হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
607

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [শেষাংশ]
লাবিবা ওয়াহিদ

সত্যি সত্যি-ই আজ রাজিব এলো। তবে একা নয়, পুরো পরিবার। আবির, জুঁই সঙ্গে আনিকাও এলো। আনিকা আসলেই অবাক হয়েছিল তরীর বিয়ের কথা শুনে। তরীর বিয়ের কথা শুনে আত্নীয় স্বজনের মধ্যে অনেকেই অনেক কথা বলেছে আকবর সাহেবকে। তাদের সবার এক কথা, তাদের কেন জানানো হয়নি? এছাড়া অনুষ্ঠান কেন করল না? আকবর সাহেব সকলকে বেশ ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যখন সবটা অনুকূলে আসবে তখন একটা না একটা ব্যবস্থা করবেই। তবে এই লোক দেখানো অনুষ্ঠানের জন্যে সিদাত এবং তরীর একসাথে থাকাটা আটকে রাখবে, এমন মানসিকতার মানুষ আকবর সাহেব নন। তিন কবুল বলে আল্লাহ্’র নিকট তারা স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠেছে। তাদের সামান্য, ঠুনকো অনুষ্ঠানের জন্যে কেন আলাদা করা হবে? তাই এই চিন্তা-ধারা আকবর সাহেব বড্ড অপছন্দ করেন। এছাড়া দেনমোহর পরিশোধ করা হয়েছে প্রথমেই। তাহলে একসাথে থাকবে না কেন?

তরীর ফুপিরাও আসত। কিন্তু শাওনের পরীক্ষা চলছে দেখে সে আসার সাহস করেনি। কারণ শাওন এমনিতেই ঠিক মতো পড়ে না। এত সিরিয়াস পরীক্ষার সময় বেড়াতে আসলে নির্ঘাত পড়াশোনা তুঙ্গে উঠিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে। তাই এই ব্যাপারে ফুপু কঠোর হয়েছে। শাওন তো জেদ করছেই সারাক্ষণ, আসার জন্যে। শাওন সিদাতের অন্ধভক্ত বলা যায়। সেই প্রিয় তারকা তার দুলাভাই হয়েছে। এতে ধৈর্য থাকে? তার কতদিনের সখ সে রেডিও অফিস দেখবে, ঘুরবে এবং ভবিষ্যতে সেও আরজে হবে।

সানিয়াকে রাতে তরীর ফুপা দিয়ে যায়। সানিয়া এত মানুষ পেয়ে খুব খুশি। সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও আনিকা বাজে রকম ভাবে মুখ গোমড়া করে ভেতরের রুমে বসে আছে। ভেতরের রুমে আনিকা, জুঁই, সানিয়া এবং মামী বসেছে। মামী কিছুক্ষণ বসার পরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল রান্না করার উদ্দেশ্যে। আনিকা মুখ ফিরিয়ে চাইল জুঁইয়ের দিকে। জুঁই রুম জুড়ে নজর বুলাচ্ছে। আনিকা চাপা স্বরে বলল,

–“তরীর মতো মেয়ে কী করে ওরকম সেলিব্রিটি মানসিকতার ছেলেকে বিয়ে করল ভাবী? আমি বলতাম না, ওর চরিত্রে ঘাপলা আছে? আমার কথা মিলল তো?”

জুঁই উত্তরে কিছুই বলল না। সে চোখ পাকিয়ে দেখল আনিকার হিংসাত্মক মুখখানা। সানিয়া কিছুটা দূরেই অবস্থান করছিল। তবে সে গতবারের মত চুপ থাকল না। হাতের মুঠোফোনটি রেখে আনিকার পাশে গিয়ে বসল। অধরে হাসি নিয়েই বলল,

–“আসলে হয়েছে কী আপু, যার মানসিকতা যেমন তার ঠিক তেমনটাই ভাবার স্বভাব।”

আনিকা তেঁতে উঠে বলল,
–“কী বলতে চাচ্ছ তুমি?”

–“বিশেষ কিছু না। গায়ে লাগল? আমি তো তোমাকে বলিনি।”

সানিয়া আবার হেসে তখনই জুঁই কে নিয়ে চলে গেল। আর আনিকা সেখানে বসেই ফুঁসতে লাগল। সে পারছে না এক্ষুণি, এই রাতেই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। কেন সহ্য করবে সে এরকম অপমান?

