নীরব সাক্ষী পর্ব-০২

0
454

#নীরব_সাক্ষী
#ফারহানা_ছবি
#পর্ব-২

“” আপু …””(মৃন্ময়)

“” হ্যা ভাই কিছু বলবি?””

“” বলছিলাম কি আমার জুতোটা না ছিড়ে গেছে দশটা টাকা হবে তোর কাছে জুতোটা সেলাই করে নিতাম ৷””

“” আম্মুকে বলেছিস তোর জুতো ছিড়ে গেছে?””

“” না মানে… আম্মুকে কিছু বলতে আমার ভিষন ভয় লাগে যদি আমাকে মারে..”” শেষের কথা গুলো নিচু গলায় বলে উঠলো মৃন্ময় “”

মুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে মৃন্ময়ের হাতে দিয়ে না খেয়েই বেরিয়ে যায় মুন…….

“” এই যে মহারানির আসার সময় হলো হুম”” মুখ ফুলিয়ে বললো সানজু

সানজুর কথা শুনে মুন মলিন হাসি দিয়ে বলতে লাগলো ” সানজু তুই তো সব টা জানিস তারপর ও কেন অভিমান করিস বলতো?”

“” মুন আর কতোদিন এভাবে সব সহ্য করবি চলে যা না তোর বাবার কাছে?””

“” এটা এখন আর সম্ভব নয় সানজু বাবার দ্বিতীয় সংসারে আমি বা আমার ভাইয়ের যায়গা নেই৷ আর আমার সেই সাহস নেই যে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো””

“” বুজতে পেরেছি তুই পরে পরে মার খাবি “”

“” চল কোচিং এর দেরি হয়ে যাচ্ছে আর পরের সপ্তাহ থেকে আমাদের জে এইস সি পরীক্ষা শুরু হবে স্যার কে বলতে হবে ম্যাথ টা আর একটু ভালো করে করাতে””

“” হুম ঠিক বলেছিস চল যাওয়া যাক””

সানজু আর মুন কে দুর থেকে দারিয়ে লক্ষ করছিলো আবিদ ৷ আবিদের বন্ধুরা আবিদ কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে আবিদের বন্ধু সুমিত আবিদ কে বলে “” কাকে দেখছিস দোস্ত? নীল টাকে নাকি কালো টাকে?””

সুমিতের কথা শুনে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুমিত কে বলতে লাগলো”” ঠিক করে কথা বল সুমিত নাহলে…””

“” স্যরি স্যরি দোস্ত আর হবে না এখন বল কার ইনফরমেশন চাই তোর?””

“” নীল ড্রেস পরা মেয়েটার?””

“” সিরিয়াসলি দোস্ত তুই ওই মেয়ে কে চিনিস না?(সুমিত)

“” না চিনি না “”

আবিদের কথা শুনে সুমিত আর বাকিরা হেসে উঠলো আবিদ রেগে সুমিত কে ঘুশি মেরে বলে” সালা বল এভাবে হাসছিস কেন?””

“আবিদ হাসবো না তো কি করবো বল ? যে মেয়ে তোদের বাড়িতে ভাড়া থাকে আর তুই জানিস না ওয়াও”(সুমিত)

“” কিহ এই মেয়ে আমাদের বাড়িতে বাসা ভাড়া থাকে “”

“” জ্বি স্যার , মেয়েটার নাম মৃন্ময়ী ইয়াসমিন মুন , ক্লাস এইটে পড়ে আর ওর একটা ছোট ভাই আছে ক্লাস ফোরে পরে নাম মৃন্ময় ৷ বাই দ্যা ওয়ে আবিদ তোর চয়েজ ঠিক আছে বাট প্রব্লেম হলো মেয়েটির মা ৷৷ খানে দরজাল আর মেয়েটির বাবা এখানে থাকে না আশে পাশে মানুষ বলে নাকি ওদের বাবা মার ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেছে ৷ ওহ ওর মায়ের আবার কাঁচা মালের ব্যাবস্যা ৷ তবে খুব ভালো একটা চলে না ৷

মুনের বিষয়ে এই সব শুনে বেশ খারাপ লাগে আবিদের ৷

“কিন্তু আবিদ তোর বাবা এই গোল্লামারিতে বেশ সুনাম আছে তোদের পাওয়ার ও বেশি এই গোল্লামারি তে বেশি ভাগ দোকান গুলো তোদের , আঙ্কেল কি মেনে নিবে মুন কে?””(নিরব)

“” এতো কিছু এখন ভাবতে চাইছি না নিরব মেয়েটাকে প্রথম দেখায় আমি প্রেমে পরেছি বলতে পারিস লাভ এট ফার্স্ট সাইড””

“” কিন্তু দোস্ত মুনের মা যদি জানতে পারে তাহলে মনের যে কি অবস্তা হবে ভাবতেই আমার পুরো শরীল শিউরে উঠছে “” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো সুমিত …

“” মানে কি বলতে চাইছিস তুই””(আবিদ )

“” সময় হলে জানতে পারবি আবিদ ”

আবিদ কিছু না বলে মুনের পিছু পিছু যেতে লাগলো….. আবিদ যেতেই নিরব বলে উঠলো “” সুমিত মুন তো কয়েকমাস হলো আবিদ দের বাসায় ভাড়া থাকে আর আবিদ জানে না?”

“” হতে পারে কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে অন্য কিছু দেখ নিরব আবিদ রা মুনদের থেকে বংশ মর্যাদা বলিস আর টাকা পয়সা সব দিক দিয়ে বড় ৷ আন্টি আঙ্কেল মনে হয় না মানবে “”

“” আঙ্কেল আন্টি মানবে কি না এটা তো পরের বেপার সুমিত তার আগে মুনের মা জানতে পারে তাহলে কি হবে বুজতে পারছিস?””

“” দেখা যাক কি হয়”””
.
.
.

.
.

মুন আর সানজু কোচিং শেষ করে গল্প করতে করতে বাসার দিকে ফিরতে লাগলো কিন্তু তখনো আবিদ কে সানজু বা মুন কেউ খেয়াল করেনি ৷ মুন সানজু কে বিদায় দিয়ে বাসায় আসে ৷ বাসায় এসে দেখে মুন তার মা আলিয়া বেগম মৃন্ময় কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে ৷ মুন কে দেখতে পেয়ে আলিয়া বেগমের রাগ যেন আরো বেরে গেল বসা থেকে উঠে তেরে আসলো মুনের দিকে এদিকে মায়ের এমন রুপ দেখে মুনের জান যায় যায় অবস্তা মুন খুব ভালো করেই বুজতে পারছে আজ ওর কপালে শুনি নাচছে ৷ মুনের ভাবনার মাঝেই আলিয়া বেগম মুনের চুলে মুঠি ধরে হির হির করে রুমে টেনে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বলে ” মা* তোকে কাল বলেছিলাম না আমার সব কাপড় ধুয়ে দিতে হ্যা দিস নাই ক্যান””

“” আম্মু আমার হাতে ভিষন ব্যাথা ছিলো তাই আজ ধুই নাই কাল ধুইয়া দি?””

“” কুত্তার বাচ্চা তাইলে আমি কাইল কি পরমু ? তোর বাপ তো আমার ঘাড়ে তোগো দুই ভাই বোন রে ফেলাই থুইয়া নিজে জাহাজে জাহাজে গিয়া ঘুরতাছে ৷ কোন খরচ দেয় না৷ আমি একা একটা মহিলা কতোদিক সামলামু ৷ মরতে পারিস না তুই “”

মুন চুপ করে কেদে চলছে ৷ মুন কে এভাবে কাঁদতে দেখে আলিয়া বেগমের মেজাজ যেন আরো বেরে গেল রান্না ঘর থেকে চলা কাঠ এনে বেধরম পেটাতে লাগলো মুন কে ৷ চিৎকার করে কাঁদছে মুন ৷ মৃন্ময় সাহস দেখিয়ে মায়ের হাতের মার থেকে বোন কে বাচাতে না পেরে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে মৃন্ময় ৷ তখনি ঘরে হুরমুর করে আবিদের মা মনিরা বেগম৷

এভাবে বাড়ি ওয়ালাকে আসতে দেখে হচকিয়ে যায় আলিয়া বেগম….

“” আপা কি হয়েছে এভাবে মেয়েটা কে মারছেন কেন?””(আবিদের মা)

“” কি বলবো ভাবি বলেন , মেয়ে টাকে সকালে বলে গেছি আমার কাপড় গুলো ধুয়ে রাখতে কিন্তু এসে দেখি সব আধোয়া কিচ্ছু ধুইনি ৷””

“” এই সামান্য কারনে এতোটুকু মেয়ের গায় হাত দিবেন আপা?””

“” এতুটুকু দেখলে কি হবে হার বজ্জাত মেয়ে ৷ নিজের পেটে ধরেছি তো তাই জানি””

“” আপা আপনি একথা গুলো কি করে বলেন আপনি যখন কাজে বেরিয়ে যান তখন এই পুচকি মেয়ে পুরো সংসার সামলায় যে সময় মেয়েটার খেলার সময় সে সময়ে মুন আপনার সংসার সামলাচ্ছে৷ এটা কি কম? আর এতোটুকু মেয়ে কে বলছেন আপনার কাপড় ধুয়ে দিতে?””

মুনের হয়ে কথা বলাটা যেন আলিয়া বেগমের পছন্দ হলো না তিরিক্ষি মেজাজে আবিদের মা কে বলে উঠলো “” দেখুন ভাবি এটা আমার সংসার আমি যেমন চাইবো তেমন টাই হবে আপনি দয়া করে আমাদের পারিবারিক বেপারে মাথা ঘামাবেন না ৷ “”

মুনের মায়ের কথা শুনে আবিদের মা অপমানিত বোধ করায় আর কিছু না বলে মুনের মাথায় হাত রেখে চলে যায়৷

আবিদ এতোক্ষন তার মায়ের রুমের জানালার কাছে দারিয়ে মুনের মায়ের কথা গুলো শুনছিলো৷ মুনের মায়ের কথা শুনে আবিদের যেন মাথায় রক্ত উঠে গেল ৷ রাগে ফুসতে ফুসতে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে আবিদ দেখে তার মা ভিতরে ঢুকছে….

“” মা ওই মহিলা তোমাকে এতো কথা শুনালো তুমি কিছু বললে না কেন?””(আবিদ)

“” কেন কিছু বললাম না জানিস কারন টা হলো আমি যদি এখন ওখানে মুনের হয়ে কিছু বলতাম তাহলে আমি যাওয়ার পর মেয়ে টা আরো মার খেতো “”

মায়ের কথা শুনে আবিদ কিছুটা দমে যায় কারন আর যাই হোক তার ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না আবিদ ৷

“” আচ্ছা মা এই মহিলা কি সত্যি ওদের মা?””

“” দূর্ভাগ্য বসত হ্যা বাবা এই কঠিন ধাতুর মহিলা মুন আর মৃন্ময়ের জন্মদাত্রী মা””

“” তাহলে ওদের বাবা কোথায় মা?””

“” আমি যতোটুকু মুনের নানীর কাছ থেকে জেনেছি ওনার মেয়ে মানে মুনের মা চামার টাইপের মুনের বাবার সাথে বিয়ে হয় গ্রামে ৷ লোকটা ভিষন শান্তশিষ্ট শান্তি প্রিয় লোক কিন্তু মুনের মা নাকি তার উলটো পান থেকে চুন খশলে চেচামেচি করতো ৷ মুনের বাবা তার সাধ্যমতো মুনের মায়ের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতো কিন্তু কখনোই মুনের মায়ের মন জয় করতে পারতো না ৷ বিয়ের দের বছরের মাথায় মুনের জন্ম হয় তার ছয় মাস পর হুট করে একদিন মুনের বাবা উধাও হয়ে যায় ৷ পরে অবশ্য জানতে পারে তিনি জাহাজে চলে গেছেন কবে আসবে কেউ জানে না ৷ মুনের মা ছিলো শক্ত ধাতুতে গড়া, মুনের বয়স তখন একবছর তখন মুন কে তার নানীর কাছে পাঠিয়ে দেয় মুন তার নানা নানীর কাছে বড় হতে থাকে আর মুনের মা আলিয়া মুনের নানার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে কাচা মালের ব্যবস্যা শুরু করে ৷ একা একাই থাকতো আর প্রত্যেক মাস শেষে মেয়ে কে দেখতে যেতো৷ এভাবে দু বছর কেটে যায় ৷ মুন তখন ও তার মা কে চিনতো না কতোবার-ই দেখেছে তার মা কে ? মুন তার মায়ের কোলে উঠলে কেদে দিতো ৷ ”

“” তারপর কি হয়েছিলো মা ? মুনের বাবা কি ফিরে এসেছিলো?””

“” হ্যা বাবা এসেছিলো তবে প্রচুর দেনা করে ৷ মুনের মা সে সব দেনা মিটিয়ে দিয়ে মুন কে নিয়ে আসে ৷ আবার নরমালি ওদের সংসার টা চলতে লাগলো তবে সংসারে টানা টানি থেকেই গেছে আর আলিয়ার বাজে ব্যাবহার ৷ মুনের মা মুন কে কখনো আদর ভালোবাসা দিয়েছে কিনা জানি না তবে শুনেছি মুনের বাবা মামুন সাহেব তার মেয়ে কে চোখে হারাতেন কিন্তু মুনের মায়ের বাজে ব্যাবহারের জন্য তিনি হুটহাট করে চলে যেতেন..””

“” মা আমি শুনেছি মুনের বাবা মায়ের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে?”

“” না বাবা যা শুনেছো ভূল শুনেছো কারন ওদের এখনো ডিভোর্স হয়নি ৷ “”

“” তাহলে তিনি আসেন না কেন তার সন্তানদের কাছে?””

“” কেন আসেন না ? কারন টা হলো তিনি এখন তার দ্বিতীয় সংসার নিয়ে ব্যাস্ত আছে তাই””

“” ওয়াট! আচ্ছা তারপর কি হলো ?”

“” মুন ক্লাস টুতে পরে তখন মৃন্ময়ের জন্ম হয় ৷ মৃন্ময় হবার কয়েকমাস আগে থেকে আলিয়া তার কাচামালের ব্যবস্যা বন্ধ করে দেয় কারন ওই অবস্তায় ব্যবস্যা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না ৷ মৃন্ময়ের জন্মের একমাসের মাথায় আবার মুনের বাবা হুট করে কাউকে কিছু না বলে চলে যায় ৷ আর এদিকে চার মাসের ঘড় ভাড়া , বাজারে দোকানের দেনা, সব কিছু মুনের মায়ের ঘাড়ে ফেলে চলে যায়৷ এদিকে অথৈ সাগরে পরে যায় মুনের মা দুটো দুধের শিশু কে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ৷ দিশা না পেয়ে মুনের মা ঘরের আসবাব পত্র বিক্রয় করে দিয়ে মুন আর একমাসের মৃন্ময় কে তার নানা নানীর কাছে পাঠিয়ে দেয়৷ তারপর খুলনা চলে আসে আর অন্য বাসায় ভাড়া নেয়৷ মৃন্ময়ের যখন দুবছর বয়স তখন মুনের নানা মারা যায় তখন বাধ্য হয়ে মুনের মা ওদের খুলনা নিয়ে আসেন ৷ খুলনা এনে লাইওন স্কুলে চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি করে দেয় মুন কে ৷ আর আমাদের বাড়িতে বাসা ভাড়া নেয় কয়েকমাস হলো””

আবিদের মায়ের কথা শেষ হতে মুনের বিকট কান্নার আওয়াজ পেয়ে চমকে ওঠে তখনি…..
.
.
.
.
#চলবে…………..