আঠারো বছর বয়স পর্ব-২৯+৩০

0
4127

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৯

আকাশে মেঘরাশিদের মতোন উড়ছে ঘোলাটে কুয়াশার কণারা। তখন পড়ন্ত বিকেল। রাউন্ড শেষ করে রুহির কেবিনে আসে বিভোর। ওর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। সকালে জ্ঞান ফেরার পরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয় রুহির। ডাক্তার এসে দেখলেন, প্র‍য়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলেন। জানালেন, খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে রুহি। দুপুরে ঘুম ভাঙার পর রুহিকে নরম খাবার খাইয়ে দিলেন নাসিমা। বিভোর তখন ডিউটিতে ছিলো। ফোন করে জানালে, তৎক্ষনাৎ বিভোর ছুটে এসে দেখলো রুহি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

মা’কে খেয়াল রাখতে বলে বিভোর হতাশ হয়ে আবার ফিরে যায় নিজের কাজে। সব কাজ শেষ করে এখন আসলো আর দেখলো রুহির ঘুমটা এখনো ভাঙেনি। নাসিমা আজ বাসায় যাবে, হসপিটালে থাকতে থাকতে ওনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বিভোর জোর করেই মাকে পাঠিয়ে দিলো। তিনি চলে যাওয়ার পরে বিভোর ঔষধপত্র গুছিয়ে রেখে, ফাইলগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলো তখন দেখলো রুহি নড়ছে। কাগজপত্র রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আস্তে করে ডাকতেই চোখ খুললো রুহি। বিভোর উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন লাগছে এখন? ঠিক আছো তুমি?’

রুহি মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। উঠে বসতে চায় সেটাও জানালো। বিভোর ওকে সাবধানে ধরে বসালো। তারপর ঔষধ খাইয়ে দিলো। তোয়ালে ভিজিয়ে চোখমুখ মুছে দিলো, আর এলোমেলো চুলগুলোতে পাতলা বিনুনি করার চেষ্টা চালালো। রুহি ওকে বলল,

‘আপনি পারবেন না, রেখে দিন।’

‘পারবো।’

বলেই অনেক চেষ্টা করে কোনোমতে বিনুনি করে দিলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

‘নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?’

‘নাহ।’

বিভোর রাগী গলায় হঠাৎ বলল,

‘এরকমই করো তুমি। খাবার-দাবার না খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছ তুমি? আর এতো দুর্বল শরীর নিয়ে অফিস কীভাবে করো? আমাকে বলোনি কেন যে তোমার এই অবস্থা? হ্যাঁ?’

রুহি মাথা নিচু করে আছে। বিভোর তা দেখে আবারো ধমক দিলো।

‘কত বয়স তোমার? জানো তুমি? আন্টির কী এখন সেই অবস্থা আছে যে তোমার পিছু ঘুরে ঘুরে খাওয়াবে? আরে, নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। সামান্য সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েই তিনদিন অজ্ঞান! স্ট্রেঞ্জ!’

রুহি মিনমিন করে বলল,

‘বকছেন কেন আমায়?’

বিভোর হতাশ ভঙ্গিতে বলল,

‘কাকে কি বলছি আমি? আমি জানতে চাইছি তোমার এই অবস্থা কেন? খাওয়ার প্রতি উদাসীন কেন?’

‘আমি তো খাই-ই।’

বিভোর তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘হ্যাঁ, জানিতো কি খাও। সকালে এককাপ চা আর বিস্কিট খেয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়ো৷ দুপুরে ডিম দিয়ে একচামচ ভাত আর রাতে শুকনো রুটি আর আলুভাজা। এসব কোনো খাবার? তুমি কী মোটা হয়ে গিয়েছো যে এই চিকনা শরীর নিয়ে ডায়েট করো! তোমার হাজব্যান্ড একজন ডাক্তার। আর তার বউ কিনা সবকিছুতে উদাসীন। এমন হলে তো মাথা ঘুরবেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কেন, হাঁটতে হাঁটতেই পড়ে যাবে। ড্যাম ইট!’

রুহি বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো। বিভোর আর রেগে থাকতে পারলোনা। ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,

‘ইশ। আর কাঁদতে হবেনা। নাকের পানিতে কি আমার শার্ট ভিজিয়ে দিবে নাকি!’

এ পর্যায়ে এসে কেবিনে ঢুকলো সিস্টার কিয়ারা। বিভোর থতমত খেয়ে গেলো। রুহির হাসি পেলো। দুজনে ঠিকঠাক হয়ে বসলো। সিস্টার কিয়ারা হেসে বললেন,

‘আমাকে লজ্জ্বা পাবার কিছু নেই। তোরা এরকম করছিস কেন!’

বিভোর মাথা চুলকে বলল,

‘তেমন কিছুই নয়।’

কিয়ারা হেসে বলল,

‘জানি। সেদিনের ঘটনাটা বলি তাহলে তোর বউকে।’

‘না, একদমই না।’

‘তুই বললেই আমি শুনবো কেন? বড়বোনের মুখের উপর একদম কথা বলবিনা।’

রুহি বুঝলো বিভোর আর কিয়ারা দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। নইলে কি আর তুই তুই করে কথা বলতে পারে কেউ! অবশ্য বিভোর সবার সাথেই ফ্রি মাইন্ডেড। কিয়ারা রুহির প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করতে করতেই সেদিনের পাগলামির কথা জানালেন রুহিকে। ও হাসতে হাসতে খুন, বেশ লজ্জ্বাও পেলো। বিভোর গম্ভীরমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন খুব হাসছে যে খুব, সেদিন তো ওর জানটাই প্রায় কেড়ে নিতে বসেছিলো।

সিস্টার কিয়ারা চলে যাওয়ার পরে রুহি চোখ গরম করে বিভোরের দিকে তাকালো। বলল,

‘এরকম পাগলামি-ছাগলামি করার মানে কী?’

বিভোর অভিমানী গলায় বলল,

‘আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে।’

রুহি হাসি হাসি মুখ করে বলল,

‘আপনি কী ভেবেছিলেন আমি মরে যাবো?’

বিভোর রেগে গেলো। ওর গাল চেপে ধরে বলল,

‘এরকম কথা শুধু মুখে নয়, তোমার মনেও জায়গা দেবেনা। আর কখনো আমাকে বলবেনা, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। তুমি শুধু আমার হাসিখুশি চেহারা আর ভালোমানুষি দেখেছো। রেগে গেলে আমি কি করতে পারি সেটা কিন্তু ধারণাও করতে পারবেনা তুমি। সো মাইন্ড ইট!’

দুজনের মধ্যে তারপর নীরবতা নেমে এলো। মাতাল হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছিলো রুহির চোখ, গাল, চিবুক। চুলগুলো উড়ে এসে পড়ছিলো কপালের উপর। বিভোর উঠে চলে গেলো বাইরে। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখলো রুহি বেড থেকে নামার চেষ্টা করছে। হাতে ক্যানোলা নেই। ও অবাক হলো। নামতে গিয়ে হঠাৎ পা ফসকে পড়ে যেতে নিলে বিভোর দ্রুত ওকে গিয়ে ধরে ফেললো। রাগী গলায় চেঁচিয়ে বলল,

‘মানে কী এসবের? নামছো কেন?’

রুহি বলল,

‘আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে। পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছে শুয়ে থাকতে থাকতে। আমাকে একটু ধরুন প্লিজ, আমি হাঁটতে চাই!’

‘পাগল হলে তুমি? এখনো পুরোপুরি ঠিক হওনি। আর লাফঝাঁপ দেওয়া শুরু করেছো! আর ক্যানোলা এসব কে খুলেছে? নিশ্চয়ই তুমি?’

‘না। কিয়ারা আন্টি খুলে দিয়েছে, আমার নাকি আর এসবের দরকার নেই।’

বিভোর রেগে বলল,

‘ওনি কী তোমাকে হাঁটতে বলে গিয়েছে?’

‘না। ওনি বারবার না-ই করেছেন। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো তাই নামলাম।’

‘বাহ! ভালো তো। আমার কথার তো কোনোই দাম নেই। না খেয়ে ওনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে আর আমি টেনশন করতে করতেই মরে যাবো। আবার নিজের যখন যা ইচ্ছা হলো ওনি তা-ই করবেন। আমি কে? আমিতো কেউওই না তাঁর!’

‘আপনি বাচ্চাদের মতোন করছেন কেন? আমি ঠিক আছি। অতো চিন্তা করার কিছু হয়নি। ইভেন আমিতো এক/দুদিনের মধ্যে বাড়িও যেতে পারবো।’

‘হ্যাঁ। তা তো যাবেই। সারাদিন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অফিসে যাবে আর গাধার খাটুনি খাটবে। নিজের প্রতি যত্ন নিবেনা। যা ইচ্ছা তা-ই করবে।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও রুহানি?’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘এসব কী বলছেন আপনি? উল্টাপালটা ভাবনা ভাবছেন কেন এতো? আর রুহানি ডাকলেন যে, আমি তো আপনার রক্তজবা! ভুলে গেলেন?’

