হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো পর্ব-০৫

0
206

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ০৫

রাতের আকাশে চাঁদ নেই।তবুও চারিদিক উজ্জল।ঐ তো গুটিকয়েক তাঁরা মিটমিট করছে।পুরো শহর আলোকোজ্জ্বল বলে চাঁদের অনুপস্থিতি কাউকে ভাবাচ্ছে না।কেউ লক্ষ্য করছে না চাঁদের অভিমান।সংকল্প বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেও সে না দেখার অভিনয় করে থাকে।আবার অনেকসময় মনে হয় সে যা ভাবছে তা মনে ভূল ধারণা।সে নিজেই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে।তখনই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছন ফেরে।সম্বোধন করে উঠে বলে,
“আব্বু!কখন এলে?”
“অনেকক্ষণ।কিছু ভাবছিলে?” রেলিং এ হাত রেখে বলেন শাহআলম সাহেব।

“না আব্বু,তেমন কিছু নয়।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সংকল্প।
“তোমার রহিমকে মনে আছে?আমার ছোট বেলার বন্ধু?”
“অস্ট্রেলিয়ায় স্বপরিবারে থাকেন যে?”ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে সংকল্প।
“হ্যাঁ,ও পুরো পরিবার নিয়ে দেশে ফিরেছে একমাস হলো।আমাকে অনেকদিন বলেছে যাওয়ার জন্য।কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি।তবে কালকে নিমন্ত্রণ করেছে,যেতেই হবে।”

“ওহ!ভালো তো।গিয়ে ঘুরে আসো।” আকাশে দৃষ্টি রেখে বলে সংকল্প।
শাহআলম সাহেব বললেন,
“তুমিও যাবা আমার সাথে।শোনো!”
“বলো।”

শাহআলম সাহেব অদূরের ঐ রাস্তাটার দিকে চোখ রেখে বললেন,
“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো,সংকল্প?”

সংকল্প চকিতে বাবার দিকে তাকালো।অবাক হয়ে শোধালো,
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেনো,আব্বু?”

শাহআলম সাহেব ছেলের দিলে তাকালেন।বললেন,
“যা জিজ্ঞাসা করেছি তার উত্তর দাও।”

সংকল্প সাথে সাথেই কিছু বললো না।চুপ করে রইলো।সময় নিলো।ভালোবাসা শব্দটি শুনতেই মানসপটে প্রতিজ্ঞার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো।কিন্তু সে তো প্রতিজ্ঞাকে ভালোবাসে না।আর না তো প্রতিজ্ঞা তাকে ভালোবাসে।ভালোবাসলে হয়তো এতোদিনে সে জানতে পারতো।তাদের সম্পর্ক নেহাতই আর পাঁচটা শিক্ষক-ছাত্রীর মতোই।
সে আর কিছু ভাবলো না,ভাবতে চাইলো না।
গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
“না আব্বু,এমন কেউ নেই।”

শাহআলম সাহেবের চেহারায় প্রসন্নতা।ছেলের উত্তর শুনে খুশি হয়েছেন হয়তো।তিনি বললেন,
“রহিমের মেয়ে রাইমাকে মনে আছে তোমার?”
“মনে আছে।কিন্তু এসব কেনো জিজ্ঞাসা করছো?”
“রহিম ওর মেয়ের সাথে তোমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব রেখেছে আমার কাছে।আমার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো এই বিয়েটা হোক।কিন্তু রহিম সপরিবারে বিদেশ চলে যাওয়ায় আর প্রস্তাব রাখা হয়নি।এইবার দেশে এসেই ও আমার কাছে তোমাকে চেয়েছে। আমি না করতে পারিনি।প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়েছি।”

বাবার কথায় যেনো সংকল্পের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।সে রাগী,গম্ভীর হলেও মা বাবার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না।এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।শুধু বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আমার মতামত না নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?একটা মেয়েকে সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছি।তারপর আর দেখি নি,কথা হয় নি কোনোদিন। তার আচার-আচরণ কেমন তাও জানি না।বিয়েতে তার মত আছে কিনা সেটাও অজানা।বিয়ে সারাজীবনের প্রশ্ন বাবা।এভাবে হুট করে কিছু হয় না।”

শাহআলম সাহেব কন্ঠ কঠিন করলেন।বললেন,
“মেয়ে রাজি না থাকলে রহিম কেনো আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে?তাছাড়া তুমি তো বললেই তোমার জীবনে কেউ নেই।কাউকে ভালোবাসো না তুমি।তাহলে সমস্যা কোথায়?”

