হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-০৯+১০

0
282

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-০৯+১০
#Nishi_khatun

বিকেলবেলা!
চেয়ারম্যান এবাড়ি থেকে একটু দূরে-ই আছে সুন্দর বড় সান বাঁধানো পুকুর। পুকুরপাড়ের চারপাশে নানারকম ফলের গাছ দিয়ে ভরা। মাঝেমধ্যেই বিকালবেলা তিনজন এখানে আসে আড্ডা দিতে। পুকুরপাড়টা অনেকটা নিরব! আশেপাশ দিয়ে লোকজনের চলাচল কম করে।

তিনজন আজকেও আড্ডা দিতে আসরের নামাজটা পড়ে চলে এসেছে। তবে আজকে তাদের আড্ডায় কোন প্রাণের উচ্ছাস নেই। রিমশা এক ধ্যানে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছে।

রিমশা হুট করে বলে ওঠে,
-“আচ্ছা কোন কাজের জন্য তো প্রকৃতি তাড়াহুড়ো করে না? আমরা মানবজাতি সব কাজে কেনো এতো তাড়াহুড়ো করি? জানো সবাই কাজে এতো তাড়াহুড়ো করি, তবুও আমাদের সব কাজে সফলতা আসে না। উল্টো অনেকসময় আমাদের ভালোর স্থানে খারাপ হয়।”

ইলমা রিমশা’র কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
-“ভাবী সবাই যদি এসব কিছু নিয়ে চিন্তা করতো তাহলে আমাদের সমাজের এতো করুণ অবস্থা হতো না। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এতোটা ব্যস্ত যে নিজের ভালো করতে যেয়ে তারা অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।”

ঝর্ণা নিরবতা ভেঙ্গে বলে,”ভাবী তুমি ভাইয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছ তা-ই না? তোমার এতো কিসের কষ্ট! তোমাদের তো আর প্রেমের বিয়ে না। এটা একটা দূর্ঘটনার বিয়ে। যেখানে বিয়ের দিন থেকে ভাইয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক নরমাল ছিলো না।”

রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আচ্ছা প্রেম ছাড়া বিয়ে করলে তার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হবে না এমনটা কে বলেছে তোমাকে? তুমি বিয়ে সম্পর্কে কতোটা জানো? বাচ্চা মেয়ে একটা, নাক চিপলে দুধ বেড়ুবে।”

ঝর্ণা লজ্জিত হয়ে আমতাআমতা করতে থাকে।

রিমশা ঝর্ণার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে বলে,
“জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিন জিনিস মানুষের জীবনের সব থেকে বড় ঘটনা।
‘দুজনের মধ্যে পারস্পারিক ভালোবাসার জন্য বিবাহের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই ।’
— ইবনে মাজাহ ১৮৪৭
বিবাহ একটি ইবাদাত। আবার ইজ্জত – আব্রু রক্ষা করার একটি হাতিয়ার ও বটে। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা মনুষ্য জাতি সৃষ্টি করেছেন। তাদের মাঝে প্রেম, ভালবাসা, মায়া, মমতা, বিবেক, বুদ্ধি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার গুণাবলি দিয়ে। নারী এবং পুরুষ এই দুটো জাতিকে তিনি এক অসীম মহিমায় (বিবাহের মাধ্যমে) একত্রিত করেন। একজন মানুষ তার লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরিধান করে থাকে। রোদ, বৃষ্টি, ঠাণ্ডা ইত্যাদি বাহ্যিক উপাদান থেকে রেহাই পেতে পোশাকের প্রয়োজন।
ঠিক তেমন-ই বিবাহ, দুইজন মানুষকেএমনই ভাবে এক করে যে, তারা একে অপরের পোশাক এর ন্যায় হয়। একে অপরের দোষ, অন্যায় গুলোকে ঢেকে রেখে আগলে রাখে আজীবন। পোশাক বাহ্যিক সৌন্দর্য রক্ষা যা অন্যদের কাছে আমরা প্রদর্শন করি। কিন্তু বিবাহিত দম্পত্তি তারা পরস্পর পরস্পরের পরিধেয় এর ন্যায়।
বিয়েরপর আল্লাহ নিজে দায়িত্ব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাস সৃষ্টি করেন। তাহলে আমার বিয়েটাতে কেনো স্বামীর প্রতি ভালোবাস থাকবে না?
সব সময় সব আমাদের কিছু সামাজিক ভাবে নয়,
কিছু সময় ধর্মিয় ভাবেও চিন্তা করা উচিৎ। ”

