#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব ২৭+২৮
#কায়ানাত_আফরিন❤
–”ভাবি কইবি না আমারে কুত্তা। তোর ভাই আমার মান-ইজ্জত সব ফালাফালা কইরা ফেলসে!’
ঘুমের ঘোরে অর্পির এ কথাটি শুনে মাইশা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখাতে চাইলেও প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো ও। এতটাই অবাক যে ওর কর্ণকুহরে অর্পির কাদো কাদো স্বরটি অদ্ভুদভাবে বেজে ওঠছে। শোয়া থেকে উঠে বসলো মাইশা। চোখে মুখে এখনও আড়ষ্ট একটা ভাব। মাইশা ঠোঁট নাড়িয়ে মিহি কন্ঠে বললো,
–”এই মাইয়্যা ! পাগল হইছিস তুই? নাকি নুহাশ ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে মাথার তার ছিঁড়ে গেসে?”
–”আরে ছিঁড়ে তো গেসে তোর ভাইয়ের মাথার তার। ওই হালারে শুধু রাগী মনে করছিলাম , কিন্ত সাথে যে আরও একটা গুণ ফ্রিতে পাবো তা কি জানতাম?”
অর্পির অসংলগ্ন বাক্যগুলো মাইশার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তাই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কাট কাট গলায় বললো,
–”ভ্যা ভ্যা না করে পুরো ঘটনাটা বল যে হয়েছেটা কি?আর একমিনিট , তুই কি জানতি যে আজ আমরা তোকে দেখতে আসবো।”
ওপাশে দম নিলো অর্পি। হয়তো নিজেকে কথা বলার জন্য প্রস্তুত করছে।তারপর মলিন গলায় বলতে শুরু করলো,
–”আমার মায়ে দুইমাস ধরে আমার কান ঝালাপালা করে ফেলেসিলো যে কবে বিয়ে করবি কবে বিয়ে করবি। পরে ভাবলাম যে সামাদ-পৃথা তো ফিক্সড, তোরও কয়দিন পর হয়ে যাবে আর আনানের কথা তো বাদই দিলাম। ওই ছাগলের জীবনেও বিয়ে হইব না। এখন আমি? ভাবলাম শুভ কাজ সারতে দেরি করতে নেই। ”
–”একমিনিট…….একমিনিট…..! তুই না শাওন ভাইরে পছন্দ করতি?”
মাইশার বোকাসুলভ কথায় বিরক্ত হলো অর্পি। তেজী সুরে বললো,
–”পছন্দ তো কলেজ লাইফে আশিক, তীব্র , নিয়াজ, মুহিত সবাইরে করসি । পাড়ার বড় ভাইয়ের ওপরও ক্রাশ খাইয়া বসে ছিলাম। ভার্সিটির ওয়ান অফ দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম মিসির স্যারও বাদ যায়নি আমার নজর থেকে।তো এখন সবাইরে বিয়ে করে বসে থাকুম? এটা সত্যি যে শাওন ভাইয়ের ওপর একটা উইকনেস কাজ করত । বাট এছাড়া আর কিছুই না।এজন্যই তো ছেলে খুঁজতে বলছিলাম মারে। তারপর আজ সকালে হুট করেই মা বললো যে আজ নাকি একজন দেখতে আসছে। আমি তখনও জানতাম না যে ওটা নুহাশ ভাই ছিলো। আম্মুর কথামতো সুন্দরমতো সেজে চশমা ছাড়াই গিয়েছিলাম ড্রয়িংরুমে। আমার ঘোলাটে চোখজোড়া দিয়ে কারও দিকে মুখ তোলার মতো ক্ষমতা ছিলো না লজ্জায়। কিন্ত সবার কথাবার্তা শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম আমার মায়ের সারপ্রাইজ।”
মাইশার ধারনাই তবে ঠিক ছিলো। এই দুই মহিলা চক্রান্ত করে এই কারসাজি চালিয়েছে। মাইশা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
–”তারপর।”
———-পূর্বের ঘটনাসমূহ———
অর্পির রুমে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশ আর অর্পি। রুমে এসেই আগে চশমাটা পড়ে নিয়েছে ও। ভয়ে বুকটা রীতিমতো কাপছেঁ। তখন যে নুহাশ নামটা শুনে ওর মনে যে কি ঝড় বয়ে চলছিলো তা বলার বাইরে। কোনোমতে নিজেকে সামলে মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসির আবরণ দিয়ে রেখেছিলো। এমনিতেও নুহাশ ভাই যে কি রাগী, ১৯ থেকে ২০ হলে বাঘের মতো হুংকার দিয়ে ওঠে আর এই ছেলে ওর জামাই হবে? বিয়ের পর তো অর্পির তবে কান্না করতে করতে চোখের পানি শুকিয়ে যাবে।সারা জীবন টিচারদের মতো স্ট্যান্ড আপ এন্ড সিট ডাউনের মুখোমুখি হতে হবে। ভাবা যায়?
