আরশি পর্ব-১২

0
2327

#আরশি
#Part_12
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তুমি মিস মুকুর না?

কথাটা শুনার সাথে সাথে ফুঁসে উঠি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই সাদমানের দিকে। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলি,

— ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু কল মি এট দিস নেম। আমি কোন মুকুর টুকুর না। আমি আরশি!

সাদমান চোখ বড়বড় করে তাকায়। অতঃপর দাঁত কেলিয়ে বলে,

— মানতে হবে আমার দৃষ্টি শক্তি খুব প্রখর। বাজের চেয়েও সুক্ষ্ম। এক দেখাই চিনে ফেললাম তোমায়। উফফ! সাদ আ’ম প্রাউড অফ ইউ।

আমি সাদমানের উদ্ভট কথা শুনে আড়চোখে তাকাই। সাদমান মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলে,

— তা মিস মুকুর থুরি আরশি এতদিন পর কোথ থেকে? ডিইউ এর ফিন্যান্স সেক্টরের মনিটার আজ আমার জুনিয়র আদৌ ভাবা যায়?

আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— তোমার আমাকে মনে আছে? বাট হাও? আমি তো ডিইউতে শুধু মাত্র এক বছর পড়েছিলাম।

— বন্ধুকেও ভুলা যায় বাট দুশমনকে না। আর তুমি তো আমার প্রাণ প্রিয় দুশমন ছিলে সেই কালে। তোমাকে কিভাবে ভুলি বলো?

— না ভুললে নাই। দ্যাট ইজ নোট মাই প্রবলেম।

সাদমান থুতনিতে হাত রেখে বলে,

— ডোন্ট ওয়ারি মিস মুকুর। এখন প্রবলেম না হলেও পরে হবে।

এই বলে দাঁত কেলায় সে। সাথে সাথে আমি পুনরায় ফুঁসে উঠি। কড়া গলায় বলি,

— বলেছি না আমাকে মুকুর ডাকবে না। আই জাস্ট হেট দিস নেম।

— ওকে ওকে কুল৷ ডাকবো না মুকুর। তা এর আপডেট ভার্সনটা ডাকি। তো কেমন আছেন মিস দর্পণ?

আমি দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রই। এই ব্যক্তিকে এখন অসহ্য লাগছে। সাদমান তা দেখে বলে,

— অহ কথা বলবেন না? ওকে দ্যান! তো এখন চলো তোমায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তারপর তোমাকে আবার কাজ বুঝাতে হবে। উফফ!! কত কাজ। চলো!চলো!

এই বলে সাদমান আগে আগে চলে যায়। আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে নিজেকে বকতে শুরু করি,

— কোন দুঃখে যে আজ নিকাবটা পড়লাম না? নিকাবটা পড়লে এটলিস্ট আজ এই পাগলের হাত থেকে বেঁচে যেতাম। এখন না জানি এই পাগল কি করে।

মনে মনে এইসব বলতে বলতে সাদমানের পিছন পিছন চলে যাই। সিড়ি বেয়ে উপরের ফ্লোরে এসে পড়ি আমরা। উপরে আসতেই দেখি বিশাল বড় এক ফ্লোর। সকলের জন্য আলাদা আলাদা ডেস্ক বসানো। ভিতরের দিকে দুইটা কেবিন। বা পাশের দিকে প্রিন্টআউট মেশিন আর ফটোকপি মেশিন। এর থেকে খানিকটা দূরে কফি মেশিন আর পানির ফিল্টার রাখা। বেশ পরিপাটি সব কিছু। আমি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সাদমানের পিছে গিয়ে দাঁড়াই৷ সাদমান গলা ঝেড়ে বলে,

— এটেনশান গাইস!

সবাই সাদমানের দিকে তাকাই সাদমান স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— উই হ্যাভ এ নিউ মেম্বার ইন আওয়ার সেকশন। মিট হার! হার নেম ইজ আরশি।

সাদমানের কথা শুনে আমার দিকে তাকায়। সকলের নজর আমার উপর এসে স্থির হতেই আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,

— আসসালামু আলাইকুম!

