#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৩]
শাওন বাড়িতে বেশিক্ষণ বসলো না। কোনোরকমে হালকা-পাতলা নাস্তা করেই বেরিয়ে গেলো পাড়া ঘুরতে। তরীদের এলাকা তার ভীষণ পছন্দ। এজন্যে এই এলাকার পথ-ঘাট হেঁটে বেড়ায় নির্দ্বিধায়। ফুপি এতবার পিছুডাক দিলো, শাওন শুনলোই না। ছেলেটা তার বড্ড চঞ্চল এবং অবাধ্য। কী করলে যে ছেলেটা সোজা পথে আসবে কে জানে?
তরী এখন মোটামুটি সুস্থ। সাবিয়া গিয়েছে তিন তলায়। তাদের উপরের ফ্ল্যাটে একটা ছোটো পরিবার থাকে। ছোটো পরিবারে একটা বাচ্চা ছেলে আছে। সম্ভবত ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ছেলেটার নাকি একটু অংক করতে সমস্যা হচ্ছে, এজন্য ছেলেটার মা এসে তরীকে ডাকলেন। কিন্তু তরী অসুস্থ হওয়ায় সাবিয়া তরীর বদলে গেলো। মাঝেমধ্যে-ই তরী ছেলেটাকে গিয়ে সাহায্য করে।
সাবিয়া আসলো বেশ কিছুক্ষণ পর। তরী সোফা ঝাড়ছিলো। সাবিয়া তরীর কাছে নীরবে এসে চাপা স্বরে তরীকে ডাকলো। তরী পিছে ফিরে তাকালো। সাবিয়া চারপাশে সতর্ক নজর ফেলে আড়াল থেকে একটা চিঠি বের করে বললো,
–“বাসায় আসার সময় দেখি দরজার সামনে এটা পরে ছিলো। চিঠিটা কুড়িয়ে দেখি তোমার নাম লেখা। এজন্যে ফেলে দেওয়ার সাহস করিনি!”
তরী তার হাতে চিঠিটা নিলো। সাবিয়া তখন কৌতুহলী নজরে তরীর হাতের খামটার দিকে চেয়ে আছে। তরীকে নীরব থাকতে দেখে সাবিয়া এবার উৎসুক স্বরে বললো,
–“এটা কে দিয়েছে আপু?”
তরী হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–“জানি না। এত জানতেও হবে না। যা গিয়ে পড়তে বস!”
সাবিয়ার মুখ ভার হয়ে গেলো। এত কৌতুহল এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। কৌতুহলকে মাটিচাপা দিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে চলে গেলো। সাবিয়া চলে যেতেই তরী রান্নাঘরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে সোফায় বসে পরলো। ফুপি রান্না করতে ব্যস্ত। মনে হয় না এত সহজে রান্নাঘর থেকে বের হবে। এজন্যে তরী এখনই খাম খুলে চিঠি পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। চিঠির ওপর আগের বারের মতোই ইংরেজীতে “ডিয়ার তরী” লেখা।
খাম থেকে চিঠিটা বের করতেই দেখলো গুটিকয়েক লাইন। তরী সেগুলোতে চোখ বুলালো। লেখা,
–“জানি, আমার লেখা এত আহামরি না। তাই জাস্ট ইগনোর মাই হ্যান্ডরাইটিং। কখনো লেখার হাতকে যত্ন করা হয়নি। এজন্যই বকের হাত-পায়ের মতো লাগে। যাইহোক, তুমি দেখা এবং কথা না বললেও এভাবে-ই চিঠি দিয়ে যাবো নিকাব রাণী। কোনো বারণ শুনবো না। তুমি ভালো আছো তো?”
তরী হতভম্ভ, বিমূঢ়। কী বলছে এসব সিদাত? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি? রোজ রোজ এই চিঠির ভার সে কী করে সইবে? কারো হাতে এই চিঠি পরে গেলে নির্ঘাত তরীর কপালে দুঃখ আছে। বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেলো তার। তরী চিঠিটা মুড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। এর হেস্তনেস্ত করতেই হবে তাকে।
তরী বেশিক্ষণ না বসে বেসিনের সামনে গিয়ে কাগজ ভিঁজিয়ে দিলো। অতঃপর সেগুলা কাপড়ের মতো দু’হাতে ঘষে লেখাগুলো নষ্ট করে দিলো। কারো বোঝার উপায় নেই এটাতে কী লেখা ছিলো! তরী ভেজা কাগজটা ডাস্টবিনে ফেলে আসতেই নিচ্ছিলো ওমনি কলিংবেল বেজে ওঠে। তরী দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলে কাউকে পেলো না। বিরক্তি যেন আরও ঘিরে ধরলো তরীকে। এভাবে হুটহাট কলিংবেল বাজানোর মানে কী? তার চাইতেও বড়ো কথা, বাচ্চাদের হাতের নাগালেই কেন কলিংবেল থাকবে? সবই বিরক্ত লাগছে তরীর। মুখজুড়েও তিতা ভাব। খাবারে রূচি নেই। তরীর এখন খিটখিটে মেজাজের হতে খুব ইচ্ছে করছে, খুব!
তরী ভেতরে আসতেই তার ফোনে টুং শব্দে মেসেজ আসলো। তরী পুণরায় সোফায় বসে ফোন হাতে নিলো। দেখলো মামা মেসেজ দিয়েছে। অবশ্যই খোঁজ-খবর নেওয়ার মেসেজ নয়। তার পোস্টে লাইক করার মেসেজ। মামার মেসেজ থেকে বেরিয়ে ফেসবুকে প্রবেশ করতেই হোমপেজে সর্বপ্রথম ভেসে ওঠে সিদাতকে নিয়ে বানানো ব্যানার। মামা লিখেছেন, “আদর্শ বাবার আদর্শ ছেলে৷”
তরী ‘থ’। কী বলবে বা বলা উচিত বুঝলো না। সিদাতকে যদি আদর্শ বলা হয় তাহলে ভালো, ভালো ছেলেদের অপমান করা হবে। মামা আজকাল এত পরিমাণে তেল দিচ্ছে। আলগা প্রসংশায় পঞ্চমুখ করে ফেলছে। এগুলো করে সময় নষ্ট না করে সময়গুলো ভালো কাজে লাগালেই তো পারতো! আশ্চর্য!
আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। এবার তরীর ধ্যান নেই। যার ফলে ফুপি এসেই দরজা খুলে দিলো। শাওন এসেছে। ফুপি শাওনকে দরজা বন্ধ করতে বলে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো। শাওন দরজা বন্ধ করে দুলে দুলে গুণগুণ করে গাইছে,
“আশিক বানায়া, আশিক বানায়া.. আশিক বানায়া আপনে!”
তরীর মুখ ঘুচে গেলো শাওনের গাওয়া গান তার কানে প্রবেশ করতেই। কপাল কুচকে গেলো এ ধরণের গান শুনে। এমনিতেই বিরক্তির শেষ নেই। তার ওপর শাওনের এ-সব গান। তরী খুব কড়া গলায় ডাকলো শাওনকে।
–“শাওন!”
শাওন চমকে সোফার দিকে তাকালো। তরী বসে আছে। সঙ্গে সঙ্গে শাওন তার গান বন্ধ করে হালকা ঢোঁক গিললো। সে বুঝতে পারেনি যে তরী এখানে বসে আছে। সে জানতো তরী অসুস্থ, এজন্যে রুমে হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছে। শাওন আমতা আমতা করে বললো,
–“বলো আপু!”
তরী আবারও কড়া গলায় বললো,
–“আমার কাছে আয়!”
শাওন আবারও শুকনো ঢোঁক গিলে আল্লাহ্-কে ডাকতে ডাকতে তরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শাওন বড্ড ভয় পায় তরীকে। তরীর মতো ভয় শাওন তার বড়ো বোনকেও পায় না। তরী গরম চোখে চেয়ে আছে শাওনের দিকে। শাওন কোণা চোখে চেয়ে তা ঢের বুঝতে পারলো। তরী কাঠকাঠ গলায় বললো,
–“আমার ঘরে তুই গুণগুণিয়ে গান গেয়েছিস! এত বড়ো সাহস? আগে বারণ করিনি?”
শাওন মিনমিন করে বললো,
–“গানটা মাত্রই শুনে এসেছি আপু। তাই প্রেক্টিস করছিলাম।”
–“বাদ্যযন্ত্র হারাম। কতবার বলেছি এ-সমস্ত গান-টান শুনবি না৷ কিন্তু তুই আমার কথা শুনিস না কেন?”
শাওন নিশ্চুপ। তরী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। অন্যদের রাগ সে শাওনের ওপর ঝাড়ছে, যা মোটেও উচিত নয়। তরী দু’হাত মুঠো করে নিজেকে সামলে নিলো। অতঃপর ঠান্ডা গলায় বললো,
–“আমার পাশে বসো!”
শাওন চট করে তরীর দিকে তাকালো। অতঃপর হাসলো। রাগ চলে গেছে, এবার নিশ্চয়ই আর বকবে না। শাওন তরীর পাশে বসলো। দুই ভাই-বোন মিলে নানান আলাপ করতে লাগলো।
রাতে সিদাত এলো কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে। ফুপি অবাক হয়ে বললো,
–“এই প্যাকেটগুলো কেন আনলে বাবা?”
সিদাত মুচকি হেসে বলে,
–“আমরা দুই বন্ধু মিলে এনেছি। নিজেরাও খাবো সাথে আপনাদের জন্যেও আনলাম। প্লিজ বারণ করবেন না। বড্ড আশা নিয়ে এনেছি। প্রতিবেশি’রা প্রতিবেশিকে ভালোবেসে কিছু না কিছু দিতেই পারে। তাই না?”
ফুপি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। ঘাড় বাঁকিয়ে রুমের দরজার দিকে তাকায়। পর্দার আড়ালে তরী দাঁড়িয়ে আছে। ফুপি তাকাতেই তরী তক্ষণাৎ নেতিবাচক মাথা নাড়ালো। ফুপি হাসার চেষ্টা করে পুণরায় সিদাতের দিকে চেয়ে বলে,
–“কিছু মনে করো না বাবা। তবে তোমার এই খাবার নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। মনে কিছু নিও না বাবা, একটু বোঝার চেষ্টা করিও!”
সিদাত অবশ্য জোর করলো না। সে হাসি-মুখে ফুপির কথা মেনে নিলো। চলে যেতেই নিবে ওমনি সিদাতের সামনে এসে দাঁড়ালো শাওন। সিদাতের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অস্ফুট স্বরে বললো,
–“আরে, আপনি আর-জে সিদাত না? আমার প্রিয় শো-এর হোস্ট?”
সিদাত শাওন দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে বললো,
–“কোনো সন্দেহ আছে? দেখো, আমি-ই সিদাত।”
সিদাতের কথায় শাওন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। ভক্তরা থাকে না, যারা তাদের পছন্দের মানুষকে পর্দা থেকে হুট করে সরাসরি দেখলে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যায়? শাওনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। বেচারার খুশিতে চোখের কোণ ভিঁজে গেছে। উপচে আসা খুশি কোনোরকমে গিলে শাওন দুই ধাপ এগিয়ে সিদাতের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমি আপনার বিরাট বড়ো ভক্ত ভাইয়া। আপনার বচন-ভঙ্গি, কথা-বার্তা, আপনার শো.. মানে সবমিলিয়ে আমি মুগ্ধ আপনার ওপর। আপনি আমাদের বাসায়? অবিশ্বাস্য! আমি কী স্বপ্ন দেখছি?”
সিদাত হাসলো। তবে চিনতে পারলো না শাওনকে। হয়তো-বা তরীর আত্নীয় সে। তাই খুব সুন্দর ভাবে কথা বললো। জানালো সিদাত বন্ধুর কাছে মাঝেমধ্যেই আসে। তাদের পাশের ফ্ল্যাটটাই সিদাতের বন্ধুর। শাওন বিশ্বাস করলো। সাথে উপচে আসা খুশিও প্রকাশ করতে চাইলো। দুজনে পরিচিত হলো। সিদাত শাওনকে বিরিয়ানির এক প্যাকেট দিয়ে বললো,
–“আমার তরফ থেকে এটা তোমার জন্যে গিফট শাওন। গুড লাক!”
বলেই সিদাত চলে গেলো। সিদাত চলে যেতেই শাওন আনন্দের সুরে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আম্মা, আমি আজ থেকে এখানে-ই থাকবো। কনফার্ম। আমিও সিদাত ভাইয়াকে প্রতিদিন দেখতে চাই। আমি এখানে থাকতে চাইই আম্মু!”
ভেতর থেকে তরীর ধমক শোনালো। শাওন সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো। ফুপি কপাল কুচকে মিনমিন করে বললো,
–“তুই এখান থেকে কালকেই যাবি! কয়েক ঘন্টাতেই জ্বালানোর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস!”
~[ক্রমশ]
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৪]
সাইফ ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। তার গাড়ির সামনেই একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো বড়ো একটি বাক্স। সাইফ কিছুক্ষণ তার ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে সাইফ মাথা বের করে মেয়েটির দিকে তাকালো। কপাল কুচকে বললো,
–“পথ থেকে সরে দাঁড়ান। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
জায়গাটা নীরব। সেরকম দোকান-পাঠ বা মানুষজন নেই। একপাশে সারি দিয়ে মোটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পেছনে আবার বড়ো দেয়াল, অনেকটা জুড়ে। গাছের শুকনো পাতা ঝড়ে পরায় পথটা শুকনো পাতায় ভর্তি। দেখতে মন্দ লাগছে না। বরং সুন্দর লাগছে। রাস্তার অপর পাশেও বড়ো দেয়াল। এক দুটো গাছ ছাড়া সেদিকটায় তেমন কিছু নেই। তবে সবমিলিয়ে এই জায়গাটা সুন্দর, স্বচ্ছল!
মেয়েটি সাইফের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
–“আপনার মনোযোগ পাইনি কখনো। পাত্তাও সেরকম কাউকে দেন না। এজন্য বাধ্য হয়েই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়েছি।”
সাইফ কুচকানো কপাল আরও কুচকে বললো,
–“বাই চান্স যদি কোনো এক্সিডেন্ট হয়ে যেত? তখন তার দায়ভার কে নিতো শুনি?”
মেয়েটি একগাল হেসে বলে,
–“অবশ্যই আপনি!”
বলেই কোনো কথা ছাড়াই দরজার সামনে দিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। দিয়াকে হঠাৎ এভাবে মাটিতে বসে পরতে দেখে সাইফের কুচকানো কপাল মসৃণ হলো। চোখ-মুখ জুড়ে ছড়ালো বিস্ময়। দিয়া হাতের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“আপনি কী আমার উপহার গ্রহণ করবেন সাইফ?”
সাইফ ‘থ’, হতভম্ভ, বিমূঢ়। এভাবে কেউ কখনো তাকে উপহার সাধেনি। এরকম ঘটনার সম্মুখীন বোধহয় প্রথম হলো। সাইফ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সাইফ দিয়ার হাত থেকে উপহারটা নিয়ে বললো,
–“করছেন কী? এভাবে হাঁটু গেড়ে কেন বসলেন?”
দিয়া উত্তর দিলো না। শুধু অধরে তৃপ্তির ফোটালো। সেই হাসির মানে সাইফের বোধগম্য হলো না। সাইফ বললো,
–“এভাবে উপহার কেন দিলেন? উপহার দেওয়ার থাকলে কারো থেকে আমার ঠিকানা নিয়ে পাঠাতে পারতেন!”
