হৃদয়েশ্বরী পর্ব-০২

0
1112

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখনীতে- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__০২

মধ্য রজনীর অন্তিমলগ্ন পেরিয়েছে ক্ষনিক আগেই। মেদিনীতে প্রভাতের আগমন ঘটেছে কিয়ংদশ পূর্বে।কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত। মাঘ মাসের শেষাংশ চলছে অথচ শীতের প্রকোপ কমার নামই নেই। বরঞ্চ শীত যেনো হুরহুর করে বেড়েই চলেছে। শৈতপ্রবাহের তান্ডব চলছে উত্তরান্চলে। যার ফলস্বরূপ শীতের উপস্থিতি এখনো প্রকৃতিতে রয়ে গিয়েছে। শব্দহীন প্রভাতে ঢাকার ব্যাস্ত সড়কে চলাচলকৃত যানবাহনের শব্দ কর্ণপাতের দরুন মীরার ধ্যান ফিরলো। তার দৃষ্টিপাত এতক্ষণ যাবৎ আঁটকে ছিলো উশানের আঁখি জোড়ার মাঝে। অদ্ভুত ভাবে উশানের আঁখি জোড়ার সাদা অংশটুকু লালচে হয়ে রয়েছে। টলমলে চক্ষুজোড়া! মীরা উশানের আঁখি দু’টো দর্শন করা মাত্রই ঠাওর করতে পেরেছিলো এই ব্যাক্তির মাঝে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।মীরা মানুষের চোখের আকার – ইঙ্গিত বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করতে জানে। সাইকোলজির ছাত্রী হওয়ার ফলস্বরূপ সে এতটুকু জ্ঞান রপ্ত করা শিখেছে।

উশানের তীক্ষ্ণ চাহনি! ভীষণ মনোযোগ সহকারে সে মীরার মুখোশ্রীতে দৃষ্টি ফেলে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। চোখেমুখে তার অপ্রকাশিত এক আর্তনাদ।মীরার জন্য আপাতত রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শেষে নিজেকে ধাতস্থ করে উশানের বক্ষঃস্থলের মাঝ বরাবর হাত রেখে সজোরে ধাক্কা দেয়। অকস্মাৎ কয়েক কদম পিছিয়ে যায় উশান।মীরা তৎক্ষনাৎ ফুঁসে উঠে বলল,

‘ আমায় একা পেয়ে আপনি সুযোগ নিতে চাচ্ছেন তাইনা উশান? লজ্জা হওয়া উচিত আপনার।এভাবে অনুমতি ছাড়া কোনো মেয়ের রুমে প্রবেশ করেন কোন সাহসে? কাপুরুষ একটা! ‘

মীরা তার নামের সাথে ‘ভাই’ শব্দটা যুক্ত করেনি দেখে উশান চমকে তাকালো। তদ্রূপ নিজেকে শান্ত করলো এই ভেবে রাগের বসে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। তেজী সেই মানব আজ নতজানু হলো। নিজের আচরণে নিজের প্রতিই ক্ষুব্ধ সে। এতোটা অসাবধান কি করে হলো সে?উশান কাতর কন্ঠে বলল,

‘ আই এ্যাম সরি মীরা। এক্সট্রিমলি সরি! ‘

উশান কথা শেষে এক বিন্দু থামলো না। হন্তদন্ত হয়ে বের হলো রুম থেকে। পাঁচ তলা বিশিষ্ট ভবন থেকে বের হয়ে নিজের বাইকে চড়ে বসলো। শুষ্ক অধর জিহ্বা দ্বারা সিক্ত করে কাঁপা হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারিতে প্রবেশ করলো। একটা ছবিতে ক্লিক করা মাত্র ভেসে উঠলো এক কিশোরীর হাস্যজ্বল মুখোশ্রী। সে তার ঝকঝকে সাদা দাঁত দিয়ে প্রাণ খুলে হাসছে। রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে অনিলে। পাশেই দাঁড়ানো যুবক সেই উশান। তার দৃষ্টিপাত সেই কিশোরীর ওপর স্থাপিত। এতটুকুই রয়েছে ছবিটিতে। কিশোরীর ছবিটি সুক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করে উশান বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ মানুষ তো একই। চেহারা, মুখের গড়ন সবই এক। তাহলে চোখের পাশের তিল আর ভোকাল কর্ডের মাঝখানের জন্মদাগটা কিভাবে গায়েভ হতে পারে?’

___________________________

মীরা আধাঘন্টা যাবৎ উশানের দাদুর বাসায় বসে আছে। উশানের দাদু ফারদিন রেজওয়ান তাকে হুট করেই ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আসার পর ফারদিনের অস্তিত্বও নেই যেনো রেজওয়ান ভিলায়। মীরাকে বসতে বলে ফারদিন কোথায় যেনো গেলো। এদিকে সাঝবেলার প্রহর শেষে রাত নামতে শুরু করেছে চারিদিকে। একটু পরই উশানের আগমন ঘটবে। উশান আসলেই মীরাকে তার সামনে পড়তে হবে যা একদমই চাচ্ছে না মীরা। সকালের ঘটনার পর ‘ উশান ‘ নামক ব্যাক্তির ওপর তিক্ত রাগ, ক্ষোভ চেপে বসেছে তার।

মীরা ঠিক করলো সে আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। তারপরই নিজ গন্তব্যে ফিরবে। ক্ষ্যান্ত হয়ে বসতেই যেই আগাম ভয়টা সে পাচ্ছিলো তাই ঘটলো তার সাথে। উশান সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে। মাথা নিচু করা। শব্দহীন পায়ে লম্বা কদম ফেলে চলছে সে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মীরা শ্বাস রুখে রইল। বারংবার নিভৃতে আল্লাহর নিকট চাইলো যেন এই উশান’টা মাথা না তুলে! তাকে দেখে না ফেলে। উশান সিঁড়িতে পা দিবে তার পূর্বে সে জোড়াল কন্ঠে হাক ছেড়ে বলল,

‘ আম্মু আমার রুমে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পাঠিয়ে দিন।’

উশান চোখের পলকেই ওপরে চলে গেলো। মীরা স্বস্তির শ্বাস ফেললো।দেখেনি তাহলে পাগলটা তাকে। মীরা ব্যাগ নিয়ে উঠে যাচ্ছিলো তৎক্ষনাৎ ঊষা ছুটে এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে। হাতে তার গ্লাস। আঁচলে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে ঊষা বলল,

‘ মা আমার একটা উপকার করো তো। উশানকে এই গরম পানির গ্লাসটা একটু ওপরে দিয়ে আসো না মা। আমি গেলে ঠান্ডা পানি আনিনি কেনো তার জন্য রাগ করবে। তুমি গেলে তেমন কিছু বলতে পারবে না। এই শীতকালে ছেলেটা শুধু ঠান্ডা পানি খেতে চায়। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে তবুও শুধরায় না। তুমি একটু যাও না মীরা। তোমার সাথে তো আর রাগারাগি করতে পারবে না। নিকট কেও ছাড়া ও কারো ওপর রাগ ঝাড়ে না। ‘

মীরা কাঁদো কাঁদো চাহনি নিক্ষেপ করলো মাটিতে। মনে মনে বলল, ‘ আপনি তো জানেন না আন্টি। আপনার ছেলে আমায় তুই – তুকারি’সহ, ধমক, রাগ নিজের ক্ষোভ পর্যন্ত ঝেড়ে ঝুড়ে শেষ করে ফেলে।’ কিন্তু সে মুখে স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘ এতো রিকুয়েষ্ট করতে হবে না আন্টি। দিন আমি পানি দিয়ে আসছি। ‘

‘ ট্রে সহ নাও। গরম হয়ে আছে গ্লাস।উশানকেও একটু পর খেতে বলো। ‘

মীরা ধপাধপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে। উশানের রুমের সামনে এসে সে লম্বা দম নেয়। উঁকি দিতেই দর্শন হয় উশান শার্টলেস। মীরার শ্যাম মুখোশ্রী গরম হয়ে উঠলো লজ্জায়। উশানের কি লাজ- লজ্জা বলতে কিছু নেই? এভাবে দরজা খুলে কেও পোশাক পরিবর্তন করে? কিয়ৎক্ষণ বাদে ঠাস করে দরজা বন্ধ করার শব্দ কর্ণপাত হয় মীরার। উশান নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে ঢুকেছে। মীরা ত্রস্ত পায়ে ঢুকলো রুমে। পা দু’টো কাঁপছে কেনো তার?সঙ্কোচে কিংবা অন্য আশংকায়? পড়ার টেবিলে ট্রে রেখে মীরা উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই কর্ণকুহরে তার প্রতিফলিত হয় উশানের কন্ঠ। সে চেঁচিয়ে বলল,

‘ আম্মু আপনি কি রুমে?আমি ভুলবশত আমার টাওয়াল বেডে ফেলে এসেছি। একটু এগিয়ে দিন তো। ‘

মীরা চলন্ত পা জোড়া থেমে গেলো। আসার সময় সে দেখেছিলো ঊষা বাহিরে যাচ্ছে। বাসায় আর কেও নেই। উশানের আবেদন নিশ্চয়ই আপাতত আর পূর্ণ হবেনা। এদিকে হুট করে মীরার মনে হলো সে যদি টাওয়াল না দিয়ে যায় তাহলে উশান জ্বরে পড়বে। উশানের জ্বরে তার মা কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করবে। তখন উশান যদি বলে ফেলে রুমে সে পায়ের শব্দ পেয়েছে তবুও তাকে কেও তোয়ালে’টা দেয়নি। তখন তো অবশ্যই ঊষা মীরাকে খপ করে ধরবে। তোয়ালে না দেয়ার জন্য শান্ত থেকে সুচালো কথা শোনাবে। ঊষা আবার ছেলেকে নিয়ে মাত্রা তিরিক্ত দরদ পেশ করেন।

