প্রেম পায়রা পর্ব-১৩

0
1755

#গল্পের_নাম:|| প্রেম পায়রা ||
#লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব______১৩

২৩.

তিথি বেলকনি দিয়ে অধীর আগ্রহে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে।তার মন বলছে আজ সম্পদ ফিরবে।আজ বাসায় ফিরবে!দুদিন হলো সম্পদ বাসায় ফিরছে না।প্রচুর কাজ নাকি জমে আছে।সেজন্য রাতের বেলা অফিসেই থেকে যাচ্ছে।

বাসায় না ফেরার কথাটি সম্পদ নিজেই তাকে ফোন করে বলেছিল।সে যাতে খাবারের অনিয়ম না করে,ঠিক মতো ভার্সিটি আসা যা-ওয়া করে তার জন্য কড়া নির্দেশ দিয়েছে।

সম্পদ বাসায় থাকলে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয় না।উল্লেখ যোগ্য কোনো ঘটনা ঘটে না। তবুও এই মানুষটা আশপাশে থাকলে তিথি স্বস্তি পায়।কাছাকাছি না থাকলেও আশপাশে আছে এতেই শান্তি শান্তি অনুভূত হয়।

অন্ধকার বেলকনি থেকে সে দেখলো একটা গাড়ি এসে মেইন গেইটের কাছে দাঁড়িয়েছে।দারোয়ান দরজা খুলছে দেরি করলো না।আস্তে আস্তে গাড়িটা ভেতরে ঢুকলো।গাড়িটা যে সম্পদের তা তিথির অজানা নয়!তার ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।সে দ্রুত বেলকনি থেকে সরে আসলো।

চোখের পলকে সে বিছানাটা গোছগাছ করলো।বেডশিট টান টান করলো।ড্রেসিং টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিস গুলো গুছিয়ে রাখলো।শেষ মুহূর্তে আলমারি থেকে সম্পদের জন্য ড্রেস বের করে বাইরে রাখল।

সম্পদ ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকলো।এক টানে গায়ের কোট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো।গলার টাইটা টেনে খুলে ফেলল।শার্টের সামনের বেশ কয়েকটা বোতাম আলগা করে সটান বিছানায় শুয়ে পড়লো।চোখ বন্ধ করে বলল,

—‘বড্ড টায়ার্ড লাগছে।ঘন্টা খানেক পর ডেকে দিয়ো তিথি!’

তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল,

—‘ঠিক আছে।’

তিথি কিছুক্ষণ সম্পদের দিকে চেয়ে রইলো।অতঃপর সুইচ টিপে ফ্যানটা বন্ধ করলো।রিমোট হাতে নিয়ে এসি অন করলো।সে রুমে থাকলে সারাক্ষণ এসি অফ করা থাকে।এসি অন করলেই তার মাথাটা ভার ভার লাগে,মাথা ধরা শুরু হয়ে যায়।সেজন্য প্রথম দিন থেকেই সম্পদ এসি অফ রাখে।

রুমের লাইট বন্ধ করে রুম অন্ধকার করলো তিথি।ফোনটা হাতে আবার বেলকনিতে এসে বসলো।বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না।সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।ডিনারের সময় হয়ে গেছে।নিচে নামতে হবে!

আবছা অন্ধকারে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে সম্পদ।তিথি ডাকলো না।এগারোটা-বারোটার দিকে ডেকে দিলেই হবে।হঠাৎ করে বড্ড মায়া অনুভব করলো মানুষটার প্রতি।মনের কোণে ইচ্ছে জাগলো সম্পদের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে।দু পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে এলো সে।কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

সে নিচে নামলো।সম্পদের খাবারটা উপরে নিয়ে আসতে হবে।

২৪.

সম্পদের ঘুম ভাঙলো রাত বারোটার দিকে।কারো ডাকাডাকিতে নয়!স্বইচ্ছায়!ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসগত ভাবে দেয়ালঘড়ির দিকে চোখ পড়ে মনটা ক্ষুণ্ণ হয়ে গেল।সে ভেবেছিল, তিথি তাকে ডেকে দিবে।এই জিনিসটা তার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।তিথি তাকে কিভাবে ডাকে সেটা!গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিবে,নাকি কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকবে নাকি অন্যকিছু!কিন্তু দেখতে পেল না।

কিছু অনুভূতির সাক্ষী জোর করে হওয়া যায় না।হওয়া যায় না একপাক্ষিক ভাবে।দুই পক্ষের সমান সমান আগ্রহ থাকতে হয়।সে উঠে বসলো।

তিথি সেন্টার টেবিলটার পাশে চেয়ারে বসে আছে।চোখ বন্ধ তার!হয়তো বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে।রুমে আলো জ্বলছে।সম্পদ উঠে গিয়ে সবার আগে এসি অফ করে ফ্যান ছাড়লো।তারপর তিথির দিকে এগিয়ে গেল।তিথি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে।অথচ তার তিথিকে আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে।

সম্পদ এগিয়ে গিয়ে অতীব সাবধানে তিথিকে কোলে তুলে নিল।ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে নিঃশব্দে তিথিকে শুইয়ে দিল।আপাতত ঘুমাক।একটুপর ডেকে দিবে।তিথিকে তার কিছু জানানোর আছে।

তিথির পেট পর্যন্ত কম্বল টেনে দিয়ে সে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করে বের হলো সে।

টেবিলে প্লেট দিয়ে খাবার ঢেকে রাখা।টাওয়ালটা কাঁধে ঝুলিয়ে সম্পদ চেয়ার টেনে বসে পড়লো।খাবার দেখে তার ক্ষুধা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।দুপুরেও আজ কিছু খাওয়া হয়নি।

মুখে এক লোকমা খাবার পুড়ে তিথির কথা মনে পড়লো।তিথি খেয়েছে তো?সম্পদ আবার উঠে বিছানার দিকে এগোল।তিথি ঘুমের মধ্যে নড়চড় করছে।

—‘তিথি?এই তিথি?’

তিথি রেসপন্স করলো না।সম্পদ বাম হাতে হালকা করে ধাক্কা দিল।তবুও তিথি চোখ খুলল না।সে শীতল হাতটা দিয়ে হালকা করে তিথির কপাল স্পর্শ করে ডাকলো,

—‘এই তিথি?তিথি!’

তিথি চোখ খুলল।কিছুক্ষণ অবাক নয়নে সম্পদের মুখপানে চেয়ে রইলো।সম্পদ হাতটা সরিয়ে বলল,

—‘রাতে খেয়েছ?’

তিথি উঠে বসে পড়লো।গায়ের ওড়না টেনেটুনে বলল,

—‘আপনি উঠে গেছেন?কয়টা বাজে?’

—‘একটার বেশি বাজে।’

—‘এত রাত হয়ে গেছে!’

—‘হুঁ!তুমি কি রাতের খাবার খেয়েছ?না খেলে আমার সাথে খেতে পারো।’

তিথির টেবিলের দিকে চোখ গেল।পরক্ষণে সম্পদের দিকে চেয়ে বলল,

—‘খেয়েছি।আপনি খেয়ে আসুন।’

সম্পদ সরে গিয়ে আবার চেয়ার টেনে বসে পড়লো।তিথি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো।সম্পদ ছোট ছোট লোকমা করে ভাত মুখে পুড়ছে।সেদিকে অপলক চেয়ে তিথির মনে হলো ভাত খাওয়ার দৃশ্য পৃথিবীর যাবতীয় চমৎকার দৃশ্যের মধ্যে একটি।

তার আবার ঘুম ঘুম পাচ্ছে।মুখে হাত রেখে সে হাই তুলল।সম্পদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

—‘আপনার কিছু লাগবে?না হলে ঘুমিয়ে পড়বো।’

সম্পদের হাত থেমে গেল।একদৃষ্টিতে ভাতের দিকে চেয়ে রইলো।কত অকপটে তিথি বলছে তার কিছু লাগবে কি না!অথচ তার যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা তিথি তালাবদ্ধ করে রেখেছে।তার মন অবধি সে কিছুতেই প্রবেশ করতে পারছে না।

অবশিষ্ট ভাতে পানি ঢেলে সম্পদ উঠে দাঁড়ালো।ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

—‘আমার কিছু লাগবে না তিথি।তবে এখনি ঘুমিয়ে পড়ো না।আমার ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার আছে তোমায়।’

সঙ্গে সঙ্গে তিথির বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।ঘুম তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাল।সম্পদ কি বলবে তাকে?ভয়ানক কিছু?

ঘুটঘুটে অন্ধকার।বেলকনিতে বেশ দূরত্ব রেখে দুজন বসে আছে।দুজনের দৃষ্টি সম্মুখ প্রাণে।বাইরে হিমশীতল বাতাস।হাঁড় চিড়বিড় করে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।তিথি গায়ের ওড়না টা চাদরের মতো পেঁচিয়ে নিল।পনেরো-বিম মিনিট হলো তারা বেলকনিতে বসে আছে।সম্পদের তাকে কিছু বলার আছে।অথচ সম্পদ তাকে কিছুই বলছে না!

সে মাথা ঘুরিয়ে সম্পদের দিকে তাকালো।সম্পদের মুখ অস্পষ্ট।অন্ধকারে শুধু একটা অবয়বের মতো।সে অবয়বের দিকে চট করে তাকালে পিলে চমকে উঠে।তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল,

—‘রুমের আলো জ্বালিয়ে আসি।বেলকনিটা একটু আলোকিত হবে।’

তিথি উঠে দাঁড়ানোর আগেই সম্পদ বাধা দিয়ে বলল,

—‘থাক!আলো জ্বালানোর দরকার নেই তিথি।কিছু কথা আছে যেগুলো আলোতে বলা যায় না।অন্ধকারে চটজলদি বলে ফেলা যায়।তাছাড়া অন্ধকারে যে কোনো ভয়ানক সত্যি অকপটে বলে ফেলা যায়।এই যে এই অন্ধকারে তোমার ছবি অস্পষ্ট।আমার মনে হচ্ছে আমি একা।নিজের সাথে কথা বলছি শুধু।আর নিজের সাথে কথা বলার সময় কেউ মিথ্যে বলে না।সব সত্যি বেরিয়ে আসে।অন্ধকারের অনেক গুণ!’

—‘আপনি কি আমায় ভয়নাক সত্যি কিছু বলবেন?’

—‘হয়তো তোমার জন্য তেমন ভয়ানক কিছু না।’

তিথি আর কথা খুঁজে পেল না।অনেকদিন হলো একই ছাদের নিচে দুজন, অথচ হঠাৎ হঠাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেলে দুজনেই।

সম্পদ অনেক্ক্ষণ পর বলল,

—‘আমি আগামীকাল বিদেশ চলে যাচ্ছি তিথি।বিজনেসের প্রোগ্রেসের জন্য ফ্যাশন ডিজাইনের উপর অনেক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।কিন্তু আমার এ ব্যাপারে মেধা প্রায় শূন্যের কোটায়।সেজন্য ফিনল্যান্ড ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ছয় মাসের জন্য ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপর একটা কোর্স করবো।’

তিথি চুপচাপ রয়েছে।তার ভেতরে কোনো পরিবর্তন হলো কি না তা সম্পদ বুঝতে পারছে না।তার অস্পষ্ট সে ছায়ামূর্তির দিকে চেয়ে সম্পদ আবার বলল,

—‘এখন আমি একা নই।এতবড় একটা সিদ্ধান্ত তোমায় জানিয়ে নেয়া উচিত ছিল।কিন্তু জানানো হয়নি।হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া অবশ্য।ভার্সিটিতে সিলেক্টেড হয়ে যাব সেটাও ধারণাতে ছিল না।কিছুদিন আগে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে ডেকেছিল।তারা সিলেক্ট করেছে।এরপর ভিসা,পাসপোর্ট সহ সব কিছু আমার ম্যানেজার করেছে।

ছয়টা মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে তিথি।তাছাড়া আমার মনে হয় তোমার নিজস্ব একটা স্পেস দরকার।তুমি এখনো আমার সাথে সহজ হতে পারছ না।ভেতরে ভেতরে এতটা প্রেশার নিয়ে পড়াশোনা করবে কি করে?আড়াই মাস পর তোমার সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম।আশা করি আমার অবর্তমানে নিজেকে সুন্দর মতো গুছিয়ে ফেলবে।ভালো মতো স্টাডি করে পরীক্ষা দিবে।

এ সময়টাতে তুমি যে-কোন জায়গা থাকতে পারবে।আমাদের এখানেও থাকতে পারো,আবার তোমার বড় বাবার ওখানেও!তোমার মন যা চায় তাই করবে।আজকের পর থেকে তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত।যা খুশি তাই করতে পারো,যা ইচ্ছে তাই হতে পারো!

আমার বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে তোমার বড় বাবা জানেন।উনার সম্মতি আছে।’

সম্পদ থামলো।বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের করতে নিয়েও শেষ মুহূর্তে আটকে ফেলল।তিথি এখনো চুপচাপ।সম্পদ গভীর দৃষ্টিতে তিথির দিকে চেয়ে রইলো।এমন একটা জীবন হয়তো তিথি চেয়েছিল।সে তো তাকে পাশে চায় না।সে অফিস থেকে ফিরলেই অস্বস্তিতে টইটম্বুর হয়ে যায় তিথি।থাক!সামনের দিনগুলো ও নিজের মতো কাটাক।নিজের মতো স্পেন্ড করুক না!সে তার ভালোবাসাকে না হয় আরেকটা সুযোগ দিল।দূরত্বে যদি তিথি তার ভালোবাসা বুঝতে পারে?তার অনুপস্থিতি যদি তিথির মনে তার জন্য জায়গা তৈরি করে?

সম্পদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।অজানা অভিমানে ভেতরটা ভরপুর হয়ে উঠছে।সে উঠে পড়লো।তিথিকে অতিক্রম করে বেলকনির কাচ ঠেলে রুমে ঢুকলো।

২৫.

সম্পদ চলে গেছে আজ বিকেল চারটার দিকে।বিমানবন্দরে অপেক্ষা করবে বাকি সময় টুকু।রাত দশটার দিকে তার ফ্লাইট।

চারিদিকে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে।দিনের ফিনিক আলোকে দূরে সরিয়ে অন্ধকার চারপাশে আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে।তিথির মাথার ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে।মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে ফেঁপে একাকার!

সম্পদ যে তার জন্য এতবড় সারপ্রাইজ রেখেছিল তা ধারণার মধ্যে ছিল না।তিথির এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সম্পদ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।তার মনে হচ্ছে সম্পদ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অফিসে গেছে।রাত হলেই চলে আসবে।মন বললে কি হবে?সে জানে সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে।দূরে,বহুদূরে!

তার বড় বাবা,বড় মা সম্পদকে সি অফ করতে এসেছিল।বড় বাবা তো এয়ারপোর্টে গেছে পৌঁছে দেয়ার জন্য।তিনি তিথিকে ও বাড়িতে যেতে বলেছিল বড় মায়ের সাথে।কিন্তু তিথি যায় নি।তার অভিমান জমেছে।বড্ড বেশি অভিমান জমেছে সম্পদের প্রতি।তার পর জমেছে বড় বাবার প্রতি।তিনি সব জানার পরো তিথিকে একবার জানানোর প্রয়োজর মনে করেনি।

তিথি আবার ডুকড়ে কেঁদে উঠলো।

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল তিথি।তার ঘুম ভাঙতে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিল।পাওয়ার বাটন চেপে দেখলো রাত দুটো বাজে। মুহুর্তে তার ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো।এতক্ষণে সম্পদ আকাশে উড়ছে।তড়িৎ গতিতে তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো।চোখ বন্ধ করে মাথার নিচের বালিশটা সরিয়ে বুকে জড়াতে হাতে খামের মতো কিছু একটা অনুভব করলো।

অন্ধকারের মধ্যে সাদা ফকফকে কাগজ।সে দ্রুত চোখ মুছে কাগজটা হাতে নিল।উঠে গিয়ে লাইটটা অন করে কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখল।ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন রাখার মতো একটা খাম।খামের ভেতর সাদা পেইজে কিছু লেখা।তিথি বুঝতে পারলো চিঠি!

দৌঁড়ে বিছানায় বসে সে পড়া শুরু করলো। চিঠির শুরুতে কোনো সম্বোধন নেই।সরাসরি লিখেছে,

“একটা সময় তোমার অবর্তমানে আমি তোমায় হাজার খানেক নামে ডাকতাম।তোমায় নিয়ে লেখা কাগজে কত শত অদ্ভুত নাম দিয়ে সম্বোধন করতাম।সে লেখাগুলো কখনো স্থায়ী হতো না।লেখার পরপরই হয়তো ছিঁড়ে টিঁড়ে ময়লার ঝুঁড়িতে রাখতাম।অথচ আজ যখন এত তোড়জোড় করে, শুধু তোমার জন্য, তোমার নামে চিঠি লিখতে বসেছি তখন সম্বোধন খুঁজে পাচ্ছি না।কেন জানি মনে হচ্ছে আমার কল্পনায় ডাকা তোমার নামগুলোর উপর থেকে অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।

তিথি,এই লেখা যখন তুমি পড়বে তখন আমি তোমার কাছে নেই।তোমার থেকে বহুদূরে।অথচ আমি যখন লেখাটা লিখছি তখন তুমি আমার পাশেই শুয়ে আছো।গভীর ঘুমে তুমি।একটু পর পর নড়াচড়া করে বুকের ওড়না সরিয়ে ফেলছো আর আমি ঠিক করে দিচ্ছি।তুমি কখনো এমন পরিস্থির স্বীকার হয়েছ যে, রাতের পর রাত জেগে একজনের দিকে তুমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো চেয়ে রয়েছো অথচ সে ঘুমের মধ্যে অন্য একজনকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাচ্ছে?স্বপ্নে অন্য একজনের হাত ধরে ছোটাছুটি করছে?অন্য একজনের কথা ভেবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠছে?

তুমি জানো এটা কতটা কষ্টের?কতটা কষ্টের তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না।অথচ রাতের পর রাত ধরে আমি সহ্য করে যাচ্ছি।ভেতরের পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ সবার আড়ালে রাখছি।তোমার থেকে নিজেকে লুকিয়ে কতটা স্বাভাবিক আচরণ করছি।এরপরও বলবে আমার ধৈর্য শক্তি কম?

তোমাকে একটা গল্প শোনাই তিথি।আমার নিজের গল্প।
ভেবে রেখেছিলাম, কোনো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে একত্রে সপ্তর্ষী তারকারাশি দেখতে দেখতে তোমায় বলব।অথবা ভরা পূর্ণিমার কোনো ফকফকে জোসনা রাতে জোসনাস্নান করতে করতে তোমায় শুনাব আমার প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা,প্রথম অনুভূতির কথা!

সেদিন স্নেহার ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য সব ডকুমেন্টস নিয়ে দুজন একসাথে যাই।ওর ভর্তির সব প্রসেসিং শেষে একটা ফোনকল আসে আমার।কথা বলার জন্য সবেমাত্র চার তলার করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছি।করিডোরের অপর প্রান্তে কাচের মতো স্বচ্ছ একটা হাত নজরে এলো।একটা মেয়ে আমার দিকে পেছন ঘুরে কারো সাথে কথা বলছে আর ডান হাতটা পেছন দিকে দিয়ে ব্যাগের চেইন খোলার চেষ্টা করছে।হাতের নীল আর সাদা পাথরে সৃষ্ট ব্রেসলেটে সূর্য রশ্মি পড়ে চিকচিক করছে।স্নিগ্ধ সে হাতে দুটো বড় বড় তিল।চোখের পলকে সে হাতের মায়ায় ফেঁসে গেলাম।মেয়েটাকে দেখার তীব্র কৌতূহল জন্মাল।ফোনটা কানে নিয়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছানোর আগেই সে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।আর খুঁজে পেলাম না।

এরপর থেকে আমায় সময় কাটতে লাগলো অস্থিরতায়।পরের দিন স্নেহাকে নিয়ে আবার ভার্সিটিতে গেলাম।মনটা ভীষণ অস্থির।কোথায় যেন বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে।স্নেহাকে নিয়ে এটা ওটা দেখাতে দেখাতে বেলা পড়ে গেল।দুপুরের দিকে ভার্সিটির সামনের ক্যান্টিনে গেছি খাবার কিনতে।এডমিশনের সময় বলে প্রচুর ভিড়!ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।হঠাৎ আমার পেছন থেকে অবিকল সেই হাতটা টাকা ধরে আছে দোকানদারের দিকে।সেই ব্রেসলেট,সেই তিল, সেই নরম তুলতুলে হাত!বড্ড চিরচেনা মনে হলো সেই হাতকে।পেছন ঘুরে হাতের অধিকারী সেই মানুষটাকে দেখার আগেই গলায় মিহি একটা সুর ভেসে এলো।সামান্য গলা উঁচিয়ে বলছে,’মামা আমার টাকাটা রাখুন!আমার টাকাটা রাখুন!’

দোকানদার টাকা হাতে নিতে হাতটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।আমি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে সেই হাতের মালিককে দেখলাম এবং সেই মায়াকাড়া চেহারায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।মেয়েটা তখন দূরে দাঁড়িয়ে সেই স্নিগ্ধ হাতে ধরে রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর বন্ধুদের সাথে গল্প করছে।তার এক কাঁধে ঝোলানো সেই গতকালের কালো ব্যাগ।আমার আর হুশ নেই!সেই যে মেয়েটার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।

এরপর একটু সুযোগ পেলে স্নেহার ভার্সিটিতে গিয়ে হাজির হতাম।সেই মেয়েটার নাম,পরিচয়, ডিপার্টমেন্ট, বাসার ঠিকানা এসব জোগাড় করতে আমার বহু সময় লেগে যায়।ততদিনে মেয়েটা আমার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে গেছে।সুযোগ পেলেই তাকে নিয়ে কল্পনার শহর খুলে বসি।যে শহরে আমি আর সে হাত ধরে পাশাপাশি বসে আছি।কখনো বা হেঁটে কুয়াশায় মিলিয়ে যাই।

যত সময় যাচ্ছিল তত আমি আরো পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।তাকে ছাড়া খেতে পারি না,শুতে পারি না,ঘুমাতে পারি না,কাজে মন বসে না!মানে পুরোদস্তুর যাচ্ছে তাই অবস্থা।এর মধ্যে পর পর সাতদিন ভার্সিটিতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না।অস্থিরতায় আমার দমবন্ধ অবস্থা।আর উপায় না পেয়ে বাবাকে বলে মেয়েটার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলাম।

মেয়েটার বাবা আমার পূর্ব পরিচিত।আমার প্রস্তাবে তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং মেয়েটা যে তার পালিতা মেয়ে সেটাও বললেন।সবচেয়ে আশ্চর্য জনক যে কথাটা উনি বললেন সেটা হলো,মেয়েটার সদ্য মন ভেঙেছে।নিশান নামক একটা ছেলেকে ভালোবেসে ভাঙচুর হয়ে গেছে সে।জানো তিথি,আমার পৃথিবী তো সেদিন উলোটপালোট হয়ে গেছিল যেদিন তোমার বড় বাবার থেকে জানতে পারলাম তুমি অন্য একজনকে ভালোবাসো।তবুও আমার সেই উলোটপালোট পৃথিবী গুছিয়ে তোলার জন্য তোমার হাত ধরতে চাইলাম।তোমার সদ্য ভেঙে চূড়ে যা-ওয়া মন নতুন করে গড়ার দায়িত্ব নিলাম।

তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার উপর এতটা বিশ্বাস ছিল যে তোমার বড় বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম অল্পদিনের মধ্যে তোমার সব পুরনো ক্ষত আমি ভুলিয়ে দিব।তোমার জীবন নতুন করে সাজিয়ে তুলবো।তোমায় আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবো।আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব দুঃখ মুছে দিব।কিন্তু আমি পারিনি।অল্পদিন কেন!টানা দু দুটো মাসেও তোমার মনে বিন্দুমাত্র জায়গা করতে পারিনি।সব জেনে না জানার ভান করে রইলাম।কতটা স্বাভাবিক আচরণ করলাম তোমার সাথে।তবুও ঘুমের মধ্যে তোমার হাত ধরলে তুমি বিড়বিড় করে নিশান নাম জপ করো,তোমায় একটু কাছে টানলে তোমার চোখের ভেতর আমি নয়!অন্য একজনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।তুমি আমার মাঝে নিশানকে খুঁজো!যেটা আমি চাই না।আমি একজন ব্যর্থ প্রেমিক,একজন ব্যর্থ স্বামী তিথি!আমার উচিত আর সারাজীবন দেশে না ফেরার!আমি বুঝতে পেরেছি তোমার মনের দখলদারিত্ব আমি আর কখনো নিতে পারবো না।কখনো না!ব্যর্থ আমি!

ইতি
তোমার না হওয়া ব্যক্তিগত সম্পদ”

শেষের দিকের লেখাগুলো পড়তে পড়তে তিথির চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।কাগজটা বুকের উপর নিয়ে সে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করলো।

(চলবে)