সংকল্প উত্তেজিত হয়ে বলললো,
“ভালোবাসি না বলে এমন না যে যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলবো।…

আরো কিছু বলার আগেই পেছন থেকে সংকল্পের মা কঠিন স্বরে বলে উঠলেন,
” এই বিয়ে হবে না,হতে পারে না।”

বাবা-ছেলে দু’জনই পেছনে নজর দিলো।শাহআলম সাহেব গমগম করে বললেন,
“আড়ি পাতছিলে তুমি?”
জাহানারা বেগম ধমকে উঠলেন।বললেন,
“রাখো তোমার আড়িপাতা।আমার, আমার ছেলের সাথে পরামর্শ ছাড়াই তুমি আমার ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছো।আবার বলো আড়িপাতা?এই বিয়ে হবে না।ঐ মেয়ে এতোবছর বিদেশে থেকেছে।ওর আদব-কায়দা, চাল-চলন সব আলাদা।ঐ মেয়ে অনেক বেলাল্লাপনাও করে।আমি শুনেছি।এই বিয়ে আমি মেনে নিবো না।”

শাহআলম সাহেব রেগে গেলেন।রাগান্বিত হয়ে বললেন,
“তোমার থেকে পারমিশন চাই নি, আর না চেয়েছি পরামর্শ। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি মানে বিয়েটা হবেই।দেখি তুমি কিভাবে আটকাও!”

তারপর সংকল্পকে উদ্দেশ্য করে থমথমে গলায় বললেন,
“সংকল্প আশা করি তুমি আমার প্রতিশ্রুতিকে অমর্যাদা করবে না।অন্যের সামনে আমার মাথা হেট হোক তুৃমি চাইবে না।যা বললাম মনে রেখো!নাহয় আমার মরা মুখ দেখবে।অন্যকারোর সামনে মাথানত করার চেয়ে মৃত্যু ঢের ভালো।”

বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শাহআলম সাহেব।
সংকল্প আর জাহানারা বেগম বিস্ময় নিয়ে তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।জাহানারা বেগমের চোখে পানি।তিনি তো চেয়েছিলেন প্রতিজ্ঞাকে এইবাড়ির বউ করবেন।কিন্তু নিজের ইচ্ছে প্রকাশের আগেই কি হয়ে গেলো এসব!সংকল্প নিশ্চুপ হয়ে রইলো।জীবন ছেলেখেলা নয়।সেখানে তার বাবা কি বলে গেলেন!বাবা কি ছেলে মানুষ হয়ে গেলেন?বাবাকে এমন ছেলেমানুষী মানায় না।

জাহানারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে গেলেন,
“এই বিয়ে করিস না।যেনো তেনো প্রকারে বিয়ে আটকা।নাহয় সর্বনাশ হয়ে যাবে।আমার সংসারটা তচনচ হয়ে যাবে।”
জাহানারা বেগমও চলে গেলেন। একদিকে স্বামীর প্রতিশ্রুতি অন্যদিকে প্রতিজ্ঞা।তিনি তো প্রতিজ্ঞাকে কতবার বলেছেন,
“আমি তোকে আমার ছেলের বউ করে আনবো, দেখিস।”
প্রতিজ্ঞাও বিপরীতে মুচকি হাসতো।আর বলতো,
“আমি কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম।”

সব ভাবতেই জাহানারা বেগম অস্থির হয়ে উঠলেন।কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিজ্ঞাকে সব জানাবেন,খুব শীঘ্রই।

মা-বাবা দুজনই চলে গেলেন।সংকল্পকে রেখে গেলেন দোটানায়।মনের কোথাও না কোথাও প্রস্ফুটিত প্রেম পুষ্প কি কলি হওয়ার আগেই নিঃশেষ হয়ে যাবে, তাহলে?বাবাকে বুঝাতে হবে।কিন্তু ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর।বুঝানোর সময়টাও সে পাবে না কে জানতো!সারারাত তার বেলকনিতেই কেটে গেলো।