নীলচে রঙের বেডশিটের ওপর থাকা তোয়ালে’টা মীরা হাতে তুললো। ওয়াশরুমের নিকট গিয়ে দরজা নক করতেই দরজা কিঞ্চিৎ ফাক করার পর শ্যামবর্ণের হাতটি দেখে উশান চট করে বুঝে ফেললো এটা মীরার হাত। দ্রুত সে দরজা আঁটকে শরীরের সাথে মিশ্রিত পানি না মুছেই পোশাক পড়ে হন্তদন্ত হয়ে বের হলো। মীরা তখন সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিলো। উশান দৌড় লাগায় সেদিকে। কন্ঠে জোড়াল ভাব এনে বলে,

‘ মীরা একটু দাঁড়া! ‘

মীরা দাড়ায় না। সকালের ঘটনার পর উশানকে তার ভয় লাগে বড্ড। তাছাড়া বাড়ি পুরো ফাঁকা। কেও থাকলে কথা ছিলো। উশান মীরাকে টপকে মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।শ্বাস টেনে বলল,

‘ দৌড়াচ্ছিস কেনো? আমি কি বাঘ নাকি? স্ট্রেঞ্জ! ‘

মীরা চিবিয়ে বলল, ‘ সকালের ঘটনার পর আমার আপনাকে তার থেকে নিকৃর্ষ্ট এক ব্যাক্তি মনে হচ্ছে।’

উশান নিভলো। মীরা যে সকালের ঘটনা একদম নিজের মধ্যে এঁটে সেঁটে নিয়েছে তা সে বেশ ভালো মতোনই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। মীরাটা সেই আগের মতোই রয়ে গেলো। সর্বদা শুধু তাকে ভুল বোঝা। উশান বিনয়ী সুরে বলল,

‘ সকালের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত মীরা। মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। দেখ একটু! এদিকে তাকা। তোর কাছে সম্মানীয় ক্যাপ্টেন উশান রেজওয়ান ক্ষমা চাচ্ছে। ‘

মীরা ভড়কে তাকালো। নিজের প্রশংসা নিজে করছে? এ কেমন লোক? আজব তো! মীরা কিছুটা চমকে গিয়েছেও। উশান তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এতোটা ব্যাকুল?দাম্ভিকতা নিয়ে চলা ক্যাপ্টেন উশান আজ তার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলো তার। পরিশেষে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘ মাফ করে দিয়েছি। হ্যাপি নাও?’

উশান বিড়বিড়িয়ে কিছু বলল তা কর্ণপাত হলো না মীরার। বাসায় ফিরতে হবে। রাত হচ্ছে। মীরা তার স্থির পা জোড়া সামনের দিকে আগাতে নিলেই উশান ভারী কন্ঠে বলল,

‘ তোর হাতে কি এগুলো মীরা?’

মীরা নিজের হাতের দিকে তাকালো। কাঁদা লেগে রয়েছে। কাঁদার উৎসটা কোথা থেকে হলো তা বুঝতে পারলো না। স্বাভাবিক হয়ে চিন্তিত গলায় বলল,

‘ কাঁদা লেগেছে। কোথা থেকে লাগলো বুঝলাম না।’

উশান এগোল। পকেটে তার সর্বদা রুমাল ঢোকানো থাকে আগে থেকেই। পকেট থেকে নিজের কালো রঙের রুমালটা বের করে সে মীরার হাত টেনে ধরলো। রুমাল দিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে সে মীরার হাতে লেগে থাকা কাঁদা গুলো মুছে দিয়ে সেই নোংরা হয়ে যাওয়া রুমাল ময়লার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেললো। অন্তরালে মীরা হতভম্ব হলেও বাহিরে সে অনুভূতিশূন্য।উশান মীরার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ বাসায় একা যেতে পারবি নাকি আমি দিয়ে আসবো?’

মীরা ঘোর থেকে বেড়িয়ে প্রতুত্তরে বলল,’ লাগবে না। বাসা তো এই সামনেই। ‘

হাতে ফোন নিয়ে মীরা বেড়িয়ে আসে চটপট। কিছু দূর যেতেই তার অনুভূত হলো কেও আসছে তার পিছনে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই ফের দৃশ্যমান হয় উশানকে। ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে তার পিছু পিছু হাঁটছে। মীরা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘ আপনি আমার পিছু পিছু আসছেন কেনো?’

উশান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘ তোর পিছে আসতে যাবো কেনো? আমি ফার্মেসীর দোকানে যাচ্ছি। সবসময় দুই লাইন বেশি ভাবিস! ‘

হাঁটা ধরে মীরা। অপমানিত বোধ হয়। উশান বড্ড বেয়াদব ধরনের। সবসময় তাকে খোঁচা মেরে কথা বলে। কে বলবে একটু আগে এই লোক তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো?বাকি সবার কাছে উশান স্বাভাবিক। ভদ্র, শান্ত এবং একজন সম্মানীয় ব্যাক্তি। বাসার কাছে এসে গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ভাং করে লুকিয়ে থাকে পাশে মীরা। অতঃপর কিয়ংদশ বাদে গেটের কাছে আসতেই সে দর্শন করলো উশান ফিরে যাচ্ছে। মীরা ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,

‘ ফার্মেসীর দোকান তো আরো সামনে। এই লোক ফিরে কেনো যাচ্ছে? আশ্চর্য! ‘

চলবে…