হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো পর্ব-১২+১৩

0
239

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ১২

ধরণীর বুকে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে।সংকল্পের নিজের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।এখান থেকে পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা সুন্দর করে দেখা যায়।তার মায়ের অনেক পছন্দের গাছটা।অনেক পুরনো।যখন তিনি এবাড়িতে বউ হয়ে আসেন তখন নিজ হাতে এখানটায় গাছটা লাগিয়েছিলেন।সেই ছোট্ট চারাটা আজ বিশাল জায়গাজুড়ে নিজের দাপট ছড়াচ্ছে। আর এই দাপটে মুগ্ধ হচ্ছে কত মানুষ। নিজের ঘরে কারো অনুপস্থিতি টের পেয়ে পেচন ফিরে তাকায় সে।রাইমা এসেছে।নক্ করতে যাচ্ছিলো তখনই সংকল্প গলা উচিয়ে বললো,
“নক্ করা লাগবে না চলে এসো।”

রাইমা চমৎকার হাসলো।এগিয়ে গেলো।দাঁড়ালো সংকল্পের পাশে যথেষ্ট দুরত্ব রেখে।তার নজর ঐ কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে।এ বাড়িতে আসার পর এই গাছটা তার অনেক প্রিয় হয়ে উঠেছে।বেশিরভাগ সময়ই এই গাছটার নিচে কাটে।মাধূরী বেগম ছাড়া বাড়ির লোক তো তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।তবে রাহিব-সাহিবের সাথে তার বেশ খাতির হয়েছে।চকলেটের লোভ দেখিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করেছে সে।বাড়ির বাহিরে তেমন বের হয় না রাইমা।একা একা কোথায় না কোথায় চলে যায়।তবে কিছু কিছু জায়গা তার চেনা হয়েছে। একা একা-ই চিনতে হয়েছে।নয়তো উপায় নেই।

সংকল্প হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,
“হসপিটালে গিয়েছিলে কেনো?”

রাইমা এই প্রশ্ন আশা করে নি।তার মুখে ভয়ের আভাস।ভয় লুকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
“তুমি দেখেছো?তুমি গিয়েছিলে নাকি?”

সংকল্প আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“হুম, গিয়েছিলাম।প্রতিজ্ঞার সাথে দেখা করতে।”
“ওহ!দেখা হয়েছে? ”
“হয়েছে।কিন্তু এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়!”
রাইমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো সংকল্প।
রাইমা চোখ সরিয়ে নিলো।জোরপূর্বক হেঁসে বলো,
“নাথিং সিরিয়াস,নরমাল চেক্ আপ।”
“সিউর?”
“ইয়েস,ডোন্ট ওয়ারি।”
জোরপূর্বক হেঁসে বললো রাইমা।

সংকল্পের যেনো বিশ্বাস হলো না।সে এখনো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে আজ রাইমাকে হসপিটালের বাহিরে দেখেছে।প্রতিজ্ঞার সাথে দেখা করে সংকল্প যখন নিজের গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিলো তখনই রািমার গাড়ি হসপিটাল ত্যাগ করে।সন্দেহে সৃষ্টি হয়।আরো টুকটাক কথা বলে রাইমা চলে যায় নিজের ঘরে।সংকল্পের মনে হলো রাইমা যেনো পালিয়ে বাঁচলো।আবার,বিদেশীরা প্রতি সপ্তাহে চেক্ আপ করেই থাকে।তাই এতো মাথা ঘামালো না।গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে তো রাইমা জানাতোই।যতই হোক,এই বাড়িতে সেই রাইমার ভরসা।রাইমা সবই বলে তাকে।

সময় দৌড়ছে।ধরতে পারছে না কেউ।তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে।দেখতে দেখতে আরো দুই মাস পার হয়ে গেছে।প্রতিজ্ঞা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।তবে আগের চাঞ্চল্যতা এখন আর নেই।গম্ভীর স্বভাবের হয়ে গেছে।এখন সে নিয়মিত ভার্সিটি যায়।সংকল্পের সাথে নিয়মিত দেখা হয়।তবে সে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।পুরো ঘা যে জেগে উঠে ঐ লোকটাকে দেখলে।লোকটার সামনে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখে।বেড়েছে বন্ধুদের সাথেও দূরত্ব।যতটুকু কথা না বললেই নয়,ততটুকুই বলে।প্রয়োজনের বেশি একটা শব্দও মুখে আনে না।সংকল্প মেয়েটার অবস্থা বুঝতে পারে বিধায় এখন আর ঘাটায় না।কয়েকটা দিন যাক তারপর সে সব ঠিক করবে।

আজ ছুটির দিন।সংকল্প বাড়ির ড্রাইনিং এ বসে আছে।দেরীতে ঘুম থেকে উঠেছে সে,ঠিক এগারোটায়।এতোক্ষণে সকালের খাবার খেতে বসেছে।তার পাশেই সাবিহা বসে ফোন স্ক্রল করছে।তার মা-চাচী রান্নাঘরে।খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
“রাইমা কোথায়?খেয়েছে ও?”

সংকল্পের প্রশ্নে ভাবান্তর দেখা গেলো না সাবিহার।জাহানারা বেগম ছেলের দিকে চোখ তুলে চেয়ে আবার নামিয়ে নিলেন।কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।মাধূরী বেগম জা কে দেখছে।এর মধ্যেই জাহানারা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“অনেকক্ষণ আগে বেরিয়েছে।”
“কোথায় গিয়েছে? ” মাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো।
“বলে বেরিয়েছে এটাই অনেক।কোথায় গিয়েছে নিজেও বলে নি,আমিও জিজ্ঞাসা করিনি।” কাজ করতে করতেই বললেন জাহানারা বেগম।
“তোমার বউ তোমাকে বলে বের হয় নি?” খোঁচা মেরে বললো সাবিহা।

সংকল্প বোনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো।এতে হেলদোল নেই সাবিহার।সংকল্প স্বাভাবিকভাবে বললো,
“ওর সাথে আমার কেমন সম্পর্ক ভালো করেই জানিস।উল্টোপাল্টা বকিস না।”

সাবিহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠে।সাবিহা উঠে গিয়ে দরজা খুলে।একজন অপরিচিত মানুষ দাড়িয়ে আছে।বোঝা যাচ্ছে কিছু দিতে এসেছে।
সাবিহা ভদ্রতাবসত জানতে চাইলে লোকটি বলে,
“আফনান আহমেদ সংকল্প আছে?তার নামে একটা চিঠি এসেছে।”

নিজের নাম শুনে সংকল্প এগিয়ে আসে।সই করে চিঠিটা গ্রহণ করে।চিঠিটা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই।তাকে কে চিঠি পাঠাবে!খামটা খুলতে যাবে তার আগেই জাহানারা বেগম ধমকে উঠলেন।বললেন,
“খাবারটা শেষ করে তারপর খুলিস।”

সংকল্পও খাওয়া শেষ করে চিঠিটা খুলবে ভেবে রেখে দেয়।
খাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে যেই চিঠিটা খুলতে যাবে তখনই তার ফোনটা নিজ আপন ছন্দে বাজতে শুরু করে।অপরিচিত নাম্বার দেখে অবাক হয়।রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ঐ পাশ থেকে অপরিচিত নারী কন্ঠ ভেসে আসে,
“আফনান আহমেদ সংকল্প বলছেন?”
“জ্বী,আপনি কে?”
“আমি সিটি হসপিটালের রিসিপশনিস্ট।আপনার স্ত্রী রাইমা আহমেদ মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছেন।এখন হসপিটালে ভর্তি আছেন।তার অবস্থা শোচনীয়।যথাসম্ভব হসপিটালে চলে আসুন।”

আর কিছু বলতে পারলো না সংকল্প।চিঠিটা খাটের উপরই পরে থাকে। আর খোলা হয় না।সে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।বারবার মেয়েটার চেহারা ভেসে উঠছে।মেয়েটা তার সাথে সবসময়ই ভালো ব্যবহার করতো।নিচে গিয়ে সবাইকে সবকিছু জানায়।তারপর বেরিয়ে পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

হাসপাতালে এসে দেখে রোগীর অবস্থা শোচনীয় বলে তাকে ওটিতে পাঠানো হয়েছে।হঠাৎ চোখ যায় ওটির সামনের করিডোরে।করিডোরে থাকা বেঞ্চে একটা অতিপরিচিত মানবী বসে আছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।মানবী দু’হাত মুঠো বন্দী করে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে।
“প্রতিজ্ঞা!তুমি এখানে?”

প্রতিজ্ঞা মুখ তুলে চায়।তখনই পাশ থেকে রিসিপশনিস্ট এসে বললো,
“উনি ই-তো আপনার স্ত্রীকে এডমিট করিয়েছেন।এমনকি আপনার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ,আপনারা আসতে দেরী করছিলেন বলে উনি নিজ দায়িত্বে বন্ডে সাইন করেছেন।”

প্রতিজ্ঞা আর কিছু বলে না।বলার প্রয়োজন মনে করে না।রিসিপশনিস্ট আরো কিছু বলে চলে যায়।সংকল্প প্রতিজ্ঞার পাশে বসে। শান্ত কন্ঠে বলে,
“কি করে হলো এসব?কোথায় পেলে রাইমাকে?”

প্রতিজ্ঞা সাথে সাথেই কিছু বলে না।নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“আমি জানি না কিভাবে হলো।আজ একাই বেরিয়েছিলাম।রাস্তায় জ্যামে আটকে পড়েছিলাম।বাহিরের মানুষদের থেকে শুনলাম একটা ট্রাকের সাথে প্রাইভেট কারের ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই জ্যাম।ট্রাক ড্রাইভার পালিয়ে যায়।কারে একটা মেয়ে ছিলো।তার অবস্থা শোচনীয় বিধায় কেউ সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না।তাই পুলিশ আসতে যতক্ষণ লাগে এই জ্যাম থাকবে।আমার কেমন জানি লাগলো।আমি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এক্সিডেন্ট স্পটে গেলাম।অনেক ভীড়।ভীড় ঠেলে দেখি রাইমাপু রক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।কেউ সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না।তারপর লোকজনের সাহায্যে আমিই এখানে এনেছি।ডাক্তার জানান যেকোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। তাই আমি আর আপনাদের অপেক্ষা করি নি।নিজেই বন্ডে সাইন করেছি।”

একনিঃশ্বাসে বলা শেষ করলো সে।এতোক্ষণে রাইমার বাবা-মা,সংকল্পের বাবা-মা,চাচা-চাচী,সাবিহা হাসপাতালে চলে এসেছে।সবার চোখে জল।সাবিহা,জাহানারা বপগমের চোখেও জল।যতই তারা মেয়েটাকে মেনে না নিক,কিন্তু সে তো তাদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন।

অনেকক্ষণ পরে অপারেশন থিয়েটারের ঐ লাল বাতিটা নিভে।ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।তিনি জানান,
“হাত ভেঙ্গেছে।মাথায় ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে।তবে সেটা ভয়াবহ কিছু নয়।মেইন প্রবলেম হচ্ছে,পেশেন্ট হার্ট অ্যাট্যাক করে ফেলেছেন।এমনিতেই আপনারা জানেন উনার হার্টে প্রবলেম।এখন হার্ট অ্যাটাক!আমরা এখনই কিছু বলতে পারছি না।”

সংকল্পের চোখে-মুখে প্রশ্নের ছাপ।বিস্ময় নিয়ে শোধালো,
“হার্টে প্রবলেম মানে কি হয়েছে?”

ডাক্তার যেনো কিছুটা আশ্চর্য হলেন।বললেন,
“আপনারা কিছু জানেন না?”
“কি জানার কথা বলছেন?পরিষ্কার ভাবে বলুন।”
গম্ভীর কন্ঠে বললেন শাহআলম সাহেব।

ডাক্তার বললেন,
“পেশেন্টের হার্টে ছিদ্র আছে।তাছাড়া অ্যারিথমিয়াও আছে তার।অনিয়মিত হৃদস্পন্দন।তার হৃদপিণ্ড সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না।এই রোগীর তো ট্রিটমেন্ট ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব না।আর আপনারা বলছেন কিছুই জানেন না!স্ট্রেঞ্জ!”

তখনই পেছন থেকে রহিম চৌধুরী, রাইমার বাবা থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
“ওর ট্রিটমেন্ট চলছিলো।কিছুদিন পর হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো।”

এই একটা কথা যথেষ্ট ছিলো বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের জন্য।এই বিষয়ে সংকল্পের পরিবার জানতো না,জানানো হয় নি।সংকল্প এতোদিতে সব হিসেব মিলালো।এরজন্যই রাইমা হসপিটালে এসেছিলো সেদিন।এরজন্যই ঐদিন তার চেহারার রং পাল্টে গেলো।উপস্থিত সবাই বিস্ময়ের সহিত তাকিয়ে আছে রহিম সাহেবের দিকে।
শাহআলম সাহেব এগিয়ে গেলেন তার দিকে।চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“এতো বড় বিষয়টা গোপন করলি কিভাবে?আমি সবার অমতে,অজানায় জোর করে আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম তোর মেয়ের সাথে।এর এই প্রতিদান দিলি?এই দু’মাসে তো জানাতে পারতি!”

রহিম সাহেব মাথা নিচু করে ফেললেন।কি বলার আছে তার!
শাহআলম সাহেব আবার চিৎকার করে বললেন,
“তোর মেয়ের সব বেলাল্লাপনার কথা আমি জেনেও চুপ করেছিলাম। তোর মেয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলো।পুরনো প্রেমিকের কাছে।সব আমি জেনেছি বিয়ের পর।তাও তোকে কিছু বলিনি!এতো বড় সত্যিটা কিভাবে পারলি লুকাতে?আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিলি।”

সবার অবস্থা থমথমে।শাহআলম সাহেব বুকে হাত দিয়ে পরে যেতে নিলে সংকল্প বাবাকে ধরে ফেললো।শাহআলম সাহেব ছেলের কাছে ক্ষমা চাইলেন।করুণ কন্ঠে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস তোরা।তোদের অমতে সব করেছিলাম আমি।বন্ধুর কথায় আমি মশগুল ছিলাম।কারো কথা ভাবি নি।মতামতের প্রয়োজন মনে করি নি।”

তারপর প্রতিজ্ঞাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“প্রতিজ্ঞা মা!আমাকে ক্ষমা করে দিও।তোমার জীবনের সব ঝড় আমার জন্য এসেছে।আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

বলতে বলতে শাহআলম সাহেব অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
জাহানারা বেগম, সাবিহা পাশেই উনাকে ধরে বসেছিলো।কান্নাদের গতিবেগ বেড়ে গেলো।প্রতিজ্ঞার কোনো হেলদোল নেই।সে তো ব্যস্ত ভাগ্যের পরিহাস দেখতে।

শাহআলম সাহেবের ভাই ডাক্তার ডাকলেন।সবাই ধরাধরি করে শাহআলম সাহেবকে কেবিনে নিয়ে গেলেন।

সংকল্প রহিম চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে শুরু একটা কথা-ই বললেন,
“জীবন হেয়ালি করার বিষয় নয় আঙ্কেল।আপনাদের এই হতবুদ্ধিতার জন্য কত্তগুলো জীবন নষ্ট হয়েছে আপনাদের কোনো আইডিয়া নেই।”

তখনই রাইমার ডাক্তার এসে জানায়,
“পেশেন্টের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে।নাহয় যেকোনো সময় সে পৃথিবী ত্যাগ করতে পারে।তার হাতে সময় খুব কম।”

#চলবে….

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ১৩

হাসপাতালে থমথমে পরিবেশ।সময় পেরিয়েছে কয়েক ঘন্টা। শাহআলম সাহেব মাইনর স্ট্রোক করেছেন।এখন অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে।স্যালাইন চলছে।রাইমার শারিরীক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে।হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করতে পারছে না।ডাক্তার হার্টের জন্য তাড়া দিচ্ছেন।এই হাসপাতালে গত কয়েকঘন্টার মধ্যে কোনো রোগী মা*রা যায় নি।ফলস্বরূপ,অপারেশন শুরু করা যাচ্ছে না।এমনকি আশপাশের অনেক হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া হয়েছে গত কয়েক ঘন্টায় মা*রা যাওয়া কোনো লা*শ নেই। যেসব মৃত দেহ পাওয়া গেছে ঐগুলোর বয়স একদিন,দুইদিন এমন।দাতা হার্ট মৃত্যুর ছয় ঘন্টার মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে হয়।কিন্তু হার্ট পাওয়া যাচ্ছে না।রাইমার মা-বাবার আহাজারিতে পুরো হসপিটাল থমথমে।সংকল্পের পরিবারের সবাই তাদেরকে অনেক কথা শুনিয়েছে।কিন্তু এমন পরিবেশে এসব কথা তারা গায়ে মাখেন নি।মেয়ে তো মৃত্যুর দোরগোড়ায়।

তখনই ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন।সংকল্পকে বললেন,
“আপনারা কিছু ব্যবস্থা করতে পেরেছেন?”

সংকল্প মাথা নত করে রেখেছে।সেও অনেক খোঁজ নিয়েছে।কিন্তু এই সময়ের মধ্যে মা*রা যাওয়া কোনো ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায় নি।
সংকল্প মাথা নত করেই বললো,
“পাই নি।”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ডাক্তার এবং সংকল্প উভয়েরই।
ডাক্তার বিপরীতে বললেন,
“দ্যান উই আর স্যরি।এখন পেশেন্টের মৃত্যুর অপেক্ষা।”

কথাটা যেনো হাসপাতালের করিডোরে বিস্ফোরণ সৃষ্টি করলো।মানুষ মরণশীল।একদিন মর*তে হবেই।তাই বলে একটা মানুষ চোখের সামনে এভাবে মা রা যাবে!এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

প্রতিজ্ঞা এখনো করিডোরেই বসে আছে।তার মাথায় চলছে ভিন্ন চিন্তা।মাথাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে।
ডাক্তার চলে যেতে নিলেই সে হুট করে বলে উঠে,
“আমি হার্ট দিবো।”

উপস্থিত সকলে চমকায়।বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে প্রতিজ্ঞার পানে।বিষয়টা বুঝতে সংকল্পের সময় লাগে।

ডাক্তার প্রতিজ্ঞাকে বলে,
“জীবিত মানুষ হার্ট দিতে পারে না।মাস্ট বি ব্রেন ডেথ।”

প্রতিজ্ঞা সাথে সাথে বলে উঠে,
“আপনারা তো ডাক্তার, আমাকে মে*রে ফেলতে আপনাদের কিছু সময়ের ব্যাপার।”
“এটা আইনগতভাবে অপরাধ।”

প্রতিজ্ঞা সাথে সাথে বলে,
“আমি বন্ডে সাইন করবো।আমার জীবন আমার ইচ্ছা।যেসব ডকুমেন্টস আছে সব আমি ফিল আপ করবো।আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।”

ডাক্তার অবাক হয়।বলেন,
“আপনি পাগ লামী করবেন না।আমরা দেখছি হার্ট পাওয়া যায় কিনা।শান্ত হোন।”

কিন্তু প্রতিজ্ঞা নিজের মধ্যে নেই।আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।অস্বাভাবিক আচরণ করছে।সেই হার্ট দিবে।একপর্যায়ে সংকল্প এসে তাকে থাপ্পড় মা*রে।চেঁচিয়ে বলে,

“আর ইউ আউট অব ইউর মাইন্ড?কি শুরু করেছো?সবকিছুতে নিজেকে জাহির করতে আসো কেনো?কেনো নাটক করছো?এখানে উপস্থিত মানুষগুলা তোমার নাটক দেখতে এসেছে?”

প্রতিজ্ঞার এতে খেয়াল নেই।সেও চেঁচিয়ে বলে,
“হ্যাঁ,পা গল হয়ে গেছি।আপনাকে বলি নি আমার নাটক দেখতে সরুন।”

বলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সংকল্পকে। তারপর ডাক্তারের কাছে যায়।ডাক্তার তাকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু সে বুঝতে নারাজ।একপর্যায়ে প্রতিজ্ঞা সামনে হুম*কি দেয়,
“যদি আমার হার্ট দেওয়ার ব্যবস্থা না করেন,তাহলে আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবো।”

অবস্থা বেগতিক দেখে সাবিহা প্রতিজ্ঞার মাকে ফোন করে সব জানায়।তিনি বলেছেন,কোনোমতে প্রতিজ্ঞাকে আটকাতে,তিনি প্রতিজ্ঞার কাউন্সিলরকে নিয়ে আসছেন।
সাথে প্রতিজ্ঞার কাউন্সিলরের নাম্বারও দিলেন সাবিহাকে।

সাবিহা কাউন্সিলরকে ফোন দিয়ে সব জানায়।প্রতিজ্ঞা উত্তেজিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করছে।কাউন্সিলর সব শুনে সাবিহাকে বলে ডাক্তারের কাছে ফোনটা দেওয়ার জন্য।সাবিহা ডাক্তারের কাছে ফোন দিলে কাউন্সিলর ডাক্তারের সাথে কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেন।

প্রতিজ্ঞা এখনো অস্বাভাবিক আচরণ করছে।ডাক্তার তখন প্রতিজ্ঞাকে শান্ত করতে বলেন,
“আমরা আপনার হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করবো।আমরা সার্জনের সাথে কথা বলছি।আপনি শান্ত হোন।”

তারপর নার্সকে ডেকে কিছু বললে নার্স প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে চলে যায়।

উপস্থিত সকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু ডাক্তার কিছু না বলে চলে যায়।সংকল্প থ মে*রে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।কি থেকে কি হচ্ছে সে কিছু অনুধাবন করতে পারছে না।

প্রতিজ্ঞা বেডে শুয়ে আছে,চোখদুটো উপরে ছাদে নিবদ্ধ।সংকল্প তার পাশে বসে আছে।সংকল্পের চোখে পানি।মানুষ ভালোবাসতে পারে,কিন্তু তাই বলে এমন!এমন ভালোবাসাকে কি বলে!কি নামে অ্যাখ্যায়িত করা যায়, সংকল্পের জানা নেই।এর মধ্যে সে অনেকবার প্রতিজ্ঞাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে,কিন্তু প্রতিজ্ঞা শুনতে নারাজ।সে তার সিদ্ধান্তে অটল।সংকল্প ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ডাক্তার ব্যস্ত।

সংকল্প ঢোক গিলে ছলছল চোখে বললো,
“নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না।তোমার পুরোটা জীবন বাকি।তুমি অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করো।নিজের জীবনে এগিয়ে যাও।এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসো।”

প্রতিজ্ঞা কিছুক্ষণ মৌন থেকে উপরে চোখ রেখেই বলতে শুরু করলো,

“এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সব এনটিটি আমি ইগ্নোর করে যেতে পারি শুধু আপনাকে ছাড়া।সেখানে মৃত্যু কোনো বড় কিছু নয়।তাছাড়া আপনার বুকে অন্য কাউকে দেখার চেয়ে আমার কাছে মৃত্যু বড় সুখের,বড়ই আনন্দের।সেখানে আপনার ভালোবাসার মানুষের মধ্যে আমার হৃদয় স্থাপন করা হবে।আমার হৃদয় আপনার হৃদয়ের সান্নিধ্যে আসবে।এর থেকে বড় পাওয়া আমার কাছে কি হতে পারে?আমার শরীর হয়তো আপনার স্পর্শ পাবে না,আপনার সংস্পর্শে আসবে না,আপনার আদর মাখানো স্পর্শ, ভালোবাসা পাবে না,আমার মাথা হয়তো আপনার বুকে ঠাঁই পাবে না,আমি হয়তো আপনার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শুনতে পারবো না, আমার অধরযুগল হয়তো আপনার অধরযুগলে বন্দি হবে না,আপনাকে নিয়ে দেখা এতো এতো স্বপ্ন হয়তো পূরণ হবে না।কিন্তু!কিন্তু,আমার হৃদয় তো আপনাকে পাবে,আমাদের হৃদয়ের মিলন হবে,এই সুযোগ আমি কিভাবে হাতছাড়া করি,বলুন সংকল্প?”

