#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৩ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২১.নিভ্রর কাঁধে মাথা দিয়ে মৌনি ঘুমিয়ে পড়েছে। এই ঘুমটা মৌনির কাছে বেশ প্রশান্তির যা ওর মুখমন্ডল দেখেই যেন স্পষ্ট বোঝা যাবে। এই ভরসন্ধ্যার সময় জীপ গাড়িটি এগিয়ে চলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের দিকে।আর ড্রাইভ করছে সোহান। নিভ্রর একবার ইচ্ছে করেছিলো যে সে ড্রাইভ করুক কিন্ত মৌনির জন্য তা পারলোনা। মৌনি নিভ্রর বাহু জরিয়ে কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। যদিও চেহারাটা বেশ দুর্বল। নিভ্র কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মৌনির মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাওয়ার তালে মৌনির চুলগুলো বারবার উড়ে আসছে নিভ্রর মুখে। মৌনির চুলে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ আছে। ঘ্রাণটা কোনো কৃত্তিম শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারের না ; প্রাকৃতিক একটা ঘ্রাণ যেটা নিভ্র সবসময় মৌনির আশেপাশে থাকলেই অনুভব করতে পারে।
জীপে বারবার উথাল-পাতাল ঝাঁকুনির ফুলে মৌনি একসময় নিভ্রর বুকে মাথা রাখলো। নিভ্র তা দেখে একগাল হাসে। নিভ্রর বুকে বারবার মিশে যাচ্ছে মৌনির উষ্ণ নিঃশ্বাস। দেখে নিতান্তই কোনো এক কিশোরী মনে হবে মৌনিকে। আর ওর এই বিষয়টাকেই তো বড্ড ভালোবাসে নিভ্র। একেবারেই সরল , মনে কোনো দাগ নেই। নিভ্র এবার চারিদিকে তাকায়।
দু ধারের সারি সারি গাছপালার মাঝে কনক্রিটের ঢালু পথ দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা প্রায় নিস্তেজ। নিভ্র সোহানের উদ্দেশ্যে এবার বললো……….
.
—সোহান! হাইওয়ের ডানপাশের মহামায়া লেকের দিকে জীপটা নিবি কিন্ত।
বাকিরা উৎসুক চোখে নিভ্রর দিকে তাকায়।যেদিকে দুজনের তাড়াহুড়ো করে ঢাকা যাওয়ার কথা সেখানে হুট করে নিভ্রর কি হলো?
—মানে? মহামায়া লেকের ওদিক গিয়ে কি করবি? (নিশু)
এই হাইওয়েতে দূর দূর কোথাও কোনো খাবার হোটেল নেই।মহামায়া লেকের পথেই দু’তিনে পাওয়া যাবে। তাছাড়া মৌনির জন্য কিছুটা রিফ্রেসমেন্ট দরকার। তাই আমি ভেবেই বলছি ওদিকটাতে চল্।
.
নিভ্রর কথাতো সোহান জীপটা ডানদিকের পথে ঢুকিয়ে দেয়। পথটা বেশ অন্ধকার। জীপের হেডলাইটের আলোর ওপর অনুমান করেই সোহান ড্রাইভ করছে। পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট রূপ ধারন করেছে। নিভ্র এবার মৌনির দিকে মনোনিবেশ করলো। অন্ধকারের মধ্যেও মৌনিকে স্পষ্ট সে অনুভব করতে পারছে চোখের আন্দাজে। হঠাৎ নিভ্রর কি খেয়াল হলো সে জানেনা। অন্ধকার পথে সবার চোখের আড়ালেই মৌনির কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো সে। মাঝেমাঝে নিভ্রর মনে আজগুবি সব ভাবনা চেপে বসে। এ ভাবনাটিও সে একই তালিকায় ফেলে দিয়েছিলো। নাহলে এমন কাজ করার মতো কোনো পরিকল্পনাই নিভ্র সজ্ঞানে থাকতে করতোনা।
সরু পথের এককোণে খাবারের দোকান পেতেই সোহান জীপ থামিয়ে দেয়। এখানে মানুষের গুটিকয়েক আনাগোণা রেয়েছে বিধায় এখানে আলোর মিহি সন্ধান আছে। মৌনির গালে আলতো করে হাত দিয়ে নিভ্র ওকে ডাকে।
নিভ্রর কন্ঠ মৌনির শ্রবণপর্দা স্পর্শ করতেই ও পিটপিট করে চোখ খুলে। নিভ্র একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে মৃদু আলো থাকাতে নিভ্রর কালচে বাদামী চোখদুটো মারাত্নক লাগছে। মৌনি আস্তে করে নিভ্রর বুক থেকে সরে উঠে বসে। নিভ্র তা দেখে বললো……..
—এখন হাত-মুখ ধুয়ে একটু খাওয়াদাওয়া করে নেও। দুর্বলতাটা হালকা হলেও কেটে যাবে।
.
নিভ্রর কথামতো মৌনি জীপ থেকে নেমে রেস্তোরাটির দিকে এগিয়ে গেলো। একেবারেই সাদামাটা ধরনের। একজোড়া বৃদ্ধ দম্পতি সবকিছু পরিচালনা করছে। মৌনি বাহিরে হাত-মুখ ধুয়ে ভিতরে চেয়ার পেতে বসে পড়লো। সোহান-নিশু-তুর্য-লিজা সবাইকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। এমনকি নিভ্রকেও। মৌনি সবার থেকে চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো। কারও মধ্যে কোনো প্রকার কোনো কথা নেই। একসময় নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র সবাইকে বললো……
—কি খাবে সবাই?
—অনেক কিছু। পেটের ভেতর ক্ষুধার্ত বাঘ ম্যারাথন দৌড় দিচ্ছে। (তুর্য)
—Bamboo chicken চলবে? এখানকার বেস্ট খাবার। সাথে ভাত , ডাল , ভর্তা তো আছেই।
—চলবে মানে? পুরা দৌড়াবে। চট্টগ্রামের মানুষ Bamboo chicken খাবে না ; তা কি আদৌ সম্ভব । এটাই খাবো? (সোহান)
—মৌনি? তুমি এটাই খাবে নাকি অন্য কিছু খাবে?
.
নিভ্রর ডাক শুনে ও একপলক নিভ্রর দিকে তাকায়। তারপর মাথা নিচু করে বললো ,
—আপনারা যা খাবেন সেটাই।
নিভ্র মৌনিকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মেয়েটা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি এটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই বৃদ্ধ লোকটিকে খাবার অর্ডার দিয়ে নিভ্র মৌনির পাশে বসে পড়ে। মৌনির মধ্যে কোনোরূপ কোনো ভাবান্তর নেই।
—এখনও ভয় পাচ্ছো?
নিভ্রর নির্লিপ্ত কন্ঠ। মৌনির এবার কোনো কিছু না বলে নিভ্রর কাঁধে মাথা রেখে দিলো। এই ছেলেটিই এখন ওর একমাত্র ভরসাযোগ্য স্থান যাে মনপ্রাণ উজাড় করে মৌনি ভালোবাসে। দুজনকে একান্ত সময় দেওয়ার জন্য তুর্য-নিশু সবাই অন্যদিকে গিয়েছে। মৌনি এবার ক্ষীণ কন্ঠে বললো…….
—জানেন। রিদান আমায় অনেক torture করলেও আমি মুখ বুঝে সহ্য করে ছিলাম। কষ্ট হতো অনেক কিন্ত এর থেকেও আরও বেশি কষ্ট লাগতো এটা ভাবলে যে আপনি আমার সাথে নেই। বিশ্বাস করুন দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। গভীর রাতে যখন রুম অন্ধকার করে রিদান চলে যেতো আপনার মুখ বারবার নূর হয়ে আমার সামনে আসতো। দুদিন আপনার কাছে ছিলাম না বিধায় আমার এ অবস্থা ; একটাবার ভাবুন তো আপনি না থাকলে আমার কি হবে?
.
মৌনি বড্ড আবেগী । ছোট ছোট কথাতেই মেয়েটা আবেগে সিক্ত হয়ে পড়ে। নিভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে মৌনির ডান হাটি আঁকড়ে ধরে থাকলো। মৌনি তখনও নিভ্রর কাঁধে মাথা এলিয়ে রেখেছে। নিভ্র এবার বললো…………
.
—আমি কেনো তোমার থেকে দূরে চলে যাবো মৌনি? এরকম কিছুই হবে না।
—আমি বিশ্বাস করি না।
—জানতে পারি , কেন?
মৌনি এবার ঠোঁট উল্টে বলে ওঠলো……….
—আমার ভয় হয়। আপনি এত সুন্দর। সব দিক দিয়েই আল্লাহ যেন আপনাকে ভরে ভরে দিয়েছে।আপনার পার্সোনালিটি যে কোনো সুন্দরী মেয়েকেই আকৃষ্ট করবে। আর আমি আপনার পুরো উল্টা । আপনি ডক্টর তো আমি জার্নালিজমের স্টুডেন্ট। আপনার জীবন কেটেছে ডাক্তারির সেই কঠিন পড়া দিয়ে আর আমার সমাজবিজ্ঞান নিয়ে। আমি নিজেকে ছোট করে দেখছি তেমন না কিন্ত আমি আপনার সম্পূর্ণই ভিন্ন। আপনি চাইলে আপনার মতো মেয়ে অনায়াসেই পেয়ে যাবেন তাহলে এর নিশ্চয়তা কি যে আপনি আমায় ছেড়ে যাবেন না?
.
মৌনির আকুল অনুভূতি। মৌনির কথা শুনে নিভ্র মুখে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। মেয়েটা আসলেই বড্ড সরলমনের। নাহলে এমন কথা এত সহজে কেউ বলতে পারতো না। নিভ্র এবার মৌনির কানে মিহি কন্ঠে বললো………..
.
—ডক্টর হলেই ডক্টরকে ভালোবাসতে হবে এমন খাপছাড়া কথা তুমি ভাবলে কিভাবে? এমন কোনো নিয়ম আছে ; আগে জানতাম না তো !
মৌনি নিশ্চুপ।
—আর কি যেন বললো…………আমি তোমায় ছাড়বো না এর নিশ্চয়তা কি? তাহলে শোনো। এই নিভ্র শুধুমাত্র তার মৌনিপরীকেই ভালোবাসে। মৌনিপরী যেভাবে আমার বুকে ঘুমিয়ে থাকে অন্য কোনো মেয়ের সে সাহস হয়নি। মৌনিপরী যখন কাতর কন্ঠে বলে , ”আই ওয়ান্ট টু কিস ইউর লিপস নিভ্র ভাই” ! অন্য কেউ কখনো নিঃসংকোচভাবে আমায় এ কথা বলেনি। আমি যতই কোনো সুন্দর মেয়েকে আকৃষ্ট করিনা কেন ; কোনো মেয়েই আমার মৌনিপরীর মতো আমায় ”ভয়ঙ্কর সুন্দর” বলেনি। ”নিভ্রভাই” ডাকার মধ্যেও অন্যরকম যে একটা মাতাল করা অনুভূতি থাকে ; মৌনিপরী সে নামে না ডাকলে হয়তো আমি তা অনুভব করতে পারতাম না। আরও কিছু জানতে চাও?
.
—না।
মৌনি লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে প্রতিউত্তর দিলো। এই ছেলের প্রতিটা কন্ঠেই মৌনি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হৃদয়ে খেলা করে কিছু নামহীন কথা।
.
.
.
————————————–
খাওয়াদাওয়ার কার্যক্রম শেষ করে সবাই এবার জীপে উঠে বসলো। মৌনি নিভ্র থেকে এবার কিছুটা দুরত্ব নিয়ে বসেছে। আগে নিভ্রর বুকে মাথা রাখলে মৌনির মনে কোনো অনুভূতি কাজ করতো না যেদিকে ওর সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত হওয়ার কথা। আর এখন দুজনের মধ্যে ভালোলাগার কিছু প্রেমখেলা চলছে আর নিভ্রর বুকে সবার সামনে মাথা রাখলে মৌনি যেন লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। মানবজগত আসলে ভারী অদ্ভুত !
.
—নিভ্র ! এবার কি প্ল্যান?(নিশু)
—একটা ট্রাকে উঠবো।
—সেটাতো বুঝলামই । কিন্ত যাবি কোথায়? ঢাকা?
—নাহ ! কুমিল্লা।
কুমিল্লা নাম শুনতেই মৌনি অবাক হয়ে যায়। মৌনিদের বাড়ি তো কুমিল্লায়। নিভ্রর মনে মনে তবে কি পরিকল্পনা করছে?মৌনি এবার বললো………
—কুমিল্লায় কেন?
—তোমায় তোমাদের বাড়িতে রেখে আসবো।
—মানে?
নিভ্রর কথার আগামাথা মৌনি কিছুই বুঝতে পারছে না। মনের মধ্যে আবারও আজগুবি চিন্তা কাজ করতে থাকলো। নিভ্র এবার তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ দেখতে পারছে সে। নিভ্র এবার বলে ওঠলো……..
—আমায় বিশ্বাস করো তো মৌনি?
—হুমম।
—তাহলে?এত ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি যার জন্যই তোমার বাড়িতে যাওয়া।
.
মৌনি আর কিছু বললো না। নিভ্রকে সে প্রচন্ড বিশ্বাস করে।
জীপটা এবার হাইওয়েতে ওঠার পর সোহান থামিয়ে দিলো। একটা ট্রাক পেলেই নিভ্র মৌনি তাতে উঠে পড়বে।বেশ কিছুক্ষণ পর এসে পড়লো সেই কাঙ্খিত সময়টা। একটা ট্রাক আসছে। নিভ্র ট্রাকটা থামিয়ে কমিল্লায় যাবার কথা বললেই চালক রাজি হয়ে যায়।
অতঃপর দুজনেই ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলো। সোহান-লিজা-নিশু-তুর্য সবাই অন্যমনস্কভাবে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।বিগত কয়েকদিনে নিভ্রর বন্ধুরা মৌনিকে খুবই আপন করে নিয়েছিলো। তাদের ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ যদি মৌনিকেই তাড়া করে তবে নিভ্রর কি অবস্থা?
.
সময় আর মানুষ কখনও স্থায়ী থাকে না। জীবনের পাল্লাক্রমে এরা হারিয়ে যায়। নিভ্র মৌনির এই প্রেমানুভূতিতে হয়তো ওদের অধ্যায় শেষ হয়ে চলেছে। এবার শুধু অপেক্ষা আগামী মুহূর্তের ; যেখানে দুজনের একটি পরিপূর্ণ সমাপ্তি থাকবে।
—তুমি কখনও ট্রাকে চড়েছো মৌনি?
—না। এই প্রথম চড়লাম।
—উপভোগ করো সময়টা। হয়তো এই সময়টা আর কখনও নাও আসতে পারে।
নিভ্রর এসব ছোটোখাটো কথাতেই মারাত্নক অভিজ্ঞতার পাল্লা আছে। নিভ্রর কথামতো মৌনিও আপনমনে উপভোগ করার চেষ্টা করলো সময়টিকে।
.
.
.
~চলবে~