হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-১১+১২

0
240

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-১১+১২
#Nishi_khatun

পরেরদিন সকালে রিমশা’র ঘুম ভাঙ্গে মুঠোফোনের রিংটোনের আওয়াজে। ঘুমঘুম চোখে বিছানাতে মুঠোফোন খোঁজা খুঁজি করে অবশেষে পেয়ে যায়। মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখে স্কিনের উপর ‘মা’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। রিমশা দ্রুত ফোনটা রিসিভ করতে-ই ওপাশ থেকে তীব্র উৎকণ্ঠিত কন্ঠে বলা শব্দ গুলো ভেসে আসতে শুরু করে।

ওপর পাশ থেকে বলে,”রিমশা জানিস আমাদের গ্রামে কি হয়েছে?”

রিমশা ঘুমকাতুরে কন্ঠে বলে,”তুমি না বললে জানতে পাড়বো কি করে? আমি তো ভবিষ্যৎ দেখতে পারি না, যে সবটা জেনে বসে থাকবো।”

রিমশা’র মা বলে,”আমাদের গ্রামের শেষের দিকে এক ববয়স্ক মহিলা থাকত। কাল রাতে ঐ মহিলার ছেলেটাকে কে বা কারা যে এতোটা মারধোর করেছে কি বলবো। ছেলেটার না বাঁচার অবস্থা। সদর হসপিটালে নিয়ে গেছে হয়তো বাঁচবে না।
জানিস ছেলেটার মা কি পরিমাণ বিলাপ করে কাঁদছে। ”

এবার রিমশা বিরক্তিবোধ করে বলে,
-“ছেলে হসপিটালে তাতে এতো কাঁদার কি আছে?”

রিমশা’র মা বলে,
“আমার সন্তান যদি হসপিটালে থাকে তাহলে আমি তার দুঃখে দুঃখী হবো না?”

রিমশা বিরক্তিকর ভাবে বলল-,
“যে সন্তান তার মা কে সম্মান করে না। নিজের বয়স্ক মায়ের গায়ে হাত তুলতে বিবেকে বাঁধে না। মা কে তিনবেলা সময়মত খাবার দেয় না। ঐ রকম সন্তানের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। ঐ সব কুলাঙ্গার সন্তানদের মরে যাওয়া ভাল।”

রিমশা’র মা আশ্চর্য হয়ে বলে,
“এসব কথা তু-ই জানলি কি করে? আমি তোকে তো কিছুই বলি নাই?”

রিমশা বলে,”আমার জীবনে গল্পটা বদলে যাওয়ার আগে, আমাদের গ্রাম থেকে ঐ বুড়ি মা এখানে শ্বশুর আব্বার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তখন দেখেছিলাম ঐ বুড়ি মা কে। তার ঠোঁটের কোণায় রক্তের শুকনো দাগ। চোখের এক কোণায় লাল হয়ে ফুলে আছে, সারা শরীরের লাঠির বারির চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেদিন উনি খুব কান্না করে। তাকে শান্তনা দিয়ে জানতে পারি তার সমস্যার কথা।”

উনার ভাষ্যমতে , ” আমি এক জনমদুখিনী। স্বামী মারা যাবার পর থেকে ছেলেটা আমার বদলে গেছে। বিয়ে করবে বললো বিয়ে দিয়েছি। বউ আর ছেলের একা থাকতে চাই। আমি তাদের সাথে থাকলে না কি সমস্যা। ছেলের বউ আমাকে পছন্দ করে না। আমি না কি অচল পয়সা। তারা আমার সাথে থাকতে পারবে না। আমার সাথে থাকলে মানসম্মান চলে যাবে।
আমি বুড়ি হয়ে গেছি, তাদের পরিবারের যোগ্য না। তারা আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু আমি নিজের স্বামীর ঘর ছেড়ে কেন যাবো? এই স্বামীর ভিটামাটি আমার শেষ সম্বল। তারা আমার কাছ থেকে শেষ সম্বল কেরে নিতে চায়। আমি তাদের আমার বাড়িটা লিখে দিচ্ছি না দেখে,
আমার উপর জুলুম করতে শুরু করেছে।
আমার নিজের ছেলে আমাকে মারধোর করে।
ঠিকমতো তিনবেলা খাবার দেয় না। সারাদিন নানারকম গালিগালাজ করে। দেখো না আজকেও আমাকে মেরেছে।
আপনারা একটু ছেলেটাকে বোঝান। আমি ওদের কোন সমস্যা করবো না। আমাকে শুধু বাড়ি থেকে যেন না তাড়িয়ে দেয়। ঘরের একটা কোণায় মুখ বুজে পড়ে থাকবো। তিনবেলা খেতে দিতে হবে না। ওরা আমাকে এক বেলা যেন পেট ভরে খাবার দেয়। আর এভাবে যেনো আমার গায়ে হাত না তোলে।

