ভালোবাসি তারে
২২.
দিনটা হলো গ্রীষ্মের তেরোতম দিন। নিঝুম আজকে প্রচুর ব্যস্ত। অথচ বিকেলেই মিসেস সানজিদাকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়ার কথা তার। কতক্ষণে কাজ শেষ করে, কতক্ষণে শপিংয়ে যাবে সে চিন্তাতেই নিঝুমের ক্লান্ত অবস্থা। মেডিকেলের ফাইলগুলো টেবিলের একসাইডে রেখে চেরায়ে হেলান দিয়ে বসল নিঝুম। ক্লান্তিতে বার কয়েকবার লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। চোখ বুজতেই ঝুমের হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠল সামনে। সেই সঙ্গে নিঝুমও হাসলো অস্পষ্ট। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজ পেলো নিঝুম। মুহুর্তেই সোজা হয়ে বসে মুখে গম্ভীরভাব এটে নিল। গম্ভীর গলায় বলল,
— “কাম ইন।”
দরজা ঠেলে কেউ একজন কেবিনে ঢুকে পরল। নিঝুম তাকালো সেদিকে। এবং বিস্মিত হয়ে চেয়েই রইল। নিলয় তার ছোট ছোট পায়ে কেবিনের অধিকাংশ জায়গা পার করে চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাসি-মুখে বলল,
— “ভাইয়া? তুমি এখানে? তুমি কি এই হাসপাতালেই কাজ করো?”
নিঝুম তখনো বিস্ময় কাটাতে পারে নি। কিছু জিজ্ঞেস করবে তখনই ঝুম প্রবেশ করে কেবিনে। নিঝুমের দিকে না তাকিয়েই অপরাধীর ন্যায় বলতে শুরু করে,
— “আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখীত ডক্টর। আমার ভাইটা একটু বেশিই দুষ্টো তো! দুষ্টুমি করতে করতে ভুলে এখানে চলে এসেছে। ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা করবেন।”
একটু থেমে নিলয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলল,
— “নিলয়, আয়!”
— “ঝুম?”
শান্ত স্বরে ডাকে নিঝুম। ডাক শুনে ঝুম চমকে উঠে। বড় বড় চোখে সামনে তাকায়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে নিঝুমকে দেখে মুখের ‘রা’ চলে যায় যেন। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়। নিঝুম একাধারে বলে উঠে,
— “তোমরা এখানে কেন এসেছো? সবাই ঠিক আছে তো? তুমি ঠিক আছো?”
ঝুম স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ম্লান হেসে বলল,
— “আমরা সবাই ঠিক আছি। শুধু আম্মার প্রেসার হঠাৎ-ই অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাই আসা..! আপনি কি এই হাসপাতালেরই ডাক্তার?”
— “হ্যাঁ।”
নিঝুম ঝুমের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। ঝুমের মুখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “এখন আন্টি কেমন আছে?”
— “অনেকটাই ভালো।”
— “কোন ডাক্তার দেখিয়েছো?”
— “আপনার পাশের কেবিনেরই। নাম ঠিক মনে নেই।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “ডক্টর সেন?”
— “হয়তো।”
— “ওহ! আঙ্কেল কোথায়?”
— “আব্বা আম্মার কাছে আছেন।”
কথা আর বাড়ে না। কথা ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না তারা। দুজনেই চাচ্ছে কথা যেন আরো বাড়ুক। আরেকটু সময় যেন দুজনে একসাথে থাকুক। অথচ আজ কি হয়েছে কে জানে? কিছু বলার খুঁজেই পাচ্ছে না কেউ।
নিরবতা ভেঙ্গে ঝুমই প্রথমে বলল,
— “আমি তাহলে আসি ডাক্তার? নিলয়? আয়!”
নিঝুম বুঝে পায় না কি বলবে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে শেষে বলেই ফেলল,
— “যাওয়ার আগে তোমার আপুকে নিয়ে একবার কেবিনে এসো, ঠিকাছে নিলয়? চকলেট আছে তোমার জন্য।”
নিলয়ের চোখ,মুখ চকচক করে উঠে। প্রায় অনেকবার মাথা নাড়ায় সে। ঝুম কিছু বলে না। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসে মাত্র। পরপরই নিলয়কে নিয়ে চলে যায়। নিঝুম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে।
______________________________
দুপুর প্রায়। ঝুম চলে যাবে এখন। নিলয় সন্ধ্যায় মিসেস শ্রেয়া এবং আলম খানের সঙ্গে বাসায় ফিরবে। ঝুম যাওয়ার আগে নিলয় ঠিকই তাকে নিয়ে চলে যায় নিঝুমের কেবিনে। নিঝুমের কাছাকাছি এসে নিলয় একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে,
— “ভাইয়া? চকলেট দাও আমার। আমি এসেছি।”
নিঝুম মুচকি হাসে। ড্রয়ার থেকে অনেকগুলো চকলেট বের করে ধরিয়ে দেয় নিলয়কে। নিলয় সাথে সাথে কয়েকটা চকলেট ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে। নিঝুম স্থির চাহনি ফেলে ঝুমের পানে। জিজ্ঞেস করে,
— “এখনই চলে যাচ্ছো?”
ঝুম আড়চোখে নিঝুমের দিকে তাকায়। যখন দেখে নিঝুমের দৃষ্টি তার দিকেই, তখন দ্রুত মাথা নত করে ফেলে আবার। ছোট্ট করে বলে,
— “জ্বী।”
— “নিলয় যাচ্ছে?”
— “না। আম্মা, আব্বার সঙ্গে সন্ধ্যায় যাবে।”
নিঝুম কিছু বলে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় হঠাৎ। এপ্রোনের দু’পকেটে দুহাত রাখে। ঝুমের সামনা সামনি এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তীব্র গাম্ভীর্য নিয়ে বলে,
— “চলো, তোমায় এগিয়ে দেই।”
গাম্ভীর্য ভাব বজায় রাখতে পারে না নিঝুম। হেসে দেয় নিঃশব্দে। ঝুমও মুচকি হাসে।
ঝুমকে নিয়ে হাসপাতালের উঠানের দিকটায় হাঁটছে নিঝুম। কেমন অস্থির, অস্থির লাগছে তার। ঝুমকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। অথচ কেন যেন পারছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিঝুমের অস্থিরতাও বেড়ে চলছে। আড়চোখে কয়েকবার ঝুমকে দেখে নিলো নিঝুম। শেষে না পেরে প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল সে। সিগারেট ধরিয়ে দক্ষিণ দিকে মুখ করে ধোঁয়া উড়ানো শুরু করল। ঝুম ভ্রু কুঁচকায়। নাকে সিগারেটের গন্ধ যেতেই নাক কুঁচকে বলে উঠে,
— “হাসপাতালেও সিগ্রেট খাচ্ছেন? ছিঃ!”
নিঝুমের নির্বিকার কণ্ঠ,
— “ছিঃ-য়ের কি আছে?”
— “ডাক্তার হয়ে সিগ্রেট খাবেন কেন? তাও আবার হাসপাতালে! আপনি এমন করলে বাকিরা কি করবে?”
— “আমার মতো সিগারেট খাবে।”
নিঝুমের এহেন নির্লিপ্ত ভাব দেখে রাগ হলো ঝুমের। নাক ফুলিয়ে রইল শুধু। কিছু বলল না। নিঝুম আশেপাশে তাকালো একবার। ব্যস্ত হাসপাতালটায় তাদের দিকে তাকানোর মত কেউ নেই। সুতরাং, সিগারেট ফেলে দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না নিঝুমের কাছে।
নিঝুমকে তবুও সিগারেট খেতে দেখে ক্ষীপ্ত ভাবে ঝুম প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “আপনি ঠিক কখন সিগ্রেট খাওয়া ছেড়ে দেবেন ডাক্তার?”
— “যখন প্রিয় মানুষটা বলবে, ছেঁড়ে দাও!”
বলেই ঝুমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নিঝুম। ঝুম মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায়। নিঝুমের হাসি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কয়েক সেকেন্ড। নিঝুম মুখ ফিরিয়ে নিতেই, সেও মাথা নত করে ফেলে।
— “তুমি বলেছিলে তোমাকে একটা ছেলে পছন্দ করে। তুমি কি তাকে পছন্দ করো?”
হঠাৎ প্রশ্নে ঝুম ভড়কে যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু নিঝুম তখনো অন্যদিকে মুখ করে আছে। এবং সেভাবেই আবার বলে,
— “কি যেন নাম?”
ঝুম ঢোক গিলে। ধীর গলায় বলে,
— “সাগ্রত।”
— “পছন্দ কর ওকে?”
ঝুম কি বলবে ভেবে পায় না। নিঝুম কেমন সিরিয়াস ভাবে বলছে কথা গুলো। মনে হচ্ছে রেগে আছে। ঝুম ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,
— “এসব কথা কেন আসছে? ভালো কিছু বলি?”