ঝর্ণা মাথা নিচু করে বলে,
“আচ্ছা ভাবী ভুল হয়েগেছে মাফ করে দাও।”

ইলমা তখন ঝর্ণার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
“আমরা যদি নিজেদের মধ্যে মাফ-সাফ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকি তাহলে আমাদের একতা থাকবে তো?”

রিমশা বলে,”জানো জীবনটা কখনোই সুন্দর থাকে না। জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে হয়। তাছাড়া আমাদের সম্পর্কটা কি প্রথমেই এমন ছিলো? আমাদের সবাই কে সম্পর্ক টা সুন্দর ভাবে গড়ে নিতে হয়েছে। তবে আমার শ্বশুর বাড়ির সকলে অনেক সাপোর্ট করেছে। নয়তো এতোদিন এবাড়িতে থাকা সম্ভব ছিলো না।”

ইলমা বলে,
“জানো ভাবী আমার দাদাভাই আর দাদীমা অনেক পরহেজগার ছিলেন। তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন।
সাথে অন্যদের নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা দিতেন।
আমাদের বাড়িটা প্রথম থেকেই মেয়েদের অনেক সম্মান করে। দাদাভাই আমার দুই ভাইয়ের জন্মের সময় এতোটা খুশি হয়েছিল না! যতোটা তিনি আমার জন্মের সময় হয়েছিলেন। মেয়ে আল্লাহর রহমত। বাড়িতে মেয়ে জন্মগ্রহণ করলে তারা খুব খুশি। আল্লাহ কন্যা সন্তানের রুপে তাদের বাড়িতে রহমত দান করেছেন। আমার জন্মের পর দাদাভাই অনেক দান করেন। ”

দাদীমা আম্মাকে সব সময় বলতেন,’রেহেনা তুমি সব সময় একটা কথাটা মাথায় রাখবে। তোমার দুই ছেলে বড় হয়ে যখন বিয়ে করে বাড়িতে বউ আনবে। তখন সেই বউ দুইটা কিন্তু কারো বাড়ির রহমত। তাদেরকে নিজের মেয়ে মনে করবে।
তুমি তাদের আদর ভালোবাস, সম্মান উপহার দিলে তারাও তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান দিবে। তারা কখনোই তোমাকে শাশুড়ি মনে করবে না। আমার আর তোমার সম্পর্কটা দেখেছো কেমন। আশা করি তুমিও আমার মতো আর্দশ শাশুড়ি হতে চেষ্টা করবে। কোন সময় নিজের সন্তানের প্রতি দুর্বল হয়ে বাড়ির বউয়ের সাথে অন্যায় করবে না। ঐ মেয়ে গুলো কিন্তু অন্যের নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাদের পিতামাতা তোমাদের মতো আদরযত্নে সন্তান বড় করেছে।
তা-ই তো আম্মা শুরু থেকে তোমার প্রতি মেয়ের মতো সহানুভূতি দেখাচ্ছে। আমি জানি আম্মা আব্বা তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে, তোমারও সারাজীবন তাদের নিজের বাবা- মা মনে করে সম্মান করবে।”

রিমশা আফসোসের সুরে বলে,”ইশ রে! দাদাভাই আর দাদীমা যদি বেঁচে থাকতেন! তাহলে খুব ভালো হতো। তাদের থেকে অনেক কিছু শেখার ছিলো। কেন যে তাদের ভালোবাসার অংশীদার হতে পারলাম না।”