ওদিকে সাবিহা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পেলো না।

রাইমা চৌধুরী দশ বছর বয়সে মা-বাবার সাথে পাড়ি দেয় সূদুর অস্ট্রেলিয়ায়।তারপর আর দেশে আসা হয় নি।ঐ দেশের সংস্কৃতি, আদব-কায়দাতেই রাইমার বড় হয়ে উঠা।অতি-আধুনিকা বলা চলে তাকে।মা-বাবার আদরে বাঁদর হয়ে উচ্ছন্নে গেছে সে।অস্ট্রেলিয়ায় ফ্রাঞ্চিস নামক এক বিধর্মী ছেলের সাথে তার দুই বছরের সম্পর্ক।তার বাবা-মা মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ভুল বুঝিয়ে দেশে নিয়ে এসেছেন।বাবা-মার একমাত্র মেয়ে বলে সে অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে।এই অবাধ স্বাধীনতাই যে কখন মেয়েকে বিপথে নিয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারে নি রাইমার মা-বাবা।যখন বুঝলেন তখন রাইমা হাতের বাহিরে চলে গেছে।রাইমা থেকে হয়ে উঠেছে রেম।রাইমা যখন বাবা-মাকে ফ্রাঞ্চিসের কথা জানায় তখন তারা নিষেধ করলে রাইমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুম*কি দেয়।তাই তার বাবা-মা বুদ্ধি করে তাকে দেশে নিয়ে এসে তার পাসপোর্ট, কাগজপত্র লুকিয়ে ফেলেন।তার বাবা তাকে বলে যে তারা আগে বাংলাদেশে গিয়ে ফ্রাঞ্চিস আর তার পরিবারকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাবেন।তারপর তাদের বিয়ে ঠিক করবেন।রাইমা বাবা-মার ফাঁদে পা দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।

আজকের আকাশটা সকাল থেকেই মেঘলা।তবে বৃষ্টির নামগন্ধও নেই।তবে একটু পর পর বজ্রপাত হচ্ছে।প্রতিজ্ঞার মনটা কোনো কারণ ছাড়াই সকাল থেকে খারাপ হয়ে আছে।মনটা কেন জানি খচখচ করছে।খারাপ কিছু হবে কি!এতোকিছু না ভেবে ভার্সিটি চলে গেলো।পরীক্ষা আছে আজকে একটা,নাহয় আজ বের হতে ইচ্ছে করছিলো না।পরীক্ষা শেষ হতে হতে দুপুর দুইটা বেজে যায়।ওরা সবাই একসাথে ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে।প্রতিজ্ঞার খচখচানিটা এখনো কমে নি,বাম চোখের পাতাটাও একটু পরপর লাফাচ্ছে।এসবে পাত্তা না দিয়ে সে সাবিহার দিকে নজর দিলো।সে জানে এসব কুসংস্কার।সাবিহাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মন খারাপ।প্রতিজ্ঞা সাবিহাকে ডাকলো।বললো,
“কিরে সাব্বু কি হয়েছে?মন খারাপ কেনো?”

সাবিহা মন খারাপ করে বললো,
“জানি না রে।সকালে মা কে দেখলাম মন খারাপ করে আছে।কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে নি।আমারও কেনো জানি মন খারাপ লাগছে।বুঝতে পারছি না।”

প্রতিজ্ঞা এবার সংকল্পের কথা জিজ্ঞাসা করলো।বললো,
“তোর ভাই আসে নি কেনো আজকে?শরীর খারাপ?”

সাবিহা পানি পান করতে করতে বললো,
“নাহ।বাবার এক ছোটবেলার বন্ধু সপরিবারে বিদেশ থেকে এসেছে।ঐখানেই বাবা ভাইকে নিয়ে গেছে।আমাকেও বলেছিলো যাওয়ার জন্য কিন্তু পরীক্ষার জন্য যেতে পারিনি।”

ছোট্ট করে “ওহ” বললো প্রতিজ্ঞা।বাকিরা এতোক্ষণ চুপচাপ তাদের কথা শুনছিলো।তারপর অনেকক্ষন তারা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

অন্যদিকে,রহিম সাহেব সংকল্পের বাবার থেকে মেয়ের কীর্তিকলাপ লুকিয়েছেন।শাহআলম সাহেব এবং সংকল্প রাইমাদের বাড়িতে এসে দেখতে পায় অনেক লোকজন।যেনো ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান বাড়ি। সংকল্প এতো আয়োজন দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেই নিজেকে বুঝায় এতোবছর পর দেশে ফেরায় হয়তো সকল আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করেছে।কিন্তু তার ভাবনায় এক বোতল পেট্রোল ঢেলে দেয় তার বাবা।তিনি সংকল্পকে আলাদা করে ডেকে বললেন,
“আজকে তোমার বিয়ে রাইমার সাথে।”
“কী!”

