সেদিন মুষুলধারে বৃষ্টি ছিল পর্ব-১৬

0
849

#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–16
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

বাইরে প্রচুন্ড ঝড় বইছে। বাতাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চারপাশ যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবার উপক্রম। বছরের প্রথম কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে আজ। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আজ বড্ড ক্ষ্যাপা। কেমন পাগলাটে রুপ দেখাচ্ছে!

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো বাইরে এক ফোটা বৃষ্টি নেই। শুধু ধুলো হাওয়া বইছে বৈকি।

সেজুতি জানালা ঘেঁষে প্রকৃতির তান্ডব দেখছে।এদিকে নিজের মনেও তান্ডব চলছে। বাইরে বৃষ্টি না পড়লেও তার চোখ বেয়ে যেন বাধ ভেঙে যাওয়া নদীর মতো জল বইছে। সে থেকে থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠছে। জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরের কোন ফাক-ফোকড় দিয়ে বাতাস এসে তার আঁচল উড়িয়ে দিচ্ছে। সেজুতি তার আঁচলের কোনে চোখের জল মুছলো। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সব ভুলে গিয়ে নতুন করে মুহিবের সঙ্গে সংসার বাধবে। এইজন্য মুহিব আসবে, সেই উপলক্ষে শাড়িও পড়েছিলো সে৷

অথচ নিয়তি! সে তো অন্য কিছুই ভেবে রেখেছে তার জন্য। সেজুতির শিরদাঁড়া পর্যন্ত রাগে কেপে উঠছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগের আভাস ঢুকে গেছে তার। মন-মানসিকতার অবস্থা খুব খুব বেশিই খারাপ। সে আবারো ফুপাতে লাগলো। তার কষ্ট উপলব্ধি করার মতো কেউ নেই পাশে!

আঁচলের কোণে আঙুল গুটাতে লাগে সে।চোখ জানালার বাইরে গিয়ে আটকে আছে। গাছ-পালা নড়ছে, কিছু নাজুক গাছ বাতাসের বেগ সহ্য না করতে পেরে বেঁকে পড়েছে।তার চোখের সামনেই অনেক জোড়ে বিদ্যুৎ চমকালো। সে নিজেও ভয়ে কেপে উঠে খানিকটা। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের বেগ ও বাড়তে লাগলো। এবং একটা হেলে পড়া গাছের বড়সড় একটা ডাল বিকট শব্দ করে জমিনে পতিত হলো।

আওয়াজটা শুনে সেজুতির আত্না ও কেপে উঠে। আজকের পরিবেশ এমন ভয়াবহ কেন? কোন ভাবে কি প্রকৃতি তার মনের গোপন অবস্থা বুঝতে পেরেছে? বুঝতে পারলেও বা কি? সে কি প্রকৃতির আপন কেউ যে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য স্বয়ং প্রকৃতি প্রতিবাদ করবে?

সে প্রকৃতির কেউ হয় না? আর না তার কোন আপনজন এই মূহুর্তে তার কাছে আছে?

রুম অন্ধকার ছিলো। বাইরে পেছনের বাগানে জ্বালানো বাতির আলোই এখান অব্দি আসছিলো। হুট করে দরজার কাড়া বেজে উঠল। সে চমকে গেল। অথচ চমকানোর মতো কিছু নেই৷এর অনেক বড় চমক তার জীবনে এইমাত্র ঘটে গেছে!

সে বাতি না জ্বালিয়েই দরজা খুলতেই সুমি হড়বড় করে বললো, ভাবী একটা মুশকিল হয়ে গেছে।

— কি হয়েছে?

— বাবুটা আধঘন্টা আগে উঠছে। উঠেই কান্না শুরু। সেই যে কাদা আরম্ভ করল।,আর থামে না। বিদ্যুৎ চমকালে আরো জোড়ে জোড়ে কাদে। ভাবী আপনি আসেন। আমার দ্বারা সামলানো সম্ভব না।

সেজুতি নির্বিকার থাকলো। একটা সময় বলল, আচ্ছা আসছি।

সে অভিকের রুমে গিয়ে ঢুকল। চোখ পড়ল, অভিক গুটিসুটি মেরে কান্না করছে।মুখ চোখ লাল হয়ে আছে। চেহারায় আতংকের ছাপ। তখনি অনেক জোরে বজ্রপাত হলো। অভিক আরো জোড়ে কেদে ফেলে।

সেজুতি এবারে তার কাছে গিয়ে বসল। বাচ্চাটা ভয়ে কাপছে।

সে কিছু বলবে আর আগেই অভিক তার কোলে উঠে বসে এবং খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

তার এতোক্ষণ রাগ লাগছিল। ভেবেছিল অভিককে বকা দিবে। কিন্তু অভিক যখন তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগে, সব রাগ পানি হয়ে যায়। সে ও স্নেহময় হাতে অভিককে আদর করে ইংরেজি তে বলে, ভয় পেয়েছো?

অভিক মাথা নাড়লো। সে বলে উঠল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দেখি মুখটা দেখাও তো!

বলে অভিককে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে এনে পাশে বসালো। এরপর আঁচল দিয়ে অভিকের মুখ মুছিয়ে দিলো।

— খিদে পেয়েছে?

— হু।

— পানি খাবে?

— হ্যা।

পানির জগ পাশেই ছিলো। সে পানি গ্লাসে ঢেলে অভিককে খাইয়ে দিলো। পানি খাওয়া হতেই সেজুতি সুমিকে বলল, নুডুলসটা নিয়ে আসো।

অভিক চুপচাপ বসে আছে। তার বড্ড ভয় করছে। সেই সাথে পেট ক্ষুধায় কাতর। সামনে বসে থাকা মানুষ টা একদম তার মাম্মার মতো। তার মাম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। মাম্মার কথা ভাবতেই সে কেদে উঠে। মাম্মা কোথায়? মাম্মা থাকলে তাকে নিশ্চয়ই খিদে লাগতে দিতনা।মাম্মা তো একটু পর পরই তাকে এটা-সেটা খাইয়ে দেয়। মাম্মার কাছে যেতে চায় সে। আর ভালো লাগছে না। কতক্ষন হয়ে গেল মাকে দেখে না সে।মাকে ছাড়া যে তার চলেই না!

সেজুতি অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে, কি হয়েছে? আবার কেন কান্না করছো?

— আমি আমার মাম্মার কাছে যাব৷

তার বুকটা ধুক করে উঠে ছোট্ট অভিকের মুখ থেকে এমন কথা শুনে। চোখে জল চলে এলো। তার যখন আট বছর বয়স, সেই সময় তার মাও মারা যায়। সে বুঝে মা হারা বাচ্চার কত কষ্ট! আর অভিক তো আরো অনেক ছোট। মৃত্যু কি তাই হয়তোবা বুঝে না। এইজন্য মৃত কারো জন্য অপেক্ষায় আছে। সে তো আর জানে না এই দুনিয়া খুব নিষ্ঠুর! মৃতরা কখনো ফিরে আসেনা। যে একবার চলে যায় আর তো ফিরে আসেনা। হাজার হাহাকার করেও তাকে এমুখো করা যায় না!

যদি কান্না করে আপনজনকে মানুষ ফিরে পেত, তবে বুঝি সবাই অমর রয়ে যেত!

সে পরম স্নেহ-মমতা নিয়ে অভিককে আগলে ধরে বলে, কান্না করেনা। তোমার না খিদে পেয়েছে? আসো খেয়ে নিই। এতো রাতে কোন বাবু জেগে থাকেনা। এটা ঘুমানোর সময়! এসো খাবে। তারপর ঘুমাবে।

ততোক্ষনে সুমি নুডুলস নিয়ে এসেছে। নুডুলস দেখে স্বস্তি পায় অভিক। মাম্মা তাকে প্রায়ই চাওমিন-নুডুলস বানিয়ে খাওয়ায়। আবারো মাম্মার কাছে যেতে মন চাচ্ছে তার। কান্না পাচ্ছে তার।

সেজুতি নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো তাকে। অভিক ও ভদ্র বাচ্চার মতো খেয়ে যাচ্ছে। খেতে খেতে অভিক অবাক হয়ে ইংরেজি তে প্রশ্ন করে, তোমার ঠোঁটে কি হয়েছে? লাল হয়ে আছে কেন?

সেজুতি বিব্রতবোধ করতে লাগলো। সে উসখুস করতে করতে বলে, ব্যথা পেয়েছি বাবু। দেখি দ্রুত খাও। ঘুমাতে হবে তো। হা করো।

বাকিটা খাইয়ে দিয়ে অভিককে শুইয়ে দেয় সে।বাইরে তখন ধুলো হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সেজুতি খেয়াল করেছে, যখনই বাতাস বেশী হবে তখন আর বৃষ্টি হবে না। আজকেও বৃষ্টি হলো না।

অভিক দশ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। রুমে তখনো সুমি দাঁড়িয়ে আছে।

সুমিকে দেখে স্মিত হাসলো সেজুতি।

সুমি কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলে, ভাবী মলম লাগাবেন?