সকলেই হাসি মুখে আমার সালাম গ্রহণ করেন। অতঃপর কয়েকজন বলে উঠে,

— সাদ স্যার! এনি কি আমাদের জুনিয়র নাকি সিনিয়র?

সাদমান বলে,

— তোমাদের জুনিয়র সে৷ সো তোমরা সকলেই একে কাজে সাহায্য করবে কেমন। না করলে তোমাদের আমি ক্লাস নিব।

পাশ থেকে একজন বলে উঠে,

— ক্লাসে খাবার পাবো তো সাদ স্যার?

সাদমান সুরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

— হ্যাঁ পাবে তো। খাবার হিসাবে বেতের বারি।

— বাহ! বেশ মজার খাবার তো৷ ইয়াম!

কথা বলার পর পরই হাসির রোল পড়ে যায়। এদের আচরণ দেখে যতটুকু বুঝতে পারলাম এরা একে অপরের সাথে বেশ ফ্রি। সাদমান এইবার সকলকে থামিয়ে বলে,

— অনেক হলো। এইবার একেক করে সবাই এর সাথে পরিচয় হয়ে নাও। আমি কেবিনে আছি। ইলমি শুনো! পরিচয় পর্ব শেষ হলে একে আমার কেবিনে দিয়ে এসো।

ইমলি নামের মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে বলে,

— জ্বী আচ্ছা স্যার।

এরপর সাদমান আর এক মূহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। অতঃপর একেক করে আমি সকলের সাথে পরিচয় হয়ে নেই। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই ইলমি নামের মেয়েটি আমায় সাদমানের কেবিনে নিয়ে যায়। আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে সে চলে যায়। সাদমান চেয়ারে বসে কাজ করছে। আমি ওর সামনে যেতেই সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। অতঃপর বলে উঠে,

— মিস দর্পণ বসো।

আমি কিছু না বলে পড়ি। সাদমান এইবার বলতে শুরু করে,

— এইখানে কিছু রুলস এন্ড রেলুগেশন আছে। তোমাকে সেগুলো মানতে হবে। এর বাদে নরমাল যে বিষয়গুলো হচ্ছে তা আমরা এইখানে সকলে বেশ ফ্রি। সকলেই সকলের সাথে বন্ধুসলুভ আচরণ করি। অফিসে সবাই আমাকে সাদ স্যার বলে তো তুমিও তাই বলবে। আর অফিসেত বাইরে এত ফরমাল হতে হবে না। সাদ বললেই হবে।

আমি ছোট করে বলি,

— হুম।

— আর হ্যাঁ তখন এর কথা গুলো ধরতে হবে না। ওইগুলো এইভাবেই ফাজলামো করে বলেছিলাম তোমাকে ফ্রি করার জন্য। তুমি বেশ নার্ভাস লাগছিলে তাই এমন করা। ডোন্ট ওয়ারি।

সাদের কথা শুনে আমি এইবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

— বাট বাট তোমার নাম মিস দর্পণই থাকবে। ইহা চেঞ্জ হবে না। শেয়ার বাজারে ধস নামতেও না।

আমি সাদমানের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেই। সাদমান এইবার বুঝে যে আমি টোটালি ফ্রি হয়ে গিয়েছি। তাই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করে।

_________________________________________________

রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি। বাসার কাছেই এক মোড়ে সাংঘাতিক জ্যাম লেগেছে। ঘন্টা দুই-এক এর আগে মেবি ছুটবেও না। তাই খামাখা সেখানে বসে থাকার মানেই হয় না। সকাল বেলা সূয্যিমামা যেই উত্তাপ নিয়ে হাজির হয়েছিল তা এখন আর নেই। বরং পুরো আকাশের কোথাও নেই। তার বদলে আছে ঘন কালো মেঘ। চারদিকে বইছে ঝিরিঝিরি বাতাস। বাতাসের বুকে ঘূর্ণিপাকের মত করে এক জোড়া চড়ুই ছুটাছুটি করছে। কোথ থেকে যেন বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে এসে বারি খাচ্ছে নাকের ডগায়। আমি চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখি রাস্তার ধার ঘেষে একটি ভ্যান দাঁড় করানো আছে। সেই ভ্যানেই বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ রাখা। হয়তো তার মধ্যে একটা বেলিফুলের চারা আছে। আর তাতেই ফুটে উঠেছে সদ্যজাত কচি বেলিফুল। তারই ঘ্রাণে এখন চারদিকটা মেতে উঠেছে। আমি আকাশের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম হয়তো আজ বৃষ্টি হবে। অতঃপর মনে করার চেষ্টা করলাম। বাংলা মাসে এইটা যেন কোন মাস। বেশ কিছুক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করার পর মনে পড়লো এইটা আষাঢ় মাস। তাহলে কি এইটা আষাঢ় মাসের প্রথম বৃষ্টি।
বৃষ্টিটা সকলের প্রিয় না হলেও আষাঢ় মাসের প্রথম বৃষ্টিটা বেশিরভাগ সকলেরই প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে সদ্য পা রাখা কিশোরীদের জন্য। তাদের কাছে এই বৃষ্টি মানেই ভালো লাগার ছোঁয়া। বৃষ্টি দেখলেই তাদের চঞ্চল মন খুশিতে নেচে উঠে। বদ্ধ ঘরে আর তাদের মন স্থির থাকে না। ছুটে চলে যায় বর্ষণের ধারার নিচে, মাখিয়ে নেয় নিজেকে তার রঙ্গে। আজ কেন যেন আমারও মন কেন যেন এই বর্ষণের ধারায় নিজেকে রাঙ্গাতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে জানি না। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করছে। ইশশ! এখন যদি বৃষ্টিটা নামতো।
কথাটা বলতেই বলতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় আর আমার পা স্থির। আমার আশেপাশে সকলেই ইতি মধ্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করে দিয়েছে। অনেকে আবার আমার মতই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশায় থাকা কিছু যাত্রী হুট উঠাচ্ছে তো কেউ নামাচ্ছে। পথচারী বাচ্চারা নেমেছে রাস্তায়। তাদের মুখে প্রাণবন্ত ঝুলন্ত হাসি। আমি চোখ বন্ধ করে আকাশের পানে চাই। বৃষ্টির ধারা আমার মুখমন্ডল ছুঁয়ে দিতেই আমি শিউরে উঠি। মনের মাঝে থাকা সুপ্ত কষ্ট গুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। ইতিমধ্যে চোখের কার্নিশ দিয়ে সেগুলো উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বচ্ছজলের সাথে ধীরে ধীরে নোনাজলের সংমিশ্রণ হতে শুরু করে। তখনই মনের মাঝে চিৎকার করে বৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলে উঠি,

— এই বর্ষণ! তুই নাকি অনেক প্রভাবশালী রে? তুই নাকি সকলের কষ্ট-গ্লানি ধুয়ে দিতে পারিস।হাজারো মানুষের জীবনের কাব্য-রচনা রচে দিতে পারিস। তা আমারটাও দে না।
এই বর্ষণ! আমাকে ছুঁয়ে তোরই মত শীতল করে দিয়ে যা। তুই যেমন স্বচ্ছ আমাকেও তেমন স্বচ্ছ বানিয়ে দে। সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে নিয়ে যা। রাস্তার ময়লার মত আমার অতীতের সকল কালো ছাপ ভাসিয়ে নিয়ে যা। কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবের মত কালো স্মৃতিগুলো লণ্ডভণ্ড করে দে। নতুন করে গড়ে দে আমায়। বর্ষণের শেষে সূর্যের প্রথম তেজ হতে দে আমায়। দিবি কি আমায়? বল না?
এই বর্ষণ! তুই কি শুনছিস আমার কথা? এই বর্ষণ!

#চলবে

আরশি শব্দটির এই সমার্থক শব্দ হচ্ছে মুকুর। এমনকি আয়না,দর্পণও। অনেকেই হয়তো বিষয়টা জানেন না তাই জানিয়ে দেওয়া হলো।