মূলত জয়ার এক্সিডেন্টটা হয় সিদাতের ছাত্র বয়সে। তখন সে অনার্স চতুর্থ বর্ষে। সাইফ তখন সদ্য লেখাপড়া শেষ করে দেশ, বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। জয়া সেদিন গুরুতর রোড এক্সিডেন্ট করে বসে। ড্রাইভারের সাথে একা একা কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিল সে। হাইওয়ে রাস্তায় ড্রাইভার খুব স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছিল। জয়া প্রথমে গতি বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে ড্রাইভারকে বলেছিল আস্তে চালাতে। কিন্তু ড্রাইভার শুনেনি। অধরে হাসি ফুটিয়ে জয়াকে আশ্বস্ত করছিল কিচ্ছু হবে না। পরে কোথা থেকে এক ট্রাক এল। ড্রাইভার জয়াকে ফেলেই গাড়ি থেকে ঝাপ দেয়। জয়া পরিস্থিতি সামলে উঠতে না পারলেও আসন্ন বিপদ বুঝে চটজলদি স্টিয়ারিং-এর কাছে এসে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফেলে। শেষ মুহূর্তে ট্রাকটা তার গাড়ির গা ঘেঁষে গেলেও রক্ষা হয়নি। গাড়িটা উলটে গেল। আর ট্রাকও পালাল। কিছু মুহূর্তে-ই সব যেন উলোট পালোট হয়ে গেল।

রাজিব সেই পথেই ছিল। প্রাইভেট কার ভাড়া করে কিছু কাজে ঢাকা এসেছিল। কিন্তু ওই হাইওয়েতেই তার সেই গাড়িটা খারাপ হয়ে যায়। ঠিক করার মুহূর্তে-ই নিজ চোখে সেই দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে সে। রাজিব এবং ড্রাইভার দুজনেই ছুটে এলো সেই গাড়ির কাছে। ভেতর থেকে মারাত্মক আহত জয়াকে বের করে হসপিটাল নিয়ে যায় সে-ই। সেখান থেকেই রাজিবের সঙ্গে সাঈদ সাহেবের পরিচয়। সাঈদ সাহেব রাজিবকে কোনোরকম কৃতজ্ঞতা স্বরূপ টাকা ধরিয়ে দেয়নি। বরং খুব ভালো একটা সম্পর্ক রেখেছে। যা রাজিবকে খুব সিক্ত করেছে। এরপর থেকেই রাজিব সাহেব এই পরিবারটার ভক্ত হয়ে গিয়েছে।

জয়ার অবস্থা ক্রিটিকাল ছিল বিধায় তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছিল ভালো চিকিৎসার জন্যে। দুই ভাই যেন হঠাৎ-ই ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাকে নিয়ে, তাদের সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে। আর সাঈদ সাহেব সব জায়গায় সেই ড্রাইভারের খোঁজ চালিয়ে দিল। কারণ রাজিব সাহেব দেখেছিল এক্সিডেন্টের আগেই ড্রাইভার গাড়ি থেকে ঝাপ দিয়েছিল।

জয়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর জয়ার মুখে সব শুনেছে তারা। জয়া সুস্থ হলেও হাঁটতে পারত না। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করত। পরবর্তীতে জানা যায় এ-সকল কান্ড ঘটিয়েছে সাঈদ সাহেবের শত্রু। মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নেমেছিল তারা। সাঈদ সাহেব তাদের ধরেছে। কিন্তু আইনের হাতে সবাইকে তুলে দেয়নি। সেই থেকে সাঈদ সাহেব আরও কঠিন হয়, দেশের নানান ভয়ংকর কিলার, গ্যাংস্টারের সাথে সে নীরবে সম্পর্ক গড়ে তোলে। যাতে করে এই ধরণের বিপদে তাদের সাহায্য পেতে পারে।

জয়া প্রথম দেড় বছর সুস্থ থাকলেও হঠাৎ সে অসুস্থ হতে শুরু করে। তার পা জোড়া ধীরে ধীরে অবশ হচ্ছিল। হাঁটতে না পারলেও জয়া তার পা নাড়াতে পারত। কিন্তু এবার সে কিছুতেই পারছিল না। নিজের এই অবস্থা দেখে সে খুব কাঁদত। আল্লাহ্’র কাছে চাইত এরকম কিছু না হোক। জয়ার আবার ট্রিটমেন্ট চলতে শুরু করে। নিজের করুণ অবস্থার জন্যে তার মনে সবসময় কু ডাকতে শুরু করল।

এর মাঝে ফিরোজা খাতুন জয়াকে কয়েকবার দেখতে এসেছে। ফিরোজা ডিভোর্সী ছিল। সে কখনো বায়োলজিক্যালি মা হতে পারবে না। এটা জানতে পেরেই ফিরোজাকে তালাক দেয় ফিরোজার প্রাক্তন স্বামী। এরপর থেকে ফিরোজাকে তাঁর পরিবার বিয়ে দিতে পারেনি। একে তো বয়স বেশি, তার ওপর ডিভোর্সী। মা হতে না পারার খবরটাও বেশিদিন চেপে রাখা গেল না। পড়াশোনা নিয়ে ফিরোজা একসময় ভীষণ শক্ত ছিল। এজন্যে সে বিয়ে করেছে চব্বিশ বছর বয়সে। তাও বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।

এত বড়ো মেয়ে কোন পরিবার নিবে? বাঙালির কাছে তো বয়স কুড়ি মানেই মেয়ে বুড়ি। তবুও ফিরোজার বিয়ে হয়। ছয় বছরের সংসার হয়। কিন্তু ছয় বছরের সংসারে তার কোনো সন্তান হলো না। সেই থেকে-ই ফিরোজা দারুণ একাকীত্বে ভুগত। একাকীত্ব কাটাতে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতে শুরু করে দেয়। এছাড়া খুব ভালো মনের মানুষ সে। তার জীবনের একটাই আক্ষেপ৷ মাবুদ কেন তাকে একটা সন্তান দিল না? মা হওয়ার অনুভূতি অনুভব করালো না?

ফিরোজাকে দেখে জয়ার হঠাৎ কী যেন মনে হলো। সে তৎক্ষণাৎ ফিরোজাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। সাঈদ সাহেবকে তখনো জিজ্ঞেস করেনি। জয়ার মন বলছিল, যেহেতু ফিরোজার সন্তান নেই সেহেতু সেই পারবে তার পরিবারকে নিজস্ব করে রাখতে, নিজের মতো করে আগলে রাখতে।

ফিরোজা অবাক হয়েছিল, কিন্তু রাজি হয়নি। তাকে রাজি করাতে করাতে জয়ার কোমর অবধি প্যারালাইজড হয়ে যায়। একসময় জয়া কেঁদে-কেটে মিনুতি করল, তার সন্তানদের সে ছাড়া আর কোনো গতি নেই। সাঈদ সাহেবও কোনোদিন দ্বিতীয় বিয়ে করবে না। জয়ার ধারণা ছিল মা ছাড়া তার দুই সন্তান বেপথে চলে যাবে, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন গড়ে তুলতে পারবে না। এ নিয়ে তার বড্ড ভয় কাজ করত। এজন্যে হাত জোর করে ফিরোজাকে রাজি করাল। ফিরোজাও বারবার মিনুতি করে বলেছিল,
–“আমি চাই না আমার প্রিয় বান্ধুবীর ঘরে সতীন হয়ে প্রবেশ করতে।”

জয়া ফিরোজার এ-কথাও শুনেনি। এরপর আর কী, সাঈদ সাহেবকে রাজি করিয়ে জয়া তাদের বিয়ে করিয়ে দিল। সাইফ, সিদাত মন থেকে এই বিয়ে মানতে না পারলেও কখনো ফিরোজাকে অসম্মান করেনি। ফিরোজাকে প্রথম দিকে এড়িয়ে গেছে। ধীরে ধীরে মায়ের জন্যে সব মানতে বাধ্য হয়েছে। তবে ফিরোজা এই দুই ভাইকে মনের গহীনে বসিয়ে ফেলল নিজের সন্তান রূপে। এইতো, সে মা অনুভূতি পাচ্ছে। গর্ভে ধারণ করলেই কী মা হতে হয়? জয়া এভাবেই ধীরে ধীরে প্যারালাইজড হয়ে গেল। কতশত চিকিৎসা করেও ফায়দা হয়নি। চিরতরে শয্যাশায়ী হয়ে গেল সে।

রাজিব সাহেব সেই দুর্ঘটনার-ই বর্ণনা দিচ্ছিল আকবর সাহেবের সঙ্গে। বাকিরাও কিছুটা শুনেছে। পর্দার আড়ালে তরীও পুরোটা শুনতে পায়। সিদাত বাসায় নেই। অফিসে আছে। অফিস থেকে সোজা তাকে এখানেই ফিরতে হবে। সব শুনে আকবর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ঘটনা আকবর সাহেব আগেও সাঈদ সাহেবের মুখে শুনেছিলেন।

রাতে সবাই গিজগিজ করে ঘুমালো। কিছু সংখ্যক অনয়ের ফ্ল্যাটেও ঠাঁই পেয়েছে। পরদিন সকালে নাস্তা বানানোর ব্যস্ততা শুরু হল। ছেলেরা বাইরে থেকে হাঁটাহাঁটি করে এসে চা খেল। অতঃপর সব ছেলেরা আগে নাস্তা করেছে, আর পরে গিয়ে মেয়েরা একসাথে বসেছে। আকবর সাহেব আজ অনয়কেও সারাদিন এখানে খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে। যেহেতু আজ ছুটির দিন সেহেতু অনয়ও বারণ করেনি। অনয়ের আর দুই সপ্তাহ বাদেই বিয়ে।

বিকালে ছোটো’রা রেস্টুরেন্টে গেল খেতে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল মৌসুমি, মৌসুমির হাসবেন্ড, সাদিয়া এবং তাদের দুজন কাজিন। ওরা ঘুরতে এসেছিল এদিকে। তাই ভাবল সবার সাথে দেখা করে যাক। সাদিয়ার পাশের ছেলেটা তরীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল। এটা সেই ছেলে যে মৌসুমির হলুদে তরীকে জ্বালাতে এসেছিল। মুচকি হেসে কিছু জিজ্ঞেস করতেই নিবে ওমনি সিদাত তরীর সামনে চলে আসে। এক গাল হেসে বলে,

–“স্যরি ব্রো। আমার ওয়াইফের সাথে কথা বলার কোনো অনুমতি আমি আপনাকে দিচ্ছি না!”

তরী মুগ্ধ হয় এ কথা শুনে। সকলেই সিদাতের এ-কথা শুনেছে। ছেলেটার মুখটা ভীষণ রকম গোমড়া হয়ে গিয়েছে। সে জানত না তরীর বিয়ে হয়ে গেছে। এদিকে সে সাদিয়ার সাথে বলছিল তরীর বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। সাদিয়া বলেছিল সময় হলে পাঠিও। এজন্য সে একটু ভেঙে পড়ল। তটস্থ হয়ে সাদিয়ার হাত ধরে কিছুটা দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলল,

–“তুই আগে কেন বললি না তরীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”

সাদিয়া এক গাল হেসে বলে,
–“মন ভাঙলে কেমন লাগে সেটাই বোঝাচ্ছিলাম। তবে আমার তুলনায় এটা কিছুই না। আমি জানি তুমি আরও মেয়ে পটানোর চেষ্টা করবে!”

–“ছোটো মানুষ, ছোটো হয়ে থাক। বড়োদের মধ্যে খবরদার ঢুকবি না!”

–“অথচ এই ছোটো মানুষকেই জিজ্ঞেস করেছিলে বিয়ের প্রস্তাব দিবে কী-না, দেওয়া ঠিক হবে কী-না, তাই না? হাহ্!”

–“তুই কী মনে করিস, তোকে ছাড়া আমার কোনো গতি নেই?”

সাদিয়া পা কিছুটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আদিবের গাল টেনে বলল,
–“আসলেই কোনো গতি নেই। সেদিনও শুনেছি, চাচী তার ছেলের বউ হিসেবে আমাকেই চায়। এখন তুমি যত ব্যাঁকা ত্যাড়া হও না কেন, বিয়ে তো তোমার আমার সাথেই হবে আদিব ভাইয়া!”

—————–
আজ অনয়ের বিয়ে। সিদাত, তরী, সাইফ এবং দিয়া ওরা সকলেই এসেছে অনয়দের গ্রামে। ট্রেনে করে আসার কথা থাকলেও তরীর জন্যে ট্রেনের ব্যাপারটা বাদ। এছাড়া ইদানীং দিয়ার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।

আজ অনয়ের গায়ে হলুদ। তরী এবং দিয়াকে রেস্ট করতে দিয়ে দুই ভাই চলে গেল ছাদে। ছাদেই অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই মুহূর্তে দিয়া আর তরী চাচ্ছে না অনুষ্ঠানে যেতে। দিয়া বিছানায় গা এলিয়ে বলল,
–“জানো তরী, মনে হচ্ছে আমার মধ্যে আরেকজন আছে!”

তরী অবাক হয়ে চাইল দিয়ার দিকে। তরী বুঝতে পারছে দিয়া কী বুঝাতে চাচ্ছে। দিয়া উঠে বসল। তরীর মুখের নকশা দেখে হেসে বলল,
–“সত্যি-ই মনে হচ্ছে। নয়তো দেখো, ঠিক মতো খেতে পারছি না, খাবারের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না, ঘনঘন বমি, সাথে অন্যান্য কিছু লক্ষণও পাচ্ছি। আমি নিশ্চিত বলতে পারো!”

তরী মুচকি হেসে বলল,
–“তাই যেন হয়। আমিও চাই তোমার মতো সুন্দর কন্ঠের অধিকারীনি আরেকজন আসুক!”

দিয়া তরীর হাতে হাত রেখে বলল,
–“ছেলে, মেয়ে যেই হোক না কেন তরী। তাকে আমি এই অসুস্থ দুনিয়া থেকে সরিয়ে তোমার আদর্শে গড়ে তুলব। শুধু দোয়া কর রব যেন আমায় সেই হেদায়াত দান করে!”

তরী দিয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে মিনমিন করে বলল, “আমীন!”

তরী দেখেছে, দিয়া আগের থেকে নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করেছে। এখন সে ঘরেও মাথা ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে, সিদাতের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। যা সত্যি-ই প্রসংশনীয়। দিয়ার সঙ্গ তরীকে খুব আনন্দ দেয়। দিয়া কথা সাহিত্যিক হিসেবে তার উপন্যাস বলার সুর, কন্ঠ অনবদ্য লাগে তার কাছে।

কিছুক্ষণ বাদে অনয়ের মা এলো দুই বউ দেখতে। সঙ্গে এনেছে নাস্তা-পানি! অনয়ের মা খুব প্রশংসা করল ওদের। এতে দুই জা-ই লাজুক হাসল।

——————–
–“দিয়া শোনো!”

দিয়া সাইফের বুকে চোখ বুজে শুয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, “হুঁ, শুনছি!”
–“ওই ছেঁড়া পেজ গুলোতে কী লেখা ছিল?”

দিয়ার চোখ মেলে গেল। কিছুটা সিরিয়াস হয়ে গেল সে। গম্ভীর হয়ে বলল,
–“কেন?”
–“কৌতুহলটা এখনো মন থেকে বেরোয়নি!”

দিয়া চুপ থাকল। সাইফ ধৈর্যহারা হয়ে গেল। কয়েকবার জোর করল দিয়াকে বলার জন্যে৷ সাইফ আবার বলল,
–“প্লিজ বলো, আর কত লুকিয়ে রাখবে? এখনো আমার প্রতি তোমার এত অবিশ্বাস?”

দিয়া তাও মিনিট দুয়েক চুপ থাকল। হঠাৎ বলল,
–“আসলে..”

এইটুকু বলে দিয়া থেমে গেলে সাইফ আরও উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–“আসলে কী?”

–“আসলে.. ওসব পেজে কিছুই লেখা ছিল না। আমার এক বান্ধুবী তার বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় এসেছিল। আমি যেহেতু ডায়েরী বিছানায় নিয়ে ঘুমাতাম সেহেতু আমার অনুপস্থিতিতে ওই বাচ্চাই এটা সেটা এঁকে রেখেছিল। আর কিছুই ছিল না!”

দিয়া হঠাৎ ফিক করে হেসে দিল। সাইফ চট করে উঠে বসল। দিয়ার হাসি থামছে না। সাইফ বেক্কল বনে দিয়ার দিকে চেয়ে আছে। ভুরু কুচকে বলল,
–“ধোকা দিয়ে বিয়ে করলে আমায়? মজা নিলে?”

–“আমি কোথায় ধোকা দিলাম? আপনি-ই তো নাচতে নাচতে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন!”

সাইফ চোখ লাল করে বলল,
–“এসব করেও ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করা যায়?”

দিয়া বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
–“ভাগ্য সহায় থাকলে যে কোনো কিছু করেই বিয়ে সম্ভব!”

সাইফ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এসব। এতদিন অপেক্ষা করল, ভেবেছিল কী না কী লেখা ছিল সেখানে। হয়তো কোনো স্ট্রাগল। অথবা অন্য কিছু!

দিয়া আবার বলল,
–“আমি এত ডায়েরী লিখতে ইন্টারেস্টেড না। মনের ব্যাপারগুলো মনে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তখন সদ্য প্রেমের ফুল ফুটেছিল, এজন্য কয়েক পেজ লিখে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে আমার অভ্যাস না থাকায় আর লেখা হয়ে উঠেনি। কিন্তু একদিন মনে হল আপনাকে আমি প্রপোজ করব, কিন্তু কীভাবে তা বুঝতে পারছিলাম না। পরে মনে পড়ল ডায়েরীর কথা। সঙ্গে পেজ দেখে মাথায় এলো এমন কিছু করি যাতে আপনি দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হন। হলোই তাই। তবে আমার ভাবনার চাইতেও বেশি ছিল।”

দিয়া কিছুটা থেমে আবার বলল,
–“রাগ করলেন নাকি?”

সাইফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“মিষ্টি বউয়ের ওপর রাগ করা যায় নাকি? রাগ করলেও তুমি ভালোবাসা দিয়ে মানিয়ে নাও। এখন এদিকে আসো, ঘুম পাচ্ছে। এখনই মনে হচ্ছে জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখেছি!”
দিয়া আবারও হেসে দিল সাইফের এহেম কথায়।

সিদাত অত্যন্ত গরমে ঘুম থেকে উঠে বসল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালানো। সিলিং ফ্যান চলছে না, অর্থাৎ রুমে কারেন্ট নেই। সঙ্গে দেখতে পেল নামাজরত তরী। পাখাটা বিছানার উপরেই ছিল। মোবাইলের আলোতে সিদাত লক্ষ্য করল তরীর মুখ ঘর্মাক্ত। সিদাত একপলক পাখাটার দিকে তাকাল। পরে কী ভেবে সে পাখাটা নিয়ে তরীর কাছে চলে গেল। তরীকে ধীরে সুস্থে বাতাস করতে লাগল সে। তরীর নামাজ শেষ হওয়া অবধি সে বাতাস-ই করল। তরী মোনাজাত শেষ করে সিদাতের হাত থেকে পাখাটা নিয়ে নিজে বাতাস করতে লাগল। তরী মুচকি হেসে বলল,
–“এত ভালোবাসেন?”

সিদাত বাচ্চাদের মতো মুখ করে উপর নিচে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলল,
–“হুঁ। সন্দেহ আছে?”
–“উহু। আপনি সন্দেহ করার মধ্যেই পড়েন না। বেশি গরমে ঘুম ভেঙেছে তাই না?”
–“হ্যাঁ। নামাজে ডাকোনি কেন?”

–“রাতে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন। এজন্যে আমার ডাক বোধহয় শুনতে পাননি। এজন্য আমি আগে নামাজটা সেরে আপনাকে ডাকতেই নিচ্ছিলাম!”

–“লোড শেডিং কখন হলো?”

–“এইত। দুই ঘন্টা হবে হয়তো!”

–“এর আগে ঘুম ভাঙেনি মানে তুমি এতক্ষণ হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিলে?”

তরী মুখে কিছু বলল না। লাজুক হয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। সিদাত হঠাৎ তরীর কপালে অধর ছুঁয়ে বলল,
–“এত সেবা-যত্নের উপহার ছিল এটা!”

তরী চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল সিদাতের দিকে। সিদাত হাসল। কী ভেবে বলল,
–“তুমি কী আমাকে ভয় পাও নিকাব রাণী?”
–“না তো।”
–“কেন ভয় পাও না?”
–“স্বামী হচ্ছে একজন স্বস্থি এবং ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসাকে তো কখনো দেখিনি ভয় পেতে!”
–“তোমার ইচ্ছে করে না, আজকালকার মেয়েদের মতো স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে, মারা-মারি করতে?”

তরী আঁতকে উঠল এ-কথা শুনে। গালে তওবা করে বলে,
–“ছিঃ, এগুলো কী বলছেন? যাকে সম্মান করি, হৃদয়ে স্থান দিয়েছি তাকে নিয়ে এসব কেন ভাবতে যাব? এগুলো তো বেঠিক, নিম্ন মানের চিন্তা-ভাবনা। মেয়েরা যদি বুঝত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কতটা মধুর, স্বামী কতটা সম্মানের তাহলে তারা কখনোই এসব চিন্তা মনেও আনত না।”

সিদাত জড়িয়ে নিল তরীকে নিজের সাথে। তার অধরে লেপ্টে আছে তৃপ্তির হাসি। সিদাত বলল,
–“হ্যাঁ! একজন স্ত্রীও কিন্তু সমান সম্মানের। একজন ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন পুরুষেরও উচিত নয় স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, তার সাথে কঠিন সুরে কথা বলা।
একজন পুরুষের সর্বোচ্চ সুন্দর ব্যবহার শুধুমাত্র তার স্ত্রীর প্রাপ্য!”

তরীও লাজুক হাসল। চোখ বুজে আবেশ কন্ঠে আওড়াল, “আপনি আমার শান্তির স্থান সাহেব। আমি আপনার শান্তির স্থান হয়ে বাঁচতে চাই।”

–“তাহলে বলছ আমার ভেজা হৃদয় তোমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে?”

তরী মুখ লুকাল সিদাতের এ-কথায়। তরীর আর বলতে হলো না সিদাতকে। সিদাত নিজেই সব বুঝে নিল। সাথে মনে হলো সে আজ সবচেয়ে সুখী মানুষ।

——————
অনয়ের বিয়ে সেরে ওরা আবার ফিরে এলো। কিছুদিন পর-ই সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা খাতুন ফিরবে হজ সেরে। এ নিয়ে সকলের গোছ-গাছ, আয়োজন করা শুরু। এর মাঝে জানা গেল দিয়া প্রেগন্যান্ট। সাইফ তো একদম আনন্দে আত্মহারা। যখন সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা খাতুন ফিরে এলো তখন তারা এ-কথা শুনে ভীষণ খুশি হলো। তারা দাদু-দাদী হবে। এই খুশির দিনে জয়াকে কেউ-ই ভুলেনি। ঠিকই বাবা এবং দুই ছেলে জয়ার কবর জিয়ারত করে আসে। সুসংবাদ শুনে নাজমুল সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীও দুইদিন থেকে যায়। এ যেন এক পূর্ণ পরিবার। দিয়ার খুশি, মা হওয়ার অনুভূতি সে প্রকাশ করে বুঝাতে পারবে না। তরী মন-প্রাণ দিয়ে দোয়া করল অনাগত অতিথির জন্যে।

তরী বিছানা ঝাড়ছে। সিদাত হুট করে রুমে এলো। ফিরেছে তো অফিস থেকেই। পা টিপে টিপে তরীর সামনে গিয়ে বলল,
–“নিকা রাণী শোনো!”

তরী পিছে ফিরে বলল,
–“ওহ, এসেছেন!”

–“হুঁ। বিছানায় বসো। কথা আছে!”

তরী বসল। কৌতুহলী চোখে সিদাতের দিকে চেয়ে বলল,
–“জি বলুন। আমি শুনছি!”

সিদাত তরীর পাশে গিয়ে বসল। পেছন থেকে গোলাপ গুচ্ছ বের করে বলল,
–“গোলাপের সঙ্গে হৃদয় এনেছি ভেজা!”

~~সমাপ্ত।