ইলমা বলে,
“ভাবী দু বছর আগে আমাদের বাড়িতে এক দূর্ঘটনা ঘটে।
যে দুর্ঘটনা দাদাভাই সহ্য করতে পারে না। ঘটনার মর্মান্তিকতা এতোটা গভীর ভাবে তাকে গ্রাস করে, যে সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। দাদাভাই এর শোকটা দাদীমা কে প্রবল ভাবে আঘাত করে। সেই কারণে বছর পেরুতে না পেরুতে দাদীমা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। জানো ভাবী তাদের দু’জনের
এভাবে চলে যাওয়াতে বাড়ির সবাই অনেক ভেঙ্গে পড়ে।
এই সব ঘটনার সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ে দাইয়ান ভাইয়ের উপর। কারণ….”

ইলমা আর কিছু বলবে তার আগেই ঐ দূরের মসজিদ থেকে মিষ্টি মধূর আযানের সুর ভেসে আসতে শুরু করে।

তিনজন দ্রুত আড্ডা ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা করে।

রিমশা বলে,”আল্লাহ আমরা এতো সময় ধরে এখানে বসে আছি। ঐ দিকে বাড়িতে বড় ভাবীর এমন অবস্থায় সে একলা আছে। তাকে একলা রেখে আমরা মনের সুখে গল্প করছি। যেখানা আমাদের তাকে সময় দেওয়া দরকার ছিলো।
এমনিতে এ সময় তার মন মানুষিকতা বদলে গেছে অনেকটা।

ঝর্ণা বলে,”মেয়ে মানুষ মানে-ই ঝামেলা! একজন মেয়ে যদি বাড়ি মাতিয়ে রাখতে পারে! সেখানে তিনজন মেয়ে একসাথে আড্ডা দিতে বসলে তারা দিনদুনিয়া ভুলে যাবে এটাই নিয়ম।”

ইলমা- হ্যা! শয়তান এসে ঘাঁড়ে চেপেছিল। নয়তো বাড়িতে যে আজ আম্মা নেই! সে কথা কেমন করে ভুলে গেছি আমরা?”

একবুক ভয় বুকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে-ই দেখে সদরদরজার সামনে রেহেনা বেগম রাগী চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে।

রেহেনা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসলে কেনো? কাল সকালে ফিরে আসলেই তো পারতে? ভাগ্যিস আমি রওনা দেওয়ার পর কি মনে করে বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। নয়তো আজ কতবড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো জানো? রাইসা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে মেয়েটা নিজেকে কোনরকম পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তোমরা জান মেয়েটা কতো ভয় পেয়েছে? ”

তিনজন আর কোন কথা না বাড়িয়ে রাইসা’র (বাড়ির বড় বউ) রুমে ছুটে যায়। রিমশা রাইসা কে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“ভাবী আপনি আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
তবে আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া একদম উচিৎ হয়নি। আজকে আপনার যদি কিছু হয়ে যেত? তাহলে সারাজীবনেও নিজেকে মাফ করতে পাড়তাম না।”

রাইসা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“আরে তোমরা সবাই এভাবে কান্না করছো কেন?
আমার কিছু হয়েছে? উঁহু হয়নি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। আর তাছাড়া তোমরা কি জানতে আমার শরীরটা আজকে হঠাৎ করে খারাপ হবে? গর্ভাবস্থায় এমনটা স্বাভাবিক বেপার। শুধু একটু সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয় এই আরকি। এতে কান্নাকাটির কিছু নেই।”

এমন সময় দিরহাম সেখানে এসে উপস্থিত হয়।

দিরহাম কে দেখে তারা রুম থেকে প্রস্থান করতে উদ্ধত হয়,
তার পূর্বে রিমশা বলে,”ভাবী আজকের পর থেকে তোমাকে একটু একা ছাড়বো না। ছায়ার মতো সবসময় থাকবো তোমার সাথে দেখে নিও।”

রাইসা মুচকি হাসি উপহার দেয়। কিন্তু ঠোঁটের কোণায় হাসি থাকলেও চোখের কোণায় জল চিকচিক করছিল।

