#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–14
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
রাতের কুটকুটে অন্ধকারে ঘরটাকে ভুতুড়ে লাগছে। কেমন গা ছমছমে অন্ধকার! ঢাকা শহরে তো কখনোই এমন অন্ধকার হতে দেখা যায়না। আজকে আকাশে চাঁদের দেখাও নেই। বোধহয় আজ অমাবস্যা!
মুহিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। হুহু করে বাতাস আসলে সে চমকে উঠছে।
রুমে অভিক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মুহিবের চোখে মুখে বেদনা। কিসের বেদনা এটা? জুই আর নেই নাকি অতীত সামনে এসে হানা দিয়েছে? কি জন্য কষ্ট পাচ্ছে সে? তার চোখের কোণে পানি লেগে আছে। কেন এমনটা হলো? এখন সে কি করবে? সেজুতি তাকে ভুল বুঝবে! অবশ্যই ভুল বুঝবে তাকে। আসলে ভুল বুঝবে না বরং সে নিজেই ভুল।
ভুলকে তো ভুল বলেই আখ্যায়িত করতে হবে!
ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে৷
একদিকে তার অতীতের মায়া অন্যদিকে তার ভালোবাসা। কিসের শক্তি বেশী? মায়া নাকি ভালোবাসার? কিসের অভাবে মানুষ ভস্ম হয়ে যায়? ভালোবাসা না মায়ার?
চোখ বুজে ফেলে সে। ভীষণ জ্বালা করছে।
মুহিব অতীতে ডুব দিলো। সেবার সে ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে। সারওয়ার বংশের বড় ছেলের বিয়ে। বিশাল আয়োজন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দাওয়াত রক্ষা করতে ইতিমধ্যে চলে এসেছে৷ মুহিবের পরীক্ষা থাকায় সে হলুদের দিন বাসায় এসে উপস্থিত হয়৷ দেরিতে আসার জন্য আম্মার সে কি ধমক!
সন্ধ্যা নাগাদ মুহিব সহ সারওয়ার পরিবারের কয়েকজন ছেলে-মেয়ে শোভা ভাবীর বাসায় গেল। মুরুব্বিদের মধ্যে কেউ যায় না মেয়ের হলুদ লাগানো দেখতে।। কম বয়সী ছেলে-মেয়েরাই যায় হলুদ ছোয়া দেখতে।
ভাবীর হলুদ ছাদে হয়েছিল। বাড়ির মেইন গেটের সামনেই তাদের মিস্টি, জুস, ফুল দিয়ে স্বাগতম করানো হয়।
মুহিবকে একটা মেয়ে মিস্টি খাইয়ে দেয়।কি তেজী মেয়ে! তাকে জোড় গলায় বলে, এতো বড় মিস্টি খাওয়ার জন্য এতো কম করে মুখ হা কেন করেছেন? মুখে ঘা কিনা?
মুহিব ভ্যাবাচ্যাকা খায়। কি তেজ গলার। বাপ রে!
সেটা মিস্টি ছিল নাকি প্রেমে পড়ার ট্যাবলেট তা আজো জানে না মুহিব।
সেই চঞ্চল হাসি, গোল গোল চোখের মায়ায় হৃদয় কেপে উঠে মুহিবের।
কাচা হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ির আচল যখন অযত্নে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। মুহিবের মন চাচ্ছিল এক দৌড়ে মেয়েটার শাড়ির আচল গিয়ে সামলাক সে! এই মেয়ের শাড়ির আচল সামলানোর দায়িত্ব সে আজীবনের জন্য চায়!!
তারপর বেখেয়ালি মেয়েটি যখন পরম যত্নে নিজের আচল উঠিয়ে নিল, মুহিবের বড্ড আফসোস হলো, সে কেন মেয়েটার শাড়ির আচল হতে পারলো না? শাড়ির আচল হলে মেয়েটা তাকে পরম আবেশে ছুয়ে দিত!
তারপর যখন মেয়েটা ঘেমে গিয়ে নিজের লম্বা চুলে হাত খোপা করতে ব্যস্ত! মুহিবের বিরক্ত লাগলো। মেয়েটা কি জানে না তাকে খোলা চুলে মানায় বেশ!
এক প্রহর দেখায় সেই মেয়ের উপর তার অভিমান, অভিযোগ, অধিকার জন্মাতে লাগলো! কি অদ্ভুত?
উফ! সেটা কালো জাম ছিলো নাকি অনুভব সজাগ করার ট্যাবলেট?
মেয়েটা যখন হাসছিলো, মুহিবের মনে হতে লাগে, এই মেয়ের হাসি যেন কেবল সে হয়!
গ্লাসে চুমুক দিয়ে যখন কোক খাচ্ছিলো বারংবার মনে হচ্ছিলো সে কেন ওই কোকের গ্লাসটা হলো না? তাহলে মেয়েটার ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া সে পেত! কোকের গ্লাসের প্রতি হিংসা হতে লাগে তার!
নিজেকে পরম অবহেলায় ফেলে যাওয়া সেই কোকের গ্লাস মনে হচ্ছে তার এখন এই মূহুর্তে। সেজুতির স্পর্শ পেয়েও যেন মনের এক কোণে ফেলা রাখা অবহেলিত কেউ একজন সে!
মুহিব ফোস করে দম ফেলে। শোভা ভাবীর হলুদে এক দেখায় প্রেমে পড়া মেয়েটা আর কেউ না বরং সেজুতি। কম বয়সের প্রথম অনুভূতি!যে অনুভূতি দ্বয়কে মুহিব মাটি চাপা দিয়ে পালিয়ে বাচে আমেরিকা। শেষ রক্ষা পায়নি৷ অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসে আবারো৷
সেজুতির জন্য যে বারংবার আত্মসমর্পণ করেও শান্তি পায়!
মুহিব আমেরিকা চলে গিয়েছিলো এর পেছনে অনেক বড় একটা কারন আছে। একটা চরম সত্য তাকে বাধ্য করে তুলে সেজুতিকে নিজের ভালোবাসার কথা না জানিয়ে সবকিছু তুচ্ছ করে সাত সাগর তের নদী দূরে চলে যেতে!
অনুভূতিদ্বয়কে তুচ্ছ করেছিলো এজন্য বোধহয় ভালোবাসা তার উপর রেগে গেছে। আর এই কারনেই আজকাল ভালোবাসা গলার কাটার মতো বিধে যন্ত্রনা দিচ্ছে৷
জুইয়ের সঙ্গে আমেরিকায় তার পরিচয়। কি সুন্দর চঞ্চল, হাসিখুশি, স্টাইলিশ মেয়ে। জুইয়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি তে যেদিন প্রথম দেখা সেদিন মুহিব চমকে যায়!
এক দন্ডের জন্য মনে হলো, সেজুতি শর্টস্কার্ট, স্কার্ফ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে৷
চোখের ভুলটা ভাঙতে মিনিট এক লেগেছিল। ভালো করে দেখার পর বুঝলো, সেজুতি না সে।বরং ভীনদেশী এক তরুণী। যার চোখে মুখে উপচে পড়া বাধা ভাঙা আনন্দের ঢেউ। আমেরিকানরা এমনিতেই আনন্দিত থাকে সবসময়।এই মেয়ে যেন একটু বেশীই আনন্দিত!
হলুদ স্কার্ফে তাকে দেখে থমকে যায় মুহিব। যাকে অজান্তে ভালোবাসলো, আবার সেই ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ না করেই পরাজিত সৈনিকের মতো পালিয়ে এলো, যাকে ভোলার জন্য এলো, তার মতোন ই কেউ একজন তার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ভাবা যায়? নিয়তির কি দারুণ খেল?
মুহিবের পড়াশোনা কিছুই ঠিকমতো হতো না৷ আম্মার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছিল। হাতের টাকা সব শেষ। একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি নিল৷ এই পরিবেশের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছিলো না সে৷ রেজাল্ট হলো। সে তিন সাবজেক্টে ফেইল।
বাঙালীরা ভাবে বিদেশে কেউ লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস না। আসলে এটা একটা গুজব। ওরা লেখাপড়া নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস৷ ওই ইউনিভার্সিটির রুলস ছিল, যে স্টুডেন্ট পিছিয়ে আছে, তাকে ওই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট রেজাল্ট ইমপ্রুভমেন্টে হেল্প করবে৷ মুহিব ফেইল করায় তাকে জুই হেল্প করতে লাগলো।
কথা ঠিক হলো, প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে তাকে ক্লাস লেকচার গুলো জুই লাইব্রেরি তে বুঝিয়ে দিবে৷
মুহিব সবচেয়ে বেশী অপমান বোধ করত তখন, যখন সে কাউকে ইংরেজীতে কিছু একটা বলছে। অথচ অপর জন ভ্রু কুচকে গটাগট বলে দিলো, আই এম নট গেটিং ইউ। ক্লাইন্ডলি স্পিক আউট ক্লিয়ারলি হুয়াট ইউ ওয়ান্ট টু সে৷ এই মূহুর্তটা খুব কষ্টদায়ক! জুইয়ের বেলায় এমন হলো না। সে খুব ইজিলি মুহিবের একসেন্ট ধরে ফেলে। দুইজনের জমে গেল বেশ। দূর দেশে কাউকে তো সে পেল যাকে নিজের কথা শোনানো যায়। যে তার কথা বুঝে!
ওইবার মুহিবদের ক্লাসে কোন বাঙালী ছাত্র ছিলো না। ইন্ডিয়ান কেউ ছিলো না।বড্ড একা হয়ে পড়ে সে।
জুইয়ের সঙ্গে পরিচয় নাহলে সে আরো অসহায় হয়ে পড়ত। মুহিবকে আরো সহজ করতে জুই বাংলা শেখার জন্য উঠেপড়ে গেলে যায়। একটা সময় জুই তার প্রতি উইক হয়ে যায়। ভালোবাসতে শুরু করে দেয় মুহিবকে৷ জুই জন্মগত ভাবে আমেরিকান হলেও তার বাবা-মা বাঙালী।
আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্ক গভীর হয়। সে জুইকে সব সত্য জানিয়ে যায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য জুই এতো বড় গোপন সত্য জেনেও মুহিবকে ঘৃণা করেনি।
এমন না যে মুহিব সেজুতিকে ভুলতে পেরেছে। কিন্তু সে চায় ভুলে যেতে। এ কারনে জুইকে একটা চান্স দেয়। কারন সেজুতি কখনোই সম্পূর্ণ সত্য জানলে তাকে মেনে নিবে না। এটা মুহিবের প্রগাঢ় বিশ্বাস
তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়। জুইয়ের সঙ্গে সে লিভ টুগেদার করে। প্রায় ছয়মাস একসঙ্গে ছিলো। দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিলো তাদের। জুইকে সেজুতির ব্যাপারেও সব জানিয়েছিলো।
কিন্তু আচমকা সব কেমন যেন হয়ে গেল। জুই কেমন যেন হয়ে গেল। তাকে এড়িয়ে চলতে লাগে৷
মুহিব বিয়ের জন্য প্রোপোজ করলে রিজেক্ট করে দেয় এবং সেজুতির কাছে ফিরে আসতে বলে। বলতে দ্বিধা নেই মুহিব তখনো সেজুতি কে ভুলে নি। একথাও জুই জানত।
জুই সাফ জানিয়ে দিল, তার দ্বারা এই সম্পর্ক আগানো সম্ভব না। ব্রেকাপ চায় সে। জুইয়ের কথায় বাধ্য হয়ে এবং নিজের অনুভূতির আদেশ মেনে ফিরে আসে বাংলাদেশে।
মুহিব জানত জুই প্রেগন্যান্ট । এইজন্যই সে বিয়ের জন্য প্রোপোজ করে। কিন্তু জুই বলে দেয় সে এর্বোশন করাবে৷ এখনি সংসারের দায়িত্ব চায় না সে।
জুইকে রাজী করানো যায় নি। মুহিবের জানামতে জুই ওয়াশিংটনের এক ক্লিনিকে এর্বোশন করিয়ে ফেলেছিল। প্রেগন্যান্ট হওয়ার সংবাদ হাইড করে জুই তাকে রেখে ওয়াশিংটন চলে যায়। হুট করে জুইয়ের পরিবর্তন মুহিবকে মচকে দেয়। একা হয়ে পড়ে সে।সে অন্যায় করেছে। নিজের সঙ্গে, জুইয়ের সঙ্গে, নিজের ভালোবাসা প্রতিও অন্যায় করে ফেলেছে। কিন্তু ততোক্ষনে কিছু করার ছিলো না তার। আমেরিকার মতো দেশে লিভ টুগেদার নরমাল। এটা তাদের সভ্যতা। মুহিব তাদের সংস্কৃতি সভ্যতা কে সম্মান করে। কিন্তু নিজের দেশের সংস্কৃতি কে ভুলতে পারেনি। মনে মনে অপরাধ বোধে পুড়তে থাকে সে। জুইয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করা ঠিক হয়নি এটা ভেবেই তার যন্ত্রনা হতে লাগে। সবকিছুই অসহ্য লাগতে লাগে। দম বন্ধ লাগতে শুরু করে তার।
জুইকেও সে সম্মান করে। ভালোবাসে কিনা জানে না? কিন্তু জুইয়ের সঙ্গে বসে সেজুতি কে নিয়ে দ্বিধা ছাড়া সে গল্প করে গেছে।
আচ্ছা সে বুঝি খুব খারাপ একটা ছেলে। নাহলে কি জুইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াত? সব কেমন পানসে হয়ে গেল। বাংলাদেশ ফিরে এসে ঢাকা থাকা শুরু করলো। মুহিব কলেজ থেকেই ঢাকায় থাকত৷
অতীত হতে বের হয়ে অভিকের পাশে এসে বসলো সে।
জুই এতোবড় মিথ্যা কথা কিভাবে বলল তাকে? এর্বোশন করার কথা বলে কেন জন্ম দিলো তাদের সন্তানকে? আর কেনই বা তাকে রেখে চলে গেল? সে তো ব্রেকাপ চায় নি।বরং সেজুতিকে ভুলে তাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলো!
জুই জোড় করে সব শেষ করে চলে যায় ওয়াশিংটন! কেন এমন করলো জুই?
মুহিবের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো৷
★★★
— ছোট বৌমা?
সেজুতি মনোয়ারা আক্তারের ডাকে সায় দিয়ে বলে উঠে, জ্বি মা।বলেন।
মনোয়ারা আক্তার গম্ভীরমুখে বলে, আজকে সকালে মুহিব রওনা দিয়েছে। রাতের আগেই ফিরবে।তুমি ওর জন্য ভালোমন্দ রাধো।
মুহিব আসবে শুনে সেজুতির গা বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায়৷ মনে মনে খুশি হয় সে।যতোই রাগ থাকুক না মনে, সেও চায় তার স্বামী তার চোখের সামনে থাকুক!
সেজুতি মাথা নাড়ল। এবং তখন থেকেই মুহিবের জন্য অপেক্ষায় অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগে। কখন হবে রাত?
ঢাকা পার হলেই জ্যাম ছুটে যায়। এরপর সাইসাই করে গাড়ি চলে৷ আর যমুনা ব্রিজ পার হলে বেশী সময় তো লাগেই না!
ঢাকা থেকে দিনাজপুর এতো দূরে কেন? আরেকটু কাছে হলে চলত না? অপেক্ষা করতে যে ভালো লাগে না!
চলবে।