নিরব সে পর্ব-২৩

0
2508

২২শ পর্বের পর থেকেঃ-

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
২৩শ পর্ব

ওয়াফিফ জিনিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকছিল। দরজায় বেল বাজাতেই আফিয়া রহমান সাথে সাথে দরজা খুলে দেন। যেন তিনি দরজা খোলার জন্যই সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়িতে ঢুকতেই একটু শব্দ করেই আফিয়া রহমান দরজা বন্ধ করে দেন। ওয়াফিফ অবাক হলে প্রথমে তেমন পাত্তা দিল না। ওরা দুজন ঘরে যাচ্ছিল, এমন সময় আফিয়া রহমান আটকালেন ওদের। ওয়াফিফ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আফিয়া রহমান টেবিলের উপর থেকে কাগজ নিয়ে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন।

–আজ তোর হাসপাতাল থেকে একটা ব্যাগ দিতে এসেছিল। সেটা হাত থেকে পড়ে গেলে ব্যাগে থাকা সব কাগজ পড়ে যায়। আমি সেটা গুছিয়ে রাখার সময় এটা পাই। এটা কি আমাকে বলবি?

জিনিয়া তখনও আফিয়া রহমানের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে ভাবছিল আসলে কি হয়েছে। কিন্তু যখন একটা কাগজ নিয়ে কথা বলতে দেখল তখনই ভয় পেয়ে গেল। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। কাগজটা কি সেই কাগজ?

ওয়াফিফ কিছুক্ষণ নিজের মায়ের দিকে তাকাল, তারপর নিজের হাতে থাকা কাগজের দিকে তাকাল। মাথায় একটু জোর দিতেই বুঝতে পারল বাড়িতে ব্যাগ আসার রহস্য। ওয়াফিফ কিছু রোগীর রোগ সম্পর্কে আরও গবেষণা করার জন্য সেগুলো ব্যাগে ভরে বাসায় পাঠিয়ে দিতে বলেছিল তার কলিগকে। সেগুলো নিয়ে রাতে চিন্তা করত সে। কিন্তু এর আগে সে জিনিয়ার রিপোর্টটার কি করা যায় সেটাই ভাবছিল। এটা রেখে দেবে নাকি নষ্ট করে ফেলবে সেটা নিয়ে দোটানায় ছিল সে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু সেটা করেও লাভ ছিল না। ওর মেডিকাল হিস্ট্রি চেক করলেই বোঝা যেত সব। তাই রেগে গিয়ে সেটা নিজের কেবিনের টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরেছিল। তারপর রোগীর রিপোর্ট আসে। রোগীতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেটা লকারে রেখে দেওয়ার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তার। এই জন্যই হয়তো তার কলিগ ভুলে সব কাগজ একসাথে ব্যাগে ভরে ওয়াফিফের বাসায় পাঠিয়ে দেয়।

নিজের ভুলে যাওয়ার রোগ কবে থেকে হল সেটাই ভাবছে ওয়াফিফ। একটাই উত্তর পেল, সে কি সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে যেমনটা জিনিয়া বলে? কিন্তু ৩১ তো তেমন বেশি বয়স না। সে চাইলেই এখন পিএইচডি ডিগ্রী নিতে পারবে। অবশ্য পড়ারও কোন বয়স হয় না।

আফিয়া রহমান ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে নিজে শান্ত হয়ে থাকতে পারলেন না। ছেলের এই রিপোর্ট দেখে যেমন কাজ করার কথা ছিল, তেমনটা না করতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে যান। ছেলে অতিরিক্ত পরিমাণে শক খেয়ে এমন অনুভুতিশুন্য হয়ে গিয়েছে কি না জানার জন্য ছেলেকে ডাক দেন,

–ওয়াফিফ।

–হ্যাঁ মা বলো।

–এসব কি?

–জিনিয়ার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট।

–এখানে কি লেখা আছে?

–জিনিয়া কবে থেকে প্রেগন্যান্ট।

–কবে থেকে?

–আমাদের বিয়ের ২ সপ্তাহ আগে থেকে।

নিজের ছেলের কাছ থেকে এমন ইন্টার্ভিউ এর মতো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আরও রেগে যান আফিয়া রহমান। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেন,

–এবার তুই এর মানেটা বুঝা আমাকে? কি করে কি হল? জিনিয়ার সাথে তোর আগে দূর দূর পর্যন্ত কোন যোগাযোগ ছিল না আমি জানি। বিয়ের আগে তোদের একবারও দেখা হয় নি। কিন্তু তোদের বিয়ের আগেই যেহেতু জিনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল তার মানে তার গর্ভে অন্য কারো বাচ্চা। কিন্তু কার আর কিভাবে? বিয়ের আগে কেন আমাদের এসব বলা হয় নি? আর এতদিন ও সবার কাছ থেকে লুকিয়েছে কেন? তুই ও তো এসব কিছুই জানতিস না? নাকি তুইও জানিস এসব? এতদিন ধরে যাকে নিজের বাচ্চা বললি সেসব কি তুই জানতি?

–হ্যাঁ মা, আমি জানতাম সব।

–তাহলে আমাকে কেন বললি না? কি এমন হয়েছে যার জন্য তুই এই কাজ করলি? আমাকে বোঝাতে পারবি?

আফিয়া রহমানের কথাগুলো খুব শান্ত কণ্ঠে বললেও সেগুলোর গভীরতা অনেক ছিল। তার সাথে আফিয়া রহমানের অনুভূতি মিশে ছিল যাতে রাগ অভিমান জমেছে, হয়তো কিছুটা ঘৃণাও। নিজের মায়ের কাছে এসব শুনতে হবে সেটা ওয়াফিফ আগেই জানত। জিনিয়া এসব শোনার পর থেকেই কান্না করে যাচ্ছে নিঃশব্দে। আফিয়া রহমান তার ছেলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সবটা জানার আশায়। ওয়াফিফ তার মা এর হাত ধরে সোফায় বসালো। তারপর গ্লাসে পানি ভরে সেটা আফিয়া রহমানের সামনে ধরল। আফিয়া রহমান প্রথমে না করলেও পরে ওয়াফিফের কথা শুনে এক ঢোকে পুরো পানি শেষ করে গ্লাসটা আবার ওয়াফিফের হাতে ধরিয়ে দিলেন। ওয়াফিফ গ্লাসটা টেবিলে রেখে আফিয়া রহমানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলতে শুরু করল,

–মা দেখো, আমি যা বলছি সব মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমার প্রশ্ন ছিল আমি এসব জানলাম কি করে? এর উত্তরে বলব, জিনিয়া আমাকে প্রথমেই সবটা জানিয়ে দিয়েছিল, আমাদের বিয়ের আগেই। গায়ে হলুদের দিন ও আমাকে কল করেছিল আমার সাথে দেখা করবে বলে। আমি ওর সাথে দেখা করার জন্য রাজি হই। ওইদিন ও সরাসরি নিজের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে সব জেনেই আমার সাথে দেখা করেছিল। সবার আগে ও কথাটা আমাকেই জানিয়েছিল। নিজের বাবা মা কিংবা যে সন্তানের বাবা তাকেও বলে নি ও। আমাকে ভরসা করে বলেছিল। আর আমি শোনার সাথে সাথে ওদের দুজনের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি প্রথমে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করলেও পরে আমি নিজে থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলাম, তাই বিয়ের কোন অনুষ্ঠানে কিছু বলিনি। এবার আসি তোমার আরেকটা প্রশ্নে, জিনিয়া কেন প্রেগন্যান্ট। জিনিয়া একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতো, ৩ বছর ধরে। কিন্তু হঠাৎ করেই ছেলেটার জিনিয়াকে ভালো লাগে না তাই সে চলে যায়। জিনিয়াকে তাকে সতিই অনেক ভালবাসত, তাই সে এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু ছেলেটা যে বিশ্বাস তাকে দিয়েছিল সারাজীবন খেয়াল রাখার সেটা ভেঙে চলে যায়। কিন্তু জিনিয়ার প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়টা ছিল দুজনের অজান্তে। ওরা যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন তারা যেই খাবার খেয়েছিল সেটার সাথে কিছু ওষুধ মেশানো হয়েছিল আর জন্য সেই পরিস্থিতির তৈরি হয়। আর জ্ঞান ফেরার পর ছেলেটা সেটা অস্বীকার করে। এর মধ্যে জিনিয়া সম্পূর্ণই ভিক্টিম ছিল। ওর দোষ ছিল না। ও শুধু ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তাদের সম্পর্ক ঠিক রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিনের আগে ওরা জীবনে কখনো এমন কাজ করে নি যাতে কারো কোন অসম্মান হয়। তাই শুধু অজান্তে ঘটা একটা ভুলের উপর ভিত্তি করে আমরা কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে পারি না। মা তুমি তোমার দিক দিয়ে ভেবে দেখো, আজ যদি তোমার মেয়ের সাথে বা নিজের সাথেই এমন ঘটত তাহলে তুমি কি ভাবতে?

–আমি জানি না।

–তুমি এখন রেগে আছো মা?

হেসে কথাটি বলল ওয়াফিফ। জিনিয়া তখনও অবাক হ্যে তাকিয়ে আছে। ওয়াফিফ এমন সিরিয়াস মুহূর্তে হাসছে কি করে আর কেন? ওয়াফিফ এসব বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো বলতে থাকল,

–মা দেখো, মেয়েটা নিজ ইচ্ছা থেকে এসব করে নি, কিন্তু ও প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছে। এখন পরিস্থিতিটার মধ্যে দিয়ে তুমি আমি কেউ যাই নি। তাই আমরা জানি না তখন কেমন লাগে। কিন্তু জিনিয়া গিয়েছে। আমি হাসপাতালে রোজ এমন পেশেন্ট পাই, যাদের অবস্থা আরও খারাপ, অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আবার বেঁচে থাকতে চায়, আফসোস করে। কিন্তু তাদের সবাইকে আমরা বাঁচাতে পারি না। সেদিক থেকে তুমি কিংবা আমি কিন্তু খুব ভালো পরিস্থিতিতে আছি। কিন্তু যারা এমন ঘটনার শিকার তাদের সবার দোষ থাকে না। তারা কত কিছু সহ্য করে। দেখ তোমাকে আমি বলেছি আমি বিয়ে করব না, গত ৩ বছর ধরে। তাও তুমি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছ আমার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করেছ আমি কেন বিয়ে করব না? না, করো নি। আমি আজ বলছি, আমি বিয়ে করব না বলেছিলাম কারণ আমি আরেকজনকে ভালবাসতাম। কিন্তু সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়। তবুও আমি তাকে ভালোবেসে গিয়েছি। তার সাথে বিচ্ছেদের ৪ বছর পরও বিয়ে করি নি। সেই ক্ষেত্রে ভালোবাসা যদি সত্যিই হয় তাহলে জিনিয়ার নিজের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জাবিরের সাথে দেখা করতে যাওয়া স্বাভাবিক, আর এর পরের ঘটনার জন্য জিনিয়া দায়ী ছিল না। সেদিক থেকে দেখলে আমিও তো আমার ভালোবাসার সাথে এমন করতেও পারতাম। ভেবে দেখ, তোমার ছেলে অন্য কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করল, তাহলে তোমার কেমন লাগবে। এখন যেদিক থেকেই ভেবে দেখো না কেন, আমার করা কাজটা তোমার কাছে ভুল মনে হবে না। তোমাদের আমি তখনই বলতে চাই নি কারণ আমি তখন প্রস্তুত ছিলাম না। আমি একটু সময় নিচ্ছিলাম। কিন্তু কি করে বলব বা শুরু করব বুঝছিলাম না। তাই তোমাদের বলা হয় নি। আর যদি বল জিনিয়ার দোষ তাহলে তোমাকে আমি বলব, জিনিয়া প্রায়ই আমাকে বলে তোমাদেরকে কথাটা বলার। কিন্তু এতো দিন আমিই ওকে মানা করেছিলাম বলতে কারণ আমি নিজে তোমাদের বলতে চেয়েছিলাম। আর জিনিয়া যেরকম মেয়ে, সে যে কথাটা বলতে পারবে না সেটা তুমি নিজেই জানো।
এবার বল তোমার কি মনে হয়?

–আমি জানি না, তোরা ভুল করেছিস।

–মা, এখন তোমার কাছে আমার সব কথাই ঠিক মনে হচ্ছে আমি জানি, কিন্তু আমাদের সমাজ কি বলবে সেটা ভেবেই তুমি এমন কথা বলছ। তাই আমি বলব তুমি তোমার সময় নেও। আমরা অপেক্ষা করব সেদিনের যেদিন তুমি সব ঠিক করে বুঝতে পারবে। আমরা সেদিনেরই অপেক্ষা করব। তার আগ পর্যন্ত আমি জিনিয়াকে নিয়ে আমার হাসপাতালের এপার্টমেন্টে থাকব। এখন জিনিয়ার অবস্থা এই সব চিন্তা নেওয়ার জন্য নয়। আর তোমার এতো চিন্তা করলেও শরীর খারাপ করবে। তার থেকে ভালো তোমরা একে অপর থেকে আলাদা থাকো। তুমি নিজে সময় নেই আর সবটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি আমার মাকে চিনি। তার ধারণা এক দিন ঠিক হবেই। আর তোমরা দুজন সামনাসামনি থাকলে এখন তোমার রাগ বাড়বে জিনিয়ার প্রতি, আর বুঝতে আরও বেশি সম্য লাগবে। তুমি বাবার সাথে কথা বল। সবার সাথে কথা বল। তারপর ধীরে সুস্থে নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের জানাও। আর আমি জিনিয়ার সাথে থাকছি তার মানে এই না যে তোমার ছেলেকে তোমার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে জিনিয়া। ও প্রেগন্যান্ট, ওর সাথে একজন মানুষ না থাকলে যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। আর আমি তোমার সাথে রোজ দেখা করতে আসব। আজ আসি।

বলেই ওয়াফিফ মাকে সালাম দিয়ে জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে গেল । আফিয়া রহমান তখনও দাঁড়িয়ে রইলেন আর ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চলবে।