সংকল্প যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না।মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।উত্তেজিত হয়ে কঠিন স্বরে বললো,
“বাবা তুমি কিসব বলছো?এভাবে বিয়ে?আমি কি বাচ্চা? যা খুশি তা করবা আমাকে দিয়ে।মা- বোন,বাড়ির সবাইকে ছাড়া বিয়ে? এভাবে কিছু হয় না বাবা। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না বাবা।ক্ষমা করো।”

বলে সংকল্প চলে যেতে নিলেই শাহআলম সাহেব কন্ঠস্বর কঠিন করে বললেন,
“আমি কখনো কারো সামনে মাথা নিচু করি নি।আজও করবো না।তুমি বিয়ের না করে চলে গেলে আমার মৃত দেহ বাড়িতে ঢুকবে।আর তোমার মা!তোমার মা বাঁধা দিবে বলেই আমি তাকে কিছু জানাই নি।সারাজীবন যা চেয়েছো, তাই করেছো।এবার আমার কথা রাখো।আশা করি,আমার মাথা হেট হবে এমন কোনো কাজ তুমি করবে না।”

বাবার কথার পিছে আর কিছু বলতে পারলো না সংকল্প।চোখের সামনে প্রতিজ্ঞার চেহারাটা ভাসছে।সে বুঝে উঠতে পারছে না,কেনো এমন হচ্ছে! সে কি পছন্দ করা শুরু করেছিলো প্রতিজ্ঞাকে!

অন্যদিকে,রাইমা দু’বার পালাতে গিয়েও ধরা পরে গিয়েছে।বাংলাদেশের কিছুই সে চেনে না,কাউকে সে চেনে না।তারউপর তার বাবা তার ফোন,তার পাসপোর্ট লুকিয়ে ফেলেছে। তার হাতে সামান্য ক্যাশ থাকলেও সেগুলো দিয়ে কিছুই হবে না।সে অনেক চেষ্টা করেছিলো সংকল্পের সাথে কথা বলার।কিন্তু সে ব্যর্থ হয়েছে।বাবা- মা বলে দিয়েছে,মানুষের সামনে সিন ক্রিয়েট করলে তাকে ত্যায্য কন্যা করবে।তাতে রাইমার-ই ক্ষতি,না বাংলাদেশে একা থাকতে পারবে আর না অস্ট্রেলিয়া যেতে পারবে। তাই সে পরিকল্প করে ফেলে বিয়ের পর সে কোনোভাবে পাসপোর্ট পেয়ে গেলেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে।এই বিয়েটা তার কাছে একটা খেলার মতো।

সংকল্পের পাশে বধূবেশে বসে আছে অতীব সুন্দরী রমণী।সৌন্দর্য দিয়ে সে যে কারো নজরকাড়তে পারবে।কিন্তু সংকল্প একবার তাকিয়ে আর তাকায় নি।ইচ্ছে করে নি।মানসপটে প্রতিজ্ঞার হাসিমুখের প্রতিচ্ছবি, কানে প্রতিজ্ঞার সুর ভাসছে।কাজী তাকে কবুল বলতে বললে তার ধ্যান ভাঙ্গে।অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সে কবুল বলে ফেলে।ইচ্ছে করছিলো সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে।কিন্তু বাবার মুখেের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে নি সে।তাছাড়া সে তো প্রতিজ্ঞাকে ভালোবাসে না,ভালো লাগে।ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য।এছাড়া,তার জন্য প্রতিজ্ঞার অনুভূতি সম্পর্কেও সে অবগত নয়।এমন ওতো হতে পারে প্রতিজ্ঞা তাকে শিক্ষকের চোখেই দেখে।তাই সবটাই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয় সংকল্প।জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সৃষ্টিকর্তার হাতে।বিধাতা হয়তো এমন কিছুই চেয়েছিলেন।

বিষন্নতায় ঘেরা সন্ধ্যাবেলা।আকাশের কালো মেঘ এখনো কাটেনি।ঝড় হবে,কালবৈশাখী ঝড়।সবকিছু লন্ডভন্ড দিবে যেমন আজকে কয়েকটা জীবন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।আহমেদ মেনশনে এখন হুলস্থুল কান্ড।শাহআলম সাহেব ছেলে,ছেলের বউসহ উপস্থিত হয়েছেন।জাহানারা বেগম দেখামাত্রই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারেন নি।সাবিহার মাথা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। ভাইকে উদ্দেশ্য করে শুধু একটা কথাই বললো,
“ভাই তুই এটা কি করলি?আমি প্রতিজ্ঞাকে কি জবাব দিবো?”

