#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-১৪
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৪০.
নিঝুম মারোলাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা ধমক দিলো, মারোলা ভাবলেশহীন চেহারায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে দিলো। আমাকে বললো, ‘কি বলছেন এই লোকটা?’
আমি ওর কানে কানে বললাম, ‘ও নিঝুম গাধি।’
মুহূর্তেই ওর মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো। ছোট ছোট চোখ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘ ওহ। কি বলে ও? আমিতো ব্যাঙলা বুঝিনা।’
ধমক দেওয়ার কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘নিঝুম তোমাকে হ্যালো বলেছেন।’
খুশিতে চকচক করে উঠে মারোলার চোখ। আহ্লাদে আটখানা হয়ে নিঝুমকে বলে, ‘হাই!’
নিঝুম জুতার বারি মার্কা চেহারা করে বলে, ‘হ্যালো।’
‘ তুমি নিঝুম? চিটের ভাই তাইনা?’
আমি বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালাম। মারোলা চোখ টিপ দিলো। নিঝুম হা করে রইলো। আমাকে বললো, ‘আমি তোমার ভাই?’
আমি বললাম, ‘ হুম।’
‘ কোন জন্মের ভাই?’
‘ জানিনা। আপনি যে আমার ভাই তা মারোলাও বুঝে ফেলছে। আমাদের চেহারায় ভাইবোন টাইপ মিল আছে। বুঝলেন ভাইয়া?’
নিঝুম দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘মজা হচ্ছে নাকি?’
‘ ভাইবোনের সম্পর্কে এক আধটু মজা থাকবেই।’
‘ তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো চিত্রা। দূর দেশ থেকে এসেছি তোমার জন্য আর তুমি এখানে আমাকে ভাইভাই ডেকে জান কারবার করে ফেলছো।’
‘ ওহ,, দূর থেকে এসেছেন যখন, তখন নিশ্চয়ই ক্লান্ত? কি খাবেন বলুন। আফটার অল আমার দেশে মানুষ!’
নিঝুম বেশ খুশিই হলো। গদগদ কন্ঠে বললো, ‘ তোমার হাতে যা আনবে তাই!’
আমি মারোলাকে বললাম, ‘ প্লিজ হানি, রান্নাঘর থেকে ব্রেড, জ্যাম আর কফি তৈরি করে নিয়ে আসো আমার ভাইয়ের জন্য। ওকে?’
‘ ওকে হানি!’
মারোলা কিচেনে গেলে নিঝুম রাগী গলায় বললো, ‘কি হচ্ছে এসব? ফাজলামো করো?’
‘ নাহ। আপনাকে আপ্যায়ন করি।’
‘ আমি তোমার হাতের খাবার চেয়েছিলাম। তুমি ওই মেয়েকে বললে কেন?’
‘ আসলে এটার সায়েন্সটা কি বলুনতো..আপনি ভালোবাসেন আমাকে সো আমার হাতের খাবার খেতে চেয়েছেন। এদিকে আমি আপনাকে দু চোখেও সহ্য করতে পারিনা কিন্তু আমার এই ফ্রেন্ড মানে মারোলা আপনার উপর ক্রাশড, যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট! ওর ওতো একটা অধিকার আছে ক্রাশকে নিজ হাতে আপ্যায়ন করার! তাই ওকে সুযোগ দিলাম। আমি আপনাদের মাঝখানে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কি করবো বলুনতো?’
নিঝুম কিছু বললোনা। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মারোলা খাবার নিয়ে এলে সে খেলোনা। আমাকে কিছু ধমকি হুমকি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি তেমন গায়ে লাগাইনি, কিন্তু মারোলা প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা। ক্রাশ তার হাতে খায়নি, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। সো স্যাড।
৪১.
রাতের ঘুমটা ছাড়াছাড়া হলেও মোটামুটি ভালোই হয়েছে। হালকা তুষারপাতও হয়েছিলো। ঘুম ভাঙলো খুব সকালে। কাল রাতেই সংবাদে বলে দিয়েছে, আজ তুষারপাত হবে। তাপমাত্রা থাকবে সর্বনিম্ন ১১ডিগ্রী ফাঃ, সর্বোচ্চ ২৬ ডিগ্রী ফাঃ। দেখতে যদি ভালোলাগে, কিন্তু স্নো-ফলে মানুষের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়না। জানালায় চোখ গেলো, চকচকে আকাশ, বাতাসে তুষারকণার ওড়াওড়ি।
বাড়িঘর, বাগান, রাস্তাঘাট সবকিছুর উপর সাদা বরফের আস্তরণ। গাছগাছালির পাতাও ঝরে গিয়েছে এই শীতের কারণে। ইউনিভার্সিটি তো ক্লোজড। ওয়েদার ডিজাস্টার বলার মত কোন কারণই তো নেই। তার মানে আজ আর কারো সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ব্যাক ইয়ার্ডে কফি হাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাতাসে সাদা সাদা, হালকা তুলোর তুষারকণারা উড়ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে তুষারকণাদের ওড়াওড়ি দেখতে লাগলাম। কতক্ষণ ভাবলাম ক্লেভের কথা। এরপর নিঝুমের কথা। কি করে এই আপদকে বিদেয় করবো কিচ্ছু জানিনা।
একটু পর মারোলা এলো। গায়ে সাদা রঙের ঘুমের পোশাক। চুলগুলো পনিটেইল করে বাঁধা। ঘুমের কারণে চোখমুখ ফুলে আছে। বললো, ‘গুড মর্ণিং!’
‘ ইউ টু। সকালটা খুব সুন্দর, তাইনা?’
বিষন্ন গলায় বললো, ‘ হুম।’
‘ মন খারাপ নাকি?’
‘ হুম।’
‘ কেন?’
‘ আমি নিজজুম্মকে স্বপ্নে দেখেছি।’
‘ বলো কী?’
‘ ইট’স ট্রু।’
‘ কি দেখলে?’
‘ দেখলাম ও আমাকে পছন্দ করেনা। আমি ওকে প্রপোজ করেছি কিন্তু সে আমাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।’
‘ বলো কী?’
‘ হুম। ও আমার একটা কথাও রাখেনি। বলো হানি, আমি কি দেখতে খারাপ?’
আমি হাসি চেপে বললাম, ‘নো মারো।’
‘ তাহলে ও কেন আমায় ফিরিয়ে দিলো?’
‘ মারো এটা তোমার স্বপ্ন শুধু। বাস্তবে এমন না-ও হতে পারে। তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তাহলে তাঁকে আগে বুঝতে হবে। সে কী চায়, কি পছন্দ করে, তাঁর ক্যারেক্টার কেমন, তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড কি সব জেনে-বুঝে তারপর তুমি আগাবে। তারপর তোমার ফিলিংসটা ওকে জানাতে হবে। এরপর ওর উত্তর শুনেই তুমি বুঝতে পারবে সে তোমাকে ভালোবাসবে কিনা? বুঝলে?’
মারোলা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ সে বুঝেছে। তুলোর মতো শুভ্র সাদা তুষার ওর গায়ে, মুখে আছড়ে পড়ছিলো, মারো হেসে উঠলো। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে কোনো অপ্সরা মনে হচ্ছে। আচ্ছা, নিঝুমের তো উচিৎ এই অপ্সরার প্রেমে পড়া। সে কেন আমার পিছু পড়ে আছে? দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটিকেই তো ওর পাশে মানায়, নাহ এলক্লেভের পাশেও মানায়। কিন্তু একজনকে মন দিয়ে অন্যকে বিয়ে করা এ জীবনে আমি করতে পারবোনা। তার চেয়ে একা জীবন কাটিয়ে দেওয়া খুব সহজ। পারবো তো আমি? একা জীবন কাটাতে?
‘ হানি আসো বেরুই!’
‘ কোথায়? স্নো-ফলে তুমি কোথায় বেরুবে?’
