#ভিনদেশি_তারা
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮
৫৩.
ভার্জিনিয়ার শ্যানানডোয়া ন্যাশনাল পার্কে আমি আর ক্লেভ এসেছি। এসেছি বললে ভুল হবে। এই সাদা বাঁদর আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। বাধ্য হয়ে আসতেই হলো শ্যানানডোয়ায়।দুই লাখ একর বিস্তৃত শ্যানানডোয়ার অবস্থান ব্লু রিজ পর্বতের বুকে। ব্লু রিজ পর্বত এপেলেশিয়ান পর্বতমালার এক লকেট। আর শ্যানানডোয়া উপত্যকা সেই লকেটের মণিমুক্তা।
শ্যানানডোয়া ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ স্কাইলাইন ড্রাইভ। ১০৫ মাইল এই পথ ব্লু রিজ পর্বতের গা বেয়ে উত্তর–দক্ষিণে লতিয়ে তিন হাজার ফুট ওপরে উঠে গেছে। যে পথের সঙ্গে এক্সেস আছে অনেক হাইকিং ট্রেইলস, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, লজিং হাউস ও শপিং মলের।
স্কাইলাইন ড্রাইভে আছে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী ৭৫টা ওভার লুক। যেখান থেকে শ্যানানডোয়ার প্যানারোমিক দৃশ্য দেখে মানুষ। স্কাইলাইন ড্রাইভ বানানো শুরু হয় ১৯৩১ সালে। যখন অটোমোবাইল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্লেভ জানালো আমাকে।
শ্যানানডোয়া ন্যাশনাল পার্কের বিখ্যাত মেরিস রক টানেল স্কাইলাইন ড্রাইভ। প্রথম দেখায়ই প্রেমে পড়েছিলাম জায়গাটার,এবার দ্বিতীয় বারের মতো প্রেমে পড়া শ্যানানডোয়ার। নিচে ঝরনা,ওপরে পর্বতের সৌন্দর্য!
স্কাইলাইন ড্রাইভে তুচ্ছ জিনিসও ভালো লাগা। শত শত ফুট উচ্চতা থেকে নানাভাবে প্রকৃতি দেখা, আকাশ দেখা! কখনো পূর্ব থেকে, কখনোবা পশ্চিম। পূর্বে সন্ধ্যার অহংকারী ফ্রোজেন প্রকৃতি, বিপরীতে সন্ধ্যা গোধূলির রঙে রাঙা।
সূর্যাস্ত দেখার সময় আমি আর এলক্লেভ একদল উৎসাহী মানুষের সঙ্গে দাঁড়ালাম। তিন হাজার ফুট উচ্চতা থেকে সূর্যাস্ত দেখা, কত সুন্দর দৃশ্য!
খুশিতে পুলকিত ক্লেভ রিনরিনে গলায় বললো, ‘আ’ম ট্রাইন্না ক্যাচ দ্য সান সেট হিয়ার!’
একঝাঁক আমেরিকান, আমি আর ক্লেভ সঙ্গে প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্য আর শ্যানানডোয়ায় অবস্থিত দর্শকদের বিস্ময়কর উদ্ভাস নিয়ে সবাই সূর্যাস্ত দেখলাম। এ অপার্থিব সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা চালালাম।
লুরে কেভার্ন গুহা ব্লু রিজ পর্বতের গোড়ালি ঘেঁষে আছে। ১৮৭৮ সালে আবিষ্কৃত এই গুহা পূর্ব আমেরিকার সর্ব বৃহৎ পর্বত গুহা। পাহাড়ের শিকড় ঝুলে আছে গুহার দেয়ালে। এই ফরমেশনগুলো এক ইঞ্চি বাড়তে ১২০ বছর লাগে। সবচেয়ে লম্বাটা ৪৭ ফুট। কমলা, লাল, সবুজ নানান রঙের।
আমি ক্লেভকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো সাদা কেন? আর লালই বা কেন?’
ও বললো, ‘লোহার কারণে লাল। ক্যালসিয়ামের কারণে সাদা।’
‘ এগুলো অনেক সুন্দর!’
‘ একদম তোমার মতো।’
‘ আমার মতো মানে?’
‘ মানে তোমার মতো অনেক সুন্দর। তুমি কী জানো তুমি আসলে কতটা সুন্দর?’
‘ জানার দরকার নেই।’
আমরা হাঁটছি পালাক্রমে আপহিল থেকে ডাউন। কখনো সুড়ঙ্গ পেরিয়ে, কখনোবা ছোটবড় হলরুম মাড়িয়ে। কিছু পথ রেলিংঘেরা। রেলিং গলিয়ে নিচে তাকালে লোকজন দেখা যায়।
একটা সুন্দর লেকও চোখে পড়লো। লেকটি এত নিথর যে ছাদের ছায়া নিখুঁতভাবে পড়েছে এতে। সারি সারি লম্বাকার ছায়া যেন পড়েছে লেকে। রিফ্লেকশনের কারণে লম্বা, সরু লেকটাকে অনেক গভীর দেখাচ্ছে।
ক্লেভ বললো, ‘এটা অনেক গভীর দেখাচ্ছে তাইনা?’
‘ হুম।’
‘ কিন্তু এটা বাস্তবে দুই ফুটের বেশি গভীর নয়। হা হা!’
মাঝারি আকারের একটা ফ্রোজেন ঝরনাও আছে। ক্লেভ বললো, ‘জানো এটা, তিন কোটি বছরের পুরোনো।’
‘ কীভাবে জানলো?’
‘ গবেষণা করে নিশ্চয়ই।’
অনেক উঁচু জায়গায় এলাম আমরা দুজন। এখানে বিরাট একটা অর্গান রাখা। “The Great Stalacpipe Organ” এটা থেকে হাম ভেসে বেড়ায় সারা গুহাময়।
৫৪.
ভার্জিনিয়া খাবারের জন্য বিভিন্ন ভাবে পরিচিত।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তার চকচকে সীফুড এবং পুরস্কার বিজয়ী ওয়াইন। অঞ্চলটি খাদ্য এবং ওয়াইনের জমকালো অনুষ্ঠান এবং উৎসবের জন্য একটি বাস্তব হটস্পট হয়ে উঠেছে। আমি আর ক্লেভ মুখোমুখি বসে আছি রেস্তোরাঁয়। একটা মেয়ে ওয়েটার সীফুড সাজিয়ে দিয়ে গেলো। ক্লেভ বললো, ‘খাওও!’
‘ আবার শুরু করলে?’
‘ একটু, ট্রাই করছি।’
‘ তোমার দেশে এই ভাষা কাজে লাগবেনা। শুধু শুধু কষ্ট করবে।’
‘ তুমি খাও তো।’
আমি চামচ ব্যবহার করে খেতে লাগলাম। এখানকার সীফুড সবচেয়ে মজাদার এবং আকর্ষণীয় । এর আগেও এসেছি আমি। ক্লেভ খেতে খেতে আড়চোখে আমাকে দেখে নিয়ে বললো, ‘তোমাকে আজ অনেক কিউট লাগছে।’
‘ কেমন কিউট?’
‘ বাচ্চাদের মতো।’
‘ থামো। বয়স আমার সাতাশে পড়বে, বাচ্চার সাথে মিলাতে যেও না।’
‘ আচ্ছা।’
‘ এবার বলো, এখানে ডাকলে কেন?’
‘ খেয়ে বলি?’
‘ আচ্ছা। তুমি কি ওয়াইন খাও?’
‘ মাঝে মাঝে। এবার থেকে আর খাবোনা।’
‘ কেন?’
‘ খেয়ে বলি?’
‘ হুম। তোমার দাদী কেমন আছে?’
‘ ভালো।’
‘ বাড়ি এসেছে? মানে ভার্জিনিয়াতে?’
‘ না। মমের কাছেই রয়েছে। এখানে আর আসবেনা।’
‘ কেন?’
‘ এমনি। তোমার কথা মাঝেমধ্যে বলে, একটা গিফটও পাঠিয়েছে তোমার জন্য।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমার জন্য কিসের গিফট পাঠাবে? ওনার সাথে তো আমার ভালো করে পরিচয়ই হয়নি।’
‘ হয়নি তাতে কী? ভালোবেসে পাঠিয়েছে। দাদী তোমার কথা মনে রেখেছে।’
‘ তাহলে আমারও উচিৎ ওনাকে উপহার দেওয়া।’
‘ সেটা আমি ঠিক করে দিই? দাদী সবচেয়ে বেশি যেটা দিলে খুশি হবে।’
আমি বললাম, ‘বলো।’
‘ খাওয়া শেষে বলি?’
আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘সবই খাওয়ার পরে বলবে যখন তখন এতো পকরপকর করছো কেন! চুপ থাকো।’
ক্লেভ অসস্তি ভরা চাহনিতে তাকালো। আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। রেস্তোরাঁয় কেউ নেই। নানা রঙের আলো জ্বলছে। আমার গায়ে সবুজ রঙের ফতুয়া, শাল জড়ানো। ক্লেভ পরিপাটি হয়ে সেজে এসেছে। কি এমন সারপ্রাইজ দিবে আমি বুঝতে পারছি না। অদ্ভুত!
ক্লেভ আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁকড়া অর্ডার করলো। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘আমার পাশে বসে
এসব খাওয়া চলবেনা।’
‘তুমি এরকম করছো কেন?’
‘ আমার বমি আসছে তোমার কাঁকড়া দেখে।’
ক্লেভ হাসতে হাসতে কাঁকড়ার ইতিহাস আমাকে বলতে লাগলো। ‘ এই যে এটা; ব্লু ক্রেব “মেরিল্যান্ডের কাঁকড়া”নামে পরিচিত, ভার্জিনিয়া দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম সিফফট প্রযোজক এবং তার তরমুজ নীল কাঁকড়া, কুলিক, ক্ল্যামস, সমুদ্রের স্কাল্পস, ক্র্যাকার, স্ট্রাইপ বাশ, স্পট, ফ্লাঞ্জার, ক্যাটফিশ এবং মাছের অন্যান্য প্রজাতি।
ভার্জিনিয়া এর পূর্ব শোরের উপর অবস্থিত ট্যাংগিয়ার দ্বীপটি ‘বিশ্বের শ্বেত শাঁকড়ের রাজধানী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বুঝলে? কাঁকড়াদের কতো সম্মান!’
‘ যতইহোক, এসব দেখে আমার গা ঘিনঘিন করছে।’
‘ তাহলে ফেলে দিই?’
‘ যা ইচ্ছে করো। শুধু এগুলো এখান থেকে নিয়ে যাও।’
ক্লেভ হাসতে হাসতে ওগুলো নিয়ে চলে গেলো। আমি আরকিছুই খেতে পারলাম না। ক্লেভ বাদাম নিয়ে এলো। ভার্জিনিয়ার বিখ্যাত চিনাবাদাম।
টিডওয়াটার এলাকা বিখ্যাত চিনাবাদামের জন্য । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উত্থিত চারটি চিনাবাদাম ধরনের বৃহত্তম ভার্জিনিয়া চিনাবাদাম হয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাদাম কেন?’
‘ তোমার জন্য।’
‘ বাদাম খাবোনা। আমার ইচ্ছে করছে তোমার গায়ে বমি করি।’
ক্লেভ আমার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো। উদ্বিগ্ন গলায় বললো, ‘খারাপ লাগছে তোমার! বমি করবে? আমি স্যরি, জানতাম না এগুলো দেখলে তোমার বমি পাবে।’
তারপর ওর শার্টটা টেনে ধরার চেষ্টা করে আমাকে বললো, ‘আমার গায়ে বমি করতে পারো। আমার প্রবলেম হবেনা। আর চিনাবাদাম একটি উচ্চ প্রোটিন এবং স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন সোডিয়াম খাদ্য যা একটি দুর্দান্ত জলখাবার তৈরি করে। খেতে পারো।’
‘ খাবোনা।’ বলে হাসতে লাগলাম। কি বোকা ছেলেটা। ভেবেছে আমি বুঝি সত্যিই ওর গায়ে বমি করবো। আসলে পাশ্চাত্যের যে লোকেরা ভালো, বিশ্বস্ত ওরা জীবন দিয়ে হলেও বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। আর যারা খারাপ, তারা অনেক ভয়ানক হয়। এটাই ভালো দিক।
৫৫.
রাতের উজ্জ্বল আকাশ। হাইওয়েতে খুব বেশি গাড়ি নেই। সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে হৈমন্তী বাতাস। কিছু শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়েছে রাস্তায়। আমি বললাম, ‘এবার তোমার কথাটা বা সারপ্রাইজটা কি আমাকে বলবে?’
ও ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বলবো তো।’
‘ বলে প্লিজ আমায় উদ্ধার করো।’
‘ আসলে আমি ভাবছি কথাটা কীভাবে বলবো, মানে তুমি কীভাবে নেবে!’
‘ ভনিতা না করে বলে ফেলোতো।’
‘ বাঙলায় বলবো?’
‘ আজব! তোমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে বলো। শুধু বলো প্লিজ!’
ক্লেভকে দেখে মনে হচ্ছে ও নিজের মনে প্রার্থনা করছে। মুখ রক্তশূণ্য। এমন করার কারণ বুঝলাম না। আমি রাগী চোখে ওকে দেখতেই মিষ্টি হাসলো। ঢোক গিলে বললো, ‘ টুমি আম্মমাকে বিবা.হ করিবে চিট?’
মাথা উঠলো চক্কর দিয়ে। বলে কী এই ছেলে? আমি কি ভুল শুনছি নাকি! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আবার বলো!’
‘ টুমি আম্মাকে বিবাহ করিবে?’
আমি হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমাকে চিমটি কাটো তো!’
ও অবাক হয়ে আমার গালে চিমটি কাটলো। আমি রেগে বললাম, ‘কী করলে এটা? আর কী বললে তুমি?’
‘ সত্য বললাম!’
‘ মজা করছো?’
‘ ন্যাহ!’
‘ তুমি মজা করছো ক্লেভ। তুমি হঠাৎ আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন?’
‘ আমি টোমাকে বালুপাসি।’
‘ তোমাকে কে শিখিয়েছে এসব ভুলভাল বাংলা? ওই তোমার জান্টুস ওয়েটার?’
ও মাথা নাড়ালো। আবারও বললো, ‘আমি টুমাকে বালুপাসি চিট।’
আমার মাথায় এবার কথাটা ধরা পড়লো। ভয় এসে জেঁকে ধরলো মনে। বারবার বলে যাচ্ছে ক্লেভ কথাটা। এবার সরাসরি উত্তর চেয়ে বসলো। আমি বুঝতে পারছিনা কি উত্তর হবে বা আমি কি বলবো, কি বলা উচিৎ। এতোদিন একতরফা ছিলো এখন সে নিজে থেকেই আমাকে বলছে। কিন্তু আমার এখন কি করা উচিৎ? অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ক্লেভও বাচ্চাদের মতো আমার হাত ধরে চুপ করে বসে আছে। করুণচোখে আমাকে দেখছে। ভার করা মুখটা বারবার যেন বলছে, আমি যেন “হ্যাঁ” বলি। কিন্তু আমি কঠোর, একজন মুসলমান হিসেবে চিন্তা করলাম, “ধর্মটাই বড়, আমার উচিৎ আবেগকে পশ্রয় না দিয়ে বাস্তবকে পশ্রয় দেওয়া।” উত্তরটাও সে-ই মতো দিতে হবে। কি রিয়েকশন হবে সেই উত্তর শুনে ক্লেভের? খুব দুঃখ পাবে কি!!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। তথ্যবর্ণনা কালেক্টেড। বিরক্তিকর, পর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত!