হৈমন্তীকা পর্ব-৯+১০

0
522

হৈমন্তীকা

৯.
কোনো এক মাসের, কোনো এক শুক্রবার।
নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে মাত্র। সুদূর পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফরজের নামায আদায় করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় হৈমন্তী। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। রাবেয়া কিছু সংখ্যক গাছ ছাদেও লাগিয়েছেন। হৈমন্তী প্রতিদিন ভোর সকালে গিয়ে গাছে পানি দিয়ে আসতো। ছাদের পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতো পৃথিবীতে সূর্যের আগমন। কিন্তু তুষারের জ্বালায় তিন, চারদিন ধরে যাচ্ছে না সে। হৈমন্তীর সঙ্গে সঙ্গে তুষারও যে প্রতিদিন ভোর বেলা হাজির হয়ে যেত ছাদে। হৈমন্তীকে বিরক্ত করতে।
তবে আজ ছাদে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে হৈমন্তীর। সে ভাবে, এতদিন না আসায় তুষারও হয়তো আজ আসবে না। একা একা ছাদে সময় কাটানো যাবে। বাহিরে তখন শীতল বাতাসের সমাগম। হালকা শীত শীত আবহাওয়া। হৈমন্তী ওড়না রেখে ভারি একখানা চাদর জড়িয়ে নিলো দেহে। চোর-ডাকাতের মতো ভীরু পায়ে ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদে উঠল।

ছাদের একপাশে বসার জন্য দু’তিনটে বেঞ্চ রাখা। এর অপর পাশেই গাছগাছালির টব। হৈমন্তী ধীরস্থির ভাবে গাছে পানি দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পরপর দখিনা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। ভালো লাগছে তার। ভীষণ ভালো লাগছে। হঠাৎ অনুভূত হলো, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। যার ঘনঘন নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে হৈমন্তী। ঘাড়ে নিশ্বাসের অস্তিত্ব অনুভব করছে। অজানা ব্যক্তিটি এবার পুরুষালী কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে উঠল,
— “এসেছেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী চমকালো খুব। পেছনে ঘুরতেই তুষারের বিস্তর বুকের সঙ্গে নাকে বারি খেল। নাকে আলতো হাত বুলিয়ে দু’কদম পেছালো সে। জোড়ালো গলায় প্রশ্ন করলো,
— “আপনি এখানে?”
— “আমি তো প্রতিদিনই আসি হৈমন্তীকা। আপনিই লুকিয়ে বেড়ান।”

হৈমন্তী কি বলবে ভেবে পেল না। তুষার এখনো তার অনেকটা কাছে। হৈমন্তীর অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্থি ভরা কণ্ঠে সে বললো,
— “দূরে সরে দাঁড়ান তুষার।”
তুষার বিনা বাক্যে সরে দাঁড়ালো। ঠোঁটে তার সূক্ষ্ণ হাসি। হৈমন্তী সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো,
— “জ্বর কমেছে আপনার?”
— “নিজেই দেখুন।”

বলে খানিক ঝুঁকল তুষার। মুখ এগিয়ে হৈমন্তীর সামনা-সামনি ধরল। হৈমন্তী চোখ বড় বড় করে তাকালো। তুষারের নেত্রজোড়ায় দুষ্টুমি ভরপুর। কপালের বেন্ডেজ খুলে ফেলায় ক্ষত স্থানে লম্বাটে এক আঁচড় দৃশ্যমান। ঠোঁট অল্প শুষ্ক। তার চাহনি আরও গভীর হতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো হৈমন্তী। কেন যেন প্রচন্ড রাগ হলো তার। তুষারের বক্ষে হালকা জোড় প্রয়োগে ধাক্কা মারলো সে। তুষার পিছিয়ে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই তাকালো হৈমন্তীর দিকে। সে তখন পা চালিয়ে ছাদ থেকে চলে যাওয়ার উপক্রম করছে। তুষার পেছন থেকে ভীষণ শীতল, নিষ্প্রভ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি চান, তা কি আপনি জানেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী থমকালো। দাঁড়ালো কিছু সেকেন্ড। এরপর আগের ন্যায়ই ব্যস্ত পায়ে চলে গেল ছাদ থেকে।

