স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৪১
Writer -Afnan Lara
.
সন্ধ্যায় সাকিবের ফোন আসলো,,হিয়ার নাকি অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে
কথাটা শুনার পর মুনতাহা আর নীল অপেক্ষা করলো না
ছুটলো হসপিটালের দিকে
ডাক্তার জানালেন ঠিক করে বলতে পারবেন না হিয়া আর কতদিন বাঁচবে
রোগটা অনেক আগেই ধরা খেয়েছিলো কিন্তু হিয়া সিনটোমস্ এ মনযোগ দেয়নি বলে আজ এতটাদিন হয়ে গেলো
হিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বেডে,সাকিব ওর পাশে চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে
নীল কাছে এসে দাঁড়াতেই সাকিব হিয়ার দিকে তাকানো অবস্থায় বললো”হয়ত আমার মন্দ কপালের কারণে আজ হিয়ার সাথে এমনটা হলো,তোমার সাথে বিয়ে হলে ও খুশি হইতো,ওর এমন রোগ হতো না,সুখে থাকলে তো আর এমন মরণরোগে ধরে না তাই না নীল?”
.
নীল সাকিবের কাঁধে হাত রেখে বললো”হিয়ার আমার কাছ থেকেও তোমার কাছে বেশি সুখী হতো বলেই ওর নাম তোমার ভাগ্যে ছিলো”
.
কিন্তু নীল,সে যে এখন নিজেই আমার ভাগ্য থেকে চলে যাচ্ছে,কটা দিন হলো আমাকে মনে নিয়েছিলো,নিজের করে নিয়েছিলো সে
এত সুখের দিন আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি আর হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো,সব ওলটপালট হয়ে গেছে
আমার মাথা কাজ করছে না কিছুতেই
.
মুন দূর থেকে সাকিবের কথা শুনছে,মাঝে মাঝে হিয়ার মুখের দিকেও তাকাচ্ছে,আজ হিয়ার প্রতি মায়া হচ্ছে,মনে মনে মুন বললো কেন নীলের সাথে হিয়ার বিয়ে হলো না
হয়ত আজ হিয়া খুশি থাকতো
নীল হিয়ার ব্যাগে ঝুলে থাকা একটা ছোট্ট আয়নায় মুনকে দেখে পিছনে তাকালো,মুন চোখ মুছে চলে যাচ্ছে
নীল সাকিবের মাথায় হাত রেখে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে
মুন আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে,এখানে থাকলে শুধু কষ্ট বাড়ে
এর চেয়ে বরং আমি বাসায় ফিরে যাই
যেতে যেতেই সে খেয়াল করলো নীল ওর হাত ধরে ফেলেছে
মুন শান্ত গলায় বললো”আমি বাসায় ফিরে যাই,আপনি এখানে থাকুন,হিয়া আপুর সাথে একটু সময় কাটান,আমি কিন্তু রাগ করিনি,হয়ত এতদিন করা রাগটাও ঠিক ছিলো না”
.
চলো বাসায় ফিরি,হিয়ার একটু শরীর খারাপ হচ্ছিলো ডাক্তার ওকে ঘুমের ঔষুধ দিয়েছেন,এখন ঘুমাচ্ছে,আমার থেকে আর কাজ নেই,আর সব চাইতে বড় কথা হলো সাকিব ওর কাছে একা থাকা জরুরি এখন
হাসবেন্ড তো সাকিব,তাই না?
.
মুন মাথা হেলিয়ে নীলের ডান হাতের পাঁচটা আঙ্গুলকে আঁকড়ে ধরলো
নীল চুপচাপ ওকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে জিপে বসালো তারপর বললো”কপালে যা আছে তা তো হবেই,চাইলেও আর ধরে রাখা যাবে না,তার চেয়ে বরং বর্তমানে যে আছে তাকে হার্ট না করি!”
.
মুন ছলছল চোখে চেয়ে বললো”আমি বলছি আপনি হিয়া আপুর কাছে গিয়ে একটু বসুন,কিছু মনে করবো না সত্যি”
.
তাহা,তোমার মন খারাপ হবে বলে আমি ওখান থেকে চলে আসিনি,,আমার চাইতেও সাকিবের হিয়ার প্রতি অধিকার বেশি,সাকিবের জায়গায় এখন আমাকে মানায় না,আর হিয়া নিজেও চায়না আমি থাকি
ও চায় যতক্ষন ওর হুস জ্ঞান আছে ততক্ষণ সে সাকিবের সামনা সামনি থাকবে
আর আমিও ভাবলাম ওদের একা থাকতে দেওয়া উচিত,ভেবো না তোমায় দেওয়া প্রমিসের কথা মাথায় রেখে এমনটা করছি আমি,,যেটা এখন একচুয়ালি ঠিক আমি সেটাই করছি
.
হিয়া আপুকে কত খোঁচা মেরে কথা বলেছিলাম আমি,আমার কান্না থামছেই না,একবার আপুর সাথে একান্তে কথা বলা যাবে না?
.
বলিও পরে,এখন বলো আইসক্রিম খাবে?
.
মুন চোখ মুছে নিয়ে বললো”এসময়ে আবার আইসক্রিম?গলা দিয়ে পানি নামবে না আমার”
.
হিয়ার জন্য আমার সাথে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে নিজেরই খেয়াল রাখা ভুলে যাচ্ছো তুমি
.
আপনি এমন কেন বলুনতো!এতদিন চাইছিলাম শুধু আমাকে নিয়ে ভাবুন,আর আজ যখন চাইছি হিয়াপুকে নিয়ে ভাবুন তখন আপনি শুধু আমাকে নিয়েই ভাবছেন
.
কারণ আমি আজ দেখলাম সাকিব হিয়ার কত খেয়াল রাখছে,হিয়াকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে সাকিব
আমার আর কিছুই জানার নেই,আমি চাই হিয়া যতদিন বেঁচে থাকবে অন্ততপক্ষে সাকিবের ভালোবাসায় ভালো থাকবে
আমাকে দেখলে ওর নাম না জানা আঘাত বুকে বিধবে,আমি চাই না আমাকে দেখে ও কষ্ট পাক
.
ঠিক আছে,তাহলে আইস্ক্রিম খাওয়ান,চকলেট ফ্লেভারের
.
নীল মুচকি হেসে জিপ থেকে নেমে গেলো আইস্ক্রিম আনতে,,মুন হসপিটালের দিকে চেয়ে ভাবলো হিয়া নীলকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে কেন
ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাবার এটাই তো সময়
আর আমি ও তো বাধা দিচ্ছি না,আমিও চাই ওরা একে অপরের সাথে আলাপ করুক
না সাকিব কিছু বলছে,আর না আমি
তাহলে কেন ওরা নিজ থেকেই আলাদা হয়ে গেলো
.
নিন,ম্যাডাম,আপনার আইস্ক্রিম
.
মুন নীলের হাত থেকে আইস্ক্রিম নিয়ে বললো”আপনি খাবেন না?”
.
নাহ,আমি আইস্ক্রিম কম খাই
.
বলতে বলতে জিপ স্টার্ট করলো নীল
মুন আইসক্রিম খেতে খেতে নীলকে দেখছে,,মুখের ভাবগতি নরমাল রেখে নীল ড্রাইভ করে যাচ্ছে
মুন দুষ্টুমি করে আইসক্রিম নীলের গালে লাগিয়ে দিলো তারপর বললো”জানি আজ আমাকে বকবেন না,কিন্তু কেন বলুন তো?”
.
একটা মানুষের চোখে সুখ দেখে আর সেই সুখ কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছা জাগে না আমার,সারাজীবন এই সুখটাই দেখতে চাই
.
কথাটা বলে হাত দিয়ে আইস্ক্রিম মুছে সেটা মুনের গালে আবারও লাগিয়ে দিলো নীল,মুন চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেললো,,হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে সে
নীল ও ওর সাথে হাসলো
হিয়ার নাম,আর কথা কিছুই নেই, কিছু মূহুর্তের জন্য নীল সবটা ভুলে গেলো
বাসায় ফিরার পর ওদের দুজনের মুখে হাসি দেখে বাকিদের মনটা কিছুটা শান্ত হলো,তারা ভেবেছিলো হিয়ার এমন সংবাদ শুনে না জানি নীল আবারও আগের মতন হয়ে যায়,মুন তাহলে শুধু শুধু কষ্ট পাবে,কিন্তু নাহ
নীল সুন্দর করে দুদিক সামলে নিয়েছে
মুনের মুখে হাসি দেখতে পেয়ে সবার মুখেও হাসি ফুটলো
মা হিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন নীলের থেকে
.
মুন নীলের রুমে এসে বিছানা টেনেটুনে দিলো,নীল আজ সারাদিন যে পরিমাণ কষ্টে ছিলো,খাওয়া দাওয়া ওর উঠেই গেছে,এবার ওর রেস্ট নেওয়া জরুরি,,মুন বিছানা জলদি করে ঠিক করে ভাবলো খাবার আনবে,নীলকে জোর করে খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলবে,,
নীল চুপচাপ রুমে ঢুকে বললো”এত প্ল্যান করতে হবে না”
.
মুন তো চোখ বড় করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ ,ওর মনের কথা নীল বুঝলো নাকি আন্দাজ করলো
নীল গায়ের শার্টটা পালটে দুম করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বললো”খিধে নেই,তুমি খেয়ে নাও,আমার পেট ভরে গেছে দারুন দারুন সংবাদে”
.
সবাইকে সবার খেয়াল রাখতে বলে আপনি নিজেই নিজের খেয়াল রাখছেন না,কেন?
.
আমি এমনিতেই ভালো থাকি,দেখো না তোমাকে আর সাকিবকে আর হিয়াকে সামলালাম,,আমি স্ট্রং না হলে কি তা পসিবল হতো?
.
আপনার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তা আপনার চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারি আমি
.
তাহলে ঠোঁট দেখো,চোখ দেখো না
.
মুন লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে রুম থেকে চলে গেলো,এত সিরিয়াস মোমেন্টও মুখে হাসি ফুটিয়ে দিলো নীল
সব কিছু থেকে দূরে থাকতে চাইছে সে,কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না সে ঠিক কতটা কষ্টে প্রতিটা মূহুর্ত কাটাচ্ছে,সাকিবকে হিয়ার পাশে রেখে এসে কত বড় প্রতিদান দিলো তা শুধু নীলই জানে
ভালোবাসার মানুষটাকে বুকে টেনে হাউমাউ করে কাঁদার অধিকার টা নীলের থেকেও নেই
মুন ভ্যাত কেঁদে দিলো এসব ভেবে, নিপা তার রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মুন করিডোরে এসে কাঁদছে
নিপা এগিয়ে এসে বললো”ভাইয়া কিছু বলেছ”
.
উনি আর কি বলবেন,উনাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না,উনি এমন কেন!
.
কি করেছে আবার?হিয়া হিয়া শুরু করেছে?
.
নাহ,,হিয়াকে এত ভালোবাসে তাও উনি হিয়ার পাশেও বসলেন না,চলে আসলেন এক নজর দেখে
.
ভালোবাসতো,এখন বাসে না
.
মুন চোখ তুলে তাকালো,নিপা মুনের থুতনিটা টেনে দিয়ে বললো”তোমায় ভালোবাসে,বলোতো কি করে জানলাম?”
.
কি করে?
.
যদি এখনও সেই আগের মতন করে পাগলমত ভালোবাসতো তাহলে স্ত্রী সন্তান কিছু না মেনে হিয়ার কাছে পড়ে থাকতো
কিন্তু সে ওটা করেনি,,তোমার কাছে,নিজের বাসায় সে আছে এই মূহুর্তে
তোমাকে বুঝাতে চাচ্ছে যাই হোক না কেন তার মনটা তোমার কাছেই থাকবে
হ্যাঁ এটা ঠিক হিয়ার প্রতি ওর একটা আলাদা টান আছে
তবে সেই টানের মানে আজও ভালেবাসা নয়
ভালেবাসার নৌকা এখন তোমার নামে পাল তুলে চলছে
বুঝলে মেয়ে?
.
নাহ তো
.
তাহলে গিয়ে নিজের বরকেই প্রশ্ন করো,এত করে বুঝালাম তাও বুঝলে না
.
মুন মাথা নাড়িয়ে আবারও নীলের রুমের দরজার কাছে এসে হাজির হয়ে গেলো
নীল ওপাশ করে শুয়ে আছে গায়ে চাদরটা টেনে
মুন পা টিপে টিপে কাছে এসে নীলের চোখদুটো উঁকি মেরে দেখলো ভিজে আছে কিনা
কিন্তু না ভিজে নেই
মুন হালকা কেশে বললো”একটা কথা বলবেন?”
.
নীল ঘুম ঘুম আওয়াজে বললো”হুম”
.
কাকে ভালেবাসেন?
.
নীল বালিশের নিচে মুখটা লুকিয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো”যে প্রশ্ন করছে তাকে”
.
তাহলে বিরক্তি নিয়ে বললেন কেন?ভালোবাসার কথা ভালোবেসেও তো বলা যায়
.
আসো বুকে বসো
.
কথাটা বলে নীল মুনের হাত ধরে টান দিয়ে বিছানার খালি জায়গায় নিয়ে আসলো,মুন চিৎকার দিতে গিয়েও পারলো না
নীল মুনের গলা টিপে ধরে বললো”লাভ ইউ!!!!
হ্যাপি?এবার আমাকে ঘুমাতে দেও”
.
আই… বলেন নাই তো
.
উফ!!তোমার মাথায় এই কথাটার ভূত কে উঠিয়েছে?
.
কেউ না,আমার জানতে মন চাইলো
.
জানা হয়ে গেছে?হয় আমার সাথে ঘুমাও নয়ত চুপ করে বসে থাকো
.
আমি যদি আপনাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকি?
.
নীল মুনকে টেনে ঝাপটে ধরে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো
মুন চুপ করে বড়- ছোট শ্বাস নিচ্ছে,নীল মনে হয় ঘুমিয়েও পড়েছে
এভাবে বাধ্য ছেলের মতন কাজ করছে কেন উনি?
.
এরকম নড়াচড়া করতেছো কেন?আর কি জানার আছে?
.
কতটুকু ভালোবাসেন আমায়?
.
যতটুকু বাসলে তোমায় আমি আমার আগে মরতেও দেবো না ততটুকু
.
আমার যদি হিয়া আপুর মতন রোগ হয় তখন কি করবেন?
.
জীবনের প্রিয় জিনিস একটা হারিয়ে গেলে সেটা হয় নিয়তি
কিন্তু দিত্বীয় টা হারাতে দিতে হয় না,আমি তোমায় আমার চোখের আড়াল হতে দেবো না,তোমায় আমি এত ভালোবাসা দেবো যে তোমার শরীরে রোগ বাসাই বাঁধতে পারবে না
.
বেশি সুখ মানুষের সহ্য হয় না তো
.
আমি তোমায় সহ্য করাবো,,সহ্য করানোর ঔষুধ আমি জানি
.
কি?
.
একটা চুমু দিয়ে একটা চড় মারি দিব,ব্যস হয়ে গেলো,সুখ দুঃখের সমাহার
.
মুন ফিক করে হেসে দিলো,হাসতে হাসতে নীলের বুকে মুখটা লুকালো সে,,
নীল ওর চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো”আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি তোমার রক্ষা করবো তাহা,,তোমার দায়িত্ব সেই শুরু থেকেই আমার,আর এখন ভালোবাসার ভার ও যোগ হয়েছে,সবটা মিলিয়ে তুমি আমার কাছে অনেক দামি”
.
ভাত খাবেন?
.
এই সময়ে তোমার আর কথা ছিল না?আমি সিরিয়াস কথা বলছিলাম এর ভিতরে ভাত ঢুকিয়ে দিলে
চলবে♥