#আরশি
#Part_16
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
— শাড়িটা মিহি আন্টির না? আজ হঠাৎ এতদিন পর বের করলে যে?
আমার কথায় যে মামার মধ্যে কোন ভাবান্তর তা কিন্তু না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেন না। আমি তখনও মামার মুখপানে উত্তরের আশায় চেয়ে রই। সে নিজের চোখ আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে থাকা আলমারির দিকে চেয়ে রইলো। আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তার নিকট। তার পায়ের সামনে দুই হাটু ভাজ করে মেঝে বসে পড়লাম। নরম চোখে তাকালাম মামার মুখ পানে। কেমন মলিন হয়ে আছে। আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে মামাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার চেহেরায় বয়সের ছাপ গাঢ় হয়ে আসছে৷ চিবুকের দিকে চামড়া ঝুলতে শুরু করেছে।ইতিমধ্যে চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। চোখ দুইটি ভেতরে ডেবে গিয়েছে। তক খসখসে হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট দুইটি শুকিয়ে কেমন আধমরা হয়ে আছে। অর্ধেক পড়ে যাওয়া চুলগুলো কেমন প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে। মামাকে আগে এইভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। করলে হয়তো বুঝতে পারতাম তিনি ভালো নেই। একদম ভালো নেই। কিছুক্ষণ মামার পানে তাকিয়ে থেকে নিচে তাকাই। সাথে সাথেই সর্বপ্রথম গাঢ় বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়িটি চোখ কাড়ে। রঙটা এখনো চকচক করছে। তারই পাশে রাখা কিছু হলদে রাঙ্গা রেশমি চুড়ি, একটা ছোট আলতার কোটা, ছোট কাজলের একটা কৌটা ও একটি রঙ উঠে যাওয়া পায়েল। জিনিসগুলো দেখেই বুঝাই যাচ্ছে এতটা বছর কত যত্নে সহকারে তুলে রাখা হয়েছিল। অতি গভীর ভালবাসার আবরণে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল এইগুলোকে। সব দেখে আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
— এখনো জিনিসগুলো আগলে রেখেছ? তা ক’বছর হলো? ১১ নাকি ১২?
মামা এইবার শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,
— ১১ বছর ৮ মাস ৯ দিন হলো।
সাথে সাথে আমি ভরকে যাই। শীতল চোখে তাকিয়ে রই তার মুখপানে। ভেবেছিলাম বছর হয়তো গুনে রেখেছে কিন্তু না সে যে মাস দিন পর্যন্ত গুনে রেখেছে। আমি নিচু গলায় বলি,
— দেখে বুঝাই যায় না জিনিসগুলো আসলে এত বছর পুরানো। এখনো নতুনত্বের ছাপ রয়েই গিয়েছে।
মামা স্মিত হাসলেন। তা দেখে আমি বলি,
— এখনো এত ভালবাসো মিহি আন্টিকে?
মামা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। কয়েক মূহুর্ত এইভাবেই কেটে যাওয়ার পর মামা নরম কন্ঠে বলে উঠেন,
— জানিস! আমার প্রথম পাওয়া পারিশ্রমিকের টাকা দিয়ে মিহি আর মায়ের জন্য দুইটা শাড়ি । মায়ের শাড়িটা মাকে দেওয়া হলেও ওর শাড়িটা দেওয়া হলো না।
কথাটা শুনে আমি চুপ করে রইলাম। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম আমার মুখ পানে। মামা আবার বলে উঠলেন,
— ওর না খুব ইচ্ছে ছিল, কোন আষাঢ়ে প্রবল বর্ষণের দিনে গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি জড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করবে। এক পায়ে পায়েল জড়িয়ে মৃদু মৃদু ঝঙ্কার তুলবে স্বচ্ছ বর্ষণের ধারায়। পায়ের উপরের পৃষ্ঠায় রাঙ্গাবে রক্তিম আভায়। আবার সেই পায়ের ছাপই ছেড়ে দিবে বর্ণহীন পানির ধারায়। গভীর ঘন কাজল দিয়ে সাজাবে নিজের দুটি নয়ন আর আমাকে ওর আঁচলের শেষ প্রান্তে বেঁধে নয়ন দুইটির দায়িত্ব দিবে আমায়। লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে দেওয়ার দায়িত্ব। সেই ইচ্ছের সাথেই ছিল কত শত স্বপ্ন তার। বেশিরভাগই ছিল আজগুবি স্বপ্ন বেশি ছিল। এই যেমন, আমাদের নাকি ছোট এক সংসার হবে। কুঁড়ে ঘরের ছাউনি দেওয়া একটা ঘর। আমি মাঠে কাজ করতে গেলে রোদ্দুরে নিজের ঘাম ঝড়াব তখন নাকি সে মাথায় কাপড় দিতে আমার জন্য গরম ধোঁয়া উঠা ভাত আর ভর্তা নিয়ে হাজির হবে। মাঠের কোন এক ছাউনিতে বসে আমার মাথার ঘাম মুছে দিবে। আমি যখন তৃপ্তি করে ভাত খাব সে দুই নয়ন জুড়ে আমায় দেখবে। কি আজগুবি স্বপ্ন ছিল দেখেছিস। কিন্তু দেখ শেষে নিজেরই হাতে বোনা সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে এক নিমিষে চলে গেল। আমায় কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের পারি দিল সুখের রাজ্যে।কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে বেঁধে গেল প্রতিশ্রুতির মায়াজালে। যে মায়াজালে আমি এখন ফেঁসে আছে। এখন তো এর শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মানুষ ঠিকই বলে, “দিন শেষে প্রতারকরাই সুখে থাকে।” দেখিস না ও কত সুখে আছে। ভালো আছে।
কথাটি বলার সাথে সাথে মামার চোখ রক্তিম লাল হয়ে যায়৷ চোখের মনি ঝলমল করে উঠে। শেষের কথাটা উচ্চারণ করার সময় কন্ঠ কেঁপে উঠে। বুঝতে আর দেরি মামা আজ নিজের মধ্যে নেই। সে আজ বেসামাল হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা যেন তাকে ঝাঁকড়ে ধরেছে তাকে। হঠাৎ আমার দুই নয়নে নেমে আসে বর্ষার ধারা। যা গড়িয়ে নেমে আসে গাল থেকে চিবুক পর্যন্ত। আমি অস্পষ্ট সুরে বলি উঠি,
— সে প্রতারক নয় মামা। সে তো তোমার বিরহে বিরহিত হওয়া এক মায়াবিনী। যার ভালবাসা এতটাই প্রখর ছিল যে তার রেশ তুমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছো না। আর হয়তো কখনো কাটিয়ে উঠতেও পারবে না। সেই ক্ষমতা যে তোমার নেই।
মামা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। নিরলস তার ভাব ভঙ্গি। আমি কিছুক্ষণ মামার মুখপানে তাকিয়ে থাকি। ভাবতে থাকি, ঠিক কতটাই না ভালবাসতো দুইজন দুইজনকে। তাদের ভালবাসার সাক্ষী যে সে নিজেই। সে তো দেখেছে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল। কতটা মিষ্টি ছিল। কিন্তু এক দামকা হাওয়া এসে সব তছনছ করে দিল। আলাদা করে দিল তাদের। কিন্তু তাও ভালবাসাটায় কোন ফাটল ধরলো না। এখনো সেই সোনার খাঁটিই আছে।
আমি কিছুক্ষণ মামার পাশে বসে থেকে চলে যাই নিজের রুমে। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চোখ দুইটি এখনো জ্বলছে। হয়তো বাঁধ ভেঙ্গে বেরুবে বর্ষণের ধারা। হঠাৎ খেয়াল করলাম। আকাশে কালো ঘন মেঘ জমেছে। শো শো শব্দ করে বাতাস বইছে। তার সাথে মিশিয়ে উঁড়ে বেড়াচ্ছে ধুলোবালি। গাছের ডালপালা একে অপরের সাথে বারি খাচ্ছে৷ মাঝে মধ্যে মেঘ তীক্ষ্ণ স্বরে জেগে উঠছে। প্রত্যেক ডাকে যেন তীব্র আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কাউরো কষ্ট যেন দেখে তাদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তার এবং নিজের কষ্ট মিহিয়ে দিতে সে বৃষ্টি হয়ে নামতে চাইচ্ছে। কতটাই না আকুলতা তার। আমি একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় বিকট শব্দে মেঘ হাহাকার করে উঠলো সেই সাথে ভেসে এলো অহনার তীব্র চিৎকার। চিৎকারটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই হকচকিয়ে উঠে। দ্রুত পায়ে চলে যাই রুমে। খাটে উঠে অহনাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেই। মেয়েটা আমার ছোঁয়া পেয়ে পিঠের জামা আঁকড়ে ধরে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ফুঁপানোর ফলে চেহেরায় ফুটে উঠে রক্তিম আভা। মেঘের ডাকটা যে সে ভীষণ ভয় পায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি কিছু না বলে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
__________________________________________________
দেখতেই দেখতে ২ দিন কেটে গেল। কাজের ব্যস্ততায় কেটেছে আমার দিনগুলো। কাজগুলো নিজের আয়ত্তে আনার বেশ চেষ্টা করছি। গতকাল রাতেই মামা নিউ একটা ল্যাপটপ কিনে এনেছেন আমার কাজের জন্য। আমারও এতে সুবিধা হয়েছে। বার বার মামার রুম থেকে ল্যাপটপটা আনতে কেমন বিব্রতবোধ করছিলাম। মামা হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেই নতুন একটা কিনে নিয়ে এসেছেন।
সাদের কেবিনে আধা ঘন্টা যাবৎ ধরে বসে আছি আমি। অথচ এই ছেলেটার কোন খোঁজ খবরই নেই। অসহ্য লাগছে বেশ। ও আমাকে কিছু ফাইল দেখতে দিয়েছ। এখন সেগুলো ওকে দেখাতে হবে। ও যতক্ষণ না ফাইলগুলো দেখে এপ্রুভাল দিচ্ছে ততক্ষণ আমি পরবর্তী কাজে এগুতে পারবো না। আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর সাদ মহোদয়ের আবর্তন ঘটে। কেবিনে ঢুকতেউ সর্ব প্রথম আমাকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাকই হলো বোধ হয়। এমন ভাবার কারণ ওর কপালের সুরু ভাঁজটি। সে কিছু না বলে আগে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
— আজকের সূর্য কোন দিক দিয়ে উদয় হয়েছে যে মিস আরশি আমার দরবারে এসে দাঁড়িয়েছেন?
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদ এর দিকে তাকিয়ে বলি,
— আপনি একটু বেশি কথা বলেন।
— তাই নাকি? কিন্তু আমার জানা মতে আমি খুব অল্প পরিমাণে কথা বলি। তাহলে কি আমার জানায় ভুল আছে?
— মানুষের স্বভাব মনের মধ্যে নিজের প্রতি এক ভুল ধারণা পোষণ করে রাখা। আপনার বেলায়ও বিষয়টা ব্যতিক্রম নয়।
— আহা! কত সুন্দর উক্তি। মন যেন খুশিতে নেচে উঠলো।
কথাটা শুনে আমি কটমট দৃষ্টিতে সাদ এর দিকে তাকাই। কথায় কথায় পিঞ্চ করার স্বভাব যে এর জন্মগত তা নিয়ে আমার মনে আর কোন সন্দেহ নেই। আমি কিছু না বলে ধুপ করে তার সামনে ফাইলগুলো এগিয়ে দিলাম। সেগুলো দেখে সাদ মুচকি হাসে। সাথে সাথে গালের মাঝে তৈরি হয় সেই গর্তটি। বরাবরের মত এইবারও সেই গর্তটা আমার চোখ কাড়লো। কিন্তু অবাক করার বিষয় আজ চোখের সামনে শুধু অহনার চেহেরাটা ভেসে উঠলো। ফাহাদের কোন অস্তিত্বই চোখের সামনে আসলো না। তাহলে কি আমি ওকে একটু একটু করে ভুলিয়ে দিচ্ছি? অতীতকে পেছনে ফেলে নব্য জীবন সূচনা লিখছি?
সাদ ফাইলগুলো খুব গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে। একেকটা পয়েন্ট চেক করছে। ফাইলগুলো দেখা শেষে ফাহাদ চওড়া হাসি দিয়ে বলে,
— গুড! আ’ম ইম্প্রেসড। ৩ দিনের মাঝেই ভালোই নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছ। এইভাবে কাজ বুঝতে ও করতে থাকে সে দিন দেরি নয় যে তুমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওয়াইফের স্বীকৃতি পাবে। চালিয়ে যাও মিস দর্পণ। আই নো ইউ ক্যান ডু ইট।
প্রথম কথাটি শুনে যতটা না ভালো লাগলো লাস্টের কথাগুলো শুনে আমি পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মনে মনে ফুঁসে উঠি। ভাবতে থাকি, মানে একটা মানুষ ঠিক কতটুকু বদের হাড্ডি হলে এমন হতে পারে? ভার্সিটি লাইফেও এমন করেছে এখনো তেমনই করছে। জাস্ট অসহ্য! আমি কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,
— এতটা লেম মোটিভেশান আমি জীবনেও শুনি নি। যে কেউ আপনার কথা শুনলে নির্ঘাত ডিপ্রেশনে চলে যাবে।
সাদ এইবার চিবুকের উপর এক হাত রেখে ভাবার অভিনয় করে বলে,
— তাই নাকি? বিষয়টা তো তাহলে ভাবার বিষয়। তুমি এত বুদ্ধিমতি আগে জানা ছিল না। নাহলে বহুত আগেই তোমার এই সুন্দর চরণের দর্শন করতাম। তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতাম।
আমি কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,
— ফুলানো হচ্ছে আমাকে? আপনার বউ যদি জানতে পারে আপনি অন্যের গুনের বাহারে পঞ্চমুখ হচ্ছেন তাহলে কি হতে পারে জানেন তো?
সাদ আমার কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায়। নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রয় আমার মুখপানে। এতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। বুঝতে পারি বেশি বলে ফেলেছি। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদ মিষ্টি হেসে নির্ভয়ে বলে,
— আমার বউ অনেক ভালো বুঝলে। সব শুনবে ঠিকই,রাগে ফুলবেও ঠিকই কিন্তু আমাকে কখনোই কিছু বলবে না। সো সেটা নিয়ে কোন প্যারাই নাই চিল।
সাদের কথা টনে বুঝা যাচ্ছে সে বিষয়টা নরমালি নিয়েছে। নেগেটিভে নেয় নি। কথা ভেবেই আমি একটু প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেই। এরপর আমি পুরোপুরি শীতল রুপ ধারণ করি। সাদ তা দেখে হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে তাই কথা না বাড়িয়ে আমায় নতুন কিছু ফাইল আর কাজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। আমিও কাজগুলো ভালো মত বুঝে নিয়ে তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসি।
#চলবে