— “না। উত্তর চাই আমার।”
নিঝুমের ক্ষীপ্ত কণ্ঠ শুনে ঝুমের এবার মজা লাগছে। নিঝুমের সঙ্গে দুষ্টুমী করতে ইচ্ছে করছে খুব। সেই ভাবনা মতেই ঝুম হাসি-মুখে বলে,
— “যদি বলি হ্যাঁ?”
নিঝুমের বুক ভারী হয়ে উঠে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কথাও যেন বলতে পারছে না। দাঁড়িয়ে যায় সে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঝুমও দাঁড়ায়। নিঝুমকে এমন করতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। পরক্ষণেই হালকা হেসে বলে,
— “আমি দুষ্টুমী করছিলাম ডাক্তার। আমি পছন্দ করি না।”
নিঝুমের মনে হলো, বুকের ভারী পাথরটা তপ্ত নিশ্বাসের সঙ্গে দ্রুত হালকা হয়ে যাচ্ছে। নিমিষেই শান্ত শান্ত লাগছে নিজেকে। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে দিল নিঝুম। বলল,
— “ভালো তো।”
নিঝুমের মুখে এমন কথা আশা করে নি ঝুম। ভেবেছিল নিঝুম হয়তো তাকে বকবে। অনতত এটা বলবে না। ঝুম মুখ ফুলালো। চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলো নিঝুমের দিকে। নিঝুম তখন সিএঞ্জি খুঁজতে ব্যস্ত। একটা সিএঞ্জি পেতেই ঝুমকে বলল,
— “যাও।”
ঝুম হালকা মাথা নাড়িয়ে সিএঞ্জিতে উঠতে নেয়। নিঝুম দেয় না। হাত ধরে ফেলে। ঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নিঝুম হেসে ঝুমের বাম গালটা একহাতে টেনে ধরে। বলে,
— “ঝুমময় পিচ্চি? একদম চিন্তা করবে না ঠিকাছে? আমি আছি আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে।”
মুহুর্তেই ঝুমের মুখে হাসি ফুটে উঠে৷ আর নীলাভ চোখজোড়ায় প্রতিবিম্ব হয়ে ফুটে উঠে ঝুমের হাসি মাখা মুখ।
______________________________
আলম খানের সঙ্গে বসে বসে চা খাচ্ছে নিঝুম। উনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। নিঝুম আশ্বস্ত গলায় বলল,
— “চিন্তা করবেন না মাস্টার আঙ্কেল। আন্টি এখন অনেকটাই সুস্থ। আশা করি পরবর্তীতে এমন কিছু হবে না। তাই এমন মনমরা হয়ে থাকবেন না। আপনি ভেঙ্গে পরলে কিন্তু আপনার পরিবার ভেঙ্গে পরবে।”
আলম খান মলিন হাসলেন। মনে মনে আশ্বস্ত হলেন খানিকটা। পরক্ষণেই মিসেস শ্রেয়ার শুকিয়ে যাওয়া চেহারা সামনে ভেসে উঠতেই ম্লান মুখে বলে উঠলেন,
— “দুনিয়ায় আর কি আছে বল তো? প্রিয় মানুষটাই যদি চলে যায় তাহলে বাঁচার উদ্দেশ্যটাই হাঁরিয়ে যাবে। তবুও বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। উদ্দেশ্য হাঁরিয়েও আরেকটা উদ্দেশ্য অজান্তেই থেকে যায়। তাই হয়তো!”
নিঝুম মনে মনে কয়েকবার কথাগুলো আওড়ায়। গভীর ভাবে চিন্তা করে কথাগুলোর অর্থ। আচ্ছা, আন্টি তো এখনও সুস্থ আছেন। তবুও আঙ্কেলের কতটা ভয় তাকে নিয়ে। নিঝুমেরও তো ভয় হয় ঝুমকে নিয়ে। ঝুমকে যদি সে হাঁরিয়ে ফেলে? হঠাৎ নিঝুম ঘামতে শুরু করে। সূর্যের তাপ যেন বেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। নিঝুম হাসফাস করছে। পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করল সে। পাশে রাখা চায়ের কাপের দিকে চাইলোই না। চা পান করলে যদি আরো খারাপ লাগে?
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ কি মনে করে নিঝুম বলে উঠে,
— “বেঁচে থাকাটা সহজ আঙ্কেল। তবে, তাদের স্মৃতি আকঁড়ে ধরে বেঁচে থাকাটা কঠিন।”
__________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা