হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-০৫+০৬

0
279

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-০৫+০৬
#Nishi_khatun

রাতের নিস্তব্ধতায় প্রকৃতি শান্ত থাকে না অশান্ত তা কেউ জানে না। প্রকৃতির মানুষের মতো সব সময় চঞ্চল থাকে না, তারা নিরবতা পালন করে! তবে যখন প্রকৃতির সহ্যশক্তি কমে আসে তখন প্রকৃতিও তান্ডব করে।

শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষেরা রাত জাগে কম।
গ্রামের বাড়িতে রাত দশটার মধ্যে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

চেয়ারম্যান বাড়ির সদস্যারা গ্রামের আর পাঁচটা বাড়ির মতো। তাদের বাড়িতেও সন্ধ্যার পরে নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।

তবে আজকে তাদের বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম।
সন্ধ্যা বেলা খাওয়াদাওয়া করার পর বাড়ির সকল সদস্যরা অন্দরমহলের বৈঠক খানাতে বসে, পারিবারিক কিছু বেপারে আলোচনা করছিল! তখন হঠাৎ করে সেখানে ইফার আগমন ঘটে।

ইফা সেখানে এসে তার শ্বশুর মশাই কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আব্বা আমার একটু নালিশ ছিলো রিমশা কে নিয়ে।”

বদুরুদ্দিন সাহসে দাঁতের উপর দাঁত চেপে বলে,

“কি বলতে এসেছো বলে যাও।”

ইফা বলে, “বড় ভাবীর বাচ্চা হবে দেখে আম্মা তাকে বাড়ির কোন কাজ করতে দেয় না। আজকাল আম্মার শরীরটা ভালো থাকেনা দেখে তিনিও রান্নার কোন কাজ করেন না। এদিকে ইলমা তার লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত, তাকে বাড়ির কোন কাজ করতে হয় না। বাকি থাকলো বাড়ির কাজের মানুষেরা। ঝর্ণার মা খালা বাড়ির অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকে দেখে সে আমাকে সাহায্য করতে পারে না। তার মেয়েটাও রান্নাঘরে আসে না আমাকে সাহায্য করতে। বাকি আছে রিমশা! আমি বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে তার পাখা গজিয়েছে। সে বাড়ির কোন কাজ করে না। আমার দ্বারা একলা রান্নার সমস্ত কাজ করা সম্ভব না। হয় রিমশা কে রান্নার কাজ করতে বলেন নয়তো বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। আমি এভাবে সারাদিন রান্নাঘরে কামলা দিতে পাড়বো না।”

বদুরুদ্দিন সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে রেহেনার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়পর রেহেনা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”কী বেপার রেহেনা? আজকাল সংসারের মহিলাদের কাজের সমস্যার সমাধান আমাকে করতে হবে? সারাদিন গ্রামের মানুষদের সমস্যার সমাধান করে এসে যদি ঘরের সমস্যা দেখতে হয় তাহলে তুমি আছো কেন বাড়িতে? বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। তাহলে আমি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব মানুষদের ভাগ করে দিবো তারা আমার সংসারটা দেখবে।”

রেহেনা মাথা নিচু করে বলে,
“আমি বুঝতে পারি নাই যে, দুদিন কাজ করে ইফা আপনার কাছে বিচার দিতে চলে আসবে।রিমশা এসে এ সংসারের হাল ধরেছিল। তারপর আর কখনো রান্নাঘর নিয়ে আমাদের কারো কোন মাথা ব্যাথা ছিলো না। যে কাজ রিমশা এতোদিন করে এসেছে সে একই কাজ, সে কখনো বিচার দিতে আসলো না? তাহলে ইফা কোন কারণে বিচার দিচ্ছে তা-ই বুঝতে পারছি না।”

বাড়ির বড় বউ তখন তাচ্ছিল্যের সাথে গলার স্বর উঁচু করে বলে,
“আব্বা আম্মা আমি এতোবছর ধরে এ সংসারে এসেছি। আজ পর্যন্ত কোনদিন আপনাদের দু জনের মাঝে মনোমালিন্য দেখি নাই। কেউ কখনো কারো উপর রাগরাগী করেন নাই। তবে আজ এই ইফার জন্য আপনি আম্মাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছেন।”

