হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব-০৩

0
233

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৩
#আনিশা_নিঝুম

ঘড়ির কাটায় রাত ১:৪৫ ছুঁই ছুঁই। ত্রিধার আমার দিকে দুটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,’নাও তোমার জন্য।’

নিভু নিভু চোখে তার হাত থেকে প্যাকেটটি ছো মেরে নিয়ে নিলাম। সারাদিন পেটে কিছু না পড়ায়, দূর্বল লাগছে, মাথা ঘুরছে। ওমনেই পেটে হাত চেপে বাথরুমের দিকে দৌড় লাগালাম আমি। আমার এহেন কান্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ত্রিধার। বাথরুমের দরজা ছিটকিনি খুলে কোনোরকম ঢুকলাম, ওমনি গড়গড় করে ব মি করে দিলাম। ত্রিধার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আফসোসের রেশ দেখিয়ে বলল,’আরেকটু সহ্য করতে পারলে না স্নিগ্ধতা! দিলে তো ওয়াশরুম নষ্ট করে। পরিষ্কার তো এখন আমাকেই করতে হবে।’

ক্লান্ত আমি, দূর্বল কণ্ঠে বলল,’আমি অপরিষ্কার করেছি আমিই পরিষ্কার করবো আপনি অযথা বকবক করবেন না এখন।’

বলেই মুখে পানির ছিটা দিলাম। ত্রিধার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,’ঠিকাছে, দ্রুত এসো খেতে হবে তোমার আবার। তুমি বাথরুম পরিষ্কার করছো জানতে পারলে আবার তোমার পলাশী আপু আমাকে বলবে আমি তোমাকে চাকরানী বানিয়ে রেখেছি।’

ত্রিধারের কথার জবাব না দিয়ে মুখের উপর বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম আমি। আমার আকস্মিক কাজে হয়তো সে কিছু অবাক ও রেগে দুটোই গিয়েছে। কিন্তু তাতে আমার মধ্যে কেনো হেলদোল নেই।

বাথরুম পরিষ্কার করে বের হতেই ত্রিধার বললেন,’এই জামা চেঞ্জ না করেই বের হচ্ছো কেনো? যাও চেঞ্জ করে আসো।’

আমার মেজাজ তড়িৎ খারাপ হলো। চোয়াল শক্ত করে, তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত ত্রিধারের দিকে নিক্ষেপ করে বললাম,’আমি কি এখন জামা বানাবো এইখানে বসে বসে? আসার সময় একটা জামাও আনতে দিয়েছেন?’

ত্রিধার ভ্রুকুঁচকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো। শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। দ্রুত আবারও ওয়াশরুম যেয়ে নিজের জামা বদ -লিয়ে বের হলাম। ততক্ষণে ত্রিধার খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমি তার পাশে যেয়ে বসলাম। ত্রিধার বললেন,’বাসা ভালো লেগেছে?’

আমি খেতে খেতে বললাম,’হুম।’

‘এখন থেকে এখানেই থাকবা। আমি কাজে থাকলে বাসা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হবা না।’

‘হলে কি হবে?’ গাছাড়া ভাব দেখিয়ে বললাম আমি।

তবে ত্রিধারের উত্তর শুনে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। তিনি আমার কথার পিঠে মৃদু হেসে বলেছেন,’মৃত্যু হবে।’

তার এই কথায় কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি। বাকহীন মানুষের মতো বসে রইলাম, খাবারও যেনো গলায় কাঁটার মতো আটকে গিয়েছে। ত্রিধার তা দেখে হাসলেন বললেন,’মজা করেছি।’

‘এটাকে মজা বলে না,থ্রেট বলে।’

ত্রিধার অদ্ভুত হাসলেন আমার কথায়। আমি ভ্রুকুঁচকে তাকালাম ত্রিধারের দিকে। আমাদের খাওয়া শেষে আমি আর ত্রিধার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গেলাম। এক রুমের এই বাসাটি বেশ বড় ও সুন্দরও। রুমের বারান্দাটি আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগলো আমার কাছে। বারান্দায় লাগানো বেশ কিছু গাছ আমার পছন্দ হলো। আমি ছু্ঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকলাম গাছগুলো। তা দেখে ত্রিধার মৃদু স্বরে বললেন,’গাছ পছন্দ তোমার?’

‘ভীষণ।’ গাছ দেখতে দেখতে জবাব দিলাম আমি।

ত্রিধার হাসলেন। তার হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। শ্যামবর্ণের পুরুষ মানুষের হাসি যে এতোটা আকর্ষণী হয় তা ত্রিধারকে না দেখলে বুঝতাম না। রাফাতও তো আমার প্রিয় মানুষ তবে কেনো তার হাসি দেখলে আমি আকর্ষণ অনুভব করতাম না? আচ্ছা! মানুষটাকে কি আমাকে নিয়ে ভাবে? অবশ্যই ভাবে কারণ তার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকদিনের ছিলো! কিন্তু রাফাত কেনো আমাকে মাঝরাস্তায় একা ছেড়ে দিলো বুঝলাম না! আজ আমার রাফাতের সাথে বিয়ে হলে বোধহয় আমরা এই মূহুর্তে একসাথে বসে আকাশের পূর্ণাঙ্গ চাঁদকে দেখতাম আর আমি রাফাতের কাঁধে মাথা রেখে তাকে ‘ভালোবাসি’ বলতাম। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এগুলো সম্ভব নয় এখন আর। কল্পনার জগৎ এ বাস করার মানে নেই।

‘দাঁড়িয়ে আছো আমার সাথে আর চিন্তা করছো অন্য কাউকে নিয়ে? নট ফেয়ার!’

রাশভারী কণ্ঠস্বর কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছাতেই ইতস্ততবোধ করে নড়েচড়ে উঠলাম। ত্রিধারের দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম,’মন আর চিন্তা জুড়ে যদি অন্য কারো বাস থাকে তবে তো চিন্তা করবোই।’

‘স্বামীর সামনে পরপুরুষকে নিয়ে কথা বলো? আমি বলে মেনে নিচ্ছি, আমার জায়গায় অন্য পুরুষ হলে তোমার মুখ ভেঙ্গে দিতো।’

‘আপনিও তাই করতে চাচ্ছেন? করুন! অন্যদের মতো নিজেকেও প্রমাণ করে দিন!’ মৃদু হেসে বললাম আমি। ত্রিধারও হাসলেন বললেন,’মেয়ে,আমাকে ভয় পাও! আমি তোমায় ছুঁলে, মৃত্যুও ভয়ে কাঁপবে!’

‘এতোটা ভয়ংকর আপনি?’

আচমকা ত্রিধার তার মুখ আমার কানের সামনে এনে বলেন,’তোমার কল্পনার চেয়েও ভয়ংকর আমি।’ তার ওষ্ঠ্যদ্বয় আমার কান ছুঁলো, ভয়ংকর ভাবে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো আমার শরীর। মূহুর্তেই যেনো সারা শরীর অবশ হতে শুরু করলো, শুকনো ঢোক গিললাম। সাথে সাথেই ত্রিধার সরে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,’আমার একটু ছোঁয়াতেই তুমি অবশ, যখন তোমার পুরো শরীরে আমার ছোঁয়া লাগবে তখন না জানি কি করো!’

নেশালো, মধুর তার কণ্ঠস্বর! এই শ্যামবর্ণের পুরুষ কেনো পা থেকে মাথা পর্যন্ত এতো আকর্ষণীয়? যেকোনো কঠিন থেকে কঠিনতর মেয়েকে ঘায়েল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই শ্যামপুরুষটি!

‘স্নিগ্ধতা এভাবে তাকিও না এই শ্যামপুরুষের দিকে! না জানি কখন ঝলসে যাও।’

নড়ে উঠলাম আমি। মুখ ঘুরিয়ে বললাম,’অসম্ভব।’

‘অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানে ত্রিধার!’

‘ঘুমোতে চলুন, দেরী হচ্ছে।’

‘আগামী দশদিন আমি থাকবো না বাসায়। অর্থাৎ কাল থেকে একাই থাকতে হবে তোমার।’

‘অচেনা এই শহরে আপনি ব্যতীত কিভাবে একা থাকবো আমি?’

ত্রিধার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,’হারিয়ে গেলে আমি আছি না খুঁজতে!’

৪.

রৌদাচ্ছন্ন প্রভাত। সূর্যের প্রখর তাপ ধরণীর বুকে এসে পড়ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় নিজের জামার এক অংশ চেপে ধরলাম আমি! লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। ভীতু চোখে আশপাশ তাকিয়ে ত্রিধারকে খুঁজতে লাগলাম৷ নেই সে পাশে! দম আটকে আসার উপক্রম আমার৷ টেবিল থেকে খপ করে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে নিমিষেই পুরো বোতল শেষ করে জোর গলায় বললেন,’ত্রিধার আপনি কোথায়?’

ওমনেই ত্রিধার হন্তদন্ত করে প্রবেশ করলো ঘরে৷ তাকে দেখেই শান্ত লাগলো নিজেকে। তিনি এসে আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন,’কি হয়েছে? ভয় পেয়েছো?’

‘হু! আপনি যখন ছিলেন না, দম আটকে আসছিলো।’

ত্রিধার মৃদু হাসলেন আমার কথায়, বললেন,’আমি একটু পাশে না থাকায় তোমার এই অবস্থা হলে আমি যখন হারিয়ে যাবো চিরতরে তখন বাঁচতে পারবে?’

ত্রিধারের কথায় ভড়কে গেলাম আমি! রাগ দেখিয়ে বললাম,’রহস্যজনক কথা না বললেই কি হয় না আপনার? চলে যান আপনি!’

‘এখনই বের হবো।’

বলেই আয়নার সামনে যেয়ে নিজের জামা ঠিক করতে লাগলেন। ততক্ষণে উনার পোশাকের দিকে আমার নজর পড়লো, বিষ্ময়ে আপনাআপনি হা হয়ে গেলো আমার চোয়াল। অবাক,হতবাক,নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ত্রিধারের দিকে। তার মধ্যে কোনোরকম হেলদোল দেখলাম না। মনোযোগ সহকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে নিলেন। তখনো আমার চোয়াল হা সবুজ, কালো, খাকি, মেরুন রঙা পোশাকের দিকে তাকিয়ে। বড় বড় শ্বাস ফেলতে শুরু করলাম আমি! অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছি আমি। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালালাম কিছু মূহুর্ত। এতক্ষণ বাদে আমি ত্রিধারের নজরে পড়লাম। তিনি গম্ভীর স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,’কি হয়েছে? তোমায় এতো হাইপার দেখাচ্ছে কেনো? আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আছো? চিন্তা করো না, আমি হারালেও বেঁচে থাকবো তোমার হৃদয়জুড়ে।’

এই মূহুর্তে ত্রিধারের কোনোকথাই কর্ণপাত হলো না আমার। আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে তাকে প্রশ্ন করলাম,’ত্রিধার আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন? ‘

#চলবে?