশা ঘুমুঘুমু কন্ঠে ফোন রিসিভ করে বললো,

–”হ্যালো ভাবি !”

ওপাশে অর্পি কাদো কাদো সুরে বললো,
–”ভাবি কইবি না আমারে কুত্তা। তোর ভাই আমার মান-ইজ্জত সব ফালাফালা কইরা ফেলসে!”
.
.
.
.
#চলবে………ইনশাল্লাহ
————————————