ভাবতেই অর্পির গলা ছেড়ে কাদতে মন চাচ্ছে এবার। নুহাশ নিরবতা কেটে বললো,
–”এমনিতেও তো তুমি চশমা ছাড়া কিছু দেখতে পাও না। তো আজ চশমা ছাড়া আসলে কেনো? উষ্টা খেয়ে হাত-পা ভেঙ্গে গেলে কি পরে ভাঙা বউ নিয়ে আমার ছুটোছুটি করতে হতো?”
একথাটি শুনেই ক্ষীপ্ত হয়ে গেলো অর্পি। এ তো তার চশমা নিয়ে রীতিমতো অপমান । তবুও কোনোমতে ও নিজেকে সামলে রাখলো। মনে রাখতে হবে এটা নুহাশ ভাই। অর্পি একটা পাল্টা উত্তর দিলে ওই ছেলে পাল্টা চড় মারতে দ্বিধা করতো না।নুহাশ এবার বলে ওঠলো,
–”কি ব্যাপার অর্পি? আমায় দেখলে তোমার অপারেটিং সিস্টেমে জং ধরে যায় নাকি?আমার দিকে তাকাও না , কোনো কথা বলো না , একটা জলজ্যান্ত মানুষ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্ত তুমি ভাবনায় মশগুল।হায় আল্লাহ ! এ আমি কার পিছে ঝুলে পড়লাম? ”
রেগে গেলো অর্পি। চেচিয়ে বলে ফেললো,
”আপনারে আমি বলেছি এমন কানা বান্দররে বিয়ে করতে? তাছাড়া আপনারে বিয়ে করার কোনো শখ নেই। ওইদিন আপনার চড়েই আমি সিধে হয়ে গেসি……………………”
এতটুকু বলেই থামলো অর্পি। নুহাশের দিকে আড়ষ্টভঙ্গিতে তাকিয়ে ওর ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। এতক্ষণের নির্বিকার নুহাশের ঠোঁটে ফুটে ওঠলো একটা অদ্ভুত হাসি। শান্ত গলায় বললো,
” আমি ওইদিন তোমার গালে চড় মেরেছিলাম দেখেই আমায় বিয়ে করবেনা তাইতো?”
নুহাশের ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকাচ্ছে না। অর্পি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো নুহাশের দিকে। নুহাশ আবার বললো,
–”বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো। তার আগে তোমাকে সাইজ করে নেই। তো তোমার ডান গালে থাপ্পড় দিয়েছিলাম না?”
কথাটা বলে নুহাশ ফট করে চুমু দিয়ে দিলো অর্পির ডান গালে।অর্পির মাথার লাইট এবার যেন ফিউজ হয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে তাই তাকিয়ে আছে নুহাশের দিকে।হাত পা বিরামহীনভাবে কাপঁছে ,যেন শরীরের ওপর দীয়ে সাইক্লোন চলে গিয়েছে। এটা কি ঘটলো ওর সাথে? নুহাশ ওর গালে…………….ভাবতেই অর্পি কাদো কাদো মুখে গালে হাত দিয়ে দিলো। নুহাশ তা দেখে মুখে রহস্যময়ী হাসি টেনে চলে গেলো এ ঘর ত্যাগ করে।
————————————————–
মাইশা স্তব্ধ। এ মাত্র কি শুনলো এটা। কানে হাত চেপে বললো,
–আস্তাগফিরউল্লাহ ! এই মাইয়্যা ! তোর লজ্জা করেনা আমার কাছে আমার বড় ভাইয়ের প্রেম কীর্তি বলতে?
–তোর ভাই আমার গালে কিস করছে যেটা আজ পর্যন্ত একটা ছেলেও করেনি আর তুই কিনা…………..!
–তো কি করবো আমি?ভাইরে বলমু যে , ভাই ! তুই তোর হবু বউরে আর কিস করবি না……….বিয়ের পরেও না। বলবো?
চুপ হয়ে গেলো অর্পি। ওর ছোট মস্তিষ্ক বুঝে গিয়েছে ওর বিশিষ্ট মাতা এই নুহাশের ঘাড়েই ওকে চাপিয়ে দেবে।মাইশা এবার ঘুমুঘুমু কন্ঠে বললো,
–”দেখ , আমার অনেক ঘুম পাইসে। আমি এবার ঘুমাইতে গেলাম। তোর যদি আরও কথা বলতে ইচ্ছে হয় যা তোর হবু জামাইরে কল দে।
বলেই টুট টুট করে কল কেটে দিলো মাইশা।
.
.
.
.
———————————————
রাতের আমেজে নিস্তব্ধটা চারিপাশ। ঘড়ির কাটা ১ঃ০৫ দেখাচ্ছে। তখন অর্পিকে ঘুমের কথা বলে কল কেটে দিলেও এখনও নিদ্রাহীন ভাবে সময় কাটাচ্ছে মাইশা। মনে পড়ছে অর্পিদের বাসায় হুট করে আয়াতের কাছাকাছি আসার দৃশ্যটা। আচ্ছা , তখন যদি মাইশা নুহাশ ভাইয়ের মতো আয়াতের গালে ফট করে একটা চুমু দিয়ে দিতো , তখন আয়াতের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো? অর্পির মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেত নাকি নিজেই একটা ডোজ দিতো? লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে মাইশা। মনটা আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। হুট মাইশার কি হলো ও জানেনা…………..মনে হলো আয়াতকে এখনই দেখতে হবে ওর…………..এখন না দেখলে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে। সহস্র ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে চার্জারের তার থেকে মোবাইল খুলে আয়াতের নাম্বারে ডায়াল করলো মাইশা।
মনে হচ্ছে যে কল রিসিভ করবে না। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে। কিন্ত ওর ভাবনাকে ভুল ধরিয়ে কল রিসিভ করলো আয়াত।
–”আসসালামু আলাইকুম , আরহাম আয়াত বলছি !
আয়াতের শক্ত পুরুষালি কন্ঠ শুনে দমে গেলো মাইশা। উত্তেজনায় হৃদয় কিছুটা কাপছে। আয়াতের কন্ঠ শুনে বোঝাই যাচ্ছে যে মাইশার নাম্বার ওর কাছে নেই।তাছাড়া মাইশা কখনোই নিজ থেকে আয়াতকে নাম্বার দেয়নি আর না আয়াত নেয়ার চেষ্টা করেছে।বরংচ আয়াতের নাম্বারটাই শাওন ভাইয়ের কাছ থেকে ম্যানেজ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো ওর।কিন্ত আয়াতের ফর্মাল কন্ঠটা আসলেই বেশ সুন্দর। এতটাই সুন্দর যে এই সুন্দর কন্ঠের মায়ায় যে কেউই বিমোহিত হয়ে যাবে। নির্বিকার ভাবে তাই এবার বললো,
–আমি মাইশা।
ওপাশে আয়াত নিশ্চুপ। নীরবতা কাটিয়ে গম্ভীর স্রে বলে ওঠলো,
–এখনও ঘুমাওনি তুমি মাইশুপাখি?
–উহু ! তুমি ঘুমাতে দিচ্ছো না তো !
ওপাশে একটু হাসলো আয়াত।বুঝে গিয়েছে যে এই মেয়েটা ওকে নিয়ে কল্পনা করতে করতেই নির্ঘুমে রাত কাটাচ্ছে।
–একি ! হাসছো কেনো? আচ্ছা শোনো না…………আমার না তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার আসবে প্লিজ ?
কি নিঃসংকোচ আবেদন মাইশার। এমন জড়ানো কন্ঠ পেয়ে আয়াত কিছুটা ভড়কে গেলো। মাইশার মুখ থেকে যে এমন কোনো কথা শুনবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই চিন্ততসুরে বললো,
–আর ইউ ফাইন মাইশা? জ্বর টর হয়নি তো?
–কি সব বলছো? আমার জ্বর টর হতে যাবে কেনো? আমি জাস্ট তোমাকে কাছ থেকে দেখতে চাই।
–তো কাল সকালে আসি?
–এখনই মানে এখনই। কাল দেখে কিছু করা আর এখন দেখে কিছু করার মধ্যে বিরাট এক পার্থর্ক্য আছে।
প্রখর কন্ঠে বললো মাইশা।ওপাশে আয়াত দুষ্টুমির স্বরে বলে ওঠতো,
–তো তুমি কিছু করতে চাও নাকি?
–চাই তো? অনেক কিছু করতে চাই।যেমন টাইট একটা হাগ করে বুকে মাথা রেখে তোমার সব ট্রাভেল এক্সপেরিয়েন্স শোনা , আরও অনেক কিছু। এখন বলা যাবে না।
ওপাশ থেকে হো হো করে হেসে ওঠলো আয়াত।কোনোমতে মিনমিনিয়ে বলে ওঠলো,
–প্রেমে পড়ে তোমার মাথা গিয়েছে মাইশু।যেই ছেলে তোমায় কোলে নিয়েছিলো বলে চলন্ত ট্রেনে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিলে এখন সেই ছেলের বুকে মাথা রেখে গল্প করবে?
–এগুলো বলবা না প্লিজ। খারাপ লাগে তো।
–আচ্ছা বলবো না। তবে কি জানো যে এখন কয়টা বাজে? ১ঃ১৫। আর এই মাঝরাতে জান হাতে নিয়ে আমি একটা মেয়ের বাসায় যাবো? লোকজন তো আমায় জুতোপিটে করবে।
–আমার জন্য একটু জুতোপিটে খেলে কিচ্ছু হবে না। তুমি এখন আসবে মানে আসবে। ব্যাস !
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আয়াত। তারপর মলিন সুরে বললো,
–আচ্ছা , আমায় সময় দেও। আমি বাসায় গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে আসছি।
–মানে? তুমি কোথায়?
–রেডিও স্টেশনে। ১২ঃ০০ টায় একটা টক শো ছিলো এক ইউটিউবারের সাথে। আমিই হোস্ট করেছিলাম। ১ঃ০০ টায় শেষ হয়েছে।
–তো এতক্ষণ বললে না কেনো?
মৃদু হেসে ওঠলো আয়াত। তারপর শ্বাস টেনে বললো,
–বড্ড ক্লান্ত ছিলাম মাইশু। আননোন নাম্বার রিসিভ করে যখন তোমার কন্ঠ শুনলাম , ট্রাস্ট মি শকড হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি এই মাঝরাতে যেমন পাগলামো করছো এখানে বসেই আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছি আমি। তো কি বলতাম বলো?এই ক্লান্ত মনে যে কেবল তোমাকেই অবাধে বিচরণের অধিকার দিয়েছি।
মাইশা নিশ্চুপ । আয়াতের কন্ঠে কেমন যেন একটা নেশা দেখতে পেয়েছে। মাইশা আবার বললো,
–তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ। আর হ্যাঁ !গেটের কাছে বাইক রাখবা না। একটা কোণে রেখে ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থাকবা? আবার পাইপ বেয়ে হিরোদের মতো বারান্দায় উঠে পড়ো না কিন্ত। আমি নিচে আসবো ।
–আচ্ছা ঠিকাছে। আমি কিন্ত অলরেডি বের হয়ে গিয়েছি। আসতে একঘন্টার মতো লাগবে।এখন তোমার ডিউটি হলো একটা সেক্সি নাইটি পড়ে নিচে এসে আমাকে পাগল করে তুলবা ।
–জুতা চিনো?
–হা হা হা। জোক করলাম। আচ্ছা শুনো। বাইরে কিন্ত ভালোই বাতাস আছে। মনে হয় শেষ রাতে বৃষ্টি পড়বে। তুমি একটা পাতলা চাদর পড়ে এসো। লাভ ইউ মাইশুপাখি !
কল কেটে দিলো আয়াত। চোখে রাজ্যের ক্লান্তি ভর করলেও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। ঠোঁট নাড়িয়ে হালকাভাবে বলে ওঠলো,
–প্রেমিকার আজকাল দেখি প্রেমিকের জন্য দৃষ্টিনেশা হয়ে ওঠেছে। উহ্………..পাগল হয়ে যাবো তো !
.
.
.
.
.
#চলবে…….ইনশাল্লাহ