হৃদমোহিনী পর্ব-১৯

0
618

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৯

ছোট ছোট কেয়ার, একটুখানি প্রেম সব মিলিয়ে দিনগুলো এবার ভালো মতোই কাটতে লাগলো।
দিনে দিনে আমাদের প্রেম গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। ধূসরও ততোদিনে সুস্থ হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের সবকিছু, মানুষের স্বভাব সবকিছু পাল্টেছে। আমাদের ঘরের রুপটাও পাল্টেছে। অর্নির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটা। বরাবরই ওর পছন্দের জিনিসপত্র ইউনিক ছিলো। আমার পছন্দ আবার ততোটা ভালো নয়। কিন্তু এতো সুখের মাঝে থেকেও মাঝে মাঝে আমি অর্নির শূন্যতা অনুভব করি। তখন কষ্টে বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। কিন্তু ধূসরের সামনে কাঁদিনা। বেচারা তাহলে খুব কষ্ট পাবে। আমার এই বোনটাকে আমি আমার হৃদয়ের একটা অংশে খুব যতনে রেখে দিয়েছি। আর ওর ভালোবাসাটাকে আগলে আমি বেঁচে আছি। এটাই নিয়তির কারুকাজ। কেউ পেয়েও পায়না, আর কেউ না চাইতেই পেয়ে যায় সবকিছু!

সপ্তাহখানিক পর, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সুস্থভাবেই আমার ছোট্ট সোনামণি পৃথিবীর আলো দেখলো। ছোট্ট একটা ধূসরমানবী আমার কোলজুড়ে এলো। আমার ক্ষুদ্র জীবনটাকে পরিপূর্ণতা দান করলো! মা হওয়ার আনন্দে আমি তখন সুখের ভেলায় ভাসছি। ধূসর তো পুরো হসপটালের সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করেছিলো। তারপর এলো বাচ্চাকে কোলে নিতে। ওনি ঠিক করলেন তোয়ালে দিয়ে ওকে কোলে নেবেন না, নিজের সেলাই করা কাঁথাতেই কোলে নেবেন বলে সে কী ঝামেলা সিস্টারদের সাথে। ওনার এক কথা, ‘আমি সবকিছু জীবাণুমুক্ত করে এনেছি, আপনি ওখানেই রাখুন আমার পিচ্চুনিকে।’

সিস্টার বেচারি অসহায় গলায় বললেন, ‘আমাকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন আপনার বাচ্চাকে যাতে কেয়ারফুলি রাখি। বাইরের জিনিসপত্র ইউজ যাতে না করি।’
ওনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
-বাইরের জিনিস? কোনটা বাইরের জিনিস? এটা আমার নিজের হাতে তৈরি করা জিনিস। আর ধূসর কখনো পুরোনো বাতিল জীবাণুযুক্ত জিনিস ইউজ করেনা।
সিস্টার এভাবে কিছুতেই ওনার কোলে দেবেনা। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
-তবুও স্যার আপনি বোঝার চেষ্টা করুন….
ধূসর ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-কিচ্ছু বোঝাতে হবেনা।
সিস্টার এবার বেশ বিরক্ত হলো। বললো,
-এতে আপনার বেবিরই প্রবলেম হবে।
একথা শুনে আমি ধূসরকে অনুরোধ করলাম এমন পাগলামো না করতে। ওনার পাগলামো দেখে সবাই হাসতে হাসতে খুন। তবু অনেক কষ্টে ওনাকে সবাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালো। দুই পরিবারে যেন ইদের মতো আনন্দ লেগেছে। এভাবে সবাইকে দেখতে খুবই ভালো লাগছে। এক পৃথিবীর সকল সুখ আমার সামনে তখন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছিলো।

হসপিটালে দু’দিন কাটিয়ে পিচ্চুনিকে নিয়ে আমরা বাসায় চলে এলাম। তারপর জীবনটা আরো রঙিন হয়ে উঠলো। আমার ছোট্ট ধূসরমানবীটা ছোট্ট হাত-পা মেলে খেলা করে, মিটমিট করে আমাদের দেখে। এভাবেই মাস কয়েক কেটে গেলো। নিকিতা মা সংসার সামলাতে ব্যস্ত, আমি ধূসর আর পিচ্চুনিকে সামলাতে ব্যস্ত। একদিন রাতে আমি পিচ্চুনিকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছি, ধূসর বাইরে থেকে ফিরে এসে আমাদেরকে এ অবস্থায় দেখে আর ডাকলোনা। সোজা ফ্রেশ হয়ে এসে আমার পেছনে শুয়ে পড়লো। আমি তখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমে মগ্ন। ওনি আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমার নাকে-মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। এতে আমার পাকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। তারপর আবার ঘুম। হঠাৎই ধূসর নাঁকি সুরে ভয়াবহ কন্ঠে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
-এই আরু…আরু!!
আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে মিটমিটিয়ে হাসছি। দ্বিতীয়বারও একইভাবে বলতে লাগলো। আমি এবার ভয় পাওয়ার ভান করে বললাম,
-ক কে কে?
– ভূততত..
-তাই বুঝি?
-হ্যাঁ।
-কিন্তু আমি যে আমার ভূত বাবাজিকে ভয় পাইনা?
ধূসর চিকম সুরে ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগলো,
-বড্ড সাহস তাইনা? বড্ড সাহস!
-আমিতো আর ভিতু নই, তাই পাঙ্গা নিতে আসবেন না ভূত মশাই। আপনি হয়তো জানেন না আমি একলা নই।
-একলা নন, তাহলে কি দোকলা?
-অভিয়েসলি মিস্টার ভূত মশাই। আমার সাথে আমার বোন অর্নি আছে..তার বোনকে ভয় দেখিয়ে আপনি পার পেয়ে যাবেন তা তো হতে পারেনা..
ধূসর ভাব নিয়ে বলল,
-তোমাদের দুটো বোনকে বোতলে করে আমার হৃদপিন্ডে ঢুকিয়ে রাখবো, ওকে? দ্যান মজা বুঝবে!
-হা হা হাসালেন আমায়! সেই স্পর্ধা আপনার নেই মিস্টার। এই যে দেখুন, আমার কোলে আমার পিচ্চুনি আছে, আমার মেয়ে তার মাকে বাঁচাবে!!
ওনি হুট করে উঠে বসে পড়লেন। ভ্রু কুঁচকে নাক টেনে বলতে লাগলেন,
-বাহ রে বাহ! পিচ্চুনিটা কী তোমার একলা নাকি? এতে বুঝি আমার কোনো অংশীদারীত্ব নেই?? আকাশ থেকে বুঝি পিচ্চুনিটা এসে পড়েছে?
-হ্যাঁ সেটাই।
ওনি রেগে গেলেন।
-কী বললে??
ওনার চিৎকারে আমি চুপ হয়ে গেলাম। ওনার রাগী কথাগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমি মুখটা গম্ভীর করে বিষাদমাখা কন্ঠে বললাম, ‘আপনার ভূত ভূত খেলা বন্ধ হলে এবার দয়া করে একটু চুপ করুন ধূসরমশাই।’
ওনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘কেন কেন? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?’
-না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পিচ্চুনিটা এতোক্ষণ কেঁদে কেঁদেই ঘুমিয়েছে, বেশি জোরে কথা বললে উঠে পড়তে পারে!
-ঘুমাবে?
-আপনি তো ভাঙ্গিয়ে দিলেন। এখন আর ঘুম আসছেনা।
ধূসর কিছু একটা ভেবেচিন্তে বললেন,
-চলো বারান্দায় যাই। আজ জোৎস্না রাত।
-জোৎস্না রাত দিয়ে আমি কী করবো?
-জোৎস্না খাবে, তোমার জীবনটাও ধূসর থেকে জোৎস্নাময় হয়ে উঠবে। অর্নির ফেভারিট কাজের মধ্যে এটাও একটা, তুমি জানো!
আমি আলতো হেসে ধূসরের গালে হাত রাখলাম। নিদারুণ এক অনুভূতি টের পেলাম মনের কোণে। একটু নয়, অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি এই মানবটাকে। আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, ‘আমি ধূসরহীন জীবন চাইনা, জোৎস্নাময় জীবন তো এটাই যেখানে আমার ভালোবাসা আছে। আমি এখন ভালোবাসার মানুষটার সাথেই সুখে আছি তাহলে কেন অন্যকিছু চাইবো!’
ধূসর হাসলো।
-চা করে নিয়ে আসি?
-হুঁ।
-পিচ্চুনিকে দেখবেন, যাতে উঠে না যায়!
-আচ্ছা আচ্ছা।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা করে নিয়ে এলাম। ঘরে এসে দেখি ধূসরমানব পিচ্চুনিকে নিয়ে খেলা করছে বিছানার উপর। ঘটনা বুঝতে পেরে আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। ওনি থতমত খেয়ে বললেন, ‘ইয়ে.. মানে!’
-মানে মানে করবেন না। আমি জানি আপনিই ওকে ঘুম থেকে উঠিয়েছেন। বাচ্চাদেরকে এভাবে ঘুম থেকে জাগানো ঠিক নয় আপনি জানেন না?

ধূসর বলল, ‘ভাবলাম আজ চন্দ্রবিলাস করবো তাই কন্যাকে সাথে নিয়েই করি।’

এটা বলতেই আমার গুণধর কন্যা হেসে হেসে বাবার কথায় সায় জানালো। ধূসর ওর গাল টেনে দিতেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। বাপ-বেটির আহ্লাদীপনা দেখে আমি মুখ টিপে হাসছি। আমি কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো। ধূসর আমাকে বিকট এক ধমক দিয়ে পিচ্চুনিকে কোলে করে বারান্দায় চলে গেলো। মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা না করে ওনি দুনিয়ার হাবিজাবি কথা বলে চলেছেন আর ওর পিঠে হাত বুলাচ্ছেন, মেয়ে আমার এমনিতেই চুপ হয়ে গেলো। এই লোকটা এতো ফাজিল। সুযোগ পেলেই পিচ্চুনিকে ঘুম থেকে জাগানোর ফন্দি আঁটে। ওনার নাকি শান্তশিষ্ট বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ নয়। বাচ্চারা থাকবে চঞ্চল, প্রাণোবন্ত, উচ্ছল। কিন্তু এটা শুধু ওনার মেয়ের জন্যই শিরধার্য! অন্য কারো বাচ্চা এমন হলে ধূসর প্রচুর বিরক্ত হন। এমনকি ফোনেও পিচ্চুনির কান্নার শব্দ রেকর্ড করে রেখে দিয়েছে। সময় সুযোগ পেলেই ওটা লাউডে দিয়ে বা মিউজিক বক্সে লাগিয়ে শুনেন। ওনার এই অদ্ভুত কর্মকান্ডে আমি প্রচুর বিরক্ত। অবশ্য আমার মেয়ে তার বাপের সব কর্মকান্ডই পছন্দ করে, যেমনটা অর্নি করতো! মাঝেমাঝে মনে হয়, আমার এই ছোট্ট পিচ্চুনির মাঝেই অর্নির বাস! সেই চোখ, সেই নাক, সেই অভ্যাসগুলো যা অর্নির মাঝে ছিলো সবই আমি আমার মেয়ের মাঝে দেখতে পাই। এমনও হয় আদৌ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ধীরপায়ে হেঁটে বারান্দায় গেলাম। নিকষকালো অন্ধকার ধুয়েমুছে দিচ্ছে মাথার উপরে থাকা বিশাল চাঁদটা। ধূসর মেয়েকে গান শোনাচ্ছে। এই লোকটা যে এতো ভালো গাইতে পারে, তাও আবার রবিবাবুর গান আমি সেটা জানতামই না। কী সুরেলা ওনার কন্ঠ, কত আবেগ দিয়ে প্রতিটি লাইনকে জীবন্ত করে তুলেন আমি বলে বোঝাতে পারবোনা।

———‘ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে
দীপের মতো গানের স্রোতে কে ভাসালে॥
যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে,
জড়াস নে শৈবালের জালে॥
তীর যে হোথা স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ সেই জ্বালালো-
অচল রহে তাহার আলো।
গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল- পানে
চপল ঢেউয়ের আকুল তালে॥’

চলবে….ইনশাআল্লাহ!