সংকল্প তখন ছিলো প্রতিক্রিয়াহীন,যেনো যন্ত্রমানব।বোনের একটা বাক্যে সে অনেক কিছু বুঝে গিয়েছে।কিন্ত তার কিছু করার নেই।সে জানতো না।সে এখন বিবাহিত।শুধু মনে মনে এতোটুকুই বললো,
“তুমি বড্ড দেরী করে ফেললে প্রতিজ্ঞা!”

জাহানারা বেগম অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় মাধুরি বেগম বধূবরণ করলেন।তার স্বামী ব্যবসার কাজে বাহিরে আছেন।বাড়ির কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি শাহআলম সাহেবের মাথায় এসব চলছিলো।ভাসুরের মুখের উপর মাধুরী কিছু বলতে পারলেন না।

বধূবরণ শেষে রাইমাকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে জাহানারা বেগমকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।তার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।সাবিহা মাকে সামলাবে নাকি প্রতিজ্ঞাকে ফোন দিবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।ফোন দিয়ে কি বলবে তাকে?যে তার এতোবছরের ভালোবাসার মানুষটা তার ভালোবাসা জানার আগেই বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এসেছে!

দোনোমোনো করে কাঁদতে কাঁদতে প্রতিজ্ঞাকে ফোন করে সাবিহা।সাথে সাথেই রিসিভ হয় কলটা।কিন্তু সাবিহা কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না।প্রতিজ্ঞা হতভম্ব হয়ে যায়।অস্থির হয়ে বলে,
“সাব্বু কি হয়েছে?কাঁদছিস কেনো?শরীর ঠিক আছে?বাড়ির কারোর কিছু হয়েছে?”

সাবিহা হিচকি তুলতে তুলতে বলে,
“না।”
“তাহলে?কি হয়েছে বল?”
“দুপুরে বলেছিলাম না বাবা ভাইকে নিয়ে উনার বন্ধুর বাড়ি গিয়েছে? সেখানে বাবা ভাইয়ের সাথে উনার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
বলে আবার কাঁদতে শুরু করে সাবিহা।
বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই যেনো প্রতিজ্ঞার মস্তিষ্কে বিস্ফো*রণ ঘটলো।চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো।সাবিহার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না।নিজেকে ধাতস্থ করে থেমে থেমে বলে,

“তুই আমার সাথে প্রাংক করছিস সাবিহা?অন্যসব বিষয় নিয়ে প্রাংক কর,কিন্তু সংকল্পকে নিয়ে করিস না।জানিস তো সহ্য করতে পারি না।”

প্রতিজ্ঞার কথা শুনে সাবিহার কান্নারবেগ আরো বেড়ে গেলো।বলতে লাগলো,
” আমি সত্যি বলছি রে প্রিতু।মা অজ্ঞান হয়ে গেছে এসব দেখে।বাসার কেউ জানতো না।এমনকি ভাইও জানতো না।”

প্রতিজ্ঞা থমথমে গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
“তোর ভাই কোথায় এখন?”
“ড্রয়িং রুমে বউকে বসিয়ে রেখে মায়ের কাছে গিয়েছে।”
“আচ্ছা!”
বলে ফোন কেটে দেয় প্রতিজ্ঞা।মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেছে।নববর্ষের দিন সাব্বিরের বলা কথাগুলো কানে বাজছে।
আসলেই সময় নিষ্ঠুর।কখন কি হয়,তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানে না,কেউ না।পরিকল্পনামাফিক কিছু হয় না।কিছু ভালোবাসা জলন্ত শিখার মতো,প্রকৃতি মেনে না।এক দমকা হাওয়ায় সব উলট পালট করে দিলো।
আকাশেও ঝড় উঠেছে,তচনচ করে দিচ্ছে সব।প্রতিজ্ঞার জীবনেও ঝড় উঠেছে।সে এক চিৎকার দিয়ে টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা ছুঁড়ে মা*রলো।

#চলবে…..