ইফা তখন বলে,”আমি কি উনাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করেছি? তারা স্বামী -স্ত্রী! তাদের কথা কাটাকাটি হতেই পারে।তার দ্বায় আমার না। তাছাড়া তাদের একটা অবিয়াত্ত মেয়ে আছে। সে মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে। ইলমার বিয়ে দিতে হবে। এক বাড়িতে দুই সতীন কেমনে থাকে? ইলমার বিয়ের সময় প্রভাব পড়বে।”

বাড়ির বড় বউ আবারো বলে,”এবার তাহলে বোঝেন দাইয়ান ভাই! কেমন মেয়েকে বাড়ির বউ করে এনেছে? যে মেয়ে একটা মেয়ের স্বামী কে কেড়ে নিতে পারে সে অন্যদের ঘর ভাঙ্গতেও পারে। দাইয়ান ভাই এখনো সময় আছে বউয়ের লাগাম টেনে ধরেন, নয়তো আমাদের সোনার সংসারটা আগুনে পুড়ে ছাই হতে সময় নিবে না। এই মেয়ের দেখছি ইলমা আর ঝর্ণা কে নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। ”

ইলমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,”দাইয়ান ভাই আপনার বউ কে বলে দিন আমি আমার বাবার বাড়িতে আছি। তার স্বামীর বাড়িতে না। আমি আমার বাবার পয়সাতে খাচ্ছি পড়ছি। তার স্বামীর পয়সাতে নয়। আমি তার মত আরেকজনের স্বামী হাতিয়ে নেয়নি। আমি বাবার বাড়িতে কতোটা কাজ করবো সম্পন্ন আমার আর আমার বাবা-মা’র বেপার। আমাকে নিয়ে যেনো দ্বিতীয় বার কখনো আপনার বউ কোন কথা না বলে।”

বড় ভাবী বলে,”দাইয়ান ভাই! তার যদি রান্নার কাজ করতে ইচ্ছা না হয়। বাপের বাড়িতে চলে যেতে বলেন। যদিও তার বাপের বাড়ি থাকলে হয়। যে বাড়িতে বড় হয়েছে সে বাড়ির মেয়ের স্বামী কে হাতিয়ে নিয়েছে। স্বার্থপর লোভী মেয়ে একটা।”

দাইয়ান তখন ইফাকে বলে,”তোমার সমস্যা হচ্ছিল সে কথা আমাকে বলতে পারতে এভাবে সোজাসুজি আব্বার কাছে বিচার দেওয়া উচিৎ হয়নি। তাছাড়া বাড়ির অন্দরমহল মেয়েদের সেখানে পুরুষের নাক গলানো আব্বা পছন্দ করে না। সারাজীবন আমাদের বাড়ির অন্দরমহলের সব সিদ্ধান্ত আম্মায় নিয়েছে।”
*
*
ইফা আর কিছু বলবে তার আগেই…
বদুরুদ্দিন সাহেব তার বড় ছেলে দিরহাম কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের ঘর গুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করো। শহর থেকে আমার কিছু পরিচিত মানুষেরা আসবে। তারা বেশ কিছুদিন এখানে এসে থাকবে। আর বাড়ির মহিলাদের জন্য বাড়ির মধ্যে দিয়ে পর্দা টাঙিয়ে দিও। যাতে করে সদরদরজা দিয়ে বাহিরের মানুষেরা আসলে অন্দরমহলের দিকে তাদের নজরে না পড়ে।
সোজাভাবে জেনো তারা উত্তরের ঘরগুলোতে প্রবেশ করতে পারে।”

দিরহাম বলে,”আব্বা তারা কবে আসবে তা যদি বলতেন।আসলে সেই হিসাবে ব্যবস্থা করতে সুবিধা হবে।”

বদুরুদ্দিন সাহেব বলে,
“সামনে সপ্তাহে তাদের আসার কথা আছে। রিমশা, ইলমা, ঝর্ণা তোমরা তিনজন মেহমানদারী করতে যাবে না। মেহমান আসলে বাড়ির অন্যদের মেহমানদারি করতে দিবে। যে দিনকাল পড়েছে তাতে আমি চাই-না তোমরা তিনজন বাহিরের পরপুরুষদের সামনে যাও। যদিও গ্রামের লোকদের কথা আলাদা। তাদের সামনে যখন যাও তখন আমি থাকি। তবে শহরের মেহমান গুলো অনেকদিনের জন্য আসছে।”

তিনজন একসাথে সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে বলে, “আচ্ছা! ”