প্রতিজ্ঞা থেমে থেমে কথাগুলো বলে থামলো।সংকল্প টলমলে দৃষ্টিতে লাল চোখে চেয়ে আছে।তবে কিছু বললো না,চুপ করে রইলো।

প্রতিজ্ঞা ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করলো,
“আপনার স্থান আমার হৃদয়ে ছিলো,আছে আর সারাজীবন থাকবে।ওপস্ জীবন তো একটু পরেই শেষ,ফিনিশ,জীবনের দ্য এন্ড!”

শেষ বাক্য চয়নে প্রতিজ্ঞা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।আবার বলতে শুরু করলো,
“কিন্তু আমার হৃদয় স্পন্দিত হতে থাকবে আপনার ভালোবাসার মানুষের হৃদয়ে।আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন।এই মৃত্যু আমি সাদরে গ্রহণ করবো,সানন্দে বরণ করবো।”

এর মধ্যেই নার্স এসে ওয়ার্ড বয়দের তাড়া দিলো।বললো,

“তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন ওনাকে।ওটি রেডি করা আছে।”

ওয়ার্ডবয়রা স্ট্রেচারে ধরতে নিলেই প্রতিজ্ঞা সংকল্পকে করুণ স্বরে বললো,
“আবার একটা অনুরোধ রাখবেন?”
“আপ্রাণ চেষ্টা করবো।বলো!”
সংকল্প জানতে চাইলো।

প্রতিজ্ঞা বিপরীতে হাসলো।বললো,

“এতো কঠিন কিছু চাইবো না।ভালোবাসার মতো সহজ জিনিস চেয়েই পাইনি।আপনাকে একটু ছুঁই? আপনার হাতটা একটু ধরি?সবসময়ই চাইতাম মৃত্যুর সময় যেনো আপনাকে পাশে পাই।আপনার হাতে হাত ধরে পুরো দুনিয়া দেখার স্বপ্ন তো পূরণ হলো না,মৃত্যুর আগে নাহয় আপনার হাতটা ধরে মৃত্যু যাত্রাটা উপভোগ করি।ধরি?”

কথা শেষ হতে দেরী,সংকল্পের হাতে ধরে মাথা ঠেকাতে দেরী নেই।প্রতিজ্ঞার চেহারায় প্রশান্তির ছাপ।সে টের পেলো সংকল্প কাঁদছে। এর মধ্যেই সংকল্ক বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি তোমাকে নিজের করতে পারিনি…”
আরো কিছু বলতে নিলেই প্রতিজ্ঞা থামিয়ে দেয়।কথার পিছে বলে,
“সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।আমি হয়তো ভূল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।”

কথাটা শুনতেই সংকল্প অশ্রুভরা দৃষ্টিতে বিস্ময় নিয়ে তাকালো প্রতিজ্ঞার দিকে।প্রতিজ্ঞা হেঁসে বললো,

” আপনি আমাকে ভালো না বাসলেও, আমি ভালোবাসি আপনাকে।আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনিথিং।”

সংকল্প মাথানত করে ফেললো।প্রতিজ্ঞা ডাকলো,
“শুনোন!”
“বলো!” দৃষ্টি না তুলেই বললো সংকল্প।

“হে সখা,মম হৃদয়ে রহো।”

আবার,বললো,

“নিঃশব্দ অশ্রুপাতে অগণিত প্রহর কাটাইয়া অবশেষে সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে।”

সংকল্প তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি তুললো।

ওর্য়াড বয়রা এবং নার্স প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে যাচ্ছে।সংকল্প এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঐদিকে।তার মানসপটে প্রতিজ্ঞার সব কর্মকান্ড,পাগলামী সব ভেসে উঠছে।মেয়েটা তার জন্য জীবনটাই দিয়ে দিলো।বিপরীতে সে মেয়েটাকে দুঃখ ব্যতীত কিছু দিলো না।তার মস্তিষ্কে যেনো বারবার ঐ একটা বাক্যই আন্দোলিত হচ্ছে,

“হে সখা,মম হৃদয়ে রহো।”

চলবে….