‘ উঠোনো নামি, চলো।’
‘ চলো।’
কফির মগ কিচেনে রেখে কাপড় পাল্টে নিলাম। কাজের মেয়েটা এখন আর আসেনা। ও থাকতে অনেক কাজই করতে হতোনা। কিন্তু সম্প্রতি ওরা মিসিসিপিতে স্যাটেল করায় মেইডের কাজটা ওকে ছাড়তে হলো। আর আমরাও নতুন মেইড রাখিনি। মারোলার বাবা প্রফেসর সামাদ অবশ্য একজনকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তাঁকে রাখিনি। দুজন থাকি, অতো কাজ নেই। শুধু শুধু ডলার খরচের কোনো মানে হয়না। মারো’র বাবা প্রফেসর সামাদ ভার্সিটি থেকে রিজাইন করে ফ্লোরিডাতে রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। এখন সেখানেই থাকেন। একা মানুষ, স্ত্রী গত হয়েছেন পাঁচ বছর। একমাত্র মেয়ে মারো’কে ভার্জিনিয়াতে নিজ বাড়িতে রেখে খুবই দুশ্চিন্তায় থাকেন। মারোলা’র সঙ্গী আমি হওয়ায় তাঁর দুশ্চিন্তা আপাতত কম। মাঝেমাঝে ফোন করেন।
যাইহোক, উঠোনে নামার পরে বুঝতে পারলাম অনেকটা বরফের আস্তরণ পড়েছে। পা বরফের ভেতর ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির বাচ্চারা বেরিয়ে এসে বরফের ছোট-বড় পুতুল তৈরি করেছে। ছুঁড়াছুঁড়ি করে কারো গায়ে বরফ ফেলছে কেউকেউ। আমি আর মারোলা একটা বরফের ঘর বানালাম। চারদিক চিকচিক করছে স্নো-ফলের বদৌলতে। সাদা আর সাদা। ঘন নীল আকাশ তুষারের বর্ষণ ঘটাচ্ছে। বর্ষণের এই সময়টাতে দূর থেকে কেউ ক্যামেরাতে আমার ছবি বন্দি করে নিলো। ফ্ল্যাশ লাইটের আলো চোখে পড়তেই আমি তাকালাম, কিন্তু লোকটা দৌড়ে পালিয়ে গেলো। কে ছিলো সে? এই শীতকালটা এমন রহস্যময় কেন? কাল রাতেও আমার ব্যলকুনিতে কারো অস্তিত্ব টের পেলাম। এই নিয়ে দশদিন! শীতকাল শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি গভীর রাতে কাউকে অনুভব করি, কিন্তু সে কে আজও জানতে পারিনি। এই গোপন বিষয়টা মারোলাকেও বলিনি। সেটা একান্তই আমার, নিজস্ব ব্যাপার।
৪২.
প্রতিবেশীর বাড়িতে বার্থডে পার্টি ছিলো। আমরা সেখানে গেলাম এবং ডিনার সেরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, তবে তুষারে চারদিক সাদা হয়ে রয়েছে ফলে পরিবেশটা কেমন কালচে-নীল হয়ে আছে। গায়ে শীতের পোশাক, মাথায় কানটুপি, পায়ে বুট! আমরা শক্ত করে একজন আরেকজনকে ধরে আছি। সামনে একটা কফিশপ দেখতে পেয়ে সেখানে গেলাম। পুরো খালি কফিশপ, কোনো কাস্টমার নেই। ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি নিয়ে দুজনে বসলাম। ঠান্ডার মধ্যে কফির স্বাদ দশগুণ বেড়ে গেছে। খেতে অমৃতের মতো লাগছে, আমি এখন তিতকুটে কফি খাওয়া শিখে গেছি। কিছুক্ষণ পরে কফিশপে ঢুকলো দুজন ছেলেমেয়ে। হয়তো গার্লফ্রেন্ড হবে ছেলেটার। দুজনে একটা কোণার টেবিলে বসলো। আমরা কফির মগে চুমুক দিয়ে কথা বলছি এমন সময় সামনে এসে ধপ করে বসে পড়লো ক্লেভ! চমকে ওঠলাম আমরা। প্রচণ্ড শীতে গায়ে পাতলা শার্ট আর পায়ে স্পঞ্জের জুতো দেখে আমরা হতবাক।
‘ এতো রাতে এখানে কি গাইস?’
‘ কফি খাই, তুমি খাবে?’
