স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-১৩

0
4925

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-১৩||

আকাশ হঠাৎ আমায় এমন একটা উদ্ভট রিকুয়েষ্ট করে বসবে যা আমি কখনো চিন্তাই করতে পারি নি।আমি চরম ক্রুদ্ধ এবং অবাক!
আজ সকালে যখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম,ঠিক তখন আকাশ কল করে।ঘুমা ঘুমা চোখে আমি কলটা রিসিভ করি।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আকাশের গম্ভীরা স্বর পাল্টে যায়।সে বাচ্চাসুলভ কন্ঠের ঝুঁড়ি খুলে বললো,

“সানা,তুই এখন ঘুমাচ্ছিস?”
আমি ঘুম মাখা কন্ঠে বললাম,
“হু।”

“একটা কথা বলব! প্লিজ শুনবি?”
“হু,বল!”
“আজ তুই যখন আসবি তখন প্লিজজ প্লিজজ একটা শাড়ি পড়ে আছিস!তোকে শাড়ি পড়া দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে !না করিস না,প্লিজ?”

এমন অপ্রস্তুতকর কথা শুনামাত্রই আমার তরল চোখের ঘুম এক নিমিষে উড়ে যায়।একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তরহর শোয়া থেকে উঠে বসি।বিবৃতি কন্ঠে বললাম,

“শাড়ি পড়বো মানে?”
“খুব করে মন চাইছে একপলক তোকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখতে।নারীদের অপ্রতিম সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় তার শাড়িতে,আর কেশেতে ত আরো বেশ!ইচ্ছে হলে শাড়ির সাথে চুলগুলোও ছেড়ে আছিস। আর ইচ্ছে না হলে ছাড়িস না।ওটায় তোকে চাপ দিচ্ছি না!”

আমি কী উত্তর করবো নিজেই বুঝতে পারছি না।চোখবুঁজে শুধু এটুকুই বললাম,

“আকাশ এটা অসম্ভব!”
আকাশ এ কথার পিঠে আর কিছু বলার সাহস পেল না।তারপর অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে বললো,
“তা কখন আসছিস?”
“বারোটার দিকে।”
“ওকে সাবধানে আসিস।আসলে কথা হবে।বায়।”

বলেই ফোন রেখে দেয়।আমি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিচে আলতো রেখে দিয়ে কিছু সময় একটা ঘোরের মধ্যে কাঁটিয়ে দিই।
তবে,যতটা ভেবেছি ও বোধহয় ঘোরের বসে এসব বলছে!নাহলে হুটহাট এমন কিছু বলা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে অসম্ভব!ভালোবাসে বুঝলাম,ভালোবাসে বলেই যে সে তার লিমিটেশন ক্রস করবে এটা আমি নিঃসন্দিহান।কারণ আকাশ আমি শুধু আজ নয় ছয় ছয়টা বছর ধরে চিনে এসেছি ও কেমন!
কাজেই বিষয়টিকে মাথায় বেশিক্ষণ আর পাত্তা দিই নি।

বারোটার দিকে রেডি হই মার রিপোর্ট আনতে। গাঁয়ে আলখাল্লার মতো একটা থ্রী-পিস জড়িয়ে নিই। আর চুলগুলো খোপা করে মাথায় ওড়না টেনে দিই।
হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে নিচে আসতেই খালামণিকে চোখে পড়ে।উনি দূর থেকে আমাকে দেখামাত্রই হেসে দেন।আমি উনার কাছে আসতেই বলে উঠেন,

“কোথাও যাওয়া হচ্ছে, সানা?”
আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বললাম,

“জ্বী,খালামণি!আপনাকে কালরাতে বলবো বলবো বলে আর বলা হয়নি।”
“ইট’স ওকে।তা কোথায় যাবা?”
“ধানমন্ডিতে আমার একটা ফ্রেন্ড আছে।ওর জব ইন্টারভিউ চলছে।নীলক্ষেত থেকে কিছু বই কিনবে।তাই কাল রাত জোড় রিকুয়েষ্ট করেছে যে করেই হোক ওর সাথে একটু নীলক্ষেত যেতে। ওখানে খুঁজে খুঁজে ওকে ভালোমানের কিছু বই সাজেস্ট করে দিতে।বান্ধবী ত..! তাই আর কি খালামণি বারণ….।”
“নো প্রবলেম।নো প্রবলেম।বান্ধবী যেহেতু বলেছে যাও।”
“জ্বী,খালামণি সেটাই।”
“সাবধানে যেও।”
“জ্বী,আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম!”

আমি সদরে পা রাখতেই খালামণি পেছন থেকে আবার ডেকে উঠেন।আমি দ্বিধান্দ্বিত চোখে পেছন ঘুরে তাকাই।ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুঁলিয়ে বললাম,

“জ্বী,আন্টি কিছু বলবেন?”
“তুমি এখন যাবে কোথায়?”
“জ্বী,নীলক্ষেতেই।ও নীলক্ষেতই আসবে।”
“তাহলে গাড়ি আছে!গাড়ি করে যাও!যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না।”

“নাহ নাহ আমি সি.এন.জি করেই যেতে পারবো!”

“সি.এন.জি অনেক ভাড়া নেয়!তাছাড়া,ঢাকায় তুমি নতুন!এরা নতুনদের পেলে ত আরো দ্বিগুণ টুঁকিয়ে নেয়!যেটা বলছি সেটা শুনো!ঢাকায় আমি আজ একত্রিশ বছর! আমি জানি এই শহরের সবাই কেমন।আমি রহমত ভাইকে ডেকে দিচ্ছি। ও তোমায় নীলক্ষেত দিয়ে আসবে!”

পরে আর কি!উনার শক্ত কথার জিম্মিতে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাধ্য মেয়ের মতো উনার কথা মেনে নিই।

তারপর, আমি গাড়িতে উঠে বসি।রহমত চাচা গাড়ির গ্লাস পরিষ্কার করছেন!এমতাবস্থায় কোথায় থেকে একটা মেয়ে এসে রহমত চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আন্টি বাসায় আছে?”
“হ্যাঁ,মামণি আপা বাসাই আছে।”
“ওকে!”
বলেই মেয়েটি রহমত চাচাকে পাশ কেঁটে গেইটের ভেতর ঢুকে যায়।আমি বড়বড় চোখ করে মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।মেয়েটির পড়নে লেডি শার্ট গেন্জি আর স্কিন জিন্স।চুলগুলো বেসামাল ছড়ানো।তার সুন্দরের কথা বললে আমি সন্দিহান। কেননা, মেয়েটি মেকআপ করায় ছিল।কাজেই কালো নাকি ফর্সা বুঝতে পারিনি।তবে,সম্ভবত ফর্সা ই হবে।

রহমত চাচার গ্লাস পরিষ্কার করা শেষ হলে উনি ড্রাইভিং সিটে এসে বসেন।আমি তড়বড় বলে উঠি,

“চাচা,ওই মেয়েটি কে ছিল?”
তিনি অবচেতব মনে বলেন,
“কোন মেয়ে?”
“এই যে মাত্র আপনার সাথে কথা বলে ভেতরে ঢুকলো।”
“ওহ জেনি?ও ত ম্যাডামের কাছে প্রায়ই আসে।সামনের তিন চার বিল্ডিং ফেরুলেই ওর বাসা!”

আমি মুহূর্তেই কেনজানি খুব কৌতূহলী হয়ে যাই।উনার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই,
“প্রায়ই কেন আসে?”
“ম্যাডামের সাথে জেনির খুব ভালো সখ্য।ম্যাডাম জেনিরে খুবই পছন্দ করে।একদিন জেনিরে না দেখলে দেখতা ম্যাডামের কি অবস্থা হয়.!”
বলেই উনি কিচকিচ হেসে উঠেন।

“তা ওই মেয়েও পাগল উনার জন্যে?”
রহমত চাচা হাসি থামিয়ে ঘাড় ঘুরে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলেন,
“হু,খুব!তাছাড়া,ম্যাডাম ত চাচ্ছেন জেনিরে তুরাব স্যারের বউ করতে তাই আর কি পাগল ত হবেই।”

“তুরাব স্যারের বউ করতে”- কথাটি আমার ডান কান দিয়ে ঢুকলেও বাম কান দিয়ে আর বেরুতে পারেনি।সতর্ক চোখে উনাকে আবারো প্রশ্নবাণে ফেলি।বললাম,

” তা বউ করবেই?”
এরইমধ্যে রহমত চাচা গাড়ি স্টার্ট করে দেন।গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে চোখের দৃষ্টি সামনে রেখেই বেখেয়ালি বলেন,

“তুরাব স্যার রাজি হইলেই ত বউ করতে পারবো!”
“উনি রাজি নয়?”
রহমত চাচা দু’পাশে মাথা নাড়েন!মুহূর্তেই আমি সতর্ক হয়ে যাই সেদিনের ডিভোর্সের ব্যাপারটায় সম্পূর্ণই এই জেনি হলো তার একটা কারণ!নাহলে খালামণি সেদিন তুরাব ভাইয়ার রিলেশনের কথা এভাবে তুলতেন না!আচ্ছা,তুরাব ভাইয়াও খালামণির কথাটায় সায় দিলেন কেন?এর কারণ কী?এর পেছনে কী এমন কারণ থাকতে পারে?জানতে হবে এর উত্তর! আর স্বয়ং তা তুরাব ভাইয়ার থেকেই।
খালামণির প্রতি এই মুহূর্তে আমার খুব ঘৃণা,রাগ অনুভূত হয়!মানুষ এত পাষাণ ভরে নিজের হাতে গড়িয়ে দেওয়া পবিত্র বন্ধনটাকে নিজেই ভেঙ্গে দিতে পারেন?মানুষ কিভাবে এতটা স্বার্থপর হয়?কীভাবে টাকাপয়সার কাছে নিজের ওয়াদাকে ভঙ্গ করে?

আচ্ছা,তাহলে জ্ঞানী গুণীরা ত ভুল বলেননি,মানুষ অহংকারের সীমা লঙ্ঘন করলে একেবারে মাটির সাথেও মিশে যেতে পারে!

নীলক্ষেতের মোড়ে এসে গাড়ি থামে।আমার অবচেতন মনের ঘোর কাঁটে রহমত চাচার কথার আওয়াজে।বললেন,

“মা নামবা না?”

আমি দৃঢ় চোখের পাতা মেলে বাইরে তাকাই। বহর বহর বইয়ের স্টল!তারমানে এখন নীলক্ষেত!তবে নীলক্ষেত এসে আক্ষেপ হইনি।বরঞ্চ মিথ্যে ভণিতায় নীলক্ষেত এসে অন্তত সত্যিটা ত জানতে পেলাম!এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি!

চলবে….