সেদিন আমি ঐ বুড়ি মা কে জড়িয়ে ধরে নিজেই কেঁদেছি। আমার পাশে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাইয়ান দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছিল। এসমস্ত কথা শুনে দাইয়ান বুড়ি মা’র ছেলেকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলে ছিল। সে যেনো তার মায়ের সাথে আর খারাপ ব্যবহার না করে। বৃদ্ধ মা তাকে কত কষ্ট সহ্য করে না বড় করেছে।

তবে দেখো তার ছেলে তবুও শুধরে যায় নি। সে তার মা’কে প্রতি দিন আঘাত করতো। ‘কথায় আছে, কয়লার ময়লা যায় না ধৌত করলে।’ যে সন্তান কুলাঙ্গার হয় তাকে শত নীতিকথা গুলিয়ে খাওয়ালেও তারা জাতে আসবে না।

হয়তো দাইয়ান বাড়িতে থাকলে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বুড়ি মা’র ছেলের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত।
তা-ই যে বা যারা ঐ ছেলেটাকে হসপিটালে পাঠিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানানোর দরকার। এবার যদি ঐ কুলাঙ্গার সন্তান মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারে। আর মায়ের কদর করতে জানে।

রিমশা’র মা সবটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘জানি না রে মা! আমাদের কয়েকটা গ্রামে কার নজর পড়েছে। কিছুদিন পর পর খুনের খবর নয়তো মারধোরের খবর।
সে যাই হোক তু-ই সাবধানে থাক রাখছি এখন।’

সকালে মায়ের সাথে কথা বলার পর ফ্রেশ হয়ে রিমশা রেহেনা বেগমের কাছে যায়।

রেহেনা বেগমের কাছে যেয়ে সে বলে,”আম্মা আমি একটু উনার সাথে দেখা করতে যেতে চাই। যদি আপনি অনুমিত দেন তাহলে যাবাে নয়ত যাবাে না।”

রেহেনা বেগম মুচকি হেসে বলে,” তোমার স্বামী কাছে যাবে তার জন্য আমার কাছ থেকে অনুমিত নেওয়ার কি আছে? যখন ইচ্ছা হবে দেখা করতে চলে যাবে।”

রিমশা আমতাআমতা করে বলে,”আম্মা এই কথাটা জেনো আর কেউ না জানে। আমি চাইনা অন্যদের জানাতে। ”

রেহেনা বেগম নিরবে সম্মতি জানাতে-ই রিমশা রেডি হয়ে বাড়ির বাহিরে বেড়িয়ে যায়।

রিমশা চলে যাবার পর ইফা জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে বলে,
-“রিমশা’র পা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। স্বামী কে জেলে বন্দী করে রেখে সে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ছেলের যে মেয়ে এমন ক্ষতি করেছে তাকে কেউ তো কটু কথা বলছে না। উল্টা তাকে মাথায় তুলে নাচছে। তাদের যত বাহাদুরি আমার বেলায়। আমিও আর আপনাদের অনুমতির অপেক্ষা করবো না এই বলে দিলাম। আমার যা ইচ্ছা হবে তাই করবো।
সবাই কান পরিষ্কার করে জেনে রাখুন। ”

রাত বিরেতে যেমন শিয়াল একাই হাক-ডাক ছাড়ে ঠিক তেমন ভাবে দিনের বেলায় ইফার চিৎকার কেউ আমলে নিচ্ছে না।
ওর যা ইচ্ছা করুক তাতে অন্যদের কিছুই না।
*
*
এদিকে আজকেও রিমশা কে নিজের সামনে দেখে দাইয়ান অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

রিমশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,” জানে কি হয়েছে?
উঁহু আপনি তো জানেন না। আমি বলছি কি হয়েছে।”

দাইয়ান বলে,”তোমার নাটক করার দরকার নেই।
আমি কিছুই জানতে চাই না। তুমি যাও এখান থেকে।”

রিমশা মুখ ভেঙ্গচি কেটে বলে,”আপনার শোনার ইচ্ছা না থাকলেও আমি তো বলতে ইচ্ছুক। এখানে আসার কিছুদিন আগে এক বুড়ি মা আমাদের বাড়িতে বিচার চাইতে এসেছিল। যার ছেলেকে আপনি তোতাপাখির মতো সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন জেনো সে তার মা’কে কষ্ট না দেয়।
কাল রাতে কে বা কারা সেই বুড়ি মা’র ছেলেটাকে কি মা’র টাই না মেরেছে। বেচার হসপিটালে ভর্তি হয়তো নাও বাঁচতে পারে।”

দাইয়ান হচকিত হয়ে বলে,”তোহহহহহ আমি কি করবো?
কে মারা গেলো বা বেঁচে থাকলো এসব জেনে শুনে আমার কাজ নেই।”

রিমশা -জানি তো আপনার কাজ নেই! তবুও আমি জানাতে আসলাম। আপনি বাড়িতে নেই এসব খবর তো জানতে পারবেন না। আশেপাশের সব তথ্য সম্পর্কে আপনাকে অবগত করাটা আমার কর্তব্য বুঝলেন। দেখুন না আপনি নেই তবুও আপনার অবর্তমানে আমি ঠিকি আপনার দায়িত্ব পালন করছি।”

দাইয়ান গম্ভীর সুরে বলে,”তোমাকে আমার পরিবারের বা আমার কোন দায়িত্ব পালনে দায়িত্ব আমি দেইনি। অযথা আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব পালনের কোন দরকার নেই।”

রিমশা -আরে ধুর! আপনি কেন বলবেন? বিয়েরপর স্বামীর সব দায়িত্বে স্ত্রীর ভাগ থাকে। তা-ই আমি নিজে থেকে আপনার সব কাজের দায়িত্ব নিয়েছি।

দাইয়ান রিমশা অনেকটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-“এই তোমাকে না আমি জীবনের সব থেকে বড় কষ্টটা উপহার দিলাম? সতীন এনেছি তোমার জন্য। তুমি তবুও কেনো দূরে যাচ্ছ না বলবে?”

রিমশা’র তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”সারাজীবন আপনার সাথে থাকার জন্য ওয়াদা করেছি । তাহলে মাঝপথে কি করে আপনাকে ছেড়ে দেই বলেন? এখানো একসাথে দু জনের মরা বাকি আছে। আর ঐ সতীন দু দিনের জঞ্জাল। ”

দাইয়ান -রিমশা তুমি জীবনটা যেমন ভাবছো এটা কিন্তু
মোটেই এমন নয়। তুমি জানো না আমার সাথে জড়ানোর পরিণাম কি ভয়াবহ হতে পারে। আমি চাইনা তুমি কোনদিন এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হও। প্লিজ এখনো সময় আছে, আমার জীবন আর আমার পরিবারের কাছ থেকে চলে যাও।”

রিমশা -সব কিছু ছেড়ে যাবার জন্য তো আমি আপনার জীবনে আসি নাই। তাহলে যাবার কথা কেনো আসছে? আর যদি চলে যাওয়ার হতো তাহলে বিয়েরদিন কখনো আপনার সাথে আসতাম না।

দাইয়ান জানে রিমশা ঘাড়-ত্যাড়া! একে বোঝানোর ক্ষমতা আর দাইয়ানের নাই। তা-ই এখন নিজেকে পরাজিত ভেবে শান্তনা দিচ্ছে।

রিমশা বলে,”এখুনি নিজেকে পরাজিত ভাবার দরকার কি? সামনে হয়তো আপনার সময় আসতে পারে বলা যায় না।
তবে হ্যা ঐ সময়ের আগে আমি ইফার থেকে আপনাকে আলাদা করে দিব এই বলে দিলাম।”

রিমশা প্রস্থান করতেই দাইয়ান বলে,
“কোন ভুল ক্ষণে যে এই লবঙ্গলতিকার সাথে দেখা হয়েছিল আল্লাহ ভালো জানে। আল্লাহ এই পাগলের হাত থেকে তোমার নিরিহ বান্দাকে বাঁচাও। আমি যতো ওর ভালো করতে চাইছি ততোই মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। জানি না আমাদের এই সম্পর্কের পরিণাম কি হবে।”

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-১২
#Nishi_khatun

রিমশা সুন্দরি খালপাড়ের সামনের মেইন রোড দিয়ে বাড়িতে আসছিল। হঠাৎ করে দেখে কয়েকটা ছেলে মেয়ে খালের পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দূর থেকে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না তারা কি করছে সেখানে।

রিমশা ভ্রু কুঁচকে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বলে,

-“এই খালপাড় বনভোজনের স্থান কবে থেকে হলো?
তাও আবার যেখানে লোকদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে।
হ্যা মানছি খালপাড়ের আশেপাশে বড় বড় গাছপালা দিয়ে ভরা। এখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর, তা-ই বলে যে কোন স্থান কে লোকদের মনোরঞ্জনের পরিবেশ বানানো উচিৎ না। তার আশেপাশে বসবাস কারী লোকদের সমস্যা হতে পারে।”

রিমশা বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে এসে ইলমা আর ঝর্ণা কে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা রুপসী খালপাড় কী বনভোজন করার জন্য উন্মুক্ত? ”

ঝর্ণা আর ইলমা দু’ জনে অবাক হয়ে যায়।
রুপসী খালের এই নতুন কাহিনী শুনে।

ইলমা বলে,
-“কী যে বলেন না ভাবী! সদর থেকে কিছুটা দূরে আমাদের গ্রাম তার মানে এই নয় যে আমাদের গ্রামটা একদম গ্রাম্য গ্রাম। আমাদের গ্রাম সদরের মতো উন্নত না হলেও এখানে সদরের মতো করে সবাই মোটামুটি জীবনযাপন করতে চেষ্টা করে। আর রুপসী খালপাড় গ্রামের সবার বেড়াতে যাবার স্থান ছিলো। তবে দু বছর আগে একটা দূর্ঘটনার পর থেকে সবাই সেখানে যাওয়া কমিয়ে দিয়ে। তার মানে এই নয় যে রুপসী খালপাড় সদরের মানুষদের বিনোদনের স্থান। হয়তো তারা নিজে থেকেই খালপাড় কে বিনোদনের স্থানে পরিণত করতে চাইছে। ”

রিমশা বলে,
-“আমি কিন্তু দু বছর আগে এই খালপাড়ে অনেকে-ই দেখেছি। দু বছর আগে খালপাড়ের দুর্ঘটনার সময় আমি আমাদের গ্রামে ছিলাম। আমি যেদিন ফিরে যাচ্ছিলাম সেদিন দেখেছিলাম সেখানে কিছু মানুষকে আর্তনাদ করতে। তবে দূরে থাকার জন্য ওখানে কী হয়েছিল তা বুঝতে পারি নাই। তবে কিছুটা সময়পর রাস্তা থেকে যা বোঝার দেখার দেখতে পেয়েছিলাম।”

ইলমা ভ্রু কুঁচকে বলে,

-“ভাবী তুমি না তোমার বিয়ের কিছুদিন আগে গ্রামে এসেছিলে? তাহলে দু বছর আগে কেনো এসেছিলে?”

রিমশা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
-“আমার বড় ভাইয়ের বিয়েতে এসেছিলাম। বড় ভাইয়ার এক কথা ছিল। আমার বোন যদি এ গ্রামে আমার বিয়েতে উপস্থিত না থাকতে পারে। তাহলে সে গ্রামে থেকে সে বিয়ে করবে না। তা-ই ভাইয়ার মন রাখতে বাবা আমাকে মামা বাড়ি থেকে আনতে গেছিলো। আমাদের গ্রামে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। আশার পথে এই খালপাড়ে কিছু তরুণ যুবক ছেলেদের আড্ডা দিতে দেখেছি। তারপর বাড়িতে গেলাম। ভাইয়ার বিয়ের আনন্দ উপভোগ করলাম। বিয়ের সকল অনুষ্ঠান শেষে মামা-মামীর কাছে ফিরে যাবার দিন খালপাড়ের দূর্ঘটনা দেখলাম।
পরে মা’র কাছ থেকে সবটা শুনেছিলাম। ঘটনা শুনে কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। তার এক বছর ছয় মাস পর গ্রামে ফিরে আসি। গ্রামে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই তোমার ভাইয়ের সাথে আব্বা বিয়ে দিয়ে দেন। তারপর থেকে জীবনটা বদলে গেলো। এই ছয় মাসে গ্রামে কতো কাহিনী হলো, আবার আমার জীবনেও নানারকম সমস্যা বেড়াতে এসেছে। সব কিছুই হাসি মুখে মেনেছি আর ভবিষ্যৎ এ মেনে যাব।”

ইলমা’র মুখটা হঠাৎ করে বিষাদের কালো ছায়াতে ঢেকে যায়।রিমশা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ভাবী আমার কাজ আছে আমি আসছি।”

