হৃদয়সিন্ধুর পাড়ে পর্ব-১৯

0
3798

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৯
#কায়ানাত_আফরিন

২৭.
চোখ পিটপিট করে খুলতেই মৌনির মুখে আছড়ে পড়লো কারও উত্যপ্ত নিঃশ্বাস। আবছাভাবে কোনো পুরুষের অবয়ব দেখতে পেলো সে। কিন্ত রোদ্দুরের অগোছালো রশ্নিটা জানালা দিয়ে এমনভাবে নুয়ে পড়ছে যার কারনে ঠিকমতো তাকাতেই পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন সামনের দৃষ্টি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে তখনই থমকে গেলো মৌনি। নিভ্র ওর দিকে গহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৌনির একপলক মনে হলো গতরাতের মতো আবারও ভ্রম হলো না-তো ! তাই চোখ বন্ধ করে মৌনি বিড়বিড়িয়ে উঠলো,

–”মৌনি ! এটা তোর নিভ্র ভাই না। তুই আবারও কল্পনা করছিস। শান্ত হ।”

–”আমিই নিভ্র মৌনি। তুমি ঠিক দেখছো।”

নিভ্রর কন্ঠ ওর স্নায়ুতন্ত্র স্পর্শ করতেই শরীরে একটা কম্পন ছেয়ে গেলো। এটা নিভ্রর সেই মনমাতানো কন্ঠ। তড়িঘড়ি করে মৌনি উঠতে যাবে নিভ্র তখনই মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দেয় ওর মুখে। যার দরুন মৌনি ভারক্রান্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। নিভ্র বললো,

–”গতরাতের তুলনায় জ্বর এখন অনেক কম । তুমি এখন রেস্ট নাও। একটু পর খাবার খেয়ে ঔষুধ খেতে হবে।”

নিভ্র এমনভাবে ওর সাথে ব্যবহার করছে যেনো তেমন কিছুই হয়নি। তাই নিভ্রর এমন ব্যবহার মৌনির মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাটা ৭ টা ৫৮ ছুই ছুই। আর দু’মিনিট পেরোলেই আটটা বেজে যাবে। কিন্ত মৌনি ভেবে পাচ্ছে না নিভ্র কখন এলো। তাই আমতা আমতা করে বললো,

–”আপনি কখন এসেছেন?”

–”ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে।”

মৌনি চোখ বড় বড় করে ফেলে। সাড়ে পাঁচটার দিকে এসেছে মানে? ঢাকা থেকে কুমিল্লা আসতেই তো চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লাগে। নিভ্র আবারও বলে উঠলো,

–”আঙ্কেল রাত আড়াইটার দিকে তোমার মোবাইল থেকে ফোন দিয়েছিলো যে তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। তাই তোমাদের এখানকার ডাক্তারকে আনলে উনি দেখেন তোমার জ্বর ১০৪ ডিগ্রি+। আমার তখন জানটাই বের হয়ে গিয়েছিলো। তাই তৎক্ষণাৎ আমি এখানে আসার জন্য রওনা হই আর আসতে আসতে সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়।”

এ কথা শোনামাত্রই মৌনি গভীরভাবে নিভ্রকে পর্যবেক্ষণ করে। হাসিও পাচ্ছে বটে।কারন নিভ্র একটা লেমন কালার টিশার্ট আর গ্রে ট্রাউজার পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে আশরাফ সাহেব কল দেওয়া মাত্র বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করেনি সে। তখনই গাড়ি নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।চুলগুলোও অনেকটা এলোমেলো , মুখে রয়েছে ক্লান্তির ছাপ।

–”গতরাতে ট্যাবলেট খেতে ভুলে গিয়েছিলে । তাই না?”
নিভ্রর কথায় তীক্ষ্ণতা স্পষ্ট। মৌনি তাই মলিন গলায় প্রতিউত্তরে বললো, ”হ্যাঁ।”

–”এসব কথায় হেলফেল করো কেনো মৌনি? ঔষধের ব্যাপারে উদাসীনতা আমি মোটেও পছন্দ করিনা। একবেলা ঔষধ না খেলেই তোমার কি অবস্থা হয় তুমি দেখেছো?”

মৌনি চুপ হয়ে আছে। নিভ্রর বকা দেওয়া এখন জায়েজ আছে। মৌনি তবুও কানে হাত দিয়ে মলিন সুরে বললো,”সরি!”
মৌনির এমন আদুরে কন্ঠ শুনে নিভ্র আর কিছুই বললো না। এই মেয়েটার সাথে বেশিক্ষণ যেন রাগ করে থাকাই যায় না। গতকাল মৌনির ঘটনা শুনে নিভ্র আসলেই বেশ ভয় পেয়েছিলো। নিভ্রকে নিয়ে মৌনি অনেক বেশি পজেসিভ। তাই নিজের ছোট বোনের সাথেও দুর্ব্যবহার করতে মৌনি দু’বার ভাবেনি। নিভ্র মৌনির হাত নিজের হাতে বন্দী করে নেয়। কোমল গলায় মৌনিকে প্রশ্ন করলো,

–”গতকাল ঠিক কি কারনে তুমি অজ্ঞান হয়েছিলে?”

–”ওই ট্যাবলেটটা না খাওয়াতেই এমন হয়েছে। একটা fake illustration তৈরি হয়েছিলো আমার সামনে।”

–”বুঝতে পারলাম। তাই বলি এত স্ট্রেস নিও না। এটা তোমার health আর mind দুটোর জন্যই খারাপ হতে পারে। আর তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।”

–”কি?”

–”তোমার প্রজেক্ট কমপ্লিট। জহির শেখের বিরুদ্ধে সকল প্রুফ তোমার প্রফেসর মিডিয়ায় বুস্ট করেছে আমার কথায়। গতকালই তাকে আটক করা হয়েছে।”

একটা আনন্দের রেশ দেখা যায় মৌনির চোখে-মুখে। এই প্রজেক্টটা নিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে মৌনির জীবনে। পরিশেষে এই অধ্যায়টি তবে শেষ হলো বলে মৌনির ধারনা।
–”সত্যি? তবে শেষপর্যন্ত মিনিস্টার জহির শেখ জেলে গেলো।”

–”হ্যাঁ। আর কিছুদিন পরেই তোমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”

–”বলেন কি? আমি তাহলে ঢাকায় ফিরে যাবো।”

–”উহু ! আগে নিজের প্রতি যত্ন নাও। তারপর পড়াশোনার কথা চিন্তা করবে।”

–”কিন্ত আমি আবার ঢাকায় ফিরে যেতে চাই। আমাদের ক্যাম্পাস, টিউশনি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা এগুলো ভীষন মিস করি। আপনিই তো বলেন আমার ডিপ্রেশন দূর করার সবচেয়ে ভালো ওষুধ হলো এগুলো ভুলে থাকা। তাহলে যাই না……….প্লিজ?”

মৌনির চোখে মুখে কৌতুহলতা। নিভ্র তাই নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
–”আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি আঙ্কেলকে বলছি যে আজই তোমায় নিয়ে যাবো।”

মৌনির এবার কি হলো সে নিজেই জানেনা। আচমকা উঠে নিভ্রর বুকে মিশে গেলো। নিভ্রর এই বুকটা কেন যেন মৌনির একান্ত নিজের মনে হয়। এটাই মৌনির কাছে একমাত্র স্থান যেখানে ও প্রচন্ড শান্তি অনুভব করে। নিভ্র মৌনির এহেন কান্ডে আলতো হেসে ফেললো।মৌনি নিভ্রর বুকের সাথে মিশে মিহি কন্ঠে বললো,

–”ধন্যবাদ নিভ্র ভাই।”

–”ধন্যবাদ কেন?”

–”আপনার মতো মানুষ আমি আমার ২০ বছরের গন্ডিতে কখনোই দেখিনি। আমরা কিন্ত নিতান্তই অপরিচিত ছিলাম। তবুও আমার কঠিন সময়ে আমার পাশে আপনি দাঁড়িয়েছিলেন। এমনভাবে আমার কেয়ার করেছিলেন যে আমি বোধহয় আপনার কাছের কেউ। আর সেই লোভ সামলাতে না পেরেই তো আপনাকে ভালোবেসে ফেললাম।”
মৌনির শেষ কথাটি শুনে নিভ্র হো হো করে হেসে উঠলো। বলে কি মেয়েটা?মৌনি নিতান্ত সহজ-সরল বলেই এতটা গভীরভাবে নিভ্র ওকে মনে ধারন করে ফেলেছে। মৌনি এখনও নিভ্রর প্রশস্ত বুকে নিজের মুখ গুজেঁ আছে। নিভ্র তা দেখে একটা ঠোঁট কামড়ে হাসি দিয়ে বললো,

–”এভাবে হুট করে আমার বুকে মিশে গেলে কি হবে? আদর করতে ইচ্ছে করে তো !”

–”এতো অসভ্য কেন আপনি? কই আমাকে বলবেন -আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি ; কিন্ত আপনি বললেন-আদর করতে ইচ্ছে করছে !”

–”ভুল বললাম নাকি? এত্ত রূপবতী একটা মেয়ে যদি নিজ থেকে কাছে এসে পড়ে কোন ছেলেই বা স্বাভাবিক থাকবে? ইচ্ছে তো করে…………….”

মৌনি তৎক্ষণাৎ নিভ্রর কাছ থেকে সরে আসলো। নিভ্র মুখে তখনও দুষ্টু হাসির রেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মৌনি আমতা আমতা করে বললো,

–”ব-ব-বাবা এসে পড়বে। আপনি প্লিজ থামুন।”

–”আমার বুকে যখন শামুকের মতো লেপ্টে ছিলে তখন বুঝি আসতো না?”

