এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৩৬

0
812

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৬

চুলায় ফুটন্ত পানি টগবগ করছে।আগুনের ভয়াবহ আঁচে রান্নাঘর ভ্যাপসা গরমে ছেঁয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।ফুচকাগুলো প্লেটে সাজিয়ে রেখে চুলোটা নিভিয়ে দিলো তোহা।দুটো কাপড়ের ছাপি দিয়ে ধরে পাতিলাটা তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
—“দরজা খুলুন।গরম পানি দিব।”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষন চুপ থেকে তিহান কাঁটা কাঁটা কন্ঠে উওর দিলো,
—“এখন খোলা যাবেনা।পানি লাগবেনা,যা।”

তোহা আবারো চেঁচিয়ে উঠলো।দাঁত কামড়ে বললো,”আমার হাতে কিন্তু গরম আঁচ লাগছে।খুলুন তাড়াতাড়ি।”
কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো তোহা।তার অপেক্ষার প্রহর আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই ছিটকিনি খুলে গেলো।অর্ধেক দরজা খুলে তিহান অস্থিরতা নিয়ে বললো,
—“আঁচ লাগবে কেনো?কাপড় দিয়ে ধরিসনি?”বলেই তোহার হাতের দিকে তাকালো তিহান।হাতের ছাপি দেখে তোহার চালাকিটা নিমিষেই বুঝে গেলো সে।চোখের মনি সরু হয়ে এলো।তোহা এগিয়ে এসেছে ততক্ষনে।তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।তিহানের পরণে শুধু কোমড় থেকে হাঁটু অবধি সাদা টাওয়াল।গা ভেজা।
টুপটুপ করে পানি গড়াচ্ছে।সেদিকে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই তোহার।মাথা নিচু করেই সে তাঁড়া দিয়ে বললো,

—“সরুন।”

তিহান সরে দাড়ালো।তোহা দু’কদম ওয়াশরুমের ভিতর বাড়িয়ে পানিটা ঢেলে দিলো বালতির মধ্য।বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই ধুম করে দরজাটা আটকে দিলো তিহান।চোখ বড় বড় করে তাকালো তোহা।তার চোখে বিস্ময়,কৌতুহলের অদ্ভুত সংমিশ্রণ।তিহানের হঠাৎ এই আচরণের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা বুঝতে না পেরে সে একবার দরজা আর একবার তিহানের মুখের দিকে চেয়ে অস্ফুস্ট স্বরে বললো,
—“দরজা আটকালেন কেনো?”

তিহান আগালো।একটু একটু করে প্রায় অনেকটা কাছে গেলো।তবে অবশ্যই অনেকটার বেশি নয়।তোহার ডানহাতটা আলতো করে টেনে ধরে তালুর দিকে তাকিয়ে কিন্চিৎ ঠোঁট নাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
—“হাতে আঁচ লাগছে তাইনা?

তোহার নির্বাক।তার স্হিরদৃষ্টি তিহানের লোমশ বুকে।তিহানের চুলের পানি চুইয়ে চুইয়ে তার কপাল গড়িয়ে গোলাপি ঠোঁট স্পর্শ করছে।তোহার কাঁপছে।তার ঠোট কাঁপছে।চোখের পাপড়ি কাঁপছে।মন কাঁপছে।ভেতরে ভেতরে সে মানুষটাই ভীষণভাবে কাঁপছে।এই লোক তার মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।তার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে।এত ক্ষমতা কেন লোকটার?তাকে কোনোদিন ঘনিষ্ঠভাবে না ছুঁয়েও লোকটা কিভাবে এত আবেগ,অনুভূতি,গভীরতম প্রণয় সৃষ্টি করতে পারে?কিভাবে?ভাবতে ভাবতেই তিহানের বুক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তোহা।
তিহান চোখ থেমে গেছে অনেক আগেই।দৃষ্টিজোড়া তোহার মুখের প্রতিটা ভাঁজ লক্ষ্য করছে মোহাচ্ছন্ন ঘোরে।অজান্তেই তার হাত চলে গেলো তোহার চিবুকে।হাতের তর্জনী দিয়ে তোহার চিবুক উচিয়ে তিহান আবিষ্টভাবে বললো,
—“অপরূপ।”

এই একবাক্যর ছোট্ট প্রশংসাটাই যেন তোহার কানে ঝংকার তুললো।লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার যোগার হলো তার।কয়েকবার ঢোক দিলেও শুকনো গলাটা ভিজলোনা।একবিন্দু পানির অবশিষ্ট নেই ভেতরে।প্রেমিকের প্রশংসার তেজে সব শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে।
তোহা গলা খাদে নামিয়ে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে অনুরোধ করলো,
—“যেতে দিন।”

তোহার কথাটা স্পষ্টই কানে গেলো তিহানের।তবে তোহাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছেনা একটুও।গরম পানির বাষ্পে বদ্ধ বাথরুম জুড়ে আবছা ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছে।উষ্মতার ছড়াছড়ি সর্বাঙ্গে।তোহার ঠোঁটের উপর ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু।ঠোঁট গুলো বোধহয় এখনো কম্পমান।তিহান দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো।অল্প কিছুক্ষনের ব্যবধানে তোহার হাত ছেড়ে দুরে সরে দরজাটা খুলে দিলো।তিহানের ইশারা বা কোন কিছু বলার আগেই একছুটে বেরিয়ে গেলো তোহা।

মুখে একটা ফুচকা পুরে নিয়ে ফ্রিজ খুলে চোখ ঘুরাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তোহার।ফ্রিজে শুধু ডালের বাটি আর ঠান্ডা ভাত।কোন তরকারি নেই।আর তিহান তখন কি বললো,”ফ্রিজে খাবার রাখা আছে খালামনি,সমস্যা হবেনা।”তিহানের কথাটা ব্যঙ্গ করে বললো তোহা।এই সারাদিন খাটাখাটনির বাড়ি ফিরে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেলে তৃপ্তি মিলে?মোটেও না।একা একা বিরবির করতে করতেই সেগুলো বের করলো তোহা।গরম করার জন্য চুলোয় চড়িয়ে দিয়ে আবারো ফ্রিজ খুললো।দেখেশুনে একটা বেগুন আর দুটো ডিম বের করে নিলো।তিহানদের চার স্টোভের চুলা বিধায় এখনো দুটো খালি আছে।পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ভেঁজে বাটিতে তুলে রেখে গোল গোল করে বেগুন কাটলো সে।মশলা মাখিয়ে ছেড়ে দিলো গরম তেলের উপর।ভাঁজা হয়ে গেলে প্লেটে তুলে ভাত ডাল সহ সব সাজিয়ে রাখলো টেবিলে।কাজের মাঝেই সে ফুচকার প্লেট খালি করেছে।

কাজ শেষে সে গেলো তিহানের রুমে।লোকটা এখনো বের হয়নি।পানি ঢালার শব্দ ঝাঁপটে আসছে কানে।তিহানের রুমের অবস্থা একেবারেই অগোছালো।সেন্টার টেবিলে কাগজের ছড়াছড়ি।সকালে ঘুম থেকে উঠার পর হয়তো বিছানা ঝাঁড়া হয়নি।চাদর কুঁচকে আছে।যদিও সবসময় এই ঘরটা শৌখিনভাবে সাজানো থাকে তবে আজকের এই বিধস্ত অবস্থার কারণ অজানা নয় তোহার।অফিসে প্রেজেন্টেশন ছিলো তিহানের।সকালে কলেজ যাওয়ার সময় বলেছিলো তাকে।সেজন্যই হয়তো টেবিলভর্তি কাজপত্রের আলুথালু অবস্থা।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো তোহা।সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই বেরিয়ে এলো তিহান।
তোহাকে দেখে মনে মনে চরম খুশি হলেও মুখে বললো,
—“এখনও যাসনি কেনো?খালামনি চিন্তা করবেতো।”

বালিশদুটো পাশাপাশি রেখে ঝাড়ুটা খাটের চিপায় ঢুকিয়ে দিলো তোহা।মাথার এলোমেলো ওড়না টেনে নিতে নিতে বললো,
—“চিন্তা করবে কেনো?আম্মুতো জানে আমি আপনার সাথে আছি।”

তিহান হাসলো।টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো,
—“আমার সাথে থাকলে কি চিন্তা করা মানা?”

—“হ্যাঁ।”

তোহার সোজাসাপটা উওরে আবারো হাসলো তিহান।চুল মোছা শেষে টাওয়ালটা সোফার পিঠ ঠেকানোর জায়গাটায় মেলে দিতেই তোহা বললো,
—“রাতের খাবার খাবেন না?”

—“হু খাবো,গরম করতে হবে।তুই যাবি আমার সাথে?কথা শেষ করে কিছু একটা ভাবলো তিহান।তারপর বললো,না থাক,রান্নাঘরে গরম।তুই এখানেই বস।”

তোহা তাকালোনা।তিহানের কাছাকাছি যেয়ে দাড়িয়ে মিনমিন করে বললো,
—“আমি গরম করে রেখেছি।চলুন খাবেন।”

তিহান থতমত খেয়ে দাড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে।খাবার গরম করা পর্যন্ত ঠি ক ছিলো।কিন্তু মেয়েটা যে কষ্ট করে আবার বেগুন আর ডিমও ভেঁজে রেখেছে।
তোহার ডাকে আর চেয়ার সরানোর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে তার।চুপচাপ যেয়ে চেয়ারে বসে সে।তোহা প্লেটে ভাত বেরে দেয়।ডাল দিয়ে ডিমভাজাটা এককোঁণে উঠিয়ে রাখে।
তিহানের চোখ যায় একপাশে কেটে রাখা লেবুর দিকে।আৎকে উঠে সে বলে,
—“লেবুতো কাঁটা ছিলোনা ফ্রিজে।”

—“আমি কেটেছি।আপনিতো লেবু ছাড়া খেতে পারেননা।”

তিহান চোখ গরম করে তাকায়।কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
—“হাত দেখি।”

তোহা ঠোঁট উল্টায়।মুখ লটকিয়ে হাত মেলে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখিয়ে বলে,”কাটেনি।”স্বস্তির শ্বাস ফেলে তিহান।তারপর ভাত মাখিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।তোহা তার পাশের চেয়ার টেনে বসে।তিহান চুপচাপ খাচ্ছে।তোহা তার প্লেটে বেগুন ভাঁজা উঠিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“আচ্ছা,আমাদের ব্যাপারটা সবাই জানলো কি করে?”

—“কোন ব্যাপার?”যথেষ্ট সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে তিহান।তবে তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে বিস্তর রসিকতা।
তোহা ধরতে পারে সহজেই।দাতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে তাকাতেই তিহান হেসে ফেলে।উওর দেয়,

—“নানা শুধু খালুকে বলেছিলো।প্রথমে অবশ্য খালু কোন মতামত দেয়নি।বলেছে তার মেয়ে যা বলবে তাই হবে।তারপর তোমার থেকে মতামত জানার পর পরেরদিন সকালে আমরা যখন ঘুরতে বের হই তখন সবাইকে জানানো হয়।খালুর সম্মতিতেই জানানো হয়।সবাই যখন কোন দ্বিমত করেনি তখন খালু নিজেই আমাকে ফোন দেয়।মানে আমার ফোনতো নষ্ট ছিলো তখন।তাই তূর্যর ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলেন তিনি।হুট করেই দেয় সেদিনই আংটি পড়ানোর প্রস্তাবটা।প্রথমে মানা করতে চেয়েও পরে আর তোমার উপর একটু অধিকার পাওয়ার লোভ টা সামলাতে পারিনি আমি।”হ্যাঁ”বলে দিয়েছিলাম।তারপর আংটির ব্যাবস্থা উনারাই সব করেন।বুঝলে?

তোহা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো পুরোটা।তিহানের কথা শেষ হতেই সে ফটাফট প্রশ্ন করে,
—“আমাকে জানানো হয়নি কেনো?”

—“কারণ আমি মানা করেছিলাম।আসলে তোমার হঠাৎ খুশি হওয়াটা দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব।”

তোহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আচমকাই তিহানের বাহুর নিচ দিয়ে ঢুকে বুকে মাথা রাখে।দুহাতে তিহানকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাসূলভ কন্ঠে বলে,
—“আমি একটু থাকি এখানটায়?”

—“থাকো।”
________________
তিহানের খাওয়া শেষ হয়েছে একটু আগে।টেবিলের সব গুছিয়ে প্লেটটা ধুয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে রুমে উঁকি দেয় তোহা।তিহান পায়ের উপর পা তুলে ফোনে কি যেনো দেখছে।তোহা আস্তে করে বলে,
—“দরজাটা আটকে দিয়ে যান।আমি যাচ্ছি।”

তিহান একপলক তাকিয়ে উঠে দাড়ায়।ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে আসে।তোহা দরজার সামনে দাড়িয়ে পায়ে জুতো পরছে।তিহান পাশে যেয়ে দাড়ায়।জুতো পরা শেষে দরজার লক ঘুরাতে নিলেই তিহান তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।একমূহুর্ত বিলম্ব না করে তোহার দু’হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগে ধরে চোখের সামনে তালু মেলে একে একে দুই হাতের তালুর মাঝখানটায় নম্রভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে মোহবিষ্ট কন্ঠে বলে,

—“এই নরম কোমল আদুরে হাতদুটোকে এত কষ্ট করানোর জন্য ঠোঁট ছুঁইয়ে ক্ষমা চাচ্ছে প্রেমিক।প্রেমিকা যেন তা গ্রহণ করে নেয়।”

~চলবে~