ঝর্ণা ইলমার পেছনে পেছনে চলে যায়।

সেদিন সারাদিন আর ইলমা বা ঝর্ণার সাথে রিমশা’র কথা হয়নি। রিমশা একটু ব্যস্ত ছিলো কারণ চেয়ারম্যান সাহেব বাড়িতে এসেছে। তার সাথে কিছু আলোচনা করতে ব্যস্ত ছিলো।

রাতে ঘুমাতে এসে রিমশা পড়েছে বিপদে কিছুতে চোখে পাতায় ঘুম পরীদের দেখা মিলছে না। সে জানালার বাহিরের ঐ দূর আকাশের প্রাণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পুরো আকাশে আজ তারার মেলা বসেছে। অন্ধকার আকাশের বুকে হাজারো তারা মিটমিট করে জ্বলছে।
এসব দেখে রিমশা’র অতীতের কথা মনে পড়ছে।

রিমশা তার অতীতের পাতায় ডুব দেয়……..
*
*

মামা-মামীর দুই পুত্র সন্তান ছিলো তাদের কোন কন্যা সন্তান ছিলো না। তারা রিমশা কে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতো। রিমশা’র মামার অবস্থা ভালো ছিলো। শহরে তাদের চারতলা বিল্ডিং বাড়ি ছিলো। শুরুতে রিমশা’র মামা-মামী নিচ তলাতে থাকত। পরে তাদের দুই ছেলে লেখাপড়া করার জন্য বাড়ি থেকে দূরে চলে গেলে, তারা তাদের বিল্ডিং এ দোতলায় শিফট করে। দোতলাতে রিমশা কে পূর্বদিকে এটার্চ বারান্দা যুক্ত রুম দেয়।

রিমশা’র সেখানে পরিচিত কেউ ছিলো না। তার উপর সে মেয়ে মানুষ দেখে মামী আশেপাশে কারো সাথে তাকে সেভাবে মিশতে দিত না। যে দিনকাল পড়েছে। আপন মানুষকে বিশ্বাস নেই। সেখানে পরের বাড়িতে সে মেয়ের যাতায়াত পছন্দ করত না।

তা-ই লেখাপড়া নিয়ে রিমশা ব্যস্ত ছিলো। রিমশা রাত জেগে পড়তে ভালোবাসত। একদিন রাত দুই টা বাজে। সামনে ক্লাস টেনের প্রথম সাময়িক পরিক্ষা। সেই পরিক্ষার টেনশনে তার ঘুম আসছিল না। কি করবে ভাবছিল, হঠাৎ মনে হলো আমার রুমে বারান্দা আছে। সেখানে রাতে কখনো যাওয়া হয়নি আজকে না হয় উদ্বোধন করি। যেই ভাবনা সেই কাজ।

বারান্দাতে আসতেই দেখে তাদের পাশের বিল্ডিং বারান্দার একদম সাথে প্রায় হাত দিলেই স্পর্শ করা যাবে। বারান্দার সামনে একটা রুমের জানালা খোলা। জানালার সামনে টেবিল চেয়ারে বসে একজন যুবক লেখাপড়া করছে। হঠাৎ করে তার রুমের সামনে এমন সুদর্শন যুবকের দেখা পাবে ভাবতেই পারে নাই। এদিকে রুমের পাশে সুপুরুষ ছেলের রুম ভাবতেই বুকের মাঝে ধুকধুক শব্দ করে ওঠে।

ঐ রুমের আলোতে পড়ুয়া ছেলেটাকে মুগ্ধ নয়নে রিমশা দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে ছেলেটা জানালার বাহিরে দৃষ্ট পাত করতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। তার জানালার সামনে মেয়ে কোথায় থেকে আসলো? সে হুট করে মাঝ রাতে তার জানালার বাহিরে কোন বালিকা কে কখনোই আশা করে নাই।

ছেলেটা বিরক্তিবোধ করে বলে,
“এই মেয়ে কে তুমি? এতো রাতে ভুতের মতো বারান্দায় এভাবে আমার জানালার সামনে দাঁড়ায় আছো কেন?
যে কেউ তোমাকে এভাবে দেখে হার্ট এটার্ক করবে।”

রিমশা প্রতিউত্তরে বলে,”আমার নাম রিমশা। আর আমি বারান্দার আলো জ্বালিয়ে এসেছি । যাতে কেউ আমাকে এভাবে দেখে ভয় না পাই। এখানে আমি নিজের রুমের বারান্দাতে আছি কারো রুমের জানালার সামনে নয়।”