তারপর বদুরুদ্দিন সাহেব বৈঠক খানা থেকে প্রস্থান করার পূর্বে ইফাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” তোমার ভাগ্য ভালো! রিমশা পুলিশের কাছে যেয়ে দাইয়ানের নামে নালিশ করে নাই। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। রিমশা যদি নালিশ করে তাহলে তোমার আর স্বামীকে নিয়ে সংসারটা করা হবে না। তোমার ঐ স্বামী সাত বছরের জন্য জেলে থাকবে। এখনো সাবধান হয়ে যাও নয়তো বলা যায় না। রিমশা যদি মামলা করে তাহলে তোমার এই স্বামী নিয়ে বড়াই টা আর থাকবে না। স্বামী কে তুমিও পাবে না, আর রিমশা তো পাচ্ছে না।” এসব বলে দেড়ি না করে চলে যায়।

রেহেনা বেগম মাথা নিচু করে রুম থেকে প্রস্থান কারার পূর্বে রিমশা’র দিকে জলভরা আখি নিয়ে একনজর তাকিয়ে চলে যায়।

রিমশা তার এতো ভালো মনের মানুষ শাশুড়ি মা’র চোখেজল দেখে নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না।
সে সোজা ইফার গালে থাপ্পড় দিয়ে বসে। ইফা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে দাইয়ান বলে,
“তোমার এতো সাহস তুমি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দাও?”

রিমশা চিৎকার দিয়ে বলে,”গলার স্বর আস্তে করে কথা বলেন। কেমন ছেলে আপনি? যে বউয়ের জন্য আপনার মায়ের চোখেরজল ঝরছিল তা চোখে পড়ে না? আমি না হয় আপনার কেউ না! কিন্তু রেহেনা বেগম তো আপনার জন্মদাত্রী মাতা।”

ইলমা বলে,”আরে ভাবী! তুমিও কার সাথে কি কথা বলছো!
ঐ দাইয়ানের চোখে এখন ইফা ছাড়া অন্য কেউ নজরে পড়ে না। এই মেয়ের জন্য দেখবা আমাদের সংসারটা পানিতে ভেসে যাবে। তুমি যদি তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তাহলে এদের মতো পুরুষেরা কখনোই নারীকে ধোঁকা দিতে পারতোনা। ”

রিমশা রহস্যের হাসি দিয়ে বলে,
“ইলমা আমাকে কি এতোটা অবলা নারী মনে হয় তোমার?
যে স্বামী আমাকে সম্মান করে নাই তাকে মাথায় তুলে রাখবো আমি? আমাকে যে সুখ না দিয়ে নিজে অন্যকে নিয়ে সুখে থাকার চিন্তায় মগ্ন তাকে এতো সহজেই ছাড় দিয়ে দিবো?”

দিরহাম এসে বলে,”দাইয়ান নিজেই তো উকিল তার সাথে তুমি কিভাবে কি করবে?”

রিমশা বলে,”দেশের আইন সবার জন্য সমান। আইনের লোকেরা আইন ভাঙ্গে বেশি। তারা ভাবে আমরা আমাদের ঠিক বাঁচিয়ে নিতে পারবো সমস্যা হবে না।”

ঝর্ণা বলে,”এই না হলে আমার রিমশা ভাবী!”

দাইয়ান ইফার হাত ধরে তাদের রুমের উদ্দেশ্যে যাবার সময় বলে,

“তুমি আমার চুলটাও ছিঁড়তে পারবে না। হুদায় মেয়েমানুষ তো লাফালাফি করবে বেশি বেশি। তোমার নিজের এই সংসারটা এবার হাত ছাড়া হয়ে যাবে দেখে নিও।”

রিমশা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“সময় দিবে জবাব! আমি না।”

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-০৬
#Nishi_khatun

আমি বড্ড স্বার্থপর মেয়ে। আমার ছোটবেলা থেকে সমস্যা। আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না। তবুও বারবার মানুষেরা আমার সাথে অন্যায় করে। ছোট বেলায় স্কুল যাওয়ার পথে একজন মুদি দোকানী ছিলো, যে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। তার দোকান থেকে কিছু আনতে গেলে নানারকম ভাবে ছলনা করে খুব খারাপ ভাবে হাত স্পর্শ করতো।

এদিকে স্কুলের সেই রতন স্যার তো ছিলোই।
সে পড়ানোর নাম করে মেয়েদের শরীরে হাতানোর কাজটা খুব সুক্ষ্ম ভাবে করতেন। গ্রামের মেয়েরা চুপচাপ তার সে সব অন্যায় সহ্য করে নিতো। কারণ মেয়ে মানুষ কিছু বললে দোষ তার। এ সমাজে পুরুষের কোন দোষ নেই। তবে আমি তাদের সবার থেকে আলাদা ছিলাম।

যখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে তখন ঘটে আমার জীবনে বনবাসী হওয়ার ঘটনা! বর্ষাকালের এক বর্ষণের দিন, ক্লাসের শেষে আমিও বাকি স্টুডেন্টদের মতো বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলাম। তখন হঠাৎ পেছন থেকে রতন স্যার আমাকে ডাক দেন। আমিও ভদ্রতার খাতিরে তার সাথে কথা বলতে চলে যায়। আমার বান্ধবীদের বলি তোরা আমার জন্য অপেক্ষ কর আমি স্যারের সাথে কথা বলে আসছি।

তখন স্কুলের দারওয়ান আমার বান্ধবীদের বাড়িতে চলে যাবার জন্য তাগাদা দিতে থাকে।

তখন আমার এক রিতু নামের বান্ধবী ছিলো।
সে হঠাৎ করে বলে,
-“রিমশা স্যার লোকটা সুবিধের নয়। বাহিরে এমন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ স্কুলে স্টুডেন্ট সংখ্যাও কম। যারা এসেছিল, তারা ছুটির সাথে সাথে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। তুই না হয় স্যারের সাথে অন্যদিন কথা বলবি।”

আমি রিতুকে অভয়দান করে বলি,
“তার সাথে আড়ালে কোথাও যাচ্ছি না। তোদের চোখের সামনে কথা বলে চলে আসবো তুই এখানে অপেক্ষা করবি কিন্তু। ”

আমি চলে আসার পর রিতু সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো।
স্যারের কাছে এসে বলি,”স্যার কিছু বলবেন? ”

স্যার বলে,”হ্যা তোমার সাথে একটু কথা ছিলো, তুমি আমার সাথে অফিস রুমে এসো।”

তখন স্যারের সাথে তার অফিসকক্ষে যাবার কথা শুনতেই আমার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। এদিকে অফিস রুমের অন্যান্য স্যারেরা আজ দ্রুত চলে গেছে। তবুও আমি সাহসের সাথে বলি,

-“স্যার যা বলার এখানে বলেন! আমার বাড়িতে যাবার জলদী আছে। দেখছেন না বাহিরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ”

স্যার ধমক দিয়ে বলে,”পরিবারের কাছ থেকে এমন শিক্ষা পাচ্ছ? গুরুজনের মুখে মুখে তর্ক করো?”

নিজের শিক্ষার অপমান সহ্য করতে না পেরে স্যারের পেছনে অফিস কক্ষে প্রবেশ করি। তখন তিনি আমার একদম গা ঘেঁষে পাশে এসে দাঁড়ায়।

তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”জানো রিমশা তুমি স্কুলের সব মেয়েদের থেকে বেশি বুদ্ধিমতী সাথে স্মার্ট আর দেখতে সুন্দরি। শহুরে ভাবটা ঠিক এখনো আছে তোমার মধ্যে।”

আমি একরাশ ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে বলি,”স্যার এসব কথা ছাড়া আর কিছু বলবেন? ”

স্যার বলে,”কেন এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না তোমার? মেয়েরা তো আমার সাথে একান্তে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে যায়। তুমি কেন আমাকে ইগনোর করছো?”

রিমশা বিরক্তিবোধ করে বলে,”স্যার আপনার মেয়েটাও না এবার আমাদের স্কুল ভর্তি হয়েছে? ”

স্যার বলে,”আমার মেয়েকে কেন আমাদের মাঝে টেনে আনছো? ওহ বাচ্চা মেয়ে ওর কথা বাদ দাও।”

স্যার এসব কথা বলছিল আর আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করছিল। যা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না। স্যার এভাবে স্পর্শ করতে থাকলে তার সাথে খারাপ কিছু হবে।

তখন ভাবতে থাকি, আমার বাবা চাকুরী করতেন শহরে।
তার চাকুরীর সূত্রে আমাদের শহরে থাকা হতো। তবে একটা এক্সিডেন্টে বাবার পায়ে সমস্যা হওয়াতে তার চাকুরী চলে যায়। তখন আমরা গ্রামের বাড়িতে শিফট করি।
আর বাবা আমাকে শহরের নামিদামী স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এই গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানে এসে প্রথমেই আমার সব কিছু মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা হাসি মুখে এডজাস্ট করার চেষ্টা করছিলাম। তার মধ্যে আজকের এই দিনটাও যে দেখতে হবে তা কোনদিন ও ভাবতে পারি নাই।

এদিকে স্যারের স্পর্শ গুলো আমার শরীরে বিষাক্ত কাটার মতো ফুটতে শুরু করে, আমার সাথে স্যার খারাপ কিছু করবে তার জন্য অপেক্ষ করতে পারছিলাম না, আর কেউ যে এখানে আমাকে সাহায্য করতে আসবে না, তা বেশ ভালোভাবে বুঝে গেছিলাম।

আমি জোড়ে স্যার কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলি,
-“স্যার আর একবার ও যদি আমার শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনার জন্য তা ভালো হবে না। আমি গ্রামের ঐ সব সহজ সরল মেয়েদের মতো মুখ বুজে আপনার অমানবিক কাজ মোটেই সহ্য করবো না।”

স্যার রেগে আমার দিকে অগ্রসর হতেই, আমি আমার সামনে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের সুন্দর একটা ফ্লাওয়ারভাস নিয়ে সোজা স্যারের মাথায় বাড়ি দিয়ে দেয়। তারপর দৌড়ে অফিস রুমের বাহিরে চলে আসি। বাহিরে এসে দেখি রিতু নেয়।
বুঝতে বাকি রইলো না দারওয়ান মামা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

আমি ঐ বৃষ্টির মধ্যে ভিজে একাকার হয়ে দৌড়াতে থাকি। দৌড়ানোর সময় আশেপাশের কোন কিছুই আমার মাথায় ছিলো না। অনেকটা পথে আমি উন্মাদের মতো ছুটেছি।
তবুও মন থেকে খারাপ কিছু হবার ভয়টার রেশ যেনো যাচ্ছিল না। তারপর বাড়িতে এসে ভয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। মা মাথায় হাত বু্লিয়ে দিয়ে বলে শান্ত হতে, তবে কিছুতেই শান্ত হতে পারছিলাম না। অতিরিক্ত কান্নার ফলে আমার হিচকি উঠে যায়।
তবুও সেই ভাবে মা’কে আমি সবটা বলে দেয়।
মা আমাকে আশ্বাস দেয় বাবা আসলে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলেবে। তবে সেদিন বাবা বাড়িতে শহর থেকে দেড়িতে বাড়ি ফিরে আসে। বাবা বাড়িতে আসার সাথে সাথে আমাদের বাড়ির উঠানের উপর অনেক লোকজন ভরে যায়। সবাই আমার বাবাকে অপমান করতে শরু করে।

বলে,”তোমার এই শহুরে মেয়েকে আমাদের গ্রামে রাখা যাবে না। এই মেয়ে গ্রামে থাকলে অন্যসব মেয়েরা এর সঙ্গদোষে খারাপ হয়ে যাবে।”

স্কুলের দারওয়ান মামা আমার নামে রতন স্যারের পক্ষ নিয়ে বলে,”এই মেয়ে নিজে স্কুল ছুটির পর স্যারের সাথে দেখা করতে গেছিলো। ওখানে গিয়ে স্যারের সাথে আপত্তিকর কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্যার রাজি না হওয়াতে এই বেয়াদব মেয়েটা স্যারের মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছে।”

মেয়ের সম্পর্কে এমন সব উদ্ভট কথা শুনে বাবা সেদিন মোটেই তাদের কথা বিশ্বাস করে নাই। তবে ঐ যে রতন স্যার খুব ভালো! তার দুইটা চেহারা ছিলো, সে খারাপ কাজ গুলো মুখোশের আড়ালে করতো। আর তার ভালো চেহারা সম্পর্কে সকলে জানতো।

বাবা সব কাহিনী না জেনেও আমাকে নিয়ে গ্রামের লোকদের সাথে অনেক তর্ক বিতর্ক করেন। তবে শেষমুহুর্ত উনি বুঝতে পারেন এ গ্রামের লোকেরা এখন আমার উপর প্রচুর ক্ষিপ্ত। তারা মোটে-ই আমাকে গ্রামে থাকতে দিবে না।

তখন বাবা সবার সামনে সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে আমার মামা-মামীর কাছে পাঠিয়ে দিবেন। এবং সেদিন রাতে-ই মা আমার সব কিছু গুছিয়ে দেয়। বাবা আমাকে নিয়ে রওনা দেন।