”শামুকের মতো লেপ্টে ছিলে” কথাটি শোনার পর মৌনির গাল লালচে আভা ধারন করলো। ওর হলদেটে ফর্সা মুখে লাজরাঙা রঙটা নিভ্রর কাছে অনন্য লাগছে। নিভ্র ছেলেটাকে মৌনি যতটা ভদ্র মনে করেছিলো ঠিক ততটাই ফাজিল সে। মৌনি বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
”অসহ্য”

—————————–
টলতে টলতে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো রিদান। গতরাতে লম্বা সময় নেশা করার কারনে এখনও আ্যলকোহলের নেশায় অনেকটা বুদ হয়ে আছে। মৃধা ড্রইংরুমেই বসে ছিলো। রিদানকে এ অবস্থায় দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো । এ আর নতুন কিছু না। প্রায়শই রিদান রাতে এরকম করে বারে যায় আর সারারাত ড্রিংক আর মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে সকালে বাড়িতে আসে। রিদানের এমন কাজে জহির শেখ কখনোই বাঁধা দিতেন না তাই মৃধারও কখনও সাহস হয়নি রিদানকে কিছু বলার। যতই ওর মামাতো ভাই হোক না কেন ; রিদানকে ও প্রচন্ড ভয় পায়।

রিদানের এমন অবস্থা দেখে মৃধা এগিয়ে এলো রিদানের কাছে। কাঁপাকাপাঁ গলায় বললো,
–”আ-আমার সাথে চলো দ-দাভাই। আমি তোমায় তোমার রুমে দিয়ে আসছি।”

–”তুই কেন আমায় হেল্প করবি? আমি তো খারাপ। আমাকে সবাই শুধু ঘৃণাই করতে পারে।”
নেশার ঘোরে রিদান এ কথা বলে ওঠলো। মৃধা বিরক্ত হয়ে তাই বলে,

–”এসব কি আবোল-তাবোল বলছো? চলো আমার সাথে।”

মৃধা রিদানের হাত ধরে রিদানের রুমে এগোতে থাকলো। এদিকে রিদান নেশাতে বুদ হয়ে রীতিমতো খাপছাড়া কথা বলেই চলছে। মৃধা তবুও কিছু বললো না।
রিদানের ঘরটা বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। পর্দা না খোলার কারনে সূর্যের তেজস্ক্রীয় রশ্নিটা সরাসরি ঘরে প্রবেশ করতে পারছে না। মৃধা রিদানের বাহু ধরে খাটে শুয়িয়ে দিতে যাবে ঠিক তখনই মৃধাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো রিদান। ঘটনার তৎক্ষণাৎ প্রবাহে মৃধা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ওর। কেননা এর আগে রিদান কখনোই ওর এত কাছে আসেনি।

–”আমি কি সত্যিই অনেক খারাপ মৃধা?”
রিদানের নেশাগ্রস্থ কন্ঠ। মৃধা বুঝতে পারলো গতরাতে ওর ব্যবহারে রিদানের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে।

–”বল না? আমার খারাপের জন্যই কি সবাই আমায় ঘৃণা করে?”

–”হ-হ-হঁ্যা।” মৃধার জড়ানো কন্ঠ।

রিদান কিছু না বলে বাচ্চাদের মতো মৃধার চুলের ব্যান্ড খুলে মুখ গুঁজে দিলো। রিদানের আকস্মিক ব্যবহারে নিজের হিতাহিত জ্ঞান মৃধা হারিয়ে ফেলছে। ঘরটিতে অন্ধকারের হাতছানি। রিদানের নেশায় বুদ হওয়া অবস্থায় ঘোর লাগানো কন্ঠ যেন অন্য কিছুই ইঙ্গিত করছে। পরিবেশটা মৃধার কাছে বেশ অস্বস্তিকর। চারিদিকে কেমন যেন রোমাঞ্চকর আভাস। রিদান এবার জড়ানো কন্ঠে বললো,

–”ছোটবেলা থেকে ভালোবাসা ঘৃণা কিছুই বুঝতাম না। বাবা যা বলতো তাই করতাম। মা হীন ছেলে ছিলাম বলে কখনও কোনো কিছুতে বাঁধা পায়নি। যা ইচ্ছে হতো সেটাই করতাম। ”

রিদানের উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর চুল ভেদ করে ঘাড় স্পর্শ করছে। তাই নিজেকে মোমের পুতুলের ন্যায় মনে হচ্ছে মৃধার। সবকিছুতেই যেন বিব্রতকর ছাপ। রিদানের জন্য মনে খেলা করছে আবেগের প্রকান্ড খেলা। এমন ভারসাম্যহীন পরিবেশে একে অপরের নিঃশ্বাস ছাড়া কিছুই অনুভব করা যাচ্ছে না।
রিদানের কোনো হুঁশ নেই। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যদি মরতে হয় তবুও সে মরতে রাজি। কিন্ত আপনজনের তিক্ততা-ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচতে পারবে না। রিদান কাতর গলায় বললো,

–”আমি ঘৃণা চাই না মৃধা। আমি ভালোবাসা চাই। আমায় একটু ভালোবাসতে পারবি?”
.
.
.
.
~চলবে