‘ খেতেই তো এলাম। ঠান্ডায় মরে যাচ্ছিলাম।’
‘ লাইক সিরিয়াসলি? ঠান্ডায় মরে যাচ্ছো অথচ গায়ে কাপড় নেই।’
‘ কাপড় পরলে আরও শীত লাগছে।’
‘ তুমি অদ্ভুত ক্লেভ।’
‘ জানি আমি।’
‘ তো হট নাকি কোল্ড কফি খাবে?’
ক্লেভ হেসে চুল নাড়িয়ে বললো, ‘কোল্ড কফি!’
‘ পাগল তুমি। মারোলা যাও ওর জন্য হট কফি নিয়ে আসো!’
মারোলা ওঠতেই ক্লেভ ওকে ডাকলো। ইতস্তত করে বললো, ‘উইথ সুগার!’
মারোলা কফি আনতে গেলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘উইথ সুগার কেন?’
‘ তিতা খেতে খেতে কলিজা পুড়ে গেছে। তাই একটু ট্রাই করতাম, তুমি তো খাও সুগার মিশিয়ে।’ মিনমিন করে বললো ক্লেভ!
আমি হেসে বললাম, ‘ আমি এখন তিতা খেতে পারি।’
ক্লেভ কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বেচারার অবস্থা খারাপ। মারোলা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসলো। ইশারায় বুঝিয়ে দিলো ক্লেভের কফিতে সাড়ে সাত স্পুন চিনি মিশিয়ে এনেছে ও। এখন দেখার পালা ও কতক্ষণ সহ্য করতে পারে এই মিষ্টতা! কারণ আর যাইহোক, খাদ্য বা স্বাস্থ্য এই দুটোতে এডওয়ার্ড এলক্লেভ কখনো কম্প্রোমাইজ করেনা। সে এ বিষয়ে অধিক সচেতন।
ওর বাচ্চার মতো মায়াভরা মুখটা দেখে আমার মায়া হলো। পানির বোতলটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে পানি খেয়ে চোখমুখ কুঁচকে বললো, ‘ পানিটা এতো তেতো কেন? ইশ, মুখটা কেমন বিদঘুটে লাগছে। ইয়াক!’
আমি বললাম, ‘তোমার ড্রামা শেষ? আমরা এবার বাড়ি যাবো।’
ধরা পড়ে ক্লেভ লজ্জ্বা পেলো। ‘ আমি ড্রামা করছিলাম না। ট্রাই করছিলাম।’
‘ জানি জানি। আমার সামনে হিরো সাজার চেষ্টা করছিলে। কিন্তু প্রথমবার ফেইল মারলে। পরবর্তীতে ভালো প্রিপারেশন নিয়ে এসো।’ হাসতে হাসতে বললাম আমি।
ক্লেভের মুখে লালচে আভা ফুটে উঠলো। কি কিউট,উফ! বললো, ‘ ধরে ফেললে!’
‘ এভাবে লজ্জ্বা পাচ্ছো কেন? তুমি কি মেয়ে?’
‘ ছেলেদের কি লজ্জ্বা পেতে নেই?’
‘ জানিনা। আমি আজ প্রথম দেখলাম কোনো আমেরিকান ছেলে বাংলাদেশি মেয়ের সামনে লজ্জ্বায় কুপোকাত হয়ে যাচ্ছে!’
ক্লেভ হেসে বললো, ‘ আমিও আজ জীবনের প্রথমবার কোনো এক্সামে ফেইল মারলাম আর ভিনদেশি মেয়ের সামনে লজ্জ্বা পেলাম। আমার সাতাশ বছরে এই প্রথম এই ঘটনা ঘটলো।’ তারপর আমাকে চোখ মেরে বললো, ‘স্পেশাল বন্ধুর সামনে স্পেশাল লজ্জ্বা।’
পেছন থেকে কে যেন রাগী গলায় চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘তোর স্পেশালগিরি আমি বের করছি হারামজাদা!’
আমরা সবাই অবাক হয়ে ঘুরে পেছনে তাকালাম। এটা দেখার জন্য প্রস্তত ছিলাম না।
চলবে…ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।