সেদিন বাবা- মা কে ছেড়ে বনবাসী হইলাম ।
গ্রাম ছেড়েছিলাম তাতে কোন আফসোস ছিলো না।
ঐ খারাপ লোকটার মাথা ফাঁটিয়ে দিতে পেরেছিলাম,
তাতেই মনের মধ্যে অনেক শান্তি ছিলো।

তারপর আমাকে মামা বাড়িতে রেখে বাড়িতে চলে আসেন। বাড়িতে আসার পর বাবা মা’র কাছে থেকে সবটা জানতে পারেন। তাতে বাবা আমার উপর গর্বিত হয়েছিল। আমি যে কাজ করেছিলাম তা শুনে বাবা খুব খুশি হয়েছিল।

*
*
জানালার বাহিরের ঐ অন্ধকার প্রকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ করে নিজের ছোট বেলার কুচ্ছিত একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেলো। যাক ভালোই হয়েছে অবশেষে রতন স্যার নামের খারাপ লোকটা তো মরেগেছে।

সারারাত নির্ঘুম কেটেছে রিমশা’র।
সকালে নতুন আলো দেখার অপেক্ষা।

এদিকে চারপাশ থেকে ফজরের আযানের ধ্বনি রিমশা’র কানে ভেসে আসতেই অজু করার জন্য রুমের বাহিরে বেড়িয়ে আসে। অজু করে নামাজ আদায় করে রুমের বাহিরে চলে আসে। আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন রিমশা’র জন্য।

সকাল হয়েছে! সবাই সবার রোজকার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
হঠাৎ করে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে পুলিশ বেড়িয়ে সোজা চেয়ারম্যান বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

বাড়িতে আচমকা এমন পুলিশের আগমনে বদুরুদ্দিন সহ তার পরিবারের সকল সদস্য বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

তখন একজন পুলিশ বলেন,

-“এখানে দাইয়ান কে? তার নামে থানাতে মামলা করা হয়েছে।”

দাইয়ান সামনে এগিয়ে এসে বলে,
“আমি দাইয়ান! আর কার এতো সাহস আমার নামে থানাতে মামলা করে?”

রিমশা দাইয়ানের সামনে এসে বলে,
“জি আপনার এই উপকারটা আমি করেছি! আসলে আপনাকে আমার চোখের সামনে ইফার সাথে সহ্য হচ্ছিল না। তা-ই ভাবলাম কিছু বছরের জন্য না হয় আপনি মামা বাড়ি থেকে ঘুরে আসলেন। ততোদিনে হয়তো আপনার উচিৎ শিক্ষা হয়ে যাবে।”

রিমশা দাইয়ানের নামে থানাতে নালিশ করেছে? এমন কথা চেয়ারম্যান কেউ হজম করতে পারছিল না। রিমশা কে দেখে সবাই ভেবেছিল সে হয়তো দাইয়ান আর ইফার বিয়েটা মেনে নিয়েছে। তা-ই নিজেকে একটু সহজ হতে সময় দিচ্ছে। কিন্তু এই চুপচাপ থাকা মেয়েটা যে সুযোগ বুঝে এমন কোপ দিবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে নাই।

এদিকে পুলিশের সাথে দাইয়ানের কিছুটা কথা কাটাকাটি হয়। তবে তাতেও কোন কাজ হয়নি! পুলিশেরা দাইয়ান কে তাদের সাথে করে নিয়ে যায়।

দাইয়ান কে পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ইফা রিমশা’র হাত জড়িয়ে ধরে বলে,

-“দেখ বোন উনি তোর ও স্বামী! তুই তাকে এভাবে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারিশ না। উনি জেলে চলে গেলে আমার কি হবে? তাছাড়া যে বাড়ির লোকেরা তোকে এতো ভালবাসা দিলো, তাদের ছেলের সাথে তুই এভাবে অন্যায় করতে পারিশ না।”

রিমশা বলে,”কোথায় কখন কার সাথে আমি ন্যায় /অন্যায়ের বিচার করবো তা আমাকে ভাবতে দিলে খুশি হবো। আর রইলো এবাড়ির সদস্যদের কথা তা আমি বুঝে নিবো।”

রিমশা’র এমন গা ছাড়া কথা শুনে ইফার পায়ের নিচের মাটি ভাঙ্গতে শুরু করে। ইফা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আর চেয়ারম্যান বাড়ির বাকি সদস্যরা নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সবটা এতো দ্রুত হচ্ছিল যে তারা কোন কিছু ঠিক ভাবে বুঝে ওঠার আগেই সবটা শেষ। তবে এতে তাদের কোন আক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

চলবে…..