বিভোর রুহির প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো। জোর করে ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। ইভা ফোন করেছিলো। রুহির সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো৷ নাদিরা ওকে অনেক বোঝালো, নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল না রাখার জন্য অনেক বকাঝকাও করলো। বিভোর শুধু ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে আছে। সিঙ্গেল বেডটায় জায়গা হয়না, বিভোর নিজের কেবিন থেকে ডিভানটা নিয়ে এসে বেডের পাশে জুড়ে দিয়েছে। যার ফলে দুজনের জায়গা অতি সহজেই হয়ে গিয়েছিলো।

পৃথিবীর বুকে অসাধারণ এক মায়াবী রাত। যে রাতে দুজন মানব-মানবী তাঁদের ভালোবাসার মানুষের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনে শুনেই পুরোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছিলো, হাসপাতালের ওই নীল রঙা কেবিনটাতে। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে আসা রুপালি চাঁদের কণারা যখন রক্তজবার চোখমুখে আলো ফেলছিলো, বিভোরের তখন মনে হচ্ছিলো এত সুখের মতো অনুভূতি কোনোদিন সে অনুভব করেনি। আর যা-ই হোক, এই অসাধারণ মানবীটিকে সে বুকের ভেতর সারাজীবন বদ্ধ করে রেখে দেবে৷ কোত্থাও যেতে দেবেনা৷ ওর শুধু জানার ছিলো, একই অনুভূতি কী সেদিন তাঁর রক্তজবারও হয়েছিলো?

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩০

হসপিটালের একঘেয়ে দিনগুলো কাটিয়ে রুহি ফিরে এলো বাসায়। নাদিরা, ইভা ওর খেয়াল রাখছে। বিভোর হসপিটালের কাজে, বিভিন্ন কনফারেন্সে ভীষণ ব্যস্ত। তবুও সর্বক্ষণ ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে। রুহির চাকরিতে যাওয়া মানা। সুস্থ না হওয়া অবধি বাসা থেকে বের হওয়ায় পারমিশন নাদিরা-বিভোর কেউই দেয়নি।

কুয়াশাঘেরা এক গোধূলি বিকেল। হলদে আলোয় ছেয়ে আছে পুরো ব্যলকনি। রুহি বসে বসে বই পড়ছিলো। ইভা ওর মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে সবেমাত্র গোসল সেরেছে। আজকাল ওর মেয়েটা বড্ড চঞ্চল হয়েছে। সাত মাসের বাচ্চাটা দাঁড়ানো শিখেছে, হাঁটতে চায়। আবার দুটো দাঁতও ওঠেছে। একদম রাতুলের কার্বন-কপি যেন। এরকম মিষ্টি একটা বাচ্চাকে রুহি সারাক্ষণ কোলে নিতে চায়। কিন্তু ইভা ওর এই বদঅভ্যাসের জন্য ভীষণ রকম বকাবকি করে। নিজের জান নিতেই নড়তে পারেনা, তার উপর বাচ্চা নিয়ে লাফালাফি। রুহি মুখ ভার করে বসে থাকে। ওকে বই পড়তে দেখে পাশের চেহারায় বসলো ইভা। রুহি একনজর দেখে আবারও মনোযোগ দিলো বইয়ে। ইভা বলল,

-কথা বলতে চাসনা আমার সাথে? রাগ করেছিস?

রুহি মাথা নাড়িয়ে অভিমানী গলায় বলল,

-হুম। মিষ্টিটাকে একটু কোলে নিলে কী এমন হতো?

-আরে, তুই তো এখনো পুরোপুরি ঠিক হসনি রে বোন।

-আমি একদম ঠিক আছি।

-তা তো থাকবিই। ডাক্তারের বউ বলে কথা!

রুহি বিড়বিড় করে বলল,

-ডাক্তার না ছাই৷ আমাকে কতশত রুটিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।

-এটাই দরকার তোর৷ ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিসনি এখন ফল ভোগ কর।

রুহি ভেঙচি কেটে বলল,

-তোমার ভাই আস্ত একটা শয়তানের নানা।

ইভা হেসে বলে,

-তোর বরের কাছে ফোন দিয়ে এসব কথা না জানাইলে আমিও রাতুলের বউ না।

-আপু প্লিজ। তোমার ডাক্তার ভাইটুর কথা বাদ দাও।

-কেন রে?

রুহি মুখ ফুলিয়ে বলল,

-সুযোগ পেলেই আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আধমরা করে ফেলে।

ইভা বলল,

-আর তুই যে এতোদিন ডুবে ডুবে জল খেলি তা কিছুনা?

-ডুবে ডুবে জল খেলাম মানে? কীসের কথা বলছো?

রুহির কথা শুনে ইভা হাসলো। হাসিটা চেপে রেখে গলাউ গাম্ভীর্য এনে বলল,

-বাহ! এখন তো তুই ধোয়া তুলসীপাতা। কিছুই জানিস না। তোর সাথে যে আমার ভাইয়ের ইটিশপিটিশ চলে তুই আমাদের কাছে একবারও বললি না!

-কই ইটিশপিটিশ করলাম? কোনোদিন দেখেছো?

ইভা ভ্রু কুঁচকে বলল,

-না দেখিনি।

-তবে বললে কেন?

ইভা মুখটা বাঁকা করে বলল,

-বলবোনা? কি বলিস রে তুই? আমার ভাইয়ের বউ। ছয়বছর হতে চললো তোদের বিয়ে হয়েছে। অথচ দুজনের কাউকে দেখেই আমরা তা বুঝতে পারিনি। আসলে তোরা বুঝতে দিসনি। আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে দিলি। এটা কী ঠিক হলো? আমরা কি তোর পর ছিলাম? বোনের মতো ভালোবাসিনি তোকে?

ইভার কথা শুনে রুহির মুখে ছায়া নেমে এলো। প্রাণবন্ত মুখটা মুহূর্তেই অস্বস্তি আর লজ্জায় নুইয়ে নিলো। ইভা কী ওকে সুবিধাবাদী, লোভী মেয়ে ভাবছে? ভাবাটা স্বাভাবিক। কারণ রুহি নিতান্তই এই বাড়িতে আশ্রিতা। যতই ওরা ভালোবাসুক, তবুও সত্যটা তো আর পালটে যাবেনা। নিজের জীবনের প্রতি বড্ড বিতৃষ্ণা নেমে এলো হঠাৎই। হায়, ওর এখন কি করা উচিৎ!
ইভা ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ দেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। আচমকাই ওর পা জড়িয়ে ধরলো রুহি। তারপর কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘আমাকে ক্ষমা করে দিও আপু। আমি স্রেফ পরিস্থিতির শিকার। ওনারও কোনো দোষ নেই। দোষ সব বোধহয় আমার কপালের। সারাটাজীবন আমার সাথে ভালো কিছুই হয়নি। আমার জীবনের গতিপথ উল্টাপাল্টা। তোমাদের কখনো এই বিষয়টি জানাতে পারিনি, কিন্তু জানানো আমার উচিৎ এবং কর্তব্য ছিলো। তোমাদের নুন খেয়েছি, অথচ তার চেয়ে বেশি কষ্টও দিয়েছি। এখন তোমরা যদি বলো তাহলে আমি ওনার থেকে দূরে চলে যাবো, চিরদিনের জন্য…’

ইভা ওর এমন কান্ডে হতবাক। ও তো শুধু মজা করছিলো, রুহিটাও না! ভাবলো সত্যিই বুঝি কিছু একটা হয়েছে। ইভা ওকে কাছে টেনে নিলো। তারপর হাসতে হাসতে খুন হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,

‘বোকা মেয়ে। আমিতো মজা করলাম। তোর সাথে আমি বা আম্মু কেউ কখনো এরকম করতে পারি? তোর জীবন সেটা তোকেই ভাবতে হবে৷ আমরা তো তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, যদিও দূরে করতে চাইনি তোকে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথেই যখন এক সুতোয় বাধা পড়লি তখন আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। এবার নাচতে নাচতে তোর বিয়ে খাবো।’

রুহি চোখমুখ মুছে ইভার দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘নাচতে নাচতে বিয়ে খাবে মানে?’

‘মানে তোর বিয়ে। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। হাতে আর পনেরোদিন বাকি।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘এটা কখন ঠিক হলো? জানিনা তো।’

‘সারপ্রাইজ। তোর ডাক্তারবাবু নিষেধ করেছিলো। নিষিদ্ধ কথা আমি বাপু বলিনা।’

রুহি হেসে ফেললো। ইভা মুগ্ধ হয়ে তার বোনটাকে লক্ষ্য করলো। ওর চোখে পানি এসে গেলো। মেয়েটার জীবনে এবার সুখপাখিরা ধরা দেবে তো? হঠাৎ মনে পড়ায় ইভা জিজ্ঞেস করলো,

‘বাড়ি যাবি রে রুহি?’

‘আমার বাড়ি?’

‘হুম। তোর গ্রামে, তোর বাড়িতে?’

‘না।’

‘কেন?’

‘আমার পরিচিত কেউ নেই ওখানে। সাত বছর আগে যে গ্রাম ছাড়তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম সেখানে গিয়ে আমি আর কি পাবো বলো তো, ইচ্ছে হয়না যে তা নয়। কিন্তু ওই অসভ্য, নোংরা, স্বার্থপর মানুষদের আমার প্রচন্ড ভয় লাগে। দ্বিতীয়বার ওদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো শখ বা ইচ্ছা আমার নেই।’

‘তার মানে পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দিলি নিজের আসল পরিচয় আর অস্তিত্ব?’

‘নাহ। ইচ্ছে করলে ঠিকই যাবো। শেকড়ের টান বলে একটা কথা আছে জানোতো, ওই টানে টান দিলে তবেই যাবো। আমায় জন্মদানকারীদের বাস ছিলো, আছে তো ওই গ্রামে। যেতে তো হবেই।’

ইভা ওর কথা শুনলো। তখন শহরের আকাশ আঁধারে ঢেকে গেছে। হাজারো কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করা শহরটা এভাবেই তার রুপের বর্ণনা করছিলো। কোথায় সেই নির্মলা বাতাস, সোদা মাটির ঘ্রাণ আর জোনাকিদের খেলা? কোথায়? নেই কোত্থাও…

বড্ড বেশি ব্যস্ত আছে বিভোর ওর কাজকর্ম নিয়ে। আজ তিনটে ওটি, কনফারেন্স, অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত একটা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে ওকে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। তার উপর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়াসহ আরও টুকটাক কাজে ভীষণ ব্যস্ত সে। নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। একবার ফোন করে রক্তজবার খোঁজটা অবধি নিতে পারলোনা। রাগে,দুঃখে নিজের কেবিনে এসেই হোয়াইট এপ্রোনটা ছুঁটে ফেললো সোফার উপর। মাঝেমধ্যে মনে হয় ডাক্তার না হয়ে রিকশাওয়ালা হলে ভালো ছিলো। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে করলে রিকশা করে বাড়ি চলে যেতে পারতো, টুকটুকে বউটার দেখাশোনা কর‍তে পারতো। সেখানে কোনো নিয়ম মানতে হতোনা, যখন ইচ্ছা রুহিকে আগলে ধরে বসে থাকতো। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠলো। চোখদুটো নিবদ্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। কানে ঠেকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল,

‘কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে সুধাময়ী রক্তজবার কন্ঠ শুনতে পেয়েই এক নিমিষে পনেরো বছরের কিশোর আবেগ গ্রাস করলো ওকে। বলল,

‘তুমি জানো আজ সারাদিন কত খাটুনি গিয়েছে আমার? শুধু মনে হচ্ছিলো একটাবার তোমার কন্ঠ শুনতে পেলে সব খাটুনির কষ্ট ভুলে যেতাম। এখন শুনলাম আর মনে হচ্ছে তুমি আমার পাশেই আছো।’

রুহি বিব্রত হয়ে বলল,

‘তো কান্নাকাটির কী হলো?’

‘কাঁদছিনা তো।’

‘আপনার কন্ঠ কান্না কান্না শুনাচ্ছে।’

‘ওফ, এটা কান্নাকান্না কন্ঠ নয়। এটা হচ্ছে আবেগ। যে আবেগে মিশে আছে তোমাকে না দেখার একবুক কষ্ট, যন্ত্রণা।’

‘এতো কষ্টিত হওয়ার কিছু হয়নি। সারাদিন তেমন কিছইই করেননি আমি জানি। সো কিপ…’

‘তুমি মজা করছো?’

‘না।’

‘বুঝি আমি।’

রুহি ওকে চমকানোর জন্য বলল,

‘আমাদের বিয়ে তো পনেরোদিন পর। জানেন তো?’

কিন্তু বিভোর চমকালো না। হাসিহাসি কন্ঠে বলল,

‘সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?’

‘বাজে, খুব বাজে।’

বিভোর মৃদু হেসে বলল,

‘আর কতকাল থাকিবে দূরে
আসতে হবে আমারই বুকে!’

বিভোরের কথা শুনে একরাশ লজ্জা নিয়ে ফোন কাটলো রুহি। মুখে লজ্জ্বামিশ্রিত আভা ছড়িয়ে পড়লো। আহা! রং লেগেছে বুঝি চারপাশের প্রকৃতিতে। হ্যাঁ, অবশেষে সবকিছু রুহির হতে চলেছে। হ্যাঁ পৃথিবী! তাঁর ভালোবাসার মানুষটা তাঁর হতে চলেছে। এতো সুখকে কোথায় বন্দী করে রাখবে সে? কিন্তু সুখকে কি আদৌ বন্দী করা যায়?

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। মন্তব্য জানাবেন আপনাদের।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!