_____

দুপুর থেকেই বিল্ডিংয়ের আশপাশে প্রচন্ড কোলাহলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তীব্র শব্দে দুপুরে ঘুমাতেও পারে নি হৈমন্তী। এবার সে বেজায় বিরক্ত। ছুটির দিনে যদি একটু ঘুমাতেই না পারে, তাহলে সেই ছুটি দিয়ে লাভ কি? তিক্ত মনে বিছানা ঝাড়ছিল হৈমন্তী। সেসময় রুমে হেমন্তর আগমন। বেশ ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাকে। এসেই ড্রয়ার থেকে কিছু একটা নিয়ে আবার চলে যেতে নিতেই হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে উঠল,
— “এই দাঁড়া, হেমন্ত। কই যাচ্ছিস?”
— “উফ! কাজ আছে। এখন ডাকিও না তো! পরে এসে বলবো।” বিরক্ত সহিত বললো হেমন্ত।

হৈমন্তী এগিয়ে এসে তার কান মলে ধরল। চোখ রাঙিয়ে ধমক দিয়ে উঠল,
— “তুই এখন বলবি, তোর ঘাড়ও এখন বলবে। এখন জলদি বল, এত ব্যস্ততা কিসের তোর?”
কান মলে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল হেমন্ত,
— “আরে ছাড়ো! ব্যথা পাচ্ছি তো! উফ.. ছাড়ো না।”
হৈমন্তী ছাড়ল না। তবে হাতের বাঁধন খানিক ঢিলে করে দিলো।
— “তুই বলবি, নাকি এবার গালে মারবো?”
— “বলছি তো। এমন করো ক্যান? তুষার ভাইয়ার সাথে কাজ করছি আমি।”
— “কি কাজ? আর বাইরে এত শব্দ কিসের?”
— “তুষার ভাইয়ার সব কাজিন আসছে আজকে। তাই রাতে ছোটখাটো একটা পিকনিক হবে। ওটার জন্যই শব্দ। এবার ছাড়ো।”

হৈমন্তী কান ছেড়ে দিলো। হেমন্ত যাওয়ার আগে তাকে আবারও ধমক দিয়ে বললো,
— “শব্দ কম কর তোরা। রুমে থাকা যাচ্ছে না।”
হেমন্ত তখন অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
— “সারাদিন শুধু ধমক আর ধমক! এটা আপু নাকি জল্লাদ? তুষার ভাইয়া যে কি দেখে আপুর প্রেমে পড়লো!”

_____

পশ্চিম দিকে হেলে পরেছে সূর্য। প্রকৃতি ঘন অন্ধকারে নেমে আসতে চাইছে। কিন্তু সফল হতে পারছে না। কৃত্রিম আলোয় এখনো আলোকিত চারপাশ। বিল্ডিংয়ের উঠোনে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়ে আছে। তুষারের বয়সী কিছু ছেলে মেয়ে মাটির উনুনে মুরগির মাংস রোষ্ট করছে। তুষার তদারকি করছে সব। হৈমন্তী বারান্দা দিয়ে একপলক দেখেছিল ওদের। এরপর আর যায় নি সেদিকে।

এখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে ১২ মিনিট.
টেবিলে বসে পড়ছিল হৈমন্তী। তবে বাহিরের প্রবল শব্দে সুষ্ঠভাবে মনোযোগ দিতে পারছিল না পড়ায়। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পরছিল। তবুও টেবিলে ঠাট হয়ে বসে আছে সে। রাবেয়া অনেকবার সবার সঙ্গে উঠোনে যাওয়ার জন্য তাকাদা দিয়েছেন তাকে। সে যাবে না বলে মন স্থির করে আছে। বাধ্য হয়ে রুমে এসে হাজির হলেন রাবেয়া। রোষপূর্ণ স্বরে বললেন,
— “তোকে আমি কয়টা ডাক দিয়েছি হৈমন্তী? ওখানে গেলে কি এমন হবে? সবাই যাচ্ছে, তুই কেন যাবি না?”
— “পড়া আছে আমার।”
— “পড়তে হবে না আজকে। ভালো একটা জামা পরে উঠানে চলে যা। ওরা ওখানে কত মজা করছে! তুই গাঁধার মতো রুমে পরে থাকবি কেন?”
— “এখানে গাঁধার কি সম্পর্ক মা?”

চোখ-মুখ কুঁচকে বললো হৈমন্তী। কথাটা বেশ গায়ে লেগেছে তার। রাবেয়া কিছু বলবেন, আর আগে আগেই ড্রইংরুম থেকে হৈমন্তীর বাবা আসরাফ সাহেব হাঁক ছেড়ে উঠলেন,
— “হৈমন্তী মা, কথা বাড়াস না। হেমন্ত অনেকবার ডেকে গেছে তোকে। তৈরি হয়ে চলে যা মা। সবার ভালো লাগবে।”

আসরাফ সাহেবের কথা ফেলতে পারলো না হৈমন্তী। না চাওয়া সত্ত্বেও তৈরি হয়ে নিলো যাওয়ার জন্য।

সাদামাঠা একটা সবুজ রঙের জামা পরেছে হৈমন্তী। অলস পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দু’তলায় আসতেই হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গেল আফতাব সাহেবের সঙ্গে। হৈমন্তীকে দেখেই তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। প্রথমেই প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “উঠানে যাচ্ছো?”
হৈমন্তী ক্ষীণ আওয়াজে উত্তর দিলো, “জি আঙ্কেল।”

আফতাব সাহেব এবার একটু গম্ভীর হলেন। থমথমে গলায় বললেন,
— “তোমার সেখানে যাওয়ার কোনো মানে তো আমি দেখছি না।”
— “জি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো হৈমন্তী। ইতিমধ্যে বিস্ময়ে কপালে ভাঁজ পরে গেছে তার।
আফতাব সাহেব খানিক কেঁশে আবারও বললেন,
— “দেখো মেয়ে, তোমার উচিত তুষার থেকে দূরে থাকা। অথচ সেই তুমিই তুষারের সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছো। ওকে সুযোগ দিচ্ছো। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তুমিই তুষারের মাথা বিগড়ে দিয়েছো। যাতে তুমি ওর গলায় ঝুলতে পারো। নয়তো আমার ছেলে তোমার মতো বয়সে বড় একটা মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় নাকি?”

বলেই অতি গর্বের সঙ্গে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন তিনি। যেন হৈমন্তীর ওপর সব দোষ দিয়ে তিনি ভীষণ আনন্দিত। এরপর হঠাৎ-ই কাঠিন্য ভাব নিয়ে বললেন,
— “আমার ছেলে থেকে দূরে থাকো। ওর আশেপাশেও যাতে তোমাকে না দেখি।”

হৈমন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুই বলতে পারলো না। ভাবতে লাগলো, আসলেই কি ও সুযোগ দিচ্ছে তুষারকে?
হৈমন্তীর আর যাওয়া হলো না উঠোনে।

___________________

চলবে~

হৈমন্তীকা

১০.
নিস্তেজ পায়ে নিজ ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলো হৈমন্তী। তাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলেন আসরাফ সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন,
— “কিরে মা, ফিরে এলি যে?”
— “ভালো লাগছে না বাবা। যাবো না।” নিষ্প্রভ স্বরে জবাব দিলো হৈমন্তী।
রাবেয়া ভ্রু কুঁচকালেন,
— “যাবি না মানে? এই না কি সুন্দর যাচ্ছিলি। আবার কি হলো?”
— “মাথা ব্যথা করছে মা। ঘুমাবো।”
— “ঘুমাবি মানে? আমার রাগ উঠাস না হৈমন্তী! চুপচাপ সবার কাছে যা।”

হৈমন্তী বিরস চোখে একপলক মায়ের দিকে তাকালো। অতঃপর কথা অমান্য করে চলে গেল নিজ রুমে। হালকা শব্দে লাগিয়ে দিলো দরজা। রাবেয়া রোষপূর্ণ চাহনি মেলে ধরলেন হৈমন্তীর যাওয়ার পথে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
— “দেখেছো তোমার মেয়েকে? একটা কথাও শুনে না। একে নিয়ে যে আমি কি করি!”
আসরাফ সাহেব দিরুক্তি করে উঠলেন,
— “আহা! এত কথা বলো না তো! ওর হয়তো সত্যিই মাথা ব্যথা করছে। তুমি বরং এক কাজ করো। ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে ঠান্ডা পানি খাও। মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

_____

রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো হৈমন্তী। ঠোঁটে তার লাল রঙা লিপস্টিক। যাওয়ার সময় রাবেয়া জোড় করে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রুক্ষ শক্তিতে বাম হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট মুছে নিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের আশপাশ, হাতের তালু সল্প লালে আচ্ছাদিত হলো। হৈমন্তী সটান হয়ে শুয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলো সিলিংএর দিকে। চেয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। নির্জীব, অনুভূতি শূণ্য হয়ে। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে আসলো। আচ্ছা, সব দোষ কি সত্যিই তার? সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র সে-ই কি দায়ী? হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল হৈমন্তীর। নয়ন জোড়ায় অশ্রু খেলতে লাগলো। গাল বেয়ে গলা অব্দি ছুটতে লাগলো সেগুলো।


তখন শীতের মাস। চারিদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন। হৈমন্তীর স্পষ্ট মনে আছে তারিখটি। ১২ই ডিসেম্বর। এই দিনটিতেই অচেনা এই রংপুরের পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ে থাকতে এসেছিল হৈমন্তীর পরিবার। সেদিনই প্রথম সে তুষারকে দেখেছিল। উঠোনের এক কোণে, এক বেঞ্চে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে এক যুবক। হৈমন্তী একপলক সেদিকে তাকায়। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয় ধীর গতিতে।
হৈমন্তী প্রকৃতি প্রিয় মানুষ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নির্মল বাতাস উপভোগ করা যেন তার নিত্যদিনের অভ্যেস। প্রতিদিনকার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করার পাশাপাশি একটা জিনিস ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে তাকে। রোজ উঠোনের মধ্যিখানের এক বেঞ্চে একটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে সে। একদম চুপচাপ, মাথা নিচু করে, মলিন মুখে। ভার্সিটি যাওয়া আসার সময়ও ছেলেটির নিশ্চুপ অভিব্যক্তিতে ওভাবেই বসে থাকা বিশেষ ভাবে খেয়ালে আসে তার। ছেলেটির কি কোনো কাজ নেই? প্রতিদিন ওভাবে চুপচাপ বসে থাকে কেন? কৌতূহল জাগলেও হৈমন্তী কখনো আগ বারিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় নি। কেমন জড়তা কাজ করতো ওর মাঝে। কেননা ছেলেটিকে দেখতে তার চেয়ে বড়ই মনে হতো হৈমন্তীর।
এভাবে বেশ কিছু দিন চলল। একদিন হেমন্ত থেকে জানতে পারলো, ছেলেটি তার চেয়ে ছোট। অনার্সে ভর্তি হয়েছে এবার। বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে। মুহুর্তেই হৈমন্তীর সব জড়তা কেটে গেল। অজানা কৌতূহলগুলো গভীর ভাবে জেঁকে বসল মস্তিষ্কে। ছেলেটা তো তার ছোট ভাইয়ের মতোই। সে হিসেবে কথা তো বলাই যায়!

এরপর থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী সূক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতো ছেলেটিকে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে তুষার ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকতো কিছু সেকেন্ড। তারপর যখন দেখত, হৈমন্তী তার থেকে চোখ সরাচ্ছে না, তখন বিরক্ত সহিত চলে যেত সেখান থেকে। ছেলেটাকে জ্বালাতে হৈমন্তীর বেশ লাগত। সে ইচ্ছে করে আরও বেশি তাকিয়ে থাকতো তুষারের মুখপানে।

এরপর একদিন সাহস করে তুষারের কাছে যায় হৈমন্তী। তুষারের পাশে বসে কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
— “আপনার নাম কি?”
তুষার একপলক তাকায়। গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়, “তুষার।”
— “ওহ্! আমার নাম হৈমন্তী।”

তুষার তখন আপন মনেই অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ায়, “হৈমন্তীকা।”
যা শুনতে পেয়ে হেসে ফেলে হৈমন্তী। বলে,
— “আমার নাম হৈমন্তীকা না তো। হৈমন্তী। আর আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বড়। তাই আমাকে আপু বলে ডাকবেন।”
প্রতিউত্তরে তুষার হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। হৈমন্তী আবার জিজ্ঞেস করল,
— “আচ্ছা তুষার, আপনি সবসময় এভাবে চুপচাপ বসে থাকেন কেন? বিরক্ত হন না?”
এবারো নিশ্চুপ তুষার। তুষারের ব্যবহারে তেমন ভাবান্তর ঘটলো না হৈমন্তীর। সে ভেবেই রেখেছিল এমন কিছু ঘটবে। সুতরাং, হৈমন্তী তার মতোই বকবক করতে লাগলো।

মাসখানেক যেতেই তুষারের ব্যবহারে পরিবর্তন এলো। আগে শুধু হৈমন্তীই কথা বলতো। তুষার চুপচাপ বসে শুনতো শুধু। কোনো কথা বলতো না। মাথা নিচু করে রাখতো সবসময়। কিন্তু এখন সেও হৈমন্তীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ গালে হাত রেখে নিমেষহীন চেয়ে রয় হৈমন্তীর মুখপানে। মাঝে মাঝে এমন সব আবেগমাখা কথা বলে, হৈমন্তী ভীষণ অস্বস্তিতে পরে যায়। তবে অত ঘাটায় না ব্যাপারগুলো। কিন্তু দিনে দিনে তুষারের আচরণ আরও পাগলাটে হতে শুরু করে। হৈমন্তীর প্রতি তীব্র অধিকার বোধ যেন তার মাঝে সর্বদা বিরাজমান। তাই তো হৈমন্তী সরে এসেছিল তুষারের থেকে। রুঢ় আচরণে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। চড়ও তো মেরেছিল তুষারকে। তাহলে সে দোষী কিভাবে হলো? এক পর্যায়ে হৈমন্তীর মনে হলো, না! সব দোষ তারই। তুষারের সঙ্গে আগ বারিয়ে কথা বলাটাই ছিল তার দোষ, মারাত্বক ভুল। যার শাস্তি হিসেবে অন্যের কথা শুনতে হচ্ছে তাকে।

_____

রাতে বেশ দেড়ি করে ঘুমায় হৈমন্তী। ফলসরূপ সকালে উঠতে দেড়ি হয়ে যায় তার। ফজরের নামায কাজা হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে নামায আদায় করে সে। এরপর অলস পায়ে সোফায় গিয়ে বসে। আসরাফ সাহেব সেখানেই বসে বসে খবর দেখছিলেন। মেয়েকে নিজের পাশে বসতে দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহভরা স্বরে বললেন,
— “শরীর ঠিক আছে তো মা? মাথাব্যথা আছে এখনো?”
— “না বাবা।”

কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলো সে। হাসফাস করতে লাগলো। এরপর ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “বাবা? এ বাসাটা আর ভালো লাগছে না আমার। অন্য বাসা দেখো।”
আসরাফ সাহেব অবাক হলেন,
— “কেন মা?”
রাবেয়া মাঝখান দিয়ে ফোড়ন কেটে উঠলেন,
— “কেন? বাসা পাল্টাবে কেন? কি সুন্দর ছাদে গাছ রাখার সুবিধা আছে এখানে। কি খোলামেলা! তার উপর প্রতিবেশীদেরও কি সুন্দর আচরণ।”
রাবেয়ার কথায় তাল মিলিয়ে আসরাফ সাহেবও বললেন,
— “হ্যাঁ, মা। তাছাড়া তোর ভার্সিটি, আমার অফিস আর হেমন্তর স্কুলও তো এখান থেকে কাছে। তাহলে অসুবিধেটা কোথায়?”

আসরাফ সাহেব এমন ভাবে বললেন, যে আর দিরুক্তি করতে পারলো না হৈমন্তী। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র।

সেদিন আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না তার। ঘর থেকেই বের হলো না। বিকেলের দিকে একটু ছাদে যেতেই ছাদের এককোণে তুষারকে দেখে থমকে গেল হৈমন্তী। তুষার তখনো দেখেনি তাকে। তড়িৎ গতিতে উলটো পায়ে আবার ফিরতে নিলেই, পেছন থেকে তুষার গমগমে স্বরে ডেকে উঠল,
— “দাঁড়ান, হৈমন্তীকা।”

____________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা