হৃদমোহিনী পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
1111

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০

রাতটা বারান্দায় মাদুর পেতে, চন্দ্রবিলাস করতে কর‍তেই আমরা তিনজন কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিরাজির ছোঁয়া চোখেমুখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তখন ভোর হচ্ছে। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। আমি ধূসরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘরে নিয়ে এলাম। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওনি আবার সেই ঘুম দিলেন। রাত জাগার ফল এটা!
আমিও পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মুহুর্তেই মাথা ভার করানো ঘুম এসে গ্রাস করলো আমাকে।

ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। হাই তুলতে তুলতে উঠে বসলাম। ধূসর নেই পাশে, এমনকিও ঘরেও নেই। আমার পিচ্চুনিও নেই। গেলো কোথায় বাপ-বেটি? ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। সাড়ে দশটা বাজে! ও মাই গড! নিকিতা মা আর আব্বু কীসব ভাববে? আল্লাহ! আমি দ্রুত দাঁত ব্রাশ করে, হাতমুখ ধুয়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এলাম। রান্নাঘরে মা আর বুয়া মিলে কুটনো কাটছে। সম্প্রতি পিচ্চুনি হওয়ার পরে বাবা বুয়া রেখে দিয়েছে যাতে আমাদের একটু সুবিধা হয়। আমাকে দেখে মা হেসে বললেন, ‘ঘুম ভাঙলো? টেবিলে বস খাবার দিচ্ছি।’

আমিও প্রতিত্তোরে হাসি দিলাম। লজ্জ্বামিশ্রিত কন্ঠে বললাম, ‘আসলে কাল রাতে… ‘
-হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবেনা। আমার গুণধর পুত্রই বলেছে তোরা রাতে জোৎস্নাবিলাস করে সকালে ঘুমাতে গিয়েছিস।
-ইয়ে মানে…
-আরে এতো লজ্জ্বা পাচ্ছিস কেন। নরমাল হ…
আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওনি কোথায়? আর ওকে নিয়েই বা কোথায় গেলো..বলেছে তোমাকে?’
-হ্যাঁ। এইতো সামনের মাঠটাতে গিয়েছে। অনেকক্ষণ হলো তো!
-পিচ্চিটাকে নিয়ে যাবার কী দরকার ছিলো?
-কাঁদছিলো। আমিই পাঠালাম, কিশমিশকেও নিয়ে গিয়েছে।

আমি পানি খাচ্ছিলাম। মায়ের কথা শুনে বিষম উঠে গেলো। মা এসে ধরলো আমাকে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এ ও সম্ভব? যার সাথে ওনার সাপে-নেউলে সম্পর্ক তাঁকে নিয়ে কীভাবে বেরুলো! আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,’সত্যিই?’
-হুম।
-কিশমিশকে তো দু’চোখে দেখতে পারেনা। ওনিই আবার নিয়ে গেলো!
মা হেসে বললেন, ‘গলায় বেল্ট বেঁধে ভদ্র সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছে, আমাদের কিশমিশ যা ছটফট করে!
-হা হা।
-আচ্ছা নাস্তা করে নে। আমি রান্না চাপাচ্ছি।
-আচ্ছা।

মা রান্না বসাতে চলে গেলেন আর আমি নাস্তা করে বাসনপত্র ধুয়ে মাকে হাতে হাতে কিছু কাজ করে দিয়ে ঘরদোর গুছিয়ে ঘরে চলে এলাম। ধূসর মেয়েকে নিয়ে এখনো আসেনি। অলরেডি দুইঘন্টা হয়ে গিয়েছে। আমি বারান্দার গাছগুলো ছেঁটে দিচ্ছিলাম। গেইটের দিকে চোখ পড়তেই ওনাদের দেখতে পেলাম। মেয়ে বাবার কোলে খিলখিলিয়ে হাসছে, এই প্রথম বাইরের হাওয়া খেলো, ভালো তো লাগবেই! কিশমিশের গলার বেল্টে লম্বা নাইলনের দড়ি বেঁধে সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে হেঁটে আসছে ধূসরমানব। বেচারা কিশমিশ ছাড়া পাবার জন্য ‘কুইকুই’ করতেই তিনি ধমকে উঠলেন। আমি ওনাকে ডাকলাম। ওনি উপরে তাকাতেই আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, ‘ তাড়াতাড়ি বাসায় আসুন।’
ওনি আসছি বলে দ্রুত বাসার ভেতরে ঢুকলেন, আমিও নিচে নেমে এলাম। মেয়েকে আমার কোলে দিতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিশমিশকে ধমক দেন কেন এতো?
ওনি বিরক্ত গলায় বললেন,
-ও লাফালাফি করে বেশি, এতোক্ষণ জ্বালিয়ে খেয়েছে। শুধু চঞ্চলতা, আমি মিষ্টি করে বললাম মা এতো দৌড়াতে নেই, ওমা আমায় মুখ ভেঙচি দিলো। বুঝতে পারছো কেমন এ!!
আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি ওকে মা ডেকেছেন?’
-হুম। তাতে কী হয়েছে?
আমি বললাম, ‘কিছুনা। বেচারি শকড হয়েছে হয়তো। আসলে আপনি তো ওকে সহ্যই কর‍তে পারেন না।
-দুষ্টামি করে বলেই ধমকাই, আমিও ওকে ভালোবাসি। হুহ!

ওনার কথা শুনে আমি আর মা হেসে ওঠলাম। মেয়েও হেসে ওঠলো। বাবা বাইরে থেকে এসে ধূসরমানবের কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘বুদ্ধি হয়েছে তাহলে।’
ওনি রাগী স্বরে বললেন, ‘আব্বু তুমিও…’
আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম। ওনি রেগেমেগে মেয়েকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। আমি কিশমিশকে খাবার দিয়ে ঘরে চলে এলাম। ধূসর কিঞ্চিৎ রেগে আছে। ওনার কপালে চুমু দিতেই ওনি বোকাবোকা কন্ঠে বললেন, ‘আমার কী সত্যিই বুদ্ধি নেই নাকি? আব্বু আমায় বোকা ভাবে! ড্যাম ইট…’

ওনার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম আবারও!

এভাবেই কাটতে থাকে আমাদের জীবন। আমাদের দুই পরিবারের সবাই-ই ভালো আছে, অন্তত আমি ভালো আছি, ধূসর ভালো আছে তাই। নইলে অর্নির পরিণতির কথা মনে হলেই আব্বু-আম্মু ভেঙ্গে পড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়ে এখনো। আমি সবসময় বুঝাই, তাই ওরা নিজেদের কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করে। যেটা খুবই ভালো একটা বিষয়। তাছাড়া অনি রাতুলের সাথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে কয়েকমাস হলো। পুনম, ছোটমা, মেজমা সবার জীবন আগের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত! নিকিতা মা, বাবা এখন চিন্তামুক্ত। তাঁদের পাগল ছেলেটা যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে তাতেই তাঁরা খুশি। আমিও আমার সংসারে সুখে আছি।

তবুও… তবুও..তবুও কোথায় গিয়ে যেনো আমি আটকে যাই, থমকে যাই! সেই দিনগুলোর কথা ভীষণভাবে মনে হয়, অর্নি! আমার সেই বোনটি যে আমার মতো কঠোর একটা মেয়েকে আবেগী প্রেমিকা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে, ভালোবাসা বুঝিয়েছে সেই মেয়েটিকে আমি খুব মিস করি। ওর শূন্যতা কুড়েকুড়ে খায়। ছেলেবেলার হাজারো পাগলামি, যেগুলো ধূসর জানেনা সেই সোনালি স্মৃতিগুলোর কথা মনে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কেন ছেড়ে গেলো সে?? উত্তর দেয়না কেউ!

আমার মেয়ে আমারই কপি, তবে.. স্বভাব অভ্যাস সব অর্নির পেয়েছে। আমি বুঝতে পারিনা এতোটা মিল কারো সাথে কী করে হতে পারে! সে যখন মাম্মাম বলে ডেকে ওঠে তখন ওর কালো মিশমিশে চোখদুটো অর্নির মতোই ঝলকে উঠে, গালগুলো হেসে ওঠে! সেই হাসিতেই প্রতিবার, প্রতি মুহূর্তে আমি আমার অর্নিকে খোঁজে পাই। আমার গালে তো আর টোল পড়েনা,অর্নির পড়তো! ধূসর নিজে তার মেয়ের নাম রেখেছে! আরু, অর্নি তাঁর হৃদয় আর মেয়ে তার মোহিনী। এরাই হলো তার হৃদমোহিনী! তাই মেয়ের নাম রেখেছে “মোহ”। আমাদের মোহ সোনা!

সেদিন এক বৃষ্টিমাখা আষাঢ়ে রাত। মেয়ে ঘুম দিয়েছে খানিক আগে। আমিও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ধূসর ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিলো, আমাকে অপেক্ষা করতে বলে সেই একঘন্টা যাবৎ এক বন্ধুর সাথে খেজুরে আলাপ বসিয়েছেন। আমি রাগে জর্জরিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। কথাই বলবোনা এই লোকের সাথে৷ বন্ধু যখন আছে তখন বউয়ের দরকার কী? অসহ্য! শুয়ে পড়ার মিনিট পাঁচেক পর
ধূসর এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। বতার এক’পা আমার উপর উঠিয়ে দিয়েছে। ওড়না ভেদ করে আমার পেটে তাঁর হাত বিচরণ করছে। আমার রাগ ভাঙ্গাতে এসেছে! আমি ঘুমঘুম চোখে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,’বন্ধুর সাথে গল্প করুন। এরকম করবেন না, আমি ঘুমাবো।’
-এখন ঘুমানো যাবেনা।
-ওফ…যান তো আপনি। ছাড়ুন আমায়…
-না। আমাকে আদর দাও!
-বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে? মেয়ে পাশে তাও আপনি এসব নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন!!
-ড্যাম ইট! আমি বুড়ো? এই এই মেয়ে তুমি এটা কী বললে আমায়? নিজে কী? একটা চাশমিশ পেত্নী, তোমার বাচ্চা তো ওই কিশমিশ…. সারাদিন ম্যাঁও ম্যাঁও করে আমার মাথা খায়!
আমি মুখ ঘুরিয়ে রেগে বললাম, ‘বাহ বাহ। ভালো তো। তো এই কিশমিশের মা’টাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? আদর পেতে চান কেন? বন্ধুকে গিয়ে বলুন আপনাকে আদর দিতে! ছাড়ুন আমায়! আর কক্ষনো আসবেন না আরুণীর কাছে, চলে যাচ্ছি!
আমি উঠে যেতে নিলেই ধূসর আমার হাতদুটো বিছানায় মুড়ে ধরলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এতো রাগ করেনা কিশমিশের আম্মু। এই ধূসরমানবকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবেনা।’
-যাবোই আমি।
-আচ্ছা স্যরি আমি। আর কখনো বন্ধুটন্ধুর সাথে কথা বলবোনা। প্লিজ…
-সত্যি?
-হান্ড্রেড পার্সেন্ট কিশমিশের আম্মু…
আমি এবার হেসে ফেললাম।
-কিশমিশ বেচারার সাথে আপনার কিসের এতো শত্রুতা?
-সে আমার বউয়ের হাতে খিমচি দিয়েছিলো কেন!!
-সে তো আপনার মেয়েও দেয়।
-তবুও…
-কেন?
-উফ..এসব বাদ দাও৷ আদর চাই আমার…. আমার জীবনের দ্বিতীয় হৃদমোহিনীর মোহ করা আদর চাই। ব্যস।।
-কোনো আ…
কথা শেষ করার আগেই ধূসরমানব আমার ঠোঁটে দখলদারিত্ব শুরু করলেন। এক অজানা সুখে শিহরিত হতে লাগলাম। বৃষ্টিভেজা রাতে প্রেমের বর্ষণ! কারো হৃদয়ের হৃদমোহিনী হওয়া এতো খুশির কেন? আহা! ভালোবাসা এতো সুন্দর কেন!!

সমাপ্ত। এন্ডিং মনমতো হয়নি মনে হলে আমি ভীষণভাবে দুঃখিত! অনেককিছুই অনিচ্ছাকৃতভাবে স্কিপ করে গিয়েছি!ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আর শেষ পর্ব বলে মতামত জানাবেন এক্সপেক্ট করছি!