তুই আমার কাব্য পর্ব-২৯+৩০

0
1889

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 29
.
🍁
.

সাত দিন হয়ে গেছে কাব্যর বাড়ির থেকে চলে এসেছে। আগামীকাল আবিরের মা বাবা এসে এন্গেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করে যাবে। দুনিয়ায় যদি দুঃচিন্তা বেঁচে দেওয়া যেতো তাহলে সর্বপ্রথম হয়তো মেঘলাই বেঁচে উদ্ভোদন করতো। ওর বেঁচে ফেলার পর আর কেউ কেনার মতো থাকতো বলেও বেশ সন্দেহ আছে। রীতিমতো চিন্তায় চিন্তায় ভুলে যাওয়ার ব্যমোও হচ্ছে। কখন কোথায় কি রাখছে, কি করছে সব ভুলে যাচ্ছে মেঘলারাণী। সকালবেলা না খেয়েও বলছে খেয়েছি, গোসল করে এসেও আবার গোসল করতে যাচ্ছে গোসল করে নি বলে, খাটে ফোন রেখে রান্নাঘরে খুঁজতে যাচ্ছে, জামা চেয়ারে রেখে সারা আলমারি এলোমেলো করে ফেলছে। এই মূহুর্তে বদ্ধ পাগল ছাড়া আর কোনো শব্দ মেঘলার জন্য প্রযোজ্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। সামান্য এন্গেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করতে আসবে তাতেই এই অবস্থা তাহলে বিয়ের দিন কি হবে ভেবেই মেঘলার মাথা ভন ভন করছে। গোল দুনিয়াকে চতুর্ভুজ মনে হচ্ছে। এখন ওর সত্যিই নিজেকে মাথা মোটা বলে স্বীকার করতে ইচ্ছা করছে। অনেকগুলো বাদাম একসাথে খাওয়ার সাথে সাথে যদি বুদ্ধি উদয় হতো তাহলে মেঘলা বোধ হয় কেজি ধরে বাদাম কিনে খেয়ে নিতো। কিন্তু তারপরও একটা চান্স নিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? যেই ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘর থেকে এক ছোটো ডিব্বা বাদাম নিয়ে আসার সময় চোখ পড়লো কিছু লাউয়ের বিচির উপর। কোনো এক সময়ে আদালত নামক এক বিনোদন অনুষ্ঠানের সবার প্রিয় কে ডি পাঠকের কাছে মেঘলা শুনেছিলো লাউয়ের বিচি খেলেও নাকি বুদ্ধি বাড়ে। তীব্র আত্মবিশ্বাসের সহিত মেঘলা লাউ বিচিগুলো ভেজে নিচ্ছে। এক হাতে লাউ বিচি ভাজা ছোট্ট পাত্র আর আরেক হাতে বাদামের ডিব্বা নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিচ্ছে। মাঝখানে মোহনার সাথে টক্কর খেয়ে গেলো। মোহনা মেঘলার হাতে এসব দেখে বেশ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করে,

– আপি! এগুলো কি?

– আমার মগজ ভাজি। খাবি? বেশ চেষ্ট হয়েছে। দেখ তো লবণ হয়েছে কিনা?

– ধ্যাত বল না।

– চোখের মাথা কি খেয়েছিস নাকি কাউকে দান করে এসেছিস?

– তুই সোজা কথার মানুষই না। খা তুই তোর মগজ ভাজি।

হন হন করে রুমে ডুকে বিছানার মাঝখানে গিয়ে দুই পা তুলে বসেছে। একপাশে বাদাম আরেক পাশে লাউ বিচি। মাঝখানে ফোন রেখে কিছু ড্রামা দেখা শুরু করে আর আরেকদিক দিয়ে খাচ্ছে।

খাওয়ার মাঝখানে হঠাৎই আনন্দে গদগদ হয়ে পড়ে মেঘলা। মুখের এক্সপ্রেশন বিশ্বজয়ের আর মনে মনে ভাবছে,

– হায়! মেঘলা! কাজ করেছে, তোর ব্রেন খুলে গেছ। লাভ ইউ কে ডি পাঠক। আজ তুমি না থাকলে আমি এসব খেতে বসতাম না, খেতে না বসলে এইটা দেখতাম না আর এইটা না দেখলে আমার ব্রেণে এমন চমৎকার বুদ্ধি আসতোই না। ধন্য তুমি ধন্য। হাহ্! আর নয় বাংলা সিনেমা, আব হোগা কামাল স্টার প্লাস কা। হা হা

মেঘলা শুধু আজকের রাতটা কাটার অপেক্ষায় আছে। যদিও কাজটা একটু রিস্কি কিন্তু এতোটুকু রিস্ক তাকে ওঠাতেই হবে এমন মনোবল নিয়ে বসে আছে। সকাল বেলা ওঠেই মিশন শুরু হবে। কালকে থেকে শুরু করে কাবিনের আগ পর্যন্ত এমন কত মিশন যে তাকে করতে হবে ভেবেই মেঘলা কাত।

সকাল হতে না হতেই মেঘলা ওঠে বসে আছে। টেনশনের প্রেসারে ঘুম যেনো তার রাগ করে উধাও। কান পেতে আছে কখন বাবা মায়ের গলার শব্দ শুনবে সেই অপেক্ষায়। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে ওর বাবা ওঠে জগিং করছে এবং মা রান্নাঘরে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সাহস দিয়ে নিচে নামচ্ছে। উদ্দেশ্য রান্নাঘর। উঁকি মেরে দেখে ওর মা রান্না করতে ভিষণ ব্যস্ত। মেঘলা আস্তে আস্তে রান্নাঘরে ঢুকছে। মেঘলার মা রান্নারত অবস্থাই বলে ওঠে,

– কি ব্যাপার! সকাল সকালই রান্নাঘরে? ভার্সিটি যাবি আজকে?

– হুম ভাবছি তাই কিন্তু একটু পড়ে যাবো। ক্লাস পড়ে আমার।

– তাহলে রান্নাঘরে হঠাৎ?

– এমনি। তোমাকে সাহায্য করতে এলাম আর কি।

– বা বা! সূর্য কি পর্ব দিকেই উঠেছে?

– আম্মু! এমন করে বলো কেনো? ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম রান্নাঘরে এসে একটু কাজ করি।

– আচ্ছা! বুঝেছি।

– ঘোড়া বুঝেছো। আচ্ছা সর। আমি একটু গরম পানি করি।

– কেনো? গরম পানি দিয়ে কি করবি?

– গরম পানি দিয়ে? গরম পানি দিয়ে….. হ্যা প্যাক পেইন করছে খুব। তাই ভাবছি একটু ভাপ দেবো।

– আচ্ছা তাহলে তুই থাক আর পানি গরম দে আমি তোর আব্বুর চা টা দিয়ে আসি।

– আচ্ছা যাও।

মেঘলার মা চা দিয়ে ফিরে আসার পথে ব্যাপক এক চিৎকার শুনে দাড়িয়ে যায়। কোথা থেকে আসলো বুঝতে গিয়ে দেখে রান্নাঘর থেকে এসেছে। দ্রুত দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখ মেঘলা একপাশে পেটে হাত দিয়ে শুয়ে আছে আর আরেকপাশে পাতিল পড়ে আছে। মেঘলার কাছে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেঘলাকে জিজ্ঞাসা করে,

– মেঘলা, মেঘলা কি হয়েছে মা? এভাবে পড়ে আছিস কেনো?

– মা ভিষণ পেট ব্যাথা করছে। সহ্য করতে পারছি না।

– হঠাৎ করে পেট ব্যাথা কেনো করছে?

– সকাল থেকেই করছে কিন্তু বলতে চাই নি ভেবেছিলাম সেড়ে যাবে কিন্তু হঠাৎ করে এতো বেড়ে গেলো আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। খুব ব্যাথা করছে আম্মু।

– কি করবো এখন? একটু কষ্ট করে ওঠ মা। চল মেডিসিন খাইয়ে দেই।

– আমি খেয়েছি মা সকালে। কিন্তু কাজ করছে না।

– তাহলে তো এখনি হাসপাতালে যেতে হবে।

মেঘলার মা চিৎকার করে মেঘলার বাবাকে ডেকে আনে।

🍁

মেঘলা বেডে শুয়ে আছে। এক হাতে স্যালাইন করা। গায়ের চাদরটা পেট পর্যন্ত টেনে রাখা। তখনি কেবিনে ডাক্তার ঢুকলো। ডাক্তার ঢুকার সাথে সাথে মেঘলা ওঠে বসে। ডাক্তার এসে মেঘলার পাশে বসে হাসিমুখে বলে,

– তে কি অবস্থা আপনার মেঘরানী? দিনকাল কেমন চলছে?

– একদমই ভালো না আন্টি। জানেনই তো সব। ভালো থাকলে কি আর এসব করতে হয়?

– হুম তা তো বুঝতেই পারছি। খুবই সেয়ানা হয়েছো। বাসার সবাই কতো টেনশন করছে বুঝতে পারছো?

– হুম বাট এছাড়া কি করা যেতো? আপনি আর তনু না থাকলে তো আরোও মুসকিল হয়ে যেতো। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো সেই ভাষা নেই আন্টি।

– হয়েছে হয়েছে। খুব বড়দের মতো কথা শিখেছো। তুমি তনুর মতোই আমার মেয়ে। সেই ছোটকাল থেকে একসাথে বড় হতে দেখেছি তোমাকে। তনুর পরে তুমিই তে আমার দ্বিতীয় মেয়ে।

মেঘল ওঠে বসে ডাক্তার ওরফে তনুর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– লাভ ইউ সো মাচ। এর জন্যই তো এতো ভালোবাসি আর ভরষাও করি।

– ভালো করে ছিলে তনুকে কালকে সব বলে রেখে। আমাগীকালকে থেকে ছুটি নেওয়ার কথা ছিলো যা আজকে আমি এপিল করতাম। কিন্তু তনু কালকে ইনফর্ম করায় একদিন পর সেইটা এপিল করবো।

– কি করবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার কথা কেউ বুঝতো কিনা জানি না। যতটুকু বুঝেছি আব্বু রাগের মাথায় ডিসিশনটা নিলেও মন থেকে নেন নি। কিন্তু আম্মু আবার ব্যপারটা মন থেকে নিয়ে খুব খুশি ইভেন আম্মুরা তো ঠিকই করে রেখেছিলো সব আগে থেকে। এখন আব্বু চাইলেও পিছাতে পারবে না আর আম্মু তো চাইবেই না।

– হুম। তনু বলেছে সব। শুনেছি সবই। যাই হোক এমন কাজ আর একদমই করবে না কেমন?

– জ্বি আন্টি। কিন্তু এই স্যালাইনটা কিসের?

– ওহ্ এইটা? এইটা গ্লুকোজ। প্রেশার লো তোমার। আচ্ছা তুমি কি বুঝো নি তোমার প্রেশার এতো ফল করছে। খারাপ লাগে নি? পঞ্চাশে নেমে এসেছে একদম। একদিকে ভালোই হয়েছে এসেছো। এদিকটা উপকার হলো।

– খুবই টেনশনে ছিলাম তাই ওদিকে খেয়াল হয় নি।

– হুম বুঝতেই পারছি। আজকে সারারাত চলুক। কালকে থেকে দুর্বলতা কেটে যাবে আর ভালোও লাগবে তোমার।

– আজকে কি থাকবো এখানে?

– হ্যা অবশ্যই। এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলে ধরা খেয়ে আমার ডাক্তারি লাইসেন্স যাবে ।

দুজনেই হাসিতে মেতে ওঠলো।

– এক্সকিউজ মি! মে আই কাম ইন?

বাহিরে একজনের গলার আওয়াজ পেয়ে দুজনেই থেমে গেলো। তনুর মা পেছন ঘুরে তাকালো। মেঘলাও গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকাতেই থ। তনুর মা আর মেঘলা একে অপরের দিকে তাকালো। মেঘলা শুকনো ঢোক গিলে দরজার দিকে তাকালো। তনুর মা হাসির চেষ্টারত অবস্থায় ওঠে বসে ভেতরে আশার অনুমতি প্রদান করলো। মেঘলা মনে মনে বলে,

– আমি…. এবার…. শেষ। সাথে মান সম্মানও।

চলবে……… ❤

হ্যাপি রিডিং।

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 30
.
🍁
.

বেডের উপর জোড়া শিং দিয়ে বসে আছে মেঘলা। চোখ মুখে অনুতপ্তটার ছাপ স্পষ্ট। তবে তা কতটুকু সত্যি তা একমাত্র মেঘলাই জানে। সামনেই চেয়ারে বসে আছে আবির। হাতে ঔষধের বক্স। কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত। মেঘলা মাথা নিচু করে নিচু স্বরে আবিরের উদ্দেশ্যে বলে,

– ভাইয়া! আই এম সরি।

আবির মাথা উচু করে মেঘলার দিকে তাকায়। সরি বলার কারণটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। শুরু শেষে কিছুই নেই হঠাৎ করে কেউ সরি বললে তার কারণটা না জানাই স্বাভাবিক। আবির মুখে হালকা হাসি ভাব রেখে ভ্রু টা কুচকে জিজ্ঞাসা করে,

– সরি! কেনো বলতো? না ঠিক কি কারণে তোমায় ক্ষমা করবো?

– সেদিন আর আজকের ঘটনার জন্য।

– কোনদিন?

– ওই যে ওই দিন যেদিন আপনি আমাকে নিয়ে আংটি কিনতে যেতে চেয়েছিলেন। ওইদিনও যেতে পারি নি আর আজকে আমাদের বাসায় আসার কথা ছিলো আপনাদের, এন্গেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করার কথা ছিলো কিন্তু কোনোটাই আমার জন্য হলো না।

আবির বক্সটা টেবিলে রেখে চেয়ারটা বেডের দিকে টেনে বসলো। দুই হাত দিয়ে মেঘলার একহাত আলতো করে ধরে বললো,

– আচ্ছা একজন মানুষের জীবনের থেকে কি এসব অনুষ্ঠান শপিং বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তুমি অসুস্থ। মানুষ কি ইচ্ছে করে অসুস্থ হয়? অসুখ একটা এক্সিডেন্টের মতো। যে কেউ যখন তখন অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আর তোমার থেকে আচার অনুষ্ঠান এসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় মেঘলা। তোমার সুস্থতা, তোমার ভালো থাকার কাছে এসব একদমই তুচ্ছ ব্যাপার। আজ না হয় কাল এসব হবে। যেইটা আগে হওয়ার কথা সেইটা না হয় দুইদিন পর হবে। ব্যাস এইটুকুই। এতটাদিন অপেক্ষা করেছি আর দু একটাদিন পারবো না?

– আপনার খারাপ লাগছে না একটুও? আপনি কি আশায় ছিলেন না?

– অবশ্যই ছিলাম। মানুষ আশায় বাঁচে। বেঁচে থাকার স্বার্থে মানুষ আশায় থাকে। কিন্তু তাই বলে কি সব সময় সব আশা পূরণ হয়? হয় না তো। তখন আমি ওটার আশায় ছিলাম যেইটা ঘটনাচক্রে হয় নি। এখন আবার আরেকটা আশায় আছি যে তুমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে চলো। তুমি সুস্থ হলে, ভালো হলেই তবেই তো আবারো ওই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো। আমার আসলে এসব এতোকিছু চাইও না। আমার শুধু তোমাকে পেলেই হলো। তুমি থাকবে এইটুকুই স্বপ্ন, এইটুকুই আশা। অপেক্ষার ফল সর্বদা মিষ্টি হয় জানো না? অপেক্ষা করে আসছি বলেই হয়তো যা চাইছি তাই পাচ্ছি। জানো মেঘলা! ছোট্ট বেলায় যখন তোমার বক বক, দুষ্টুমি, অযথা চিল্লিয়ে এটেনশন গ্রো করার মতো বাচ্চামো গুলো ফেস করতাম তখন না সেই সময় খুবই রাগ লাগতো। কারণ ছোট বেলায় অনেকটা গম্ভীর ছিলাম। তোমার সাথে লাষ্ট দেখাও জগড়া করে হয়। পানির গ্লাস দিয়ে ভিজিয়ে নিজেই কেঁদে বাড়ি মাথায় করেছিলে। সব বকা আমি খেয়েছিলাম। তারপর থেকেই রাগে আর আসতাম না। তারপর তো সময়ের পরিক্রমে আর দেখাই হলো না। আমি দেখেছি কয়েকবার কিন্তু তুমি দেখো নি। প্রায়ই ভিডিও কলে পাশ থেকে দেখতাম তোমায়। আম্মু তো প্রায়ই ক্ষেপাতে আমাকে। আস্তে আস্তে আর ক্ষেপতাম না। হাসতাম শুধু, কেনো সেটাও জানি না। যেদিন শুনেছিলাম তুমি আমার ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো এতো আনন্দ হয়েছিলো শুধু ছেলে বলে প্রকাশ করতে পারি নি। আমি নিজেও বলতে পারবো না জানো কিভাবে তোমায় এতো করে চাইতে লাগলাম। কেমন যেনো একটা অধিকার বোধ কাজ করে। তুমি তো ছোট থেকেই আমার হয়ে আছো। বুঝিনিই কখনো এই দুষ্টু, চঞ্চল মেয়েটাকে এতটা ভালোবাসবো।

আবির কথাগুলো বলে একটা নিঃশ্বাস নিলো। চোখে আবছা অশ্রুর প্রতিচ্ছবি। মেঘলা নির্বাক হয়ে শুধু মুখের দিকে তাকিয়েই আছে। আবিরের চোখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকাতে পারছে না। চোখে যে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে তার মধ্যে স্বচ্ছ কাচের মতো ওর কথাগুলো আরো বেশি আবেগ নিয়ে ভেসে ওঠছে। আবির থেমে মেঘলার হাতে হালকা চাপ দিয়ে বলে,

– আমি জানি না তুমি কি ভাবো, কি ধারণা আমাকে নিয়ে। হয়তো আমাকে ভালোবাসো না। সেটুকু সময়ও তুমি পাও নি। ইটস ওকে। তার জন্য যত সময় লাগবে লাগুক। ভালোবাসতে না পারলেও আমার কোনো অবজেকশন থাকবে না। শুধু আমার পাশে থেকো, বিশ্বাস রেখো আর কাছে থেকো। ছেড়ে যেও না শুধু এইটুকু অনুরোধ। আমি তোমায় কি পরিমাণ চাই তা বলা তো দুর বোঝানোও সম্ভব না আমার পক্ষে। আমার কাছে থেকো, তোমার ছায়া হয়ে থাকতে দিও এতটুকুই যথেষ্ট।

আবিরের আবেদনময়ী চোখ জোড়া মেঘলার গায়ে কাটার মতো বিধছে অনুতপ্তার তাপে। কি বলবে এখন মেঘলা? কি বলা উচিৎ? আবিরের এই চাউনি, এই ভালোবাসা মেঘলার মন মস্তিষ্ককে ঘিরে চেপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেঘলা কখনো ভাবেই নি যা ও এতোদিন ছেলেখেলা করে আসছে তা কারো কাছে এতোটা স্পেশাল, এতোটা স্বপ্ন নিয়ে আছে। কারো অনেকদিনের সাধনার ফল এইটা। কি করবে এখন? সব দিক দিয়েই নিজেরই হার আবার নিজেরই জিত। নিজের সাথে এ কেমন দোটানা? এ তো যুদ্ধ। নিরব, অদৃশ্য যুদ্ধ।

মেঘলার চোখের নিচে বিন্দু পানি গরিয়ে পড়লো গাল বেয়ে। আবেদনময়ী চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বাধা বাধা নিঃশ্বাসে বলে,

– ভাইয়া! ভালো লাগছে না শরীরটা। আমার না খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুমও পাচ্ছে। অনেক সকালে ওঠেছিলাম আর দুপুরেও ঘুমানো হয় নি। ম্যজ ম্যজ করছে। মাথাটাও চাপ ধরছে। একটু বিশ্রাম নিতে চাই।

আবির মেঘলার হাতটা ছেড়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছোট্ট একটা হাসি দেয় যেটাতে অদ্ভুত এক অসহায়ত্বের মিশ্রণ রেয়েছে। হয়তো আবির বুঝে গিয়েছে মেঘলা তার কথাগুলো এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে অথবা পালাতে চাচ্ছে কথা দেয়া থেকে। আবির হাসি মুখেই ওঠে গিয়ে মেঘলাকে শুয়ে দিলো। চাদরটা বুক পযন্ত ঢেকে দিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

🍁

ঘড়িতে সময় প্রায় দশটা। ঘুমে আচ্ছন্ন মেঘলা। পাশ ফিরে গালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। নিঃশব্দে কেবিনের ভেতরে হাতে খাবারের একটা বক্স নিয়ে ঢুকলো আবির। মেঘলাকে ঘুমুতে দেখে মৃদু এক হাসি দিয়ে বেডের সামনে হাটু গেড়ে বসে মেঘলার এক হাত যত্ন সহকারে ধরে ধীর কন্ঠে বলে,

– আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো না। কিন্তু এটাও জানি আমার সাথে থাকতে থাকতে ঠিক একদিন ভালোবাসবে আমায়। তোমায় আমি হারাতে পারবো না। জীবনে সবকিছু ভাগ করে নেওয়া শিখলেও তোমায় ভাগ করতে পারবো না। তোমায় অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে পারবো না আমি। একটা চুলও না। বিশেষ করে ওই কাব্যর সাথে তো একদমই না। প্রয়োজনে ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবারো ঘটবে। আমি ঘটাবো। তবুও তুমি শুধু আমা…

আবিরের কথার মাঝে হঠাৎ করে ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে। আবির এক হাত দিয়ে মেঘলার হাত ধরে আছে আর আরেক হাত দিয়ে ফোন বের করে। স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে মেঘলার হাতটা আলতো রেখে ওঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে,

– হুম আন্টি আমি মেঘলার কাছে এসে পড়েছি। ওর খাবারটাও দিয়েছি। কিন্তু ঘুমিয়েছে তাই ডাকছি না। ও অনেকটা দুর্বল তো আর ভালো লাগছে নক বলেে ডাকছি না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি ওঠে কিনা। তা না হলে নার্সকে বলে যাবো যেনো ওকে আধ ঘন্টা পড়ে এসে ওঠিয়ে খাইয়ে দেয়। আপনি একদম টেনশন করিয়েন না। এখন অনেকটাই সুস্থ আছে ও। সেলাইনটাও খুলে দিয়েছে। আপনারা ঘুমিয়ে যান। আর ও তো এডাল্ট তাই কাউকে থাকতে দেবে না তার মধ্যে প্রবলেমটা মেজর। সিরিয়াস হলেও থাকা যেতো। আমাকেও মনে হয় আর থাকতে হবে না। আমিও চলে যাবো একটুপর। আমি একদম নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাদের মেঘলা কালকেই ইনশাআল্লাহ বাড়ি ফিরবে। এখন রাখি আমি আন্টি।

আবির ফোনটা পেকেটে রেখে মেঘলার দিকে এগিয়ে যায়। মেঘলার সামনে বসে একহাত দিয়ে সামনের চুলগুলো ভালো করে গুজে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ঠোঁট ছুয়ে বসবে তখনই দরজায় নার্স এসে কড়া নেড়ে আবিরকে এবার কেবিন ছাড়ার জন্য অনুরোধ করে। আবির মেঘলার হাতে চুমু দিয়ে বেড়য়ে নার্সকে খাওয়ার ব্যাপারটা বুঝিয়ে চলে যায়।

আবির চলে যেতেই মেঘলা চোখ মেলে তাকায়। পাশ ফিরে ওঠে বসে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। আবির আর কাব্যর একে অপরের প্রতি এই তীব্র প্রতিহিংসার কারণটার সম্পূর্ণ কারণ এখনো তার অজানা। কেনো কাব্যকে এতোটা ঘৃণা করে আবির? কি এমন করেছিলো কাব্য যে অহনা ওভাবে, অকালে মারা যায়? সত্যিই কি কাব্য দায়ী? কাব্যর কোনো ভুলেই কি অহনার মৃত্যু ঘটেছে? যদি এটাই সত্যি হয় তাহলে মেঘলা কি করবে?
খিচে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মেঘলা।

.

গম্ভীর মুখে কেবিনের উপর বসে আছে মেঘলা। ফাঁকা গহ্বরে পরিণত হয়েছে মেঘলার মস্তিষ্ক। গহ্বরের শেষ খুঁজে পাচ্ছে না। আবিরের কথাগুলো, আবিরের চোখ, মুখ সবকিছু ভাসছে চোখে, কানে বাজছে বার বার। বিরক্ত রাগের এক মিশ্রণ নিয়ে বসে আছে। এইভাবে শুয়ে বসে থেকে থেকে মরিচা পড়ছে যেনো। ফোনটাকে খুব মিস করছে। অনন্ত ফোনটা থাকলেও সময় কিছুটা ভালোভাবে অতিবাহিত হতো। মেঘলা বেড থেকে নামতে যাবে তখনই সোজা কালো পোষাক পরিধানকারি এক ব্যক্তি ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই সাথে সাথে দরজার দিকে ঘুরে দরজা আটকে দিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় মেঘলা শুধু তাকিয়েই আছে। ব্যক্তিটা মেঘলার দিকে ঘুরে মেঘলার বেডের ওপর সরাসরি ওঠে জোড়া শিং দিয়ে মেঘলার বরাবর ওঠে বসে। মেঘলা চোখের পলক দুবার ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করে,

– কাব্য ভাইয়া আপনি? এখন এখানে? কেনো? কিভাবে? এখন তো আপনাকে এলাউ করার কথা না।

কাব্য পকেট থেকে ফন বের করতে করতে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে,

– কোনটার উত্তর আগে দেবো?

– সবগুলা

– ওকে। আমি কাব্য নই। কাব্যর ডুপ্লিকেট রোবট। আর হ্যা এখন এখানে আমি। মন চেয়েছে তাই এসেছি। আর এসেছি অবশ্যই পায়ে হেঁটে। আর কিছু?

কাব্য ফোন থেকে কিছু একটা খুঁজে মেঘলাকে পা ওঠে বসাতে বললো। মেঘলা ওঠে বসেও পড়লো। ফোনটা ওদের দুজনের মাঝখানে রেখ কাব্য বলে ওঠলো,

– চলো লুডু খেলবো। তুমি আগে খেলো।

মেঘলা কাব্যর কথা শুনে ফোনের দিকে তাকায়। এ তো দেখি সত্যি সত্যি লুডুর অ্যাপ নামিয়ে খেলার স্ক্রীন এনে বসে আছে। ড্যব ড্যব করে তাকিয়ে আছে মেঘলা। কাব্যর মুখ একদম ভাবলেশহীন। অদ্ভুদ! মেঘলার এবার মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে এইটা কাব্যর ডুপ্লিকেট। এ কাব্য হতেই পারেই না। হলেও নিশ্চিত উন্নতমানের আর না হলে মেয়াদ উত্তীর্ণ নেশা করেছে। না হলে কাব্যর পক্ষে এতো রাতে এভাবে এসে লুডু খেলার অফার করা সত্যি খুবই আশ্চর্যজনক। একটু বেশি আশ্চর্যজনক। অতিরিক্ত আশ্চর্য জনক!

চলবে…. ❤