#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৫]
রাজিব সাহেব আবিরকে মেনে নিয়েছেন তা ভাবাটা ভুল। সে শুধুমাত্র চুপ আছেন মেয়ের জন্যে। বাড়ি-ভর্তি মানুষের মাঝে চিল্লা-পাল্লা করাটা তার অপছন্দের বিষয়। পারিবারিক সমস্যা সে পারিবারিক ভাবেই সমাধান করবেন। এজন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই নীরবে সব কাজ করছেন। আবির আসার পরপর বাবার সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে আবিরও। একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা, সে তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারবে না। বড়ো ভাইয়ের দায়িত্বটুকু নিজের সবটা দিয়েই পালন করবে সে।
রাতে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। আজ একটু তাড়াতাড়ি-ই মৌসুমির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। আজ সাদিয়া আসেনি। তাদের মুখে শোনা যায় গতকালের পরপর দু’বার লম্বা জার্নির জন্যে সাদিয়া কিছুটা অসুস্থ। এজন্যে সে চেয়েও আসতে পারেনি তার হবু ভাবীর গালে হলুদ ছোঁয়াতে। তরী এক পাশে একা দাঁড়িয়ে সাবিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখছে। সাবিয়া ছাদের আরেক প্রান্তে কিছু সমবয়সীদের সাথে খুব আনন্দ করছে। তরী তাকে বারণ করেনি। প্রাণ খুলে আনন্দ করুক। এখন তো ওদের আনন্দ করার বয়স। অবশ্য এই আনন্দ একদমই লাগাম ছাড়া নয়। লাগাম ছাড়া যাতে না হয় সেদিকেও তরী লক্ষ্য রাখছে।
আচমকা কোথা এক ছেলে এসে তরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তরী অপ্রস্তুত হলো এতে। এক পলক ছেলেটিকে পরখ করে চোখ নামিয়ে অন্যদিকে সরে গেলো সে। তবুও ছেলেটি সরলো না। তরীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে একটু টিটকারি মে*রে বললো,
–“ব্যাপার কী মিস? বিয়ে বাড়ির পরিবেশে এমন মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? খোলামেলা নিঃশ্বাসের সাথে অভিমান করেছেন বুঝি?”
তরী অস্বস্তিতে পড়লো, তবে কোনো জবাব দিলো না। ছেলেটি আবার হেসে বললো,
–“আপনি বেয়াইন রাইট? মুখ লুকাবেন না, বন্ধুত্ব-ই করতে তো এসেছি। আচ্ছা রিলেক্স!”
ছেলেটি আরও কিছু বলার পূর্বেই তাদের দুজের মাঝের দূরত্বে এসে দাঁড়ালো সিদাত। চওড়া হাসি দিয়ে নরম গলায় বললো,
–“একটি মেয়ে কথা বলতে চাইছে না, অস্বস্তি অনুভব করছে, তাকে খুঁচিয়ে কথা না বলাই ভালো ব্রো।”
সিদাতকে দেখে ছেলেটা চমকালো। মনে হলো সিদাতকে কোথায় যেন দেখেছে? তবে সিদাতের কথাগুলো তার কাছে অপমানজনক লাগলো। তাও অধরে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
–“বুঝতে পেরেছি।”
বলেই ছেলেটি চলে গেলো। তরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিছে ফিরে রেলিঙে দু’হাত প্রসারিত করলো। সিদাত হঠাৎ হাঁচি দিয়ে উঠলো। পরমুহূর্তে পকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে পরে নিলো সে। কারো সম্মুখে হাঁচি দেওয়াটা তার নিকট বড়োই বিব্রতকর। এজন্যে মাস্ক পরে হাতের ব্যবহৃত টিস্যুটা ফেলে তরীর থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়ালো। অদূরে শূন্য নজর নিক্ষেপ করে বললো,
–“আমার ধন্যবাদ পাওয়ার কথা ছিলো!”
তরী কোণা চোখে সিদাতের দিকে চাইলো। সিদাতের কন্ঠটা কেমন ভেঙে গিয়েছে। কন্ঠ অন্যরকম শোনাচ্ছে। হয়তো-বা ঠান্ডা ভালোই তাকে কাবু করে নিয়েছে। তরী সঙ্গে সঙ্গে বললো,
–“ধন্যবাদ!”
সিদাত হাসলো। পরমুহূর্তে আর কথা হলো না। সময় গড়াতে লাগলো। চারপাশে মানুষদের সমাগম, সড়গোল অথচ তাদের দুজনের মধ্যে রাজ্যের নীরবতা। এভাবেই কতক্ষণ কেটে যায়। সিদাত হঠাৎ আনমনে বলে ওঠে,
–“আমার সাথে কেন বন্ধুত্ব করলে না তরী? আমার সাথে বন্ধুত্ব না করার দুটো কারণ বলো তো?”
তরী এবার পাশে তাকালো। সিদাত হাত দুটো অস্বাভাবিক ভাবে পকেটে পুরে রেখেছে। কেমন যেন হাবভাব তার। কন্ঠস্বরও কেমন বদলাচ্ছে। তরী ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে সিদাতের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো।
–“কী হলো তরী? বলো?”
তরী চোখ ফিরিয়ে নিলো। সিদাতের এতক্ষণে হুঁশ এলো। সে কীসব বলছে? বরফে জমে যাওয়ার হাতটা কপালে রাখলো। জ্বর-টর এলো নাকি? হ্যাঁ! আসছে আবার জ্বর। এজন্যই তো হঠাৎ কেমন শীত শীত করছে। হাত-দুটো পকেটেও উষ্ণ হচ্ছে না। তরীকে করা প্রশ্নটা মাথায় আসতেই সিদাত বিব্রত হয়ে পরলো। একদম চুপসে গেলো সে। কিন্তু তরীর কাছে উত্তর জানতেও সে আগ্রহী। এজন্যে তার জায়গা থেকে সরলো না। সটান মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।
মিনিটখানেকের মধ্যে হঠাৎ তরী মুখ খুললো,
–“আপনি পুরুষ মানুষ!”
সিদাত হয়তো এই উত্তরটা ধারণা করেছিলো। তাও তরীর মুখের বুলি শুনতে ইচ্ছে করছিলো। এজন্য ইচ্ছেকৃত আবার প্রশ্ন করলো,
–“আর?”
তরী ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো সিদাতের দিকে। ভুরু কুচকে বললো,
–“এটার চাইতে বড়ো কারণ আর কী হতে পারে?”
সিদাত নাছোড়বান্দা কন্ঠে বললো,
–“দ্বিতীয়টাও বলো!”
তরী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। অদূরে চেয়ে কিছু একটা ভাবলো। এরপর আবারও থমথমে চাপা গলায় বললো,
–“আপনি মাতাল হয়ে আমার বাসায় ঢুকেছেন!”
তরীর এ-কথা শুনে সিদাতের আর সেখানে দাঁড়ানোর ইচ্ছা করলো না। মুখ ঘুচে সে তৎক্ষনাৎ নিচে চলে এলো। রুমে এসে জ্বর, সর্দির নির্ধারিত ওষুধ খেয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলো। কাশির মেডিসিনটা খেলে সিদাতের খুব ঘুম পায়। হাই পাওয়ারের ওষুধ ওটা। সেজন্যই লাইট নিভিয়েছে সে। শুয়ে শুয়ে ভাবছে তরীর কথা। তরীর বলা দ্বিতীয় কারণটা তাকে পোড়াচ্ছে। ভীষণরকম ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সিদাতের কাছে মনে হলো তরীর প্রথম বলা কারণের চাইতে দ্বিতীয় কারণটা বেশি শক্ত, গভীর, বিক্ষত। অন্ধকারে অসংখ্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। তরীর কাছে বারবার ছুটে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
–“তুমি আমাকে ভুল বুঝলে নিকাব রাণী। আমি মোটেও স্ব-জ্ঞানে আজ অবধি নেশা করিনি। অন্যের দায় আমার কাঁধে কেন পরবে, আমার কাঁধ-ই কেন ভার হবে?”
কিন্তু সাফাই দিতেও ইচ্ছা করলো না। তরী তাকে অলরেডি সেই ধরণের ছেলে ভেবেই নিয়েছে। কিন্তু একটা মানুষকে ভুলের পর্দার আড়ালে রাখাটাও বোকামী। এরকম নানান চিন্তা-ভাবনা করতে করতে সিদাত ঘুমিয়ে পরলো।
পরেরদিন বিয়ে শেষ করেই সিদাত ইমার্জেন্সি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এখানে তার এখন দমবন্ধকর অনুভব হচ্ছে। তরীকে দেখলেই নিজেকে মাতাল, নেশাখোর লাগে। এই পদবী সিদস্ত একদমই নিতে পারে না। তরীকে দেখেও নিজের অস্থিরতা কমাতে পারে না। মেয়েটা তাকে প্রতিনিয়ত ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে।
তরীরা ঢাকা ফিরলো বিয়ের আরও দুই দিন বাদে। মৌসুমীর বিদায় দিয়েই রাজিব সাহেব জুঁইয়ের বাবা-মাকে ডেকে পাঠালো। সবার সামনে রাজিব থমথমে গলায় তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো,
–“একটা কথা মনে রাখবেন, ছেলে-মেয়েরা মাঝেমধ্যে বাবা-মায়ের কঠোর শাসনের ভয়ে ভুল করে বসে। সেই ভুলের শাস্তি প্রতিনিয়ত পোহাতে হয় বাবা-মা কে। যখন আপনারা জানলেন আপনাদের মেয়ে সম্পর্কে জড়িয়েছে তখন মেয়ের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা না বলে, ছেলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর না নিয়ে কীভাবে পারলেন এরকম চরম বোকামি করতে? মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিলে কী পেতেন? আল্লাহ্ না করুক, আপনাদের এই তীব্র জেদ এবং রাগের বশবর্তী হয়ে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর শুনলেন মেয়ে সুখে নেই। তখন কেমন লাগতো?”
রাজিব সাহেব থেমে আবার খুবই নরম সুরে বললেন,
–“আপনাদের উচিত ছিলো মেয়ে কার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে তার খোঁজ-খবর নেওয়া। যদি দেখতেন ছেলে এবং ছেলের পরিবার আপনার মেয়েকে সুখে, শান্তিতে রাখবে না তখন আপনি অন্য পন্থা অবলম্বন করবেন। কারণ আমরা বাবা-মা কখনোই চাই না ছেলে-মেয়ে অসুখী, বেপথে যাক। আপনাদের এই একটা ভুলের জন্যে আমরা দুই পরিবারই ক্ষতির সম্মুখীন হলাম!”
এভাবে নানান কথাবার্তার মধ্যেই দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। জুঁইয়ের বাবা অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে জানায় সে ভালো ছেলে খুয়াতে চায়নি, একপ্রকার ভয় নিয়েই জলদি জলদি সব ব্যবস্থা করেছে। তার ভাষ্যমতে ভালো ছেলে কখনোই সম্পর্কে জড়ায় না। কিন্তু পরে তার মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার পরপরই তার কানে খবর আসে জুঁইয়ের জন্যে ঠিক করা ছেলেও নাকি অন্য এক মেয়ের সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলো। এ খবর কানে আসতেই তীব্র আফসোসে জর্জরিত ছিলেন। মেয়ের খোঁজ-খবরও নিতে পারেননি সে। আফসোসের সাথে দিন-রাত মনে হতো, একবার মেয়ের কথা শুনলে কী এমন ক্ষতি হতো?
ঝামেলা মিটমাট করে বাসায় ফিরে তরী প্রথমে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। সাবিয়া তরীর আসার পরপরই বাথরুমে ঢুকেছে। তরীর মনে হচ্ছে কতদিন পর সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। অদ্ভুত শান্তি, ভালো লাগা, স্বস্তি সব দেহ জুড়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার। আসলেই, আপন নীড়ের মতো শান্তি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
———–
সিদাত ভুরু কুচকে সাইফের দিকে চেয়ে বলে,
–“এভাবে ইমার্জেন্সি ডাকলে কেন ভাইয়া?”
সাইফ সিদাতের কথায় ফোড়ন কেটে বললো,
–“সেসব কথা বাদ। তার আগে এটা বল তুই আবার কবে গার্লফ্রেন্ড জুটালি? এত বড়ো কথা তুই আমার থেকে এভাবে লুকাতে পারলি?”
সিদাত শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলো। সবেই গোসল দিয়ে বেরিয়েছে সে। ভেজা চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে তার। সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে। সাইফের কথা শুনে সিদাতের হাত নিজের অজান্তেই থেমে গেলো। বিস্ময় ভরা চোখে সাইফের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বললো,
–“এসব কী বলছো? গার্লফ্রেন্ড?”
সাইফ চোখ গরম করে তাকালো সিদাতের দিকে। হাত উঠিয়ে মা*র দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
–“মে*রে পিঠের চামড়া তুলে নিবো। আড়ালে-আবডালে সব সেরে এখন ন্যাকা সাজা হচ্ছে? গার্লফ্রেন্ড কী জিনিস তা তুমি বুঝো না?”
–“আমি আসলেই বুঝতে পারছি না ভাইয়া তুমি কী বলছো? আমার গার্লফ্রেন্ড আসবে কোথা থেকে? আমি তো সবেই জামালপুর থেকে আসলাম। মাথাটা তোমার আসলেই গেছে?”
–“মাথা আমার পুরোপুরি সুস্থ। কোথাও যায়নি। তুই সত্যি বলবি নাকি আমি বাবার কানে এই কথা লাগাবো?”
–“আমার গার্লফ্রেন্ড আছে আমিই জানি না আর তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছো? কে বলেছে এসব অহেতুক কথা?”,
সাইফ ভুরু কুচকালো। সিদাতের মুখ-ভঙ্গি স্বাভাবিক। সিদাত মিথ্যে বললে সাইফের কাছে সবসময় ধরা খায়, কিন্তু আজ কোনো দিক দিয়ে মনে হচ্ছে না সিদাত মিথ্যে বলছে। এর মানে কী দিয়া তাকে ভুল বললো? সাইফ কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
–“তোর ভাবীর বোনেরা নাকি বলেছে তোর গার্লফ্রেন্ড আছে?”
সিদাত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবার শার্টের বোতাম লাগাতে মনোযোগী হয়ে বললো,
–“এমনেই বলেছিলাম গার্লফ্রেন্ড আছে। স্বভাব সুবিধার লাগছিলো না এদের!”
সাইফ এতক্ষণে অংকের হিসেবটা মেলাতে সক্ষম হলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“যাক, ভালোই হয়েছে। ও হ্যাঁ তোকে আরেকটা নিউজ দেওয়ার আছে!”
–“কেমন নিউজ?”
–“বাবা এবার বিয়ের জন্যে তোর পিছে লেগেছে। মায়ের ইচ্ছে তোর বউও শীঘ্রই দেখতে চায়!”
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৬]
তরী ফুটপাতের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছে ফিরতেই কারো সঙ্গে ধাক্কা খেল। যার ফলে তার হাতে থাকা স্কেচবুক আর পেন্সিলগুলো পরে যায়। তরী অপ্রস্তুত হয়! সামনে তাকাতেই ভড়কালো। সিদাত মাথা নিচু করে স্কেচবুকের পেজটির দিকে চেয়ে আছে। তরী শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত সেগুলো উঠিয়ে তার ব্যাগে পুরে নেয়। সিদাত অবাক স্বরে বললো,
–“তোমার স্কেচ তো দারুণ নিকাব রাণী!”
তরী বিব্রত হলো। মিথ্যাও বলতে পারল না। এজন্যে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“যা দেখেছেন তা ভুলে যান!”
বলেই সিদাতের পাশ কেটে যেতে নিলে সিদাত বলল,
–“প্রতিভা ভুলতে নেই। তোমার স্কেচ সত্যি-ই সুন্দর। তুমি কী চারুকলা থেকে পড়ছো?”
তরী জবাব দিলো না। সে চলতে লাগলো। সিদাতও তার পিছে পিছে হাঁটছে। তরী প্রথমে সেভাবে খেয়াল করেনি। কী মনে করে পিছে চাইতেই সিদাতকে পেলো। সিদাত অমায়িক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। তরী সিদাতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
–“ভুলে যেতে বলেছি ভুলে যাবেন!”
–“কেন? আঁকিবুঁকি তোমার টপ সিক্রেট নাকি?”
তরী মুখে কিছু না বললেও সিদাত যা বোঝার বুঝে নিল। সিদাত হেসে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
–“ট্রুলি বলি নিকাব রাণী? তোমাকে দেখলে আমার চক্ষের শান্তি মিলে। এমন কেন হয়?”
তরী হকচকালো। মাথা তুলে সিদাতের চোখের দিকে চাইলো। পরমুহূর্তেই বিব্রত হয়ে পরলো সে। এই চোখ জোড়ায় অন্য রকম কিছু ছিল, যা তরীকে কেমন চমকিয়ে দেয়। তরী কোনো রকমে বললো,
–“আমার পিছু নেবেন না!”
বলেই তরী চলে গেলো। সিদাত সত্যি-ই পিছু নেয়নি। পাশের টঙে গিয়ে বলল,
–“আমাকে দুই কাপ চা দিন তো। হৃদয় ম্যাজম্যাজ করছে!”
দোকানদার অবাক চোখে চাইলো সিদাতের দিকে। কী ম্যাজম্যাজ করছে, তা বোধহয় বুঝতে পারেনি। সিদাত ভুরু কুচকে বলল,
–“তাকিয়ে আছেন যে?”
–“কী ম্যাজম্যাজ করছে বললা?”
সিদাত মাথা চুলকালো। আমতা আমতা করে বলল,
–“নাথিং, চা দিন। দুধ মেশানো চা কিন্তু!”
সিদাত চা দুই কাপ নয়, বরং পাঁচ কাপ খেলো। এক নাগাড়ে নয় অবশ্য। থেমে, থেমে। দুশ্চিন্তা, দোটানা, অস্থিরতা সব একসাথে তার ওপর হামলে পরেছে। এজন্যই এই চা খেয়ে মন ও মস্তিষ্ক ঠিক করতে চাইছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! মাগরিবের আযান পড়েছে। সিদাত চায়ের বিল পে করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনয়কে ভয়েজ মেসেজ দিলো,
–“প্লিজ ভাই! তুই আজ আমার অফিসে আয়। অস্থির লাগছে। সলিউশন না পেলে আজকে আমি হোস্ট করতে পারবো না। জলদি আসিস!”
সিদাত মসজিদে ঢুকে পরলো।
—————
সিদাত তার মায়ের পাশে বসে আছে। জয়া আজ চোখ বুজে রয়েছে। সিদাতের উপস্থিতিতেও তিনি চোখ খুলছে না। চাপা অভিমানে জর্জরিত তিনি। সিদাত হতাশ হয়ে বলছে,
–“কথা বলবে না আমার সাথে? বিয়ে করবো না বলেছি দেখে এত রাগ?”
জয়া চোখ মেলল না।
–“আম্মা, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। সবে তো ভাইয়ার বিয়ে হলো। একটু তো সময় দাও আমায়?”
জয়া তাও উত্তর দিলো না। হঠাৎ দিয়া পেছন থেকে বলে ওঠে,
–“মা ততক্ষণ রাজি হবে না, যতক্ষণ না তোমার গার্লফ্রেন্ডকে সে নিজের ছোটো ছেলের বউ হিসেবে দেখছে!”
সিদাত পিছে ফিরে বললো,
–“মেয়েটা মোটেও আমার গার্লফ্রেন্ড নয় ভাবী। জাস্ট চেনা-জানা।”
–“সেই একই হলো। মায়ের চাওয়াটা পূর্ণ করাটা এখন তোমার দায়িত্ব!”
–“পূর্ণ করবো কী করে বলো ভাবী? সামান্য বন্ধুত্ব করতে গিয়েছিলাম, এতেই আমার মুখের ওপর বলে দিলো আমি নাকি মাতাল হয়ে তার বাসায় ঢুকেছি, তাই আমাকে মেনে নিবে না। আমি মোটেও ইচ্ছাকৃত মাতাল হইনি এটা তাকে কে বুঝাবে?”
জয়া এবার চোখ মেলে তাকালো। দিয়া হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“দারুণ, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! মা, আপনার পছন্দ আছে!”
জয়া পলক ফেললো। সিদাত কিছুক্ষণ আপনমনে তার মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। মিনিটখানেক সময় নিয়ে বললো,
–“ওকে, ফাইন। করবো ওকে বিয়ে। তবে আমার কিছুটা সময় চাই।”
—–
–“এত ডাকাডাকি কেন?”
সিদাতের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। সিদাত চাপা স্বরে বললো,
–“আই থিংক, তুই রাইট!”
অনয় ভুরু কুচকে বলল,
–“প্রেমে পড়াটা?”
–“খাচা ভেঙে মন পালানোটা!”
সিদাতের এরূপ স্বীকারোক্তি শুনে অনয় হো হো করে হাসতে শুরু করলো। বলল,
–“একই তো!”
সিদাত আবার বললো,
–“বিয়ে বাড়িতে না গেলেই হতো। ওখানেই চব্বিশ ঘন্টা ঘুরঘুর করতো, মন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না!”
–“তাহলে আর চিন্তা কিসের? তুই কী খুশি হোসনি?”
এই পর্যায়ে এসে সিদাত হাসলো। বলল,
–“খুশি না হওয়ার কী আছে? অস্থির ছিলাম তোকে বলার জন্যে। দ্যাট’স ইট। আমি যথেষ্ট হ্যাপি নিকাব রাণীর মতো একজনকে পেয়ে। কেউ সাধনা করেও এরকম মেয়ে পায় না রে!”
–“তাহলে আর সমস্যা কী? ঝামেলা তো মিটেই গেলো!”
সিদাত হাসলো। পরমুহূর্তে অনয়কে বললো,
–“আমার আম্মা তরীকে পছন্দ করেছে আমার বউ রূপে!”
অনয় যেন আকাশ থেকে পরলো সিদাতের কথা শুনে। সিদাতের অধরে তৃপ্তির হাসি ঝুলছে। অনয় অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
–“সত্যি?”
–“হ্যাঁ! মা-ই জেদ ধরেছে আমার বউ দেখার। অবশ্যই তরীকে। কিন্তু বাবাকে বলব কী করে?”
–“বাবাকে বলার আগে শ্বশুরের মন জিততে হবে। শ্বশুর মেয়ে না দিলে তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার বন্ধু। এজন্যে আগে শ্বশুরকে প্রায়োরিটি দিতে হবে! সে পটে গেলেই ভেবে নে তোর লাইফ সেট!”
—————————-
সিদাত অনয়ের সাথে কলে কথা বলতে বলতে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। হঠাৎ অদূরে চাইতেই দেখলো আকবর সাহেব বাজারের ভারী ব্যাগ বয়ে হাঁটছে। সিদাত অনয়কে কল কাটতে বলে চোখের সানগ্লাস খুলে ফেললো। চুল ঠিক করতে করতে আকবর সাহেবের দিকে চলে গেল। প্রথমেই অমায়িক হাসি দিয়ে সালাম দিলো আকবর সাহেবকে। আকবর সাহেব হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
–“তুমি সিদাত না?”
–“জি আঙ্কেল। বাজারের ব্যাগটা আমায় দিন, আপনার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে।”
–“আরে না, না। আমি পারবো।”
–“সেটা তো বললে চলে না আঙ্কেল। প্লিজ না করবেন না, আমাকে দিন!”
আকবর সাহেবের থেকে একপ্রকার জোর করে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। এরপর দুজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন ব্যাপারে গল্প করতে লাগলো। সিদাত আকবর সাহেবের কাছে মাদ্রাসার ঠিকানা চাইলে আকবর সাহেব বলল,
–“হঠাৎ? কেন বাবা?”
–“একচুয়ালি আঙ্কেল, হঠাৎ নয়। আগামী সপ্তাহেই আমার দাদীর মৃত্যুবার্ষিকী। এজন্য বাবা প্রতিবারের মতো চাচ্ছেন কিছু মাদ্রাসায় মিলাদ পড়িয়ে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্যে৷ এতিমখানাতেও খাবার রান্না হবে। তাই আমি মাদ্রাসার ঠিকানা যোগাড় করছি!”
আকবর সাহেব সন্তুষ্ট হলেন সিদাতের কথা শুনে। যাক, অন্তত এই ধরণের ছেলেরা টাকা ওড়ায় না। খুবই নেক চাওয়া এগুলো। আকবর সাহেব সায় জানিয়ে ঠিকানাটা বলে দেয়। সিদাতের এখানে মিলাদ নিয়ে আকবর সাহেবকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছে নেই।
আজ ছুটির দিনে সকাল সকাল বের হয়েছেই এসব কারণেই। সাইফ বাজার, আয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখছে আর সে সর্বপ্রথম এতিমখানা, মাদ্রাসার খোঁজ করতে বেরিয়েছে। আকবর সাহেবের বাজার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে সে চলে গেলো মাদ্রাসায়।
পরের সপ্তাহে খুব সুন্দর ভাবে মিলাদ পড়ানো হলো। সাঈদ সাহেব নিজে সিদাতের নির্ধারিত এতিম খানা এবং মাদ্রাসাগুলোতে চক্কর দিয়েছিলেন। বাচ্চারা খুব খুশি হয়েছে সাঈদ সাহেব, সাইফ এবং সিদাতকে পেয়ে। তরী খবর কিছু কিছু জানলেও সেরকম কোনো পতিক্রিয়া করেনি। আকবর সাহেবের মুখেই শুনেছিলো।
তরী ছাদের এক পাশে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বিকালের শীতল বাতাস তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনে চোখ মেলে চাইলো। পাশে চাইতেই চমকালো। বিস্ময়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যায় তরী। সিদাত পশ্চিমাকাশে চেয়ে আছে আগের মতোই। তরী ভুরু কুচকে সিদাতের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তে পিছে ফিরে তরী অন্য দিকে যেতে নিলে হঠাৎ সিদাত উচ্চস্বরে বললো,
–“বিয়ে করবে আমায়?”
তরীর পা জোড়া না চাইতেও থমকে গেল। হতভম্ভ সে। পিছে ঘুরে সিদাতের দিকে তাকাতেই সিদাত মুচকি হেসে বললো,
–“এই প্রস্তাবই সরাসরি তোমার বাবাকে গিয়ে দিব। তুমি আমার মায়ের পছন্দ। আমার মায়ের পছন্দ আমি খোয়াতে পারি না নিকাব রাণী!”
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]