ভালোবাসি তারে পর্ব-২৩

0
5799

ভালোবাসি তারে

২৩.
বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল ঝুম। হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে তার সুন্দর ঘুমটা নিমিষেই ভেঙ্গে গেল। সেই সঙ্গে বিগড়ে গেল ঝুমের মেজাজ। তবুও নিজেকে সামলে নিলো সে। বিছানা ছেড়ে উঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলল। আলম খান এসেছেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নিলয় চলে যায় নিজের রুমে। হয়তো ফ্রেশ হয়ে পড়াশোনা করতে বসবে। ছেলেটা আবার পড়াশোনায় বড্ড সিরিয়াস। আলম খানের এক কাঁধে মিসেস শ্রেয়া ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একপা একপা করে মিসেস শ্রেয়াকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। ঝুম সরে দাঁড়ালো। তারা যেতেই আবারো দরজা লাগাতে গিয়ে সামনে যখন তাকালো, এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল যেন। চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকিয়ে রইল হাসি-মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নিঝুমের পানে। এটা কি সত্যি নিঝুম? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। আনমনেই বলল,
— “আপনি?”

নিঝুম ভারী অবাক হলো যেন। পরক্ষণেই মুচকি হেসে জবাব দিলো,
— “আমি? আমি নিঝুম। তোমার ডাক্তার।”
ঝুম থতমত খেয়ে যায়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
— “আমি তো চিনি আপনাকে।”
— “তাহলে জিজ্ঞেস করছ যে?”
ঝুম আগের তুলনায় আরো মিনমিনিয়ে বলল,
— “আমি ত-তো শুধু…”

বাকি কথা বলার আগেই আলম খান ভেতরের রুম থেকে জোড় গলায় বলে উঠলেন,
— “ঝুম মা? এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিঝুম কোথায়? ও কি চলে গেছে?”

ঝুম আলম খানের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
— “যায় নি আব্বা।”
পর মুহুর্তে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় ঝুম। নিচু স্বরে বলে,
— “ভেতরে আসুন।”
বিনা বাক্যে ভেতরে ঢুকে পড়ে নিঝুম। ড্রইংরুমের দিকটায় আলম খান বসে ছিলেন। তিনি নিঝুমকে তার পাশে বসতে বলেন। অতঃপর তারা দুজনেই বসে বসে গল্প করা শুরু করে দেন।

মিসেস শ্রেয়া যেহেতু অসুস্থ, আপাতত ঝুম রান্নাঘরের দিকটা সামলাচ্ছে। বুঝতে পারছে না নিঝুমকে কি খেতে দেবে। মাস শেষ! বাসায় সব কিছুই অল্পসল্প। ঝুম একবার শুনেছিল, নিঝুমের নাকি পায়েস বেশ পছন্দের। পায়েস রাঁধলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ! পায়েস রাঁধার সবকিছু এক এক করে বের করতে লাগল ঝুম। এবং বিপত্তি বাঁধলো সেখানেই। বাসায় চিনি নেই। এবার? ঝুম হাত কঁচলাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নেয়। পরক্ষণেই জোড় গলায় ডেকে উঠে নিলয়কে,
— “নিলয়? ভাই রান্নাঘরে আয় তো একটু।”

দেখা গেল নিলয় আসতে দেড়ি করছে। ঝুম রান্নাঘর থেকে উঁকি দিলো ড্রইংরুমে। নিলয় আসছে কি না দেখতে। অথচ বেশিক্ষণ উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থাকতে পারল না। নিঝুম আগে থেকেই তার শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল রান্নাঘরের দিকটায়। ঝুমের কাছে অদ্ভুদ লাগলো সেই দৃষ্টি। সঙ্গে লজ্জাও পেলো। নিলয়কে ডেকে কি ঝুম ভুল করেছে? চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল ঝুম। সে এত ইরিটেটিং কেন? উফফ!

নিলয় রান্নাঘরে এলে ঝুমের ইচ্ছে করে তাকে কয়েকটা বকা দিতে। দিতেও চাইলো। কিন্তু পরে ভাবলো, বকা দিলে যদি নিলয় চিনি আনতে না যায়? নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে ঝুম। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— “বাসায় চিনি নেই। পাশের বাসা থেকে নিয়ে আয় তো। যা!”

নিলয় হা করে ঝুমকে পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ। কিছু বলতে চাইলো যেন। পড়ে যখন দেখলো তার বোন কোনো কিছু নিয়ে রেগে আছে, তখন আর মুখ থেকে একটি শব্দও বেরুলো না তার। দৌঁড়ে চলে গেল পাশের বাসায়।

_________________________

পায়েস বানানো শেষে সেখান থেকে একটু চেখে দেখলো ঝুম। উহু, বাজে হয় নি। বরং ভালোই হয়েছে। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল ঝুম। একরাশ শান্তি শান্তি ভাব নিয়ে কাঁচের বাটিতে পায়েস টুকু ঢেলে ট্রে-তে করে নিয়ে চলে গেল ড্রইংরুমে। তারপর যখন নিঝুমের সামনে টেবিলে রাখলো নিঝুম তাকাল তার দিকে। একঝাঁক মায়া নিয়ে। ঝুম ঢোক গিলল। হাসার চেষ্টা করল একটু। তবুও নিঝুনের দৃষ্টি পাল্টালো না। পাশ থেকে আলম খান এবার বলে উঠলেন,
— “বসে আছো কেন নিঝুম? খাওয়া শুরু করো।”

নিঝুম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। পায়েসের বাটি নিতেই আলম খান আবারো বলে উঠলেন,
— “লজ্জা পাবে না। নিজেরই বাসা ভাববে।”
নিঝুম এবারো কিছু বলে না। বরং মারাত্ত্বক একটা হাসি উপহার দেয়।

এদিকে ঝুমের হাত, পা কাঁপছে। যদিও সে জানে পায়েসটা খেতে ভালোই হয়েছে। তবুও যদি নিঝুমের ভালো না লাগে? ফাঁকা ঢোক গিলল ঝুম। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে রইল। নিঝুম আস্তে ধীরে এক চামচ পায়েস খেয়ে নিলো। তবে পায়েস খেয়ে কোনো ভাবগতি প্রকাশ করল না। সে স্বাভাবিক। তার দৃষ্টি বাটি-টির দিকে। একটু পর নিঝুম আরেক চামচ পায়েস খেল। এবং সে তখনো আগের ন্যায় স্বাভাবিক। ঝুম বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। নিঝুমের কি ভালো লাগে নি পায়েসটা? নাকি ভালো লেগেছে? আচ্ছা, সব কিছু এত জটিল কেন? মাথায় কিছুই ঢুকছে না ঝুমের।

ঝুম বিরক্তি নিয়ে আবারো নিঝুমের দিকে তাকাতেই দেখলো নিঝুম তার দিকেউ তাকিয়ে আছে। ঝুম তাকাতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ঝুম হকচকিয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুদ ভাবে তার মন ভালো হয়ে যায় তখনই।

নিঝুম চলে যাবে এখন। আলম খান মিসেস শ্রেয়ার সঙ্গে রুমে আছেন। ঝুম মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুমের সামনে। নিঝুম গম্ভীর গলায় বলে,
— “আমার দিকে তাকাও।”
ঝুম না তাকিয়েই প্রশ্ন করল,
— “জ্বী?”
— “তাকাতে বলেছি ঝুম।”
ঝুম ধীরে ধীরে নিঝুমের পানে তাকায়। সাথে সাথে নিঝুম ঝুমের কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে আবার আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায়। ঝুম বিস্ময়ে হা হয়ে বড় বড় চোখে তাকায়। নিঝুমের এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি। সে দিব্যি হাসছে। কয়েক সেকেণ্ড ওভাবে থেকে হঠাৎ ঝুঁকে দাঁড়ায় নিঝুম। ঝুম ভড়কে যায়। এক পা সরে দাঁড়ায়। নিঝুম পাত্তা দেয় না সেদিকে। তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

— “ঝুমময় পিচ্চি? নিজের খেয়াল রাখবে। ঠিকাছে?”
ঝুম নিশ্চুপ। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না তার। নিঝুম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মুখের সাথে সাথে নিঝুমের নীলাভ চোখজোড়াও হাসছে। প্রাণভোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। কি মনে করে হঠাৎ বলে উঠে নিঝুম,
— “জানো ঝুম? আমার ঝুমময় বৃষ্টি আমার বুকের বা’পাশটায় খুব গভীর ভাবে ছেঁয়ে আছে। একদম সমস্ত জুড়ে।”

কথাটা শোনা মাত্র ঝুম চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। অনুভূতিতে সারা শরীর শিরশির করে উঠছে তার। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকে ঝুম। তারপর যখন চোখে খুলে, তখন নিঝুমকে দেখতে পায় না। ততক্ষণে নিঝুম চলে গেছে। হয়তো লজ্জায় ফেলতে চায় নি ঝুমকে। অথচ নিঝুম কি জানে? নিঝুমের অনুপস্থিতিতেও ঝুম লজ্জা পাচ্ছে। ভীষণ ভাবে পাচ্ছে!

____________________________

বাসায় এসে মিসেস সানজিদার ক্ষীপ্ত চোখের সম্মুখীন হতে হয়েছে নিঝুমের। নিঝুম ঘাবড়ালো না। খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজ মার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল। তবে পারল না। মিসেস সানজিদার কড়া কণ্ঠে থমকে দাঁড়ালো।
— “তোর কখন আসার কথা ছিল নিঝুম? তুই জানিস, আমি রেডি হয়ে বসে ছিলাম তোর জন্য। মায়ের প্রতি কি একটুও ভালোবাসা নেই তোর?”

নিঝুম জিহ্বা কামড়ে তাকায়। সে একদমই ভুলে গিয়েছিল শপিংয়ের কথা। হাসার চেষ্টা করল নিঝুম। বলল,
— “কাজ ছিল আম্মু।”
— “কিসের কাজ? মিথ্যে বলবি না একদম!”
ক্ষীপ্ত কণ্ঠ মিসেস সানজিদার।

নিঝুম বলল,
— “সত্যি আম্মু। ঝুমের আম্মুর শরীর খারাপ ছিল। আমি তাদের সঙ্গেই ছিলাম এতক্ষণ।”
তিনি সন্দিহান কণ্ঠে আবার বললেন,
— “সত্যি?”
নিঝুম মাথা নাড়ালো। মিসেস সানজিদার মুখের রঙ পাল্টে গেল নিমিষেই। নিঝুমের কাছে এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তিনি বললেন,
— “এখন কেমন আছে ভাবী?”
— “অনেকটাই ভালো।”
— “আলহামদুলিল্লাহ। আগে বলবি না আমাকে?”

নিঝুম চলে যেতে যেতে ক্লান্ত গলায় বলল,
— “মনে ছিল না আম্মু।”
— “আচ্ছা রুমে যা! আমি ভাত নিয়ে আসছি।”
— “খাবো না। পেট ভরা।”

মিসেস সানজিদা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “কে খাওয়ালো তোরে?”
নিঝুম মিসেস সানজিদার দিকে তাকালো। হেসে বলল,
— “তোমার বউমা।”
তিনি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— “এটা কে?”
— “তুমি চেনো। ভেবে দেখো।”

মিসেস সানজিদা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কে হতে পারে? অন্যদিকে আবার মাথাও ঘুড়ছে তাঁর। নিঝুম যে এভাবেও কথা বলতে পারে, জানা ছিল না মিসেস সানজিদার। রীতিমতো মাথা ঘুরাচ্ছে উনার।

________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~গল্প অগোছালো হওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।