#Crush_Villain
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৭ ||
মধ্যরাত।অন্ধকারের চাদরে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। রাত্রিজাগা পাখি এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদটা যেনো লজ্জা পেয়ে মেঘগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে। আবছা আবছা কুয়াশা আছে সাথে রয়েছে চারপাশে শীতল হাওয়া। দুপাশে গাছপালা এবং তার মাঝে হাইওয়ে রোড। হাইওয়ে রোড কে আলোকিত করেছে রাস্তার ধারের একেকটা ল্যাম্পপোস্ট।লোকজন নেই বললেই চলে। চারপাশে শুনশান নিরবতা! শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া দূর-দূরান্তে আর কোনো শব্দ নেই। সেই হাইওয়েতেই চলে যাচ্ছে দুইজন যুবক-যুবতী। যুবতী বিয়ের কনের সাজে রয়েছে যেনো বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে প্রেমিকের সাথে রাত্রি ভ্রমণে বেরিয়েছে। মেয়েটি ভয় ভয় চোখে চারপাশটা দেখছে। গাছপালা গুলো তার কাছে অনেকটা ভূতের মতো লাগছে। সামনের প্রেমিক হেসে বলে,”উফফ সানি তুমিও না! বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছো আর এখন এই সামান্যতে ভয়ে মরে যাচ্ছো?”
– তুমি চুপ করো! তোমার লজিক তোমার পকেটে ঢুকিয়ে রাখো আমাকে শোনানো লাগবে না!
– ওহ রিয়েলি?(হেসে) তাহলে চলো তোমায় এই জঙ্গলে রেখে আমি চলে যাই।
সানিয়া পেছন থেকে আয়াফকে ঝাপটে ধরে রাগি কন্ঠে বলে,”এক কিলে তোমার লাইফ হ্যাল করে দিবো! আ…কিইইইইল!!!!”
আয়াফ মুখ গোমড়া করে বলে,”মায়ের জ্বালায় বউয়ের কাছে এই আকিল নামটা এভাবে শোনা লাগছে!”
সানিয়া ফিক করে হেসে দেয় আর আয়াফ গাল গুলিয়ে বাইক চালাচ্ছে। সানিয়া তা বুঝতে পেরে পরম আবেশে আয়াফকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা দিয়ে চোখ বুজে থাকে। মুহূর্তে-ই আয়াফের রাগ গলে গেলো তবুও বুঝতে দিলো না। সানিয়া বলে,”এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
– আমার বাসায়! মা বাবা কাজি নিয়ে বসে আছে নাকি এমনটাই জানালো!
– ওরিম্মা! আমার শাশুড়ী শশুড় তো দেখছি অনেক ফাস্ট!
– তা তাদের পুত্রবধূ এতো ফাস্ট হলে তারা কেন হবে না?
সানিয়া হেসে দেয়। শহরের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ দূরে দেখতে পায় একটা টঙ। তআ দেখতে পেতেই সানিয়া বলে উঠে,”আয়াফ ওই টঙ এ চলো গরম গরম চা খাবো!”
– হোয়াট! এই ফুটপাতের আনহাইজিনিক চা খাবা? এসব খাওয়ার দরকার নেই বাসায় চলো মায়ের হাতের চা তৃওতি করে খেয়ো!
– না আমি টঙের চা-ই খাবো! নিকুচি করেছি তোমার আনহাইজিনিকের দাদার নাম!
– সে তুমি যাই বলো না কেন আমি তোমাকে খেতে দেবো না।
সানিয়া গাল ফুলিয়ে বলে,”আপনি যাবেন নাকি আমি বাইক থেকে লাফ দিবো!”
– এই না, না!
– তাহলে যাবেন কি না?
– ওকে যাচ্ছি।
বলেই বাইক টঙ এর সামক্নে পার্ক করলো। তারপর আয়াফ চলে গেলো চা আনতে। স্নাইয়া চেঁচিয়ে বলে,”এইযে শুনছেন?”
আয়াফ সানিয়ার দিকে ফিরতেই সানিয়া আবার চেঁচিয়ে বলে,”দুই কাপ আনবেন!”
সানিয়ার কথামতো আয়াফ দুইকাপই আনলো। সানিয়া এক কাপ হাতে নিয়ে তৃপ্তি করে খেতে লাগে আর আয়াফ কেমন মুখ করে তাকিয়ে আছে সানিয়ার দিকে। সানিয়া আয়াফকে খেয়াল করতেই বলে,”দাঁড়িয়ে আছেন কেন খেয়ে নিন জলদি করে গরম গরম নয়তো মজা লাগবে না!”
– কিহ আমি খা…(সানিয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই) আচ্ছা আচ্ছা খাচ্ছি।
বলেই এক চুমুক দিলো আয়াফ। আয়াফ নিজেই অবাক হয়ে গেলো এমন টেস্ট পেয়ে। আয়াফ এক ঢোকেই পুরোটা খেয়ে ফেলে। সানিয়া হেসে হেসে বলে,”কি মজা পেলেন তো?”
– হুম অনেকটা। অনেক বড় অভিজ্ঞতা হলো। যাইহোক আর খাবা?
– নাহ আপনি কাপগুলো দিয়ে আসুন।
– আচ্ছা।
বলেই আয়াফ চলে গেলো। ফিরে এসে বাইক স্টার্ট দেয়। এভাবেই খুনশুটি করতে করতে দুজন প্রায় রাত ১ঃ৪৭ মিনিটে আয়াফের বাসায় পৌঁছায়। সানিয়া ভেতরে গিয়ে দেখে আরাভ জুরাইজ পায়চারি করছে। আয়াফের মা এক সিঙ্গেল সোফায় নিশি আপু আর রোজার সাথে বসে আছে আর কাজী সাহেব ঘুমে ঢুলছে। মেইন গেইটের সামনে নীল, যাহির আর তিনয় দাঁড়িয়ে ছিলো। আয়াফকে পেতেই একসাথে এসেছে। আরাভ জুরাইজের হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যেতেই বলে,”আরে ওইতো ওরা চলে এসেছে।”
আরাভ জুরাইজের কথা সকলের ঘুম, চিন্তা ছুটে যায় এবং সাথে সাথেই দরজার দিকে তাকালো। আয়াফ তাড়া দিয়ে বলে,”ডেড এতো সময় নেই তাড়াতাড়ি যা ব্যবস্থা করার করো অনেক টায়ার্ড আমরা।”
– হ্যাঁ তাতো বটেই। তোরা আয় বস আর কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।
আরাভ জুরাইজের কথা শুনতেই সে বিয়ে পড়ানো শুরু করে আর আয়াফ সানিয়া কাজির অপজিটে বসে। অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। তবে সানিয়া কবুল বলতে কিছুটা দেরি করেছিলো। বিয়ে শেষ হতেই আয়াফের মা নিজহাতে খুবই যত্ন করে সানিয়াকে আর আয়াফকে খাইয়ে দিলো। সানিয়া মুগ্ধ হয়ে তার শাশুড়ীকে দেখছে। এত্তো ভালো মানুষ আদৌ কি আছে?
খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আয়াফের মা বলে উঠে,”আজ আয়াফ আর সানিয়া আলাদা ঘরে ঘুমাক। ওর পরিবার থেকে মতামত নিয়েই একসাথে থাকবে।”
এই কথায় আয়াফ এবং সানিয়া উভয়ই সম্মতি দিলো। তারপর আয়াফ নিজের ঘরে চলে গেলো আর সানিয়া নিশির সাথে একটা রুমে চলে গেলো। আজ নিশির সাথেই সানিয়া ঘুমোবে। অনেকদিন পর শান্তির ঘুম দিবে সে।
পরেরদিন,,
মাহিদের মা জুঁই গালে হাত দিয়ে শোকাহত হয়ে বসে আছে। দূরে নিলুফা তার ছোট বোনের সাথে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অন্যপাশের এক সোফায় সানিয়ার বাবা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে পত্রিকা পরছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি সবটা স্বাভাবিক। নানুও চুপ করে তার বড় ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি আলিজা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ড্রয়িং রুমে এসে সবার কান্ড দেখছে। আত্নীয়-স্বজন কেউ-ই নেই একমাত্র ওরা বাদে। কিছুক্ষণ পর নতুন বউয়ের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে মুনতাহা। ঠোঁটে লেগে আছে তার এক তৃপ্তিময় হাসি। জুঁইয়ের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে মুনতাহার হাসি-খুশি মুখ দেখে।মুনতাহা মিষ্টি হেসে বলে,”তা মা নাস্তার ব্যবস্থা হয়েছে নাকি আমি নাস্তা বানাবো!”
জুঁই রেগে চেঁচিয়ে বলে,”কোন মুখে তুমি আমায় মা বলো হ্যাঁ?”
– আমার মুখে।(মজা নিয়ে)
– বেয়াদব মেয়ে একটা! কই থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো আমার ছেলের জীবনে খবরদার আমাকে কখনো মা বলবা না নয়তো তোমার ঘাড়ে মামলা চাপিয়ে দিবো!
– হাহা শাসুমা! পুরান আমলের ডায়লগ দিলে হয়? আর আপনি আমার ঘাড়ে মামলা নয় আমি আপনার ঘাড়ে মামলা দিবো যদি শাশুড়ী হয়ে বউ নির্যাতন করতে আসেন। জানেন তো আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার?(ডেবিল হাসি দিয়ে)
জুঁই আবার চুপসে গেলো। মনের ঝাল এই মুনতাহার উপর ঝাড়তে পারেনা এইটাই তার বড় কষ্ট। গতকাল বিয়ে হওয়ার পর থেকেই মুনতাহা তাকে এই থ্রেডের উপরেই রাখছে। তাই না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। মুনতাহা হেসে নিলুফার দিকে এগিয়ে বলে,”ফুপি আমি কি নাস্তা বানাবো?”
সানিয়ার মা তার ভাবির দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”না নাস্তা আগেই বানিয়েছি তুমি এক কাজ করো মাহিদকে ডেকে আনো ততোক্ষণে আমি খাবার ডাইনিং এ সাজাচ্ছি।”
– আচ্ছা ফুপি।
বলেই মুনতাহা তার শাশুড়ীর দিকে একপলক তাকায়। তার শাশুড়ী তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে মুনতাহা মুচকি হেসে চোখ টিপ মারলো। তারপর উপরে চলে গেলো। দূরে দাঁড়িয়ে রুহি আর আলিজা মুখ টিপে হাসছে।
নিলুফা খাবার বাড়ছে তখনই জুঁই রেগে বলে,”তোমার মেয়ে পালিয়ে গেছে সেদিকে চিন্তা না করে তুমি এই মেয়েকে নিয়ে পরে আছো? সামান্য খোঁজ কেন নিচ্ছো না যে মেয়ে কোথায় আছে?”
নিলুফা কিছু বললো না কারণ সে অনেকটা জানে মুনতাহা তাকে অনেক আপডেট দিয়েছে তাই এই মুহূর্তে তার মেয়ের চিন্তা নেই। সে মনে করে পালিয়েছে বেশ করেছে। এটা শুধু নিলুফার ভাবনা নয় উপস্থিত সবার ভাবনা একমাত্র জুঁই বাদে। নিলুফা কিছু বলছে না দেখে জুঁই আবার বলে,”আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি নিলু!”
– আমার মেয়ের উপর আমার ভরসা আছে ঠিক ফিরে আসবে তাই আপাতত ওকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই।
– বিয়ে টা যে তোমার মেয়ে করলো না, এখন কি তুমি ওরে ঘরে জায়গা দিবা?
– অবশ্যই না দেয়ার কি আছে?
– আমার মেয়ে হলে তো আমি ওকে মেরে মাটিতে পুতে রাখতাম আর তুমি কি না গর্ব করে বলছো ওকে বাসায় রাখবে?
– আপনার আর আমার মাঝে এইটুকুই তফাৎ। আল্লাহ হয়তো এই কারণেই আপনাকে মেয়ে দেননি কিন্তু আমাকে দিয়েছে।
– অপমান করছো আমায়?
– যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। তবে কন্যাসন্তান আল্লাহ’র রহমত। আর আল্লাহ’র রহমত মাটিতে পুতে রাখার মতো গাছের আগাছা না। আপনি নিজেও একজন মেয়ে তাই ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। আপনারা জোর করেছেন দেখেই পালিয়েছে।
– ওওও আচ্ছা তার মানে পালাতে তুমি সাহায্য করেছো তাইনা?
– না তা করিনি তবে মনে হচ্ছে আমি করলে দ্বিগুণ স্বস্তি পেতাম! এখন আল্লাহর কাছে শুকুরিয়া যে দুটো ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ক নষ্ট করেন নি।
– নিলুফা!!(উঠে দাঁড়িয়ে)
জুঁই আরও কিছু বলতে নিলেও পারলো না কারণ মাহিদ আর মুনতাহা ততোক্ষণে চলে এসেছিলো। জুঁই শুধু এইটুকু-ই রাগি সুরে বলে,”বিকালে বউভাতের পর যাতে তোমাদের এবাড়িতে না দেখি!”
– থাকার প্রশ্নও উঠে না।
এই উত্তর পেয়ে জুঁই রেগেমেগে ভেতরে চলে গেলো। নিলুফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো এই ব্যবহার টা তার আগে করা উচিত ছিলো। যদি করতো তাহলে হয়তো এই দিন দেখতে হতো না। হ্যাঁ সে কথা দিয়েছিলো তবে তার কথার কারণে ২টা নয় ৪টা জীবন নষ্ট হতো। জীবন নষ্টের কাছে একটা কথা ভাঙ্গা তেমন কিছু না। আর এখানে তার কোনো দোষ নেই কারণ যা করার ছেলেমেয়েরাই করেছে।
নিলুফা মুনতাহাকে খাবার দিতে দিতে বলে,”আলিজা, রুহি তোরাও এসে বস খেয়ে নে।”
আলিজা, রুহি এসেও খেতে বসে গেলো। নিলুফা আবার বলে,”হ্যাঁ রে মুনতাহা মা সানিয়া এখন কোথায়?”
– ফুপি নো চিন্তা এখন সে তার শশুড়বাড়িতেই আছে।
নিলুফা ভ্রু কুচকে বলে,”শশুড়বাড়ি মানে?”
– তোমার মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।(আলিজা)
নিলুফা আর কিছু বললো না। নিলুফাকে চুপ থাকতে দেখে রুহি বলে,”খালামনি তুমি কি সানিয়ার উপর রেগে আছো?”
– না। তবে বেশ অনুতপ্ত।
বলেই স্বামীর দিকে তাকালো। সানিয়ার আব্বু তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিলুফা তাকানোর চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো।
[সকলের মনে এখন প্রশ্ন জাগলো কিভাবে কি হলো তাইতো? তাহলে চলুন ফ্লাসব্যাক পড়ে আসি।]
রোজার বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ পর,,
চলবে!!!
(অতিরিক্ত পর্ব দেয়ার চেষ্টা করবো তবে আপনাদের মন্তব্যের উপর নির্ভর করেই দেবো)