#কারণে_অকারণে_সে
#পর্ব:১২
#লেখক:রিয়ান আহমেদ(ছদ্মনাম)
;
সাভাশ আর আরশি থানায় বসে আছে।ঐ তিনজন গুন্ডাকে ধরে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
সাভাশের বন্ধু একজন পুলিশ।আসলে তারা আগে থেকে বন্ধু ছিল না দুজনের দেখা হয় কাজের সূত্রে।এরপর একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়।সাভাশের বন্ধুর নাম আনিস।
আনিস সাভাশকে জিজ্ঞেস করে,
“দোস্ত বল কি খাবি চা না কফি?”
“এটা থানা কোনো ক্যাফে না।আর তুই আমাদের এভাবে আর কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি?আরুকে বাসায় যেতে হবে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
আনিস হেসে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাবি আপনি তো বলেন কি খাবেন?আজকে আপনি এতো বড় একটা কাজ করেছেন।আপনার তো আমার কাছে একটা ট্রিট তো পাওনা।”
আরশি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“এখন কিছু খাবো না।আরেকদিন দেখা হলে ট্রিট নিয়ে নেবো।”
আনিস বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে।আপনি আজ যেই গুন্ডাগুলোকে ধরতে সাহায্য করেছেন তারা অনেকগুলো ছিনতাই করেছে এই পর্যন্ত।আজ আপনার কারণে ওদের ধরতে পারলাম।”
আরশি হেসে বলল,
“কোনো বড় ব্যাপার না।এমন দুই একটা চোর ধরা আমার জন্য সময়ের ব্যাপার।,,আজ উঠি সাভাশ চলুন।”
;
;
আরশি আর সাভাশ রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে আছে।দুজনেই একটা রিকশার অপেক্ষায় আছে কারণ তাদের গাড়ি আর স্কুটার দুটোই তারা চন্দ্রিমা উদ্যানে ফেলে এসেছে।
ঐ তিন গুন্ডাকে মরিচের স্প্রে মারার পর সাভাশ আর আরশি কোনোমতে দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে রোডে চলে আসে তারপর একজন ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে পেয়ে তাকে সবকিছু বলে।এরপর যা পদক্ষেপ নেওয়ার সে নেয়।আর সাভাশ আর আরশি একটা জিটি করার জন্য থানায় আসে।
সাভাশ আরশির দিকে দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।আরশি বিষয়টাতে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে।সে গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে,
“আপনি আমাকে এভাবে দেখছেন কেন?মনে হচ্ছে কোনো সুপার স্টার।”
“তুমি ঐ কাজটা কিভাবে করলে আমি এখনো বুঝতে পারছি না।”
আরশি না জানার ভাব করে বলল,
“কোন কাজের কথা বলছেন আপনি?”
” আরে কলা দিয়ে বন্দুক অদলবদল করার কথা বলছি।তুমি কি ম্যাজিক জানো না কি?”
“আরে না ওটা তো জাস্ট হাত সাফাই ছিল।ম্যাজিক বলতে কিছুই হয় না সবটাই চোখের ধোঁকা আর ট্রিক্সের ব্যাপার।”
“তুমি কিভাবে শিখলে?সিরিয়াসলি এতো smoothly তুমি কাজটা করেছো যে আমরা কেউ টের পাই নি।”
“এখন মনে হয় আপনাকে কথাটা বলতেই হবে।,,আমার যখন নয় দশ বছর বয়স তখন আমরা মিরপুরে একটা ফ্ল্যাটে কিছুদিনের জন্য থাকতে গিয়েছিলাম বাড়ির রেনোয়েশন করা হচ্ছিল বলে।তখন আমার দেখা হয় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ছিলেন দুজন বৃদ্ধ দম্পতি।ঐ দুজনকে আমি দাদা আর দাদী বলেই ডাকতাম।ওনাদের ছেলে মেয়েরা ওনাদের থেকে অনেক দূরে থাকতো তাই ওনারা খুব একাকিত্ব বোধ করতো।আমার মধ্যে ছোটবেলা থেকে একটা অদ্ভুত ট্যালেন্ট ছিল বৃদ্ধ মানুষদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার।অন্য ছেলে মেয়েরা হয়তো বৃদ্ধ মানুষদের কথা শুনলে অনেক বোর ফিল করে কিন্তু আমার অনেক মজা লাগে তাদের সাথে কথা বলতে।,,যাইহোক তো এভাবে একদিন দুইদিন তাদের সাথে কথা বলতে বলতে তাদের খুব আপন হয়ে গেলাম।ঐ দাদাটা একজন জাদুকর ছিলেন এই কথাটা আমি দাদীর থেকে জানতে পারি।পরে দাদাটার কাছে জেদ করি আমাকে টুকটাক ম্যাজিক শেখাতে।সে প্রথমে না করলেও পরে আমার জেদের কাছে হার মেনে আমাকে এই হাত সাফাইয়ের বিষয়টা শেখান।,,,আস্তে আস্তে আমি এটা শিখেও ফেলি।,,,আমি একবার কিছু শিখলে সেটা সারাজীবনেও ভুলি না বুঝলেন।”
সাভাশ রিকশায় উঠে বসে বলল,
“বুঝেছি এখন চলো না হলে তোমার স্কুটার আর আমার গাড়ি চুরি হওয়ার জন্য জিটি করতে আবার থানায় আসতে হবে।”
আরশি রিকশায় উঠে বসে বলল,
“একটু সরে বসুন আমি আরাম করে বসতে পারছি না।”
সাভাশ সরে বসে।সাভাশ রিকশায় আরশির সঙ্গে বসাতে ওর নিজেরই অস্বস্তি লাগছে।ও জানে আরশি ওর বাগদত্তা কিন্তু কিন্তু এখনো তো স্বামী স্ত্রী হয় নি তারা তাই দুজনের মাঝে শারীরিক দুরত্ব রাখাটা খুবই প্রয়োজন।
আরশি নিজের ব্যাগের থেকে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ বের করে সাভাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার হাতটা কেঁটে গেছে।আপাদত এটা লাগান পরে কোনো হসপিটালে গিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়েন।”
সাভাশ হাত এগিয়ে দিতেই আরশি সযত্নে ব্যান্ডেজ তার হাতে লাগিয়ে দেয়।আরশির চুল উড়ছে বাতাসে। অদ্ভুত ব্যাপার আরশির উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা রোদের আলোর কারণে কেমন কমলা মনে হচ্ছে।চোখের চশমাটা না থাকলে ভালো হতো কারণ তাহলে হয়তো সাভাশ আরশির চোখের মনির রঙটাও এই পড়ন্ত বিকেলে কেমন হয় তা দেখতে পেতো।সাভাশ গুন গুন করে গান গায় কিন্তু তা রাস্তার হাজারো গাড়ির হর্ণের আওয়াজের আড়ালে চাপা পড়ে যায়।সাভাশ গাইছে,
“কোনো রূপকথার দেশে আমি থাকছি মিলেমিশে
কেনো বইছে হাওয়া দখিন দিকে খুব ?
সে কি দেখতে পেয়েও পায়না
নাকি দেখতে আমায় চায়না ?
তবু সুযোগরা দেয় তারই ঘরে ডুব ।
বোঝেনা সে বোঝেনা, বোঝেনা সে বোঝেনা।”
আরশির খেয়ালটা সাভাশের হাতের দিকে না থাকলে সে হয়তো গানটার একটা বাক্যও শুনতে পেতো।
;
;
আরশি সন্ধ্যায় মায়ের ঘরে বসে বসে চিপস্ খাচ্ছিলো।তার বাজে অভ্যাস হচ্ছে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে খাবার খাওয়া।আয়েশা বেগম মেয়ের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বললেন,
“আমার বিছানাটা মাত্র গুছিয়েছি আর তুই এখানে বসে চিপস্ খাচ্ছিস!নিজের রুমে গিয়ে খা না আমার বিছানাটা ময়লা করছিস কেন?”
আরশি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আম্মাজান আমার একা রুমে ভয় লাগছিল তাই তোমার রুমে আসলাম।এমন করো কেন?আমি তোমার রুমে খাবো না তো কে খাবে?”
“আমার সঙ্গে মজা করছিস?যেই মেয়ে রাত তিনটায় ছাদে গিয়ে বসে থাকতে পারে তার আবার এই সন্ধ্যাবেলা ভয়।,,আমি জানি তো তুই যে আমাকে জ্বালানোর জন্য এমন করতাছোস।”
“তোমাকে জ্বালাবো কেন?,,এমনিতে তোমার মোবাইলটা একটু দেও তো বান্ধবীকে ফোন দেবো।”
“কেন?তোর মোবাইল কোথায়?”
“টাকা নাই।তোমার মোবাইল দিয়ে বান্ধবীর সাথে কথা বলে ভাইকে বলবো মোবাইলে টাকা দিতে।”
আয়েশা বেগম আরশির হাতে মোবাইল দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন।উনি বলছিলেন,
“নিজের মোবাইলের টাকা খরচ করতে চায় না আমার মোবাইলেরটা খরচ করে।”
আরশি মুখ চেপে হেসে এক বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে আরহামকে ফোন দেয় আর মোবাইলে টাকা পাঠাতে বলে।
রিজা আহসান তখনই ঘরে প্রবেশ করেন।তিনি নিজের গলার টাই খুলতে খুলতে আরশির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মামুনি তোমার মাকে ডাকো।”
আরশি মাকে ডাকতে চলে গেল।
আয়েশা বেগম আসতেই রিজা আহসান বললেন,
“আগামীকাল আমাদের পুরো পরিবারকে সাভাশের বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।সাদমান ভাই আমার অফিসে এসেছিলেন।”
আয়েশা বেগম বললেন,
“ঠিকাছে।তুমি আর আরহাম তাহলে কাল ব্রেক টাইমে চলে এসো।”
“আচ্ছা।”
;
আয়েশা বেগম আরশির রুমে গিয়ে দেখেন মেয়ে পড়াশোনা করছে।আয়েশা বেগম বেশ খুশি মনে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“মা কি করছো তুমি?”
আরশি নিজের মাকে এমন আদুরে গলায় কথা বলতে দেখে ভড়কে যায়।হঠাৎ এতো ভালোবাসা নিয়ে কথা বলছে কেন?আরশির হঠাৎ মনে হয় এটা তার মা না এটা কোনো জ্বীন।তাই এক হাত দূরে চলে যায় লাফ দিয়ে।আরশি মায়ের দিকে তাকিয়ে ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“মা তুমি ঠিক আছো?তুমি হঠাৎ এতো সুন্দর করে আমার সঙ্গে কথা বলছো কেন?তোমার কথার মধুতে তো আমার ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।”
আয়েশা বেগম মেয়ের কথায় রেগে যান।অগ্নিশর্মা হয়ে বলেন,
“তুই আমার সঙ্গে আবার মজা করছিস?”
আরশি শিওর হলো এটাই তার মা।কারণ তার মায়ের রেগে গেলে কান লাল হয়ে যায়।আরশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“এবার বলো কি বলবে?”
আয়েশা বেগম নিজের হাতের কিছু শাড়ি আর একটা গয়নার বাক্স আরশির সামনে রেখে আরশির পাশে বসলেন।আরশিকে শাড়িগুলো দেখাতে দেখাতে বললেন,
“আগামীকাল আমরা তোমার হবু শশুড়বাড়িতে যাচ্ছি তোমাকে এখান থেকে কোনো একটা শাড়ি পছন্দ করে পড়তে সবে।সাথে এই গয়নাগুলো পড়বে বুঝলে?”
আরশি চোখ বড় বড় করে শাড়ির দিকে তাকায় শাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক বহুবছর আগে থেকেই ছিন্ন হয়েছে।এরপর কখনো তার শাড়ি পড়ার ইচ্ছা জাগে নি।আসলে মোট কথা শাড়ি পড়ার সাহস হয় নি।আরশি নাকচ করে হাত নাড়িয়ে বলল,
“না না মা আমি পড়তে পারবো না।আমি সেলোয়ার কামিজ অথবা গোল ফ্রক পড়ে নেবো তবুও শাড়ি পড়তে বলো না।”
আয়েশা বেগম আদেশের সুরে বললেন,
“তোকে পড়তেই হবে।প্রথমবার ওনাদের বাসায় যাচ্ছিস তাই শাড়ি না পড়লে তারা কি মনে করবে।আর তুই চিন্তা করিস না আমি তোকে সুন্দর করে পড়িয়ে দেবো।”
“তোমার শাড়ি তুমিই পড়ো।আমার মনে আছে ক্লাস ফোরে থাকতে একবার তোমার খালাতো ভাইয়ের গায়ে হলুদে শাড়ি পড়েছিলাম।আর সেই শাড়ি পুরোটা খুলে কি যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়েছিল।শীতের দিন ছিল বলে কোনোমতে শাল গায়ে দিয়ে সেখান থেকে পালাতে পেরেছিলাম।এই ভুল আমি আর করবো না।আমি শাড়ি পড়বোই না।”
“তুমি এই গোলাপি শাড়িটা কাল পড়বে আর এই গয়না গুলোও সাথে পড়বে।আমার কতো দিনের শখ আমার মেয়েটাকে শাড়িতে দেখবো।”
আয়েশা বেগম চলে যান আরশির রুম থেকে।আরশি কিছু বলতে চাইলে তিনি বলেন,
“আমি আর কিছু শুনতে চাই না।যদি এই শাড়ি আর গয়না তুমি না পড়ো তাহলে তোমার ল্যাপটপ আর মোবাইল আমি ভেঙ্গে ফেলবো।”
আরশি জানে তার মা যা বলে তাই করে।এইটে থাকতে আরশি অংকে ফেল করেছিল বলা পরীক্ষার আগে বলা নিজের কথা অনুযায়ী বাড়ির টিভির লাইন কেটে ফেলেছিলেন আর আরশির সব বিনোদন মাধ্যমে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন।সেই তালা খুলেছিল একেবারে আরশি জেএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের পর।আরশি বুঝতে পারছে না কাল মায়ের কথা শুনবে না নিজের মনের কথা শুনবে।
;
;
;
;
সাভাশের মা তাসনিম বেগম বড় ছেলের কাছে হবু বউ মার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন।তিনি গালে হাত দিয়ে বললেন,
“বাহ্ আমার ছেলের বউ তো দেখছি বুদ্ধিতে সবার আগে।,,তবুও যাই বল সাভাশ আজ কিন্তু তোরা দুজনে অনেক বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেলি।আমি এই শুক্রবারে ভাবছি মসজিদে একটা মিলাদ পড়িয়ে দেবো। তোরা এতোবড় বিপদ থেকে বেঁচে গেলি এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে।”
তাসনিম বেগম চলে যেতেই সাভাশ নিজের হাতে আরশির লাগিয়ে দেয়া ব্যান্ডেজটা দেখতে থাকে।সেটার উপরে হাত বুলিয়ে সে হেসে দেয়।সাভাশের কাছে মনে হচ্ছে আরশির সবকিছুতেই তার জন্য অসীম ভালোবাসা।প্রেমে পড়লে বোধহয় এমনটাই হয়।ভালোবাসার মানুষটার বলা প্রতিটি কথা,তার করা প্রতিটি কাজ,তার আচরণ সবটাতেই ভালোবাসা খুঁজে নিতে চায় সাভাশ নামক প্রেমিক পুরুষটি।
সাভাশ নিজের ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটা বুকের উপরে রেখে চোখ বন্ধ করে প্রেয়সীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।ঠোঁটের কোনে সে ঝুলিয়ে রাখে একটি অমায়িক হাসে।
#চলবে!