সবাই রুম থেকে প্রস্থান করতে-ই দিরহাম রাইসা কে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে ভালবাসার পরশ এঁকে দেয়। তারপর নিজে স্ত্রীর কে বুকের মাঝে ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুড়িয়ে রাখে।

এরপর রাতে বাড়িতে কেউ আর কোন আলোচনা করে না। রিমশা নিজের রুমে এসে বিছানাতে শরীরটা এলিয়ে দিতেই, নিজের সম্পর্ক নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।

যেখানে সুখের সাগরে ভাসার কথা ছিলো! সেখানে সে দুঃখের সাগরে ধাক্কাধাক্কি খাচ্ছে! এসবের জন্য সে কাকে দায়ী করবে? দাইয়ান কে? না কি বিপরীত মুখি পরিস্থিতি কে? আসলেই কি এসবের জন্য দাইয়ান আসল দোষী? হ্যা! দাইয়ান অন্যায়ের প্রতিকার করতে যেয়ে আমার সাথে বড্ড বেশি অন্যায় করেছে। দাইয়ান আমাকে সুখি রাখবে বলেছিল!
কিন্তু সে কথা রাখে নাই। তা-ই তো বাধ্য হয়ে তাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হচ্ছে। সে দাইয়ান কে ভালোবাসে তারমানে এই নয় যে, তার করা অন্যায়ের কোন প্রতিবাদ করবে না। নিজের বুকের উপর পাথার চাঁপা রেখেছিল এতোদিন। সবাই চোখে যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করে! কানে যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে। আচ্ছা কখনো কেউ কেনো এসবের সত্যতার যাচাইবাছাই করে না কেন? এসব করার সময় কোথায় মানুষের? আমাদের সম্পর্কের গভীরতা আমরা-ই জানি।

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-১০
#Nishi_khatun

আজ অনেকদিন পর রিমশা দাইয়ানের সাথে দেখা করতে এসেছে। রিমশা যে দাইয়ানের সাথে দেখা করতে এসেছে সে কথা কাকপক্ষীও জানে না।

আজ অনেকদিন পর সে তার প্রিয় না অপ্রিয় মানুষটার সামনে দাঁড়িয়েছে। রিমশা কে দেখে দাইয়ান মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।

দাইয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,” তুমি এখানে কেনো এসেছো?”

রিমশা প্রতিউত্তরে বলে,
“আপনাকে এক নজর দেখে আমার আঁখিদুটির তৃপ্তি মেটাতে। এই বুকের মাঝে থাকা ছোট অশান্ত হৃদয়টাকে কে শান্ত করতে এসেছি। বহুদিন হলো একান্তে আপনাকে এভাবে দেখার সুযোগ হয় না।”

দাইয়ান তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর দেয়,
-“বলো আমাকে উপহাস করতে এসেছো। তুমি সব কিছু যেনে বুঝে কেনো আমাকে এভাবে বিপদে ফেলছো? আমি তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি বলতে পারো? না কি তোমার উপকার করেছি দেখে, আমার অপকার করে ফেরত দিচ্ছ?”

রিমশার কন্ঠ দিয়ে কোন আওয়াজ বাহির হচ্ছে না।
সে চেষ্টা করছে তার স্বামীর সাথে তর্ক করতে কিন্তু কেনো জানি কিছুতেই কণ্ঠনালী দিয়ে এখন কোন আওয়াজ বাহিরে আগমন করছে না। সত্যি রিমশা’র অনেক বড় উপকার করেছে সে। আজকের এই দিনটা তৈরি করার পেছনে তার অবদান অনেকটা জুড়ে।

দাইয়ান এবার রাগী কন্ঠে বলে,”তুমি সবকিছু জানো আমার জীবনের উদ্দেশ্য, আমি কেনো এসব করছি। তবুও কেনো আমার লক্ষের বাঁধা হয়ে সামনে এসে দাঁড়াও। কেনো আমাকে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে দিচ্ছ না? কি চাই তোমার আমার কাছ থেকে? আমি তোমার কাছে কোন কিছুতে দায়বদ্ধ না।”

রিমশা বেহায়ার মতো বলে,
-“আমার আপনাকে চাই! সারাজীবন ভালোবেসে পাশে থাকার জন্য নয়। সারাজীবন আমার কাছ থেকে অবহেলা পাবেন তা ভোগ করার জন্য। আপনি নিজে স্বার্থপরের মতো কাজ করেছেন। তাহলে আমি কেনো আমার প্রতিশোধের তৃষ্ণা মেটাতে স্বার্থপর হতে পারবোনা? আমার #হৃদয়ের_সুখ_আপনি এটা না বুঝলে কিছু করার নাই।
কারণ আপনি শুধুমাত্র আমার স্বামী। আমাদের পবিত্র সম্পর্কটা কে আমি অনাদরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না। আর না কোনদিন আপনাকে ছাড়তে পাড়বো আমি। কেনো পাড়ব না তা আপনি খুব ভালো করে জানেন। কারণ আমার পুরো পৃথিবীটা শুধু মাত্র আপনার মাঝে সীমাবদ্ধ। সেই পৃথিবী একান্ত আমার করার জন্য কখনো আপনার সামনে আত্মসম্মান বিষর্জন দিবো না। আপনার একটু ভুলের জন্য আমার জীবনে আপনার অবদান ভুলে যাবাে না।”

দাইয়ান চিৎকার করে বলে,
-“তুমি চলে যাও আমার সামনে থেকে।
আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না।
তোমার জন্য আমার হৃদয়ের মাঝে
রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা তুমি বোঝ না?
নিজের ভালোবাসা, আত্মসম্মান, ভবিষ্যৎ সব কিছু বিষর্জন দিয়েছি আমি শুধুমাত্র আমার লক্ষ পূরণের জন্য। কিন্তু তুমি আমার সে লক্ষ পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো।
কেনো করছো আমার সাথে এমন আচরণ? ”

রিমশা’র চক্ষু হতে অশ্রু ঝড়ছে, নিজের অশ্রু নিজেই দ্রুত মুছে। কান্না সিক্ত কন্ঠে বলে,

“আপনি নিজের লক্ষ পূরণের জন্য ভুল পথের পথিক হয়েছেন। আপনার অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে আমার কর্তব্য আমি যেনো আপনাকে সঠিকপথে নিয়ে আসি। সবাই যদি আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে ভালো মন্দের পার্থক্য কে বোঝাবে?”

দাইয়ান মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,”আমি চাইনা তুমি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকো। কারো দরকার নেই আমার। আমার জন্য আমি নিজেই যথেষ্ট। আমি যে পথে চলছি সে পথের সঙ্গী তোমাকে করতে পাড়বো না। আমি কোনদিন ও তোমাকে কষ্টে দেখতে পারি না, এটা তুমি খুব ভাল করে জানো। প্লিজ সোনা এসব বাচ্চামি বাদ দিয়ে নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাও। আমাকে আমার মতো চলতে দাও। মুক্তি দাও আমাকে তোমারও থেকে।”

রিমশা প্রতিউত্তরে আবারো বলে,

-“সুন্দর করে জীবনটাকে আপনার সাথে সাজাতে চেয়েছি। তবে আপনি কি করলেন? আমার হক, আমার অধিকার নষ্ট করে দিলেন। আমার বিনা অনুমতিতে আমার জন্য সতীন নিয়ে চলে আসলেন? তাও আবার নিজের লক্ষ পূরণের জন্য। কেনো আমার উপর একটু বিশ্বাস ছিলো না। আমাকে বললে হয়তো আপনার দ্বিতীয় বিয়ে করা লাগতো না। আপনি এমন কিছু করবেন, এমনটা আপনার থেকে আশা করি নাই।
আপনার কাছ থেকে এই প্রাপ্তি বাকি ছিলো?”

দাইয়ান -যখন দেখলে তোমাকে তাড়ানোর জন্য সতীন এসেছি। তখনও কেনো চলে গেলে না আমার জীবন থেকে? কেনো আঠার মতো লেগে আছো এই নষ্ট মানুষটার পেছনে?”

রিমশা ‘র ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বলে,”আপনি খুব ভালো করে জানেন। আমি আমার সাথে করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানি। সেখানে স্বামী মহাদয় আমার জন্য সতীন আনবে তাকে এমনিতে ছেড়ে দিব? এতো ভালো আমাকে ভাবার দরকার নেই।”

দাইয়ান চিৎকার করে বলে,
“তুমি চলে যাবে না কি আমি চলে যাবো দুনিয়া থেকে?”

রিমশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”আপনি মরবেন না, তা আমি খুব ভালো করে জানি। আচ্ছা থাক আপনাকে আর ডিস্টার্ব না করি। আজকের মতো এটুকু প্রেম-আলাপ যথেষ্ট। ”

এরপর মনের প্রশান্তি নিয়ে দাইয়ানের সামনে থেকে রিমশা প্রস্থান করে।

দাইয়ান নিজের সামনে থাকা দেয়ালে হাত দিয়ে জোড়ে
বারি দিয়ে বলে,

“কেনো তোমার আগমন আমাকে বারবার পোড়ায়? কেনো তোমার আগমন আমাকে বারংবার কাঁদায়! বলতে পারবে? তুমি কেনো এলে আমার অন্ধকার জীবনে? কেন জড়ালে নিজেকে এই সম্পর্কে? এর উত্তর জেনেও অজানা রইলো।”
*
*
এদিকে সকালে বাবার বাড়িতে যাবার নাম করে বেড়িয়ে ছিল রিমশা। তবে সে বাবার বাড়িতে যাবার পথিমধ্যে দাইয়ানের সাথে দেখা করেছে। সে যেহেতু বাবার বাড়ির নাম করে এসেছে তা-ই সে এখন বাবা- মা’র সাথে দেখা করবে।

‘সন্ধ্যাবেলা ফিরে যাবে ঐ নীড়ে,
যে নীড়ে তার হৃদয়ের মানুষের স্মৃতি দিয়ে সাজানো। ‘

বাবার বাড়িতে এসেই বাবাকে আলিঙ্গন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রিমশা। পাশেই তার মা দাঁড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বু্লিয়ে দিচ্ছে।

রিমশা নাক টেনে বলতে থাকে,”তোমরা কতোটা স্বার্থপর ভাবা যায়?”

রিমশা’র বাবা মা ভেবেছে এতো ঘটনা ঘটে গেছে তবুও তারা ঐ বাড়ি থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি দেখে হয়তো এভাবে কান্না করছে।

তবে রিমশা বাবা- মা কে অবক করে দিয়ে বলে,
-“এতোদিন পর মেয়ে বাড়িতে এসেছে তাকে বাড়ির সদরদরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছ। মনে হচ্ছে আমি ভিক্ষুক! আমাকে কিছু দান করে বিদায় করবে।”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে তারা দুজনে খুব অবাক হয়ে যায়। তাদের মেয়ে এমন পরিস্থিতি তে এভাবে কথা বলবে তারা আশা করে নাই।

এরপর রিমশা কে নিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে তারা। আজকে রিমশা’র পছন্দমত সব কিছু রান্না করেছে তার মা। এদিকে রিমশা খাবার খেতে বসে ওর মা কে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“মা আমার জন্য যত আইটেম রান্না করেছ সব কিছু টিফিন বক্সে ভরে দাও। ভাবী আর দুই ছোট বোনের জন্য নিয়ে যাব।”

রিমশা’র মা অবাক হয়ে বলে,
“বক্সে ভরে দিব মানে কী? তুই কতদিন পর বাড়িতে এসেছিস! কিছুদিন থাকবি না এখানে?”

রিমশা’র সোজাভাবে উত্তর দেয়,”উঁহু! আমার এতো সময় নেই। তাছাড়া আমি অনেক ব্যস্ত, আমার ব্যস্ততা তোমরা বুঝবে না।এখন যা বলেছি তা-ই করো।”

রিমশা’র বাবা বলে,”আজকের রাতটা না হয় এখানে থেকে যা!”

রিমশা -কি দরকার বাবা? আমি যদি এখানে থাকি তাহলে দেখবে আবার কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমি এ গ্রামে থাকা মানে বিপদে পরা। ছোট বেলায় বনবাসী হয়েছিলাম, আর বড় বেলায় বিয়ে করে যাবজ্জীবন কারা ভোগ করছি দাইয়ানের কারাগৃহে।”

রিমশা’র বাবা- মা দু’জনে মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

তখন রিমশা বলে,”তা মা তোমার ছেলে আর বউমা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসবে না? না মানে সেই যে বিয়ের পর বউ নিয়ে শহরে গেলো তারপর আর কোনদিন বাবা- মা’র সাথে দেখা করতে আসার প্রয়োজন বোধ করলো না।”

রিমশা’র মা বলে,”দেখা করতে না আসলেও রোজ দু’জনে কয়েকবার ফোন করে খোঁজ-খবর নেয় আমাদের।
মাসে মাসে আমাদের জন্য হাত খরচের টাকাও পাঠিয়ে দেয়। আমাদের দু’জনেকে ওদের সাথে যেয়ে থাকতে বলে। ”

রিমশা নরম কন্ঠে বলে,”আচ্ছা মা টাকাপয়সা কি সব? বাবা- মা এই বয়সে তাদের সন্তানদের সাথে কিছু সময় কাটাবে এটাই তো তাদের ইচ্ছা তা-ই না?”

তারা দু’জনে আর কোন কথা বলে না কিছু সময় নিরবতা পালনের পর রিমশা’র মা বলে,

“তুই তো জানিস তোর ভাই তোকে কতোটা ভালোবাসে।
তোর সাথে এখানে এতো কাহিনী ঘটেছে দেখে সে গ্রামটা কে ঘৃণা করে। আর মনের বিতৃষ্ণার জন্য সে গ্রামের বাড়িতে আসতে আগ্রহ বোধ করে না। তা-ই আমরাও জোড় করি না।”

রিমশা জানে তার ভাই সত্যি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
তা-ই তাদের সাথে আর কোন বাড়তি আলোচনা করে না।
এবাড়ির কেউ তাকে শ্বশুরবাড়ির কথা জিজ্ঞাস করে না।
কারন তারা জানে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি ভালো না হতো, তাহলে তাদের মেয়ে কোনদিন ও ঐ বাড়িতে এভাবে পড়ে থাকত না। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে রিমশা ঐ বাড়িতে সবার সাথে আনন্দে আছে।

রিমশা’র বাবার বাড়ি থেকে বেড়ুতে রাত হয়ে যায়। তাকে এতো রাতে একা ছাড়তে চাইনি তবুও সে জোড় করে একাই বেড়িয়ে পড়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।
*
*
চেয়ারম্যান বাড়িতে রিমশা অনেক রাতে প্রবেশ করে।
ইলমা রাত জেগে লেখাপড়া করছিল, তখন সে বুঝতে পারে রিমশা এসেছে। কারণ সে ইলমার কাছে ফোন করে দরজা খোলার জন্য। তাই সে বাড়ির মেইন দরজা রিমশা’র জন্য খুলেদেয়।

ইলমা তখন বলে,”ভাবী এতো রাতে বাড়িতে না আসলেই পারতে। কী দরকার ছিলো বলে একা রিস্ক নিয়ে রাতে এভাবে আসার।”

রিমশা বলে,”ও তুমি বুঝবে না। রাতে না আসলে সকালের মজা নিবো কি করে? তা-ই বলে ইলমা’র সামনে শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে, খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে দাও। কাল সকালে সবাই মিলে খাবো। আম্মা সবার জন্য পাঠিয়েছে। যেহেতু অনেক রাত হয়েগেছে আজকে আর খাওয়া হলো না।”

ইলমা শপিং ব্যাগ হাতে খাবার ঘরের দিকে চলে যায়।
এদিকে সদরদরজা বন্ধ করে রিমশা নিজের রুমে চলে যায়।



চলবে…….