আঠারো বছর বয়স পর্ব-১৪

0
3533

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

রাতুলদের বাড়িটা দোতলা। সামনে ছোট্ট একটা বাগান। সেখানে বাহারি ফুলের গাছ লাগানো। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে হাসনাহেনা, কামিনী ফুলের সুবাস। গেইটের কাছে লাগানো কামিনী গাছটাতে সাদা রঙের অসংখ্য ফুল ফুটেছে। গন্ধে ম ম করছে চারিপাশ। বিয়েবাড়ি উপলক্ষে বাড়িটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ভেতরের ঘরগুলো থেকে মানুষের হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেসময় ঘর থেকে বেরুতে দেখা গেলো রাতুলকে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের দেখতে পেয়ে মুখে লজ্জ্বার আভা দেখা গেলো রাতুলের। এগিয়ে এসে সালাম করলো নাদিরা, নাসিমাকে। সারা বাড়িতে একপ্রকার হইচই লেগে গেলো। রাতুলের বাবা-মা, চাচা-চাচি সহ অন্যান্য আত্মীয়রা খুবই মিশুক। ওদেরকে আপ্যায়ন করা হলো মিষ্টি-শরবত দিয়ে। বিভোর কিছু খেলো না। সারাক্ষণ চোখগুলো খুঁজে ফিরছে রুহিকে। ও এসেই ইভার কাছে চলে গিয়েছে। ইভাকে বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি পরানো হয়েছে। রুহি মুখটা হা করে বলল,

‘ ওয়াও। তোমাকে তো পুরাই দীপিকা পাড়ুকোন লাগছে আপু।’

‘ ধুর বাল।’

‘ ধুর বাল মানে?’

‘এই শাড়ি নিয়ে মহা ঝামেলায় আছি।’

‘ কেন? কী হয়েছে?’

‘ বললে বিশ্বাস করবিনা রে রুহি। এই উদ্ভট পোশাক পরে সকালে দুইবার পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছি।’

রুহি হাসতে হাসতে বলল,

‘ ধরলো কে তাহলে?’

ইভা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ তুই কী ভাবছিস এটা সিনেমা? রাতুল এসে হিরোর এন্ট্রি নিবে? তাহলে ভুল! আমি নিজেই কোনোমতে খাটের কোণা ধরে বেঁচেছি।’

‘ লেইম এক্সকিউজ আপু।’

‘ বিশ্বাস না করলে নাই।’

‘ ভালো শাড়ি পরবে কবে?’

‘ পার্লার থেকে মেয়েরা আসছে। ওরা এলেই ঠিকঠাক হবো!’

‘ ওহহ আচ্ছা।’

রুহির হঠাৎ মনে পড়লো ইশতিয়াকের কথা। ওর কথাটা কি বলা উচিৎ ইভাকে? অবশ্যই বলা উচিৎ। এরকম বন্ধু থাকলে অলওয়েজ বিপদে পড়তে হবে। আর ইভা অল্পতেই সবাইকে আপন করে নেয়। এটারও সুযোগ নিতে দ্বিধা করবেনা ইশতিয়াক। এরকম দুমুখো সাপের সাথে বন্ধুত্ব না রাখাটাই শ্রেয়। ইতস্তত করে পুরো ঘটনাটাই ইভাকে বলে দিলো রুহি। রেগে গেলো ইভা। ইশতিয়াক যে এতোটা নিচে নেমে যাবে, ভাবতেও পারেনি। ওর চরিত্রে দোষ আছে আর রুহিকে পছন্দ করে এটা ইভা আগেই জানতো। ভেবেছিলো ওকে সব বুঝিয়ে বললে অন্তত বন্ধুত্বের খাতিরে রুহিকে আর ডিস্টার্ব করবেনা। অথচ কত বড় কান্ড করে বসলো! বন্ধুমহলে এরকম বেইমান আছে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো ইভার। ভালো সেজে সবার সাথে মিশে যাওয়া শত্রুদের চিনতে খুবই কষ্ট হয়। তাই কারো সাথে বন্ধুত্ব করার আগে অন্তত দশবার ভাবা আর পরখ করে নেওয়া উচিৎ। ইভা বলল,

‘ ওই কু* বাচ্চার বিরুদ্ধে যদি আমি হেডের কাছে কমপ্লেইন না জানাই আর ভার্সিটি থেকে বের না করতে পারি, তাহলে আমার নামও ইভা নয়। হারামির বা*।’

রুহি মিনমিন করে বলল,

‘ সব আমার জন্য। আমার জন্য তোমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হলো।’

‘ রুহি তুই চুপ কর। ওইরকম দুশ্চরিত্র বন্ধু আমার দরকার নাই।’

‘ লোকটা ভালো নয়।’

‘ জানতাম। কিন্তু এতো বাড় বাড়তে পারে ভাবিনি।’

‘ থাক যা হবার হয়ে গিয়েছে!’

‘ আমাকে ক্ষমা করে দিস রুহি।’

‘ আপু তুমি চুপ করো।’

ইভা আরো কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রুমে ঢুকলো পার্লারের মেয়েরা। সাথে রাতুলের কিছু কাজিন। মেয়েকে এবার সাজানো হবে। কথা বলার জো নেই হইচইয়ের কারণে। রুহি সেখান থেকে বসে বসে দেখতে লাগলো। ওর বিয়ের সময় জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজেনি ও। শাড়িও পরেনি। কবুল বলেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। পরদিন জ্ঞান ফেরার পর শিয়রে দেখতে পায় বিভোরকে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় অতিব সুন্দর পুরুষটি বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছিলো। দেখতে আদুরে বেড়ালের মতো লাগছিলো। ধূসর রঙের আলোর ছটা’য় যখন পৃথিবীর আকাশ ছেয়ে গিয়েছিলো একগুচ্ছ দৈবাৎ হাওয়া এসে বারবার জানান দিচ্ছিলো পৃথিবী কারো প্রেমে পড়েছে। কার প্রেমে পরেছে সেটা রুহি বোধহয় টের পেয়েছিলো। আগ্নেয়গিরির রুপ ধারণ করেছিলো সেই ভালো লাগা। ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে সেই ভালো লাগা। সেই আগ্নেয়গিরির আগুনেই তো রুহি এখনো পুড়ছে, মরছে।

সন্ধ্যার দিকে ইভার সাজগোজ সম্পন্ন হলো। খয়েরী রঙের কারুকার্যমন্ডিত বেনারসি শাড়ি আর বউয়ের মতো লুকে ইভাকে পরীর মতো লাগছিলো। বাসায় গিজগিজ করছে মেহমান। সবাই বর-বউয়ের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত। রুহি এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। এমন সময় সামনে পড়লো নিরব। রুহিকে দেখে হাতের কাজগুলো দ্রুত সেরে ফেললো। তারপর ডাক দিলো। রুহি সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। নিরব টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,

‘ কেমন আছো?’

‘ ভালো। আপনি?’

‘ তোমাকে দেখে অনেক ভালো হয়ে গেলাম।’

বিরক্তি এসে গেলো রুহির। এর হাত থেকে কীভাবে নিস্তার পাবে ভাবছে। নিরব বলল,

‘ চলো বাড়িটা ঘুরে দেখাই।’

রুহি বলল,

‘ জি।’

নিরব রুহির সাথে কথা বলতে বলতে সারাবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলো। বাগান, লন ঘুরে এসে ছাদে গেলো ওরা। এই দৃশ্য চোখে পড়লো বিভোরের। কতক্ষণ ধরে খুঁজে চলেছে রুহিকে। আর ও কিনা নিরবের সাথে ঘুরছে! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ছাদে গেলো ও। দেখলো নিরবের কথায় হেসে কুটিকুটি হচ্ছে রুহি। একপর্যায়ে নিরব রুহির হাত ধরে। রুহি তখন সেই খেয়ালে নেই, নিরবের কথায় খুব হাসি পাচ্ছিলো ওর।

বিভোরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এতদূর? এতদূর চলে গিয়েছে নিরব? আর রুহি কিছু বলছেওনা? বিভোরের সাথে কথাই বলতে চায়না আর নিরবের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে! অনেক হয়েছে, আর নয়। রুহিকে বুঝিয়ে দিতে হবে বিভোর ওর সব। দ্বিতীয় কোনো পুরুষ ওর জীবনে জায়গা নিতে পারবেনা। বিভোর রক্তবর্ণ চেহারা নিয়ে ছাদে ঢুকলো। নিরবের হাত থেকে রুহির হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে টানতে টানতে রুহিকে নিয়ে এলো। নিরব আর রুহি দুজনই অবাক হয়ে গেলো। রুহি বলল,

‘ হচ্ছেটা কী এসব? আমার হাত ছাড়ুন।’

বিভোর ওর কথার জবাব দিলোনা। হিড়হিড় করে টেনে নিচে নেমে এলো। তারপর বেরিয়ে পড়লো রুহিকে নিয়ে। একপ্রকার জোর করে রুহিকে গাড়িতে বসিয়ে দরজা লক করে দিলো। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে নাসিমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো রুহি আর ও একসাথে একটা জায়গায় যাচ্ছে।

রুহি বিভোরের কান্ডকারখানায় শকড হয়ে গিয়েছে। চোখমুখ অসহায় হয়ে আছে। চুলগুলো খোঁপা করে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

‘ কোথায় যাবেন আমাকে নিয়ে?’

বিভোর তখনো রেগে। গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বলল,

‘ কেন? ওই নিরবকে ছেড়ে যেতে মন চায়না,তোমার?’

‘ কী বলছেন আপনি? ওনাকে ছেড়ে যেতে মন চায়না মানে? গাড়ি থামান, আমি কোথাও যাবোনা আপনার সাথে।’

‘ তোমার চাওয়াপাওয়া আমি জানতে চাইনি। পরপুরুষের সঙ্গে হাত ধরে কথা বলা কোথা থেকে শিখেছো? তোমাকে ভালো ভাবতাম, আর তুমি কিনা!’

রুহি বলল,

‘ আমি কী? কী করেছি আমি?’

‘ লোকটা তোমার হাত ধরে কথা বললো কেন? আর তুমি কিছু বললে না কেন? ওয়েট..ওয়েট, নিরব ছেলেটা তোমাকে প্রপোজ করেছে নাকি? তাই তুমি হেসে কথা বলছিলে।’

বিভোরের উদ্ভট কথাবার্তা ভালো লাগছেনা রুহির। নিরব যদি ওকে প্রপোজ করে তাহলে ওরই বা সমস্যা কোথায়? ও নিজে প্রেম করতে পারবে তাহলে রুহি কেন করতে পারবেনা? অবশ্য রুহি বিভোরের মতো বেইমান ও নয়। কখনোই ভালোবাসবেনা কাউকে। ভালোবাসে তো এই উল্লুক ডাক্তারটাকেই।

রাতের শহর। রাস্তার কোণায় কোণায় ঘাপটি মেরে বসে আছে অন্ধকার। বিভোরের সাথে বসে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছে রুহি। বুঝতে পারছেনা বিভোর এরকম কেন! দীর্ঘক্ষণ পরে একটা বাসার সামনে গাড়ি থামালো বিভোর। নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো,

‘ নামো।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘ এটা কার বাসা?’

বিভোর সিটবেল্ট খুলতে খুলতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ এটা তোমার শ্বশুরের বাড়ি, তোমার বরের বাড়ি।’

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!