দিয়া এবারও হাসলো। হেসে বললো,
–“সরাসরি দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো। দিয়েছি। এখন শান্তি। আসি নাহয়! উপহার আবার ফেলে দিবেন না। ভেতরে হয়তো-বা এমন কিছু আছে, যা অমূল্য। দয়া করে আমার অমূল্য সম্পদের হেফাজত করবেন। আমার এটা প্রথম এবং হয়তো শেষ চাওয়া!”
বলেই দিয়া চলে গেলো। সাইফ তখন আগের জায়গাতেই বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দূর থেকে তরী সবকিছু দেখলো। তবে সাইফের চেহারা অস্পষ্ট ছিলো। এই পথটা তার প্রিয়। ছবি আঁকার জন্যেও বেস্ট। এজন্যে মন ভালো রাখার জন্যে মাঝেমধ্যেই এখানে এসে এক কোণে বসে স্কেচ করে। এই বিষয়টা তরীকে দারুণ উপভোগ করায়। কিন্তু এই পর্যায়ে দিয়াকে হাঁটু গেড়ে বসে সাইফকে উপহার দেওয়ার দৃশ্যটা দেখে ফেলে। আশেপাশের ব্যস্ত অনেকেই দেখেছে। সকলের জন্যে এটা সেরা এবং সুন্দর দৃশ্য লাগলেও তরীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখালো। তরীর এই অবস্থা দেখে নাক কুচকে ফেললো। মিনমিন করে বললো,
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্। আজকালকার মেয়েদের লাজ কোথায় গিয়ে পৌঁছিয়েছে মাবুদ!”
তরী সেখানে আর থাকলো না। অর্ধেক স্কেচ ব্যাগে ভরে চলে গেলো। এখানে সিএনজি পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সিএনজি গুলো যায়। তরীদের বাড়ির গলি সেই রাস্তাতেই পরে। এজন্যে তরী সিএনজিতে উঠে বসলো। তরীর পাশের একটি সিট খালি ছিলো। সেখানে একজন লোক বসতে নিচ্ছিলো ওমনি কেউ একজন লোকটির হাত টান দিয়ে ধরে বললো,
–“কী করেন মিয়া! মহিলা আসছে তারে বসতে দেন!”
কন্ঠ চেনা-জানা লাগলো। তরী বিস্ফোরিত চোখে বাইরে তাকালো। সিদাত দাঁড়িয়ে। সত্যি সত্যি-ই একজন মহিলা উঠে বসলো। মহিলার বেশ-ভূষা দেখে মনে হলো ভালো পরিবারের থেকেই এসেছে। সিদাত লোকটিকে ছেড়ে মহিলার উদ্দেশ্যে ঝুঁকতেই তরীর দিকে চোখে গেলো। এবং সে চমকে গেলো। দুজন দুজনের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সিদাত কয়েক সেকেন্ড তরীর দিকে চেয়ে অধর বাঁকিয়ে হাসলো। আপনমনেই বললো,
–“বাহ! পৃথিবী দেখছি আসলেই গোল!”
তরী শুনলো সিদাতের কথা। কিন্তু স্বভাবসুলভ নীরব রইলো। তবে ফিরোজা খাতুন বুঝলো না সিদাতের কথা। ফিরোজা বললো,
–“কী বললে, বুঝলাম না বাবা!”
সিদাত হাসি বজায় রেখে মৃদু গলায় বললো,
–“কিছু না ছোটো মা। তুমি এই সিএনজি করে আপাতত অনয়ের বাসায় যাও। চাবি তো দিলাম-ই। আমি গাড়ি ঠিক করে আসছি। ঠিক করতে ঘন্টাখানেক লাগবে, এর চাইতে বরং তুমি অনয়ের বাসাতেই চলে যাও। যেতে বেশি সময় লাগবে না। আর তুমি না চিনলেও কোনো সমস্যা নেই। তোমার পাশেরজন চিনিয়ে দিবে!”
বলেই সিদাত তরীর দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে চলে গেলো। আর কাউকে সিদাত উঠতে দেয় না। সিএনজি ড্রাইভারকে দুজনের জন্যে রিজার্ভ করে দিলো। সিএনজি ড্রাইভার টাকা পেয়ে বিনা-বাক্যে উঠে বসে এবং সিএনজি চালু করে।
–“তুমি কী সিদাতকে চিনো?”
তরী চমকে চাইলো ভদ্র মহিলার দিকে। ফিরোজা খাতুন উৎসুক নজরে চেয়ে আছে তার দিকে। ফিরোজা খাতুন একটি বোরকা এবং হিজাবের ওপর নিকাব পরে আছে। তাই জন্য ওনার মুখ দেখতে পারেনি তরী।
ওনার এহেম প্রশ্নে তরী কন্ঠস্বর যথেষ্ট নরম করে বললো,
–“ওনার বন্ধু আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে!”
ফিরোজা খাতুন বুঝতে পারলো। তরী এর বেশি কিছু বলেনি। ফিরোজা বুঝলো তরী অল্প ভাষী। এই গুণ তার পছন্দ হয়েছে। তাই সে নিজেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। তরী কী মনে করে ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে ফিরোজা খাতুনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। বললো,
–“ভাড়াটা আপনি নিন আন্টি।”
ফিরোজা খাতুন ভারী অবাক হলো তরীর কথায়। চোখ বড়ো বড়ো করে অবাক সুরে বললো,
–“ওমা। কিসের ভাড়া আবার?”
তরী কিছুটা বিব্রত সুরে বললো,
–“আপনার ছেলে রিজার্ভের ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। আমি মোটেও নিজের ভাড়া অন্যকারো বহন করাটা পছন্দ করছি না। তাই আপনি এই টাকাটা রাখুন। মনে দুঃখ নিবেন না আন্টি, তবে আমি সত্যি-ই এটা সহ্য করতে পারি না!”
ফিরোজার যেন আজ চমকানোর দিন। মেয়েটার স্বভাব, আচরণ বড়োই ভাবাচ্ছে তাকে। ছোটো মেয়েটার থেকে টাকা নিবে, কেমন দেখাচ্ছে না? তার ওপর বারণও করতে পারছে না। কার খপ্পরে পরলো সে কে জানে। তবে মেয়েটির কন্ঠে বিব্রতবোধ স্পষ্ট ছিলো। হয়তো ফিরোজা স্মার্ট পরিবেশে ওঠা-বসা করায় এই ব্যাপারগুলো হজম করাটা কষ্টকর। তবে ফিরোজা খাতুন দীর্ঘক্ষণ ভেবে টাকাটা নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই তরীর চোখ জুড়ে স্বস্তি দেখতে পেলো ফিরোজা। এতে ফিরোজাও স্বস্তি পেলো। ফিরোজা হেসে বললো,
–“তোমাকে আমার ভীষণ মনে ধরেছে। একদিন চায়ের দাওয়াতে চলে এসো আমাদের বাড়ীতে। নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াবো!”
তরী হাসলো। বললো,
–“ধন্যবাদ দাওয়াতের জন্য!”
ওরা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে-ই পৌঁছালো। তরী অনয়ের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়ে নিজেও বাড়িতে চলে আসে। ফুপি সোফায় বসে টিভি দেখছে। কোথাও অগ্নিকান্ড ঘটেছে। সেটারই খবরা-খবর খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। তরী একপলক টিভির দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। সকালেই ফুপি শাওনকে বহু হুমকি-ধামকি দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তরী বলেছিলো শাওন থাকুক, কিন্তু ফুপি শোনেনি। কখন কী কান্ড করে বসে সে নিয়ে ফুপির আবার ভীষণ ভয়। বড়ো ভাইয়ের কানে কিছু গেলে ফুপি তাকে কী উত্তর দিবে? এজন্যে ফুপি আর সাহস করেনি।
সাবিয়াও এখন মাদ্রাসাতে। ফিরতে আরও অনেক সময় বাকি। তরী চিন্তা করলো সাবিয়াকে মাদ্রাসা থেকে তরী-ই নিয়ে আসবে।
————
সাইফ বক্সটা রাতে গিয়ে খুললো। এবং সে দারুণ অবাক হলো। এ যে এলাহি কান্ড।
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]