ছেলেটা বলে,
“রিমশা নামের মানে কি? এইসব নাম রাখে কেন? তাছাড়া তুমি আমার জানালায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছ দেখে বোঝা যাচ্ছে। ”

রিমশা বিরক্তিবোধ করে বলে,”Rimsha নামের অর্থ সফল বা বিজয়ী নির্দিষ্ট করে। বাবা মা তাদের নামের সাথে মিলিত করে আমার নাম রেখেছে রিমশা। বাবার নাম শাওন হোসেন আর আম্মুর নাম রিমঝিমি। আম্মুর নামের প্রথম দুই অক্ষর রিম আর বাবার প্রথম অক্ষর শা দিয়ে হয়ে গেলো রিমশা আর রিমশা নামের অর্থ সুন্দর। তাই তাদের আদুরের মেয়ের নাম রিমশা রেখেছে। ”

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলে,”আমাদের এলাকাতে শাওন হোসেন নামের কেউ নেই। আর তুমি এখানে কি ভাবে আসলে?”

রিমশা মুখ ভেঙ্গচি দিয়ে বলে,
“এই বিল্ডিং টা আমার মামার। আমি আজমল সাহবের
একমাত্র বোনের মেয়ে। দিন পনেরো হলো নিচ তলা থেকে তারা উপরতলাতে শিফট করেছে। ”

ছেলেটা বলে,”ওহ আচ্ছা তুমি আজমল আঙ্কলের ভাগ্নি।
কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”

-ক্লাস টেনে পড়ি, সামনে বছর এসএসসি পরিক্ষা দিবো।

ছেলেটা এবার গম্ভীর কন্ঠে বলে,”একদম পিচ্চি মেয়ে।
যাও অনেক রাত হয়েছে নিজের রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

রিমশা বলে,”আপনিও তো রাত জেগে আছেন!
আগে নিজে ঘুমাতে যান তারপর অন্যকে জ্ঞান দিবেন। ”

-তুমি আচ্ছা ফাজিল মেয়ে তো। দেখছ না আমি লেখাপড়া করছি। এখন ঘুমবার সময় নেই আমার। লেখাপড়া করাটা আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য। এই লেখাপড়া করে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো। অন্যের উপকার করে নিজের নাম উজ্জ্বল করবো।”

রিমশা জিজ্ঞাস করে,” তা আপনার না কি?”

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলে,”আমার নাম জেনে তোমার কাজ কি?”

-আপনি এতো সময় ধরে আমাকে এতো প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দিতে ত্যাড়ামি করেছি? তাহলে আপনি কেন উত্তর দিবেন না? আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হিসাব সোজাসুজি করেন।

‘আহীদ হক আমার নাম! আর কিছু জানার থাকলেও বলতে বাধ্য না। আর মাঝ রাতে পরপুরুষের সাথে বেশি কথা বলতে নেই বুঝলে মেয়ে।

রিমশা বলে,
-“মাঝরাতে বাচ্চা মেয়েকে একা পেয়ে প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসার সময় মনে ছিলোনা? ”

বলেই নিজের রুমের ভেতরে গটগট প্রবেশ করে। কি দরকার অজানা মানুষের সাথে রাতদুপুরে কথা বলার। আশেপাশে কেউ দেখলে খারাপ ভাবতে পারে। নানারকম আজেবাজে কথা সৃষ্টি হতে পারে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি ঝগড়া করাটা।

তবে এই জ্যোৎস্নাময় রাতে ঐ লোকটার সাথে কথা বলে ভালোই লেগেছে। বহুদিন পর কারো সাথে একটু প্রাণ খুলে কথা বলেছি। তবে পুরুষ মানুষদের সাথে কথা বলতেও ভয় করে। সবাই যদি রতন স্যারের মতো হয়? আচ্ছা পুরুষ মানুষ মানেই কি খারাপ ব্যক্তি? কই আমার বাবা মামা তাদের দৃষ্টি তো এমন নয়! তাহলে কিছু খারাপনজরের জন্য নিজেকে কেনো গুটিয়ে নিতে হয়?

সেদিন রাতে আর ঘুমটা হলো না। তা-ই মাঝরাতে তাহাজ্জত নামাজটা আদায় করে বসেছিলাম তার কিছু সময় পর ফজরের আজান দিলো নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ি।



চলবে…..