— না।

— এমন জেদ ধরিয়েন না ভাবী। শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছেন। মলম লাগালে ব্যথা কমে যাবে৷

— ব্যথা কমাতে চাচ্ছিনা! এই আঘাতের চিহ্ন গুলো দৃশ্যমান থাকা দরকার। যেন লোকে বুঝতে পারে, তোমাদের ভাই একটা জানোয়ার।

— ভাবী,,,,

— তোমার ভাই এখন কোথায়?

— দোতলায়।

— দোতলায় কি করছে? ওখানে তো থাকার ব্যবস্থা নেই।

— নেশা করতেছে ভাই।

— ভালো। খুব ভালো।

সুমি চুপ হয়ে গেল। আজকে ভাই আর ভাবীর রুম থেকে ভাবীর আর্তনাদ ভেসে আসছিলো। নিশ্চয়ই ভাই গায়ে হাত তুলেছিলো। সে সামান্য একজন কাজের মেয়ে। সাহস হয় নি ভাইকে গিয়ে থামানোর। ভাবীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সুন্দর সুশ্রী চেহারাটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে কেটে গেছে। গাল লাল হয়ে আছে। এই দুই জায়গার জোটগুলো দেখা যাচ্ছে আর না জানি কোথায় কোথায় মেরেছে ভাই, যার ক্ষত চোখে পড়ছে না ! কিন্তু যন্ত্রণা মরণ ছুঁইছুঁই!

সুমি ভাবতে লাগলো, সব বড়লোক গুলো কি এমনই হয়? অত্যাচারী, শোষক?

সে ফোস করে দম ফেলে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। ফ্লোরিং করে সে বিছানা পেতেছে। আজকের রাত এখানেই ঘুমাবে। এই বাসায় কাজের মেয়েদের থাকার জন্য রুমের ব্যবস্থা আছে।

সেজুতি কিছুক্ষন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে অভিকের পাশে শুয়ে পড়লো৷

বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া মাত্র সারা শরীর জুড়ে বিষব্যথা শুরু হলো। তার মনে হয়, বিছানার সঙ্গে যন্ত্রণার কোন যোগসূত্র আছে। শুলেই ব্যথা বেড়ে যায়! সেটা শরীরের হোক মনের!

আজকের রাত তার চিরদিন মনে থাকবে। মনের স্মৃতির পাতায় লিখে রাখবে আজকের দিন সে। আজকে মুহিব তার গায়ে হাত তুলেছে!

★★★

মুহিব দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে শীতল হাওয়া বয়ে আসছে। একটু শীত করছে তার। তারপর ও ভালো লাগছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।সেই সঙ্গে মাথা ছিড়ে ফেলে দেওয়ার মতো মাথা ব্যথা করছে তার। নাড়ি-ভূড়ি বাকিয়ে বমি আসতে চাইছে কিন্তু কোন কারনে বমি হচ্ছে না। বমি হলেই নেশাটা কেটে যাবে।

কিছুক্ষন আগেই সে ছয় পেগ হুইস্কি একবারে খেয়ে প্রায় মাতাল হয়েছিলো। এর পর পর কি নিয়ে যেন সেজুতির সঙ্গে আরেক দফা কথা কাটাকাটি হলো। এর মাঝে আচমকা সেজুতি তার গায়ে থুথু মারলো।

মুহিবের রাগ সপ্তম আকাশে উঠে যায়। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। মদের নেশা চড়া হলে অনুভূতি গুলো খুব সুক্ষ্মভাবে মনের মধ্যে সজাগ হয়। তার ও খুব রাগ লাগছিলো। এরপর নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে সব রাগ সেজুতির উপর ঝাড়লো। ঝাপসা মনে আছে, খুব বাজে ভাবে আঘাত করছিলো সে সেজুতির গায়ে! হাতের কাছে যা পাচ্ছিলো তাই নিয়েই তার শরীরে আঘাত দিচ্ছিলো। সেজুতি কি কাদছিলো তখন? এটা মনে আসছে না। তখন সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। রাগে মাথা ফেটে চাচ্ছিলো। আম্মা না আসলে আজকে কেলেঙ্কারী ঘটে যেত।

আচ্ছা সে তো সেজুতিকে ভালোবাসে! এ কেমন ভালোবাসা!

ভালোবাসায় তো আঘাত করা ঘোর পাপ! সে কেন সেজুতির গায়ে হাত তুললো? সে কি তাকে ভালোবাসে না?

মুহিব সিগারেট ধরালো। বিরক্ত লাগছে তার। সবকিছু তেই বিরক্ত ভাব এসে গেছে। সে দিব্যি টের পাচ্ছে আজকে রাতে ঘুম হবে না। দুই প্যাকেট সিগারেট আর এক বোতল হুইস্কি আজকে রাতে তার অনিন্দ্রায় জেগে থাকার সঙ্গী।

মুহিব দোতলার একটা রুমে প্রবেশ করলো। দোতলায় চারটা ঘর।এরমধ্যে একটা লাইব্রেরী আছে। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো লাইব্রেরি। তিনটা বুক সেলফে বইয়ে ঠাসা। দুইটা চেয়ার আর একটা টেবিল আছে। লাইব্রেরীর চার দেয়ার মধ্যে একটা দেয়ালে সম্পুর্ন কাঁচ দিয়ে জানালা বানানো। এবং বাকি তিন দেয়ালে পেন্টিং। মোনালিসার রেপলিকা ও আছে। এই ঘরটা মুহিব নিজে সাজিয়েছে। একটা সময় প্রতিদিন বিকেলে বই পড়তে আসত সে৷ কিন্তু এখন বই আর ধরা হয় না৷

আসলে বই পড়তে আর ভালোবাসতে একটা সুন্দর পরিবেশ দরকার। বইপোকা ও প্রেমিক হতে হলে একটা সুন্দর ও পবিত্র মন দরকার। যা তার নেই। বা ছিলো কোন এক সময়!

তার মধ্যে যদি বইপ্রেম না থাকত তবে এই নরকে কি লাইব্রেরী বানাত? নিশ্চয়ই না।

মানবমন পরিবর্তনশীল। — ইহা চিরন্তন সত্য।

অর্ধেক যুগ আগেও সে বই পড়তে ভালোবাসত। অথচ এখন বিরক্ত লাগে। তেমনি এখন কি আর সে সেজুতি কে ভালোবাসে না? কোন একসময় বাসত ভালো, নাহলে কি তাকে নিয়ে এত্তো কিছু লেখা সম্ভব! এই যে বুক সেলফে ঠাসা প্রতিটা বইয়ের ২৭ নং পেজে একটা লাল গোলাপের পাপড়ি আর একটা চিঠি লেখা৷ চিঠির প্রতিটা শব্দ সেজুতিকে উৎসর্গ করে। ২৭ নং পেজে চিঠি লুকিয়ে রাখার রহস্য হলো, সেজুতির সঙ্গে তার প্রথম দেখা ২৭ শে আষাঢ় হয়েছিল।

এইসব কি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়?

মুহিব ঢুলতে ঢুলতে একটা চেয়ারে বসে কাগজ কলম বের করলো। আজকেও সে একটা চিঠি লিখবে। সেজুতিকে উদ্দেশ্য করে লিখবে৷

মুহিব লেখা শুরু করলো,

প্রিয়তমেষু,

আমি খুব খারাপ একজন মানুষ তাই না? এটা অবশ্য আমার কথা না। তুমি বলেছো। আমি মেনে নিয়েছি। তোমার বলা কোন কথায় আমি যুক্তি খুজি না। তুমি যুক্তির উর্ধ্বে এইজন্য হয়তোবা তুমি ভালোবাসা। তোমার কাছে একটা প্রশ্ন, বল তো কার শক্তি বেশী? ঘৃণা না ভালোবাসা?আমার মনে হয় ঘৃণার ক্ষমতা বেশী। উপস! ভুল বললাম, শক্তি আর ক্ষমতা তো এক না। দু’টোর একক আলাদা। চিঠিটা আমি ছয়টা হুইস্কি খাওয়ার পর লিখছি কাজেই এমন ভুল নিজ গুনে মাফ করবে। যদিও বা এই চিঠি তোমার হাতে পৌছাবে না তাও মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আমার শৈশব কিন্তু আর দশটা বাচ্চার মতো না। ছোট থেকে টানা-ছ্যাচড়া, মারামারি,শক্রুর আক্রমণ, অনৈতিক কাজ দেখেই বেড়ে উঠা। মাঝে মাঝে মনে হত, রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া অভিশাপ। শান্তি নেই কোথাও! দুই ভাইকে সবসময়ই আম্মা ভুল শিক্ষা দিত। একটা জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে দিল যে, তোমার ক্ষমতা আছে, তা কাজে লাগাও সেটা ভালো কাজে হোক বা খারাপ কাজে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, কোন সৎ বা ভালো কাজে কোন দিন ক্ষমতা লাগে না। ক্ষমতার দরকার পড়ে অনৈতিক কাজে!

মানুষ জগতে নিজের ভিত তৈরি করে নিজের কর্মের মাধ্যমে। আর ভিত্তির শিকড় হলো সততা। আমাদের কাজে কোন সততা নেই। আমরা সব ধরনের দুর্নীতি করি। একটা উদাহরণ দেই, আমাদের ঔষধ কোম্পানি আছে। কাচামালের অবস্থা যা নয় তাই! ডেট এক্সপায়ারড মেডিসিন ও বাজারে সেল করি। আমি জানি আমার শিকড়ে সততার ছিটেফোঁটা ও নেই। তুমি খুব বোকা সেজুতি! বোকা বা সরল তুমি! তুমি জানো না, আম্মা খুব খারাপ, নিষ্ঠুর একজন মহিলা আর আমি সেই মহিলার সবচেয়ে আদরের ছেলে!

আম্মার নারী ব্যবসা আছে। তবে স্বেচ্ছায় হচ্ছে সবকিছু। ছোট শহরে জোর করে কাউকে ধরে এনে এই ব্যবসায় নামানো যায় না। যা হচ্ছে সবার মর্জিতে হচ্ছে। বিয়ের পরের দিন তুমি যেই ফ্লাটে আমাকে নিতে এসেছিলে, ওখানে কাস্টমাররা আসে আর আমরা সার্ভিস দিই। আমার ওই বিল্ডিংয়ে বিয়ের পরের দিন তোমাকে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। এক কাস্টমার ঝামেলা শুরু করলো, আম্মা আমাকে অনুরোধ করল, সব ঝামেলা চুকিয়ে আসতে। আম্মার আদেশ মানতে গেলাম। বলা বাহুল্য, এমন একটা অনৈতিক ব্যবসায় সবসময়ই একটা না একটা কলহ লেগে থাকবে। আম্মা কিন্তু জানত আমি কাজে বাইরে গিয়েছি। ইন ফ্যাক্ট সে নিজেই আমাকে পাঠিয়েছিলো। সব কিছু মিটমাট করতে করতে রাত হলো। আগের ডিসি সাহেব আমাদের পুরাতন কাস্টমার। উনিও সেদিন এসেছিলো। তাকে সঙ্গে দিতে গিয়ে আমি নেশা করলাম। অবস্থা এমন হলো যে হাঁটার শক্তি নেই৷ না পেরে আমার ম্যানেজার কে তোমার নাম্বার দিলাম। তুমি আসলে, কিন্তু কিছুই বুঝলে না। না বোঝারই কথা! আমিও আগে কিছু জানতাম না। আচ্ছা আমার লেখা গুলো কি এলোমেলো? আসলে নেশা চড়ে গেছে৷ লিখতে বেগ পেতে হচ্ছে। এবার অতীতের কথা বলি?

আমি বিবিএ শেষ করে ভাবলাম, তোমাকে নিজের মনের কথা বলব। কিন্তু কোথায় যেন একটা সংকোচ, লজ্জা পেতাম।বলা হত না। আম্মার কথায় অফিস জয়েন করি। তখন জানতে পারলাম, আমাদের সবকিছুই প্রায় অনৈতিক ভাবে গড়া। নারী ব্যবসাও আছে। এসব শুনে আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। আমি জানি তুমি খুব প্রতিবাদী। তোমাদের সম্ভবত একটা ছোট খাটো এনজিও আছে। মানুষের সেবা করতে পছন্দ করো তুমি। নিজের ইনকাম সোর্চের সত্যতা জানার পর আমি ভেঙে যাই৷ আম্মার সঙ্গে ঝগড়া হয়। আমি জানতাম, তুমি সব জানলে কোন দিন আমাকে ভালোবাসবে না। এজন্য সব ফেলে চলে যাই দূরে।

মুহিব থেমে গেল। বোতল খুলে এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে, সিগারেট ধরালো এবং লাইটার দিয়ে চিঠি টা জ্বলিয়ে ফেলে। কোন প্রমাণ থাকলো না